Friday, December 16, 2011

আত্মত্যাগ

ভারী আওয়াজ তুলে সাঁজোয়া গাড়ির বহরটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দিকে আসছে, গাড়ির উপরে বসানো মেশিনগান আর সেনাদের বন্দুকের চকচকে বেয়নেটগুলো আলো-আঁধারীতে এক নারকীয় আবহ তৈরী করছে| নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতা কায়েম করার এক পৈশাচিক আনন্দে তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চোখ হায়েনার মতো জ্বলন্ত| বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে- শুরু করেছে "অপারেশন সার্চলাইট" নামক পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে জঘন্যতম গণহত্যা| গাড়ির বহরটা তখন ঢুকছে ছাত্র হল গুলোর দিকে, আর রাস্তার ভিত পলায়নপর মানুষগুলোর দিকে চলছে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ, এরই মাঝে বহরের প্রথম গাড়িটার সামনে এসে দাড়ালো এক তরুণী| গুম গুম শব্দ তুলে চাকার নিচে পিষে ফেলতে এগিয়ে এলো ধাতব যন্ত্রটা, আর ঠিক তখন প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে উড়ে গেলো যন্ত্রদানব, মুহুর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল| বুকে বিস্ফোরক বেঁধে সাঁজোয়া গাড়ির নিচে আত্মাহুতি দিয়ে প্রথম প্রতিরোধের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা| ঠিক কতটা সাহস আর মাটির জন্য ভালোবাসা থাকলে এভাবে আত্মত্যাগ করা যায় তা পৃথিবীর কোনো বর্ণমালা লিখে বোঝাতে পারবেনা, কোনো ভাষা পারবেনা এই সাহসিকতার বর্ণনা দিতে, কোনো বিশেষণে দেওয়া যাবেনা এর তুলনা| গ্রামের বড় মাঠটা পেড়িয়ে আসার চেষ্টায় মরিয়া পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী, এপাশ থেকে আমরণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা| গুলি, মর্টার, গ্রেনেড এর শব্দে তখন চারিদিক বিভীষিকাময়| বারবার পেছাতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা| মাটি কাঁমড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিযোদ্ধারা, মাঝখানের জায়গাটুকুতে মাইন পেঁতে রেখেছে তারা| এরই মধ্যে পাকিস্তানিদের সাহায্যে এগিয়ে এলো ভারী ট্যাঙ্ক| ঘর্ঘর যান্ত্রিক শব্দ তুলে মৃত্যুদূতের মতো মাঠ পেড়িয়ে আসতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে, আর তার আড়ালে এগিয়ে আসতে থাকলো পাকিস্তানি সৈন্যরা| মর্টার এর প্রচন্ড শেলিং আর ট্যাঙ্কের সামনে পিছু হটতে বাধ্য মুক্তিযোদ্ধারা, ভরসা শুধু একটু দূরের পেঁতে রাখা মাইন| কিন্তু মাইন বিস্ফোরিত হলনা, ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসতে থাকলো, এখান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার একটাই মানে পুরো এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের দখল| হঠাৎ পাশ থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো কে যেনো, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী ১০ বছরের লালু| বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে সেদিন যে বীরত্বগাঁথা লালু রচনা করে গিয়েছিলো তা বর্ণনা করার সামর্থ্য কার আছে? মাত্র ১০ বছরের শিশুর আত্মত্যাগে সেদিন যে আগুন জলে উঠেছিলো সহযোদ্ধাদের মনে, তার সামনে দাড়াতে পারেনি পাকিস্তানি সেনারা, কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো সব প্রতিরোধ, মুক্ত হয়েছিল অঞ্চল| মাটির মূল্য সেই শিশুটির থেকে ভালো আর কে জানে? ৩রা ডিসেম্বর, ভোরবেলা নবীগঞ্জ থানা মুক্ত করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো ৫নং সেক্টরের কোম্পানী কমান্ডার, মুর্শেদ ইউ জামান রশিদ এর নেতৃত্বে ৩৬ সদস্যের মুক্তিবাহিনী, তার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড চার্জ করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য একজন, একটি গুলি এসে মাথায় লাগে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেই অকুতোভয় কিশোরের| শহীদ হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব| শ্রমিক পিতার সন্তান ধ্রুব স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেনি, কৈশোরের চাঞ্চল্যের জীবন ছেড়ে হাতে নিতে হয়েছিল বন্দুক-গ্রেনেড, লড়তে হয়েছিল নরপিচাশদের সাথে| নিজে আত্মত্যাগ করে আমাদের সুযোগ করে দিয়ে গেছে টকটকে লাল সূর্যের আভায় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার| জামালপুর জেলার সদর উপজেলার ইটাইল ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের কাছাকাছি এক স্কুল ঘরে রাতের বেলা গোপন মিটিংয়ে জমায়েত হয়েছে পাকিস্তানিদের দোসর এদেশের শান্তি বাহিনীর কিছু সদস্য, এখবর পেয়েই আর অপেক্ষা করেনি হালু| কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হালু তখন সবেই যুদ্ধশেষে গ্রামে ফিরেছে| রাতের বেলা একাই চলে গিয়েছিলো ওদের প্রতিরোধ করতে, গভীর রাতে শোনা গিয়েছিলো গোলাগুলির আওয়াজ|পরের দিন সকালে মাঠের পাশে পাওয়া গিয়েছিলো কিছু রাজাকারের লাশ| শুধু পাওয়া যায়নি হালু'কে| ১৬ই ডিসেম্বরের মাত্র কয়েকদিন আগে এভাবেই হারিয়ে গেলো মাত্র ১৫/১৬ বছরের অসীম সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হেলাল উদ্দিন| না, বহু বছর পরেও তার খোঁজ মেলেনি| ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে সেদিন প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা, সাভারের উপকন্ঠে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম| কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ভারী মেশিনগানের সামনে অবস্থানগত কারণে বেকায়দায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ| ভারী মেশিনগান বন্ধ করতে না পারলে এগোনো যাচ্ছেনা, এই বার্তাটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে অন্য দলটির দিকে এগিয়ে যেতে গেলো কিশোর টিটো| সাথে সাথে একঝাঁক বুলেট এসে মাটিতে শুইয়ে দিলো ওকে| বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে, ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ হলো গোলাম দস্তগীর টিটো| সেদিন কিশোর সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে পাগলপ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সব নিয়ম ভেঙ্গে অতিমানবীয় ভাবে পরাস্ত করেছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে| মৃত্যুর আগে টিটো বলেছিলো, "বাচ্চু ভাই, আমাকে বাচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই"| না, টিটো বাঁচেনি, দেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত করে দিয়ে সেদিন ও চলে গিয়েছিলো| বুকে একঝাঁক বুলেট নিয়ে স্বাধীন দেশে, সাভারের ডেইরি ফার্মের কাছে শুয়ে আছে টিটো| "স্বাধীনতা"-শব্দটা কতটা শক্তিশালী, কতটা গভীর| ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া না পাওয়া এরকম অজস্র শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা| রক্তস্নাত দেশের মাটির প্রতিটি শস্যকনা শহীদদের স্বপ্নের কথা বলে, বাতাস প্রতিনিয়ত গেয়ে যায় তাদের না গাওয়া গান| ৩০ লক্ষ্ শুধু একটি সংখ্যা বা হিসেব না, ৩০ লক্ষ্ মানুষের না দেখা বিজয়, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা সব| ৩০ লক্ষ্ শহীদের অস্তিত্বের অংশীদার আমরা সবাই| এরকম অসংখ্য বীরসন্তানের প্রানের বিনিময়ে যে কষ্টার্জিত বিজয়, তা শুধু কাগজে-কলমে নয়, এ বিজয় দেশের প্রতিটি মানুষের প্রানের সাথে মিশে আছে| তাই কোনো স্মৃতিফলকে তাদের নাম থাকুক বা না থাকুক, আমাদের কাছে তারা গল্পের স্পার্টাকাস-একিলিসের থেকেও অনেক বড় বীরসন্তান| প্রমিথিউসের মতো তারাও ছিনিয়ে এনেছিলো স্বাধীনতার লাল সূর্য| বছরের পর বছর বহু ঘটনা ঘটবে, নষ্ট রাজনীতি হবে, ইতিহাস বদলে দেওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা হবে, কারণ কিছু মানুষ ভুলে যাবে শহীদের নাম মুছে দেওয়া হয়তো যায় কিন্তু মুছে দেওয়া যায়না তাদের দেখা স্বপ্ন, তাদের চেতনা| তাই বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আজকের ভোরের সূর্যটা তাদের বুকের রক্তেই আরও রাঙ্গা হয়ে উঠবে, আর আমরা তাদের চোখে দেখা স্বপ্নকে পূরণ করতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবো|

Tuesday, December 6, 2011

কিছু সাধারণ প্রশ্ন

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মনের মধ্যে বেশ কিছু অতি সাধারণ প্রশ্নের উদয় হয়, যা কোনভাবেই রাজনৈতিক চিন্তা-ধারণা প্রসূত নয় বরং একজন বাংলাদেশী হিসেবে কিছু মৌলিক চিন্তা মাত্র| এই প্রশ্নগুলোর উত্তর স্বাধীনতার এতো বছর পরেও পাওয়া যায়না বরং এতো বছর পরেও এই প্রশ্নগুলো করতে হয় দেখে কিছুটা অবাক হই| বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বর্তমানে চলাকালীন প্রতিযোগিতার সময় প্রশ্নগুলো আরও বেশি করে উঁকি দেয়| বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান চেষ্টা করেছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে আমাদের মুছে দিতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান কখনই পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন দেশের অংশ হিসেবে মনে করেনি, বরং সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শোষণ ও নির্যাতন বজায় ছিলো| একটি স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান কখনই পারতপক্ষে স্বাধীন ছিলো না| বরং রাজনৈতিক শোষণ থেকে শুরু করে সামাজিক শোষণ সব দিকেই পূর্ব পাকিস্তান জর্জরিত ছিলো| এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকেও কোনো রকমের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি| এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং তাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গুলিবর্ষণ| অন্য ইতিহাস ঘাটার কোনো দরকার দেখি না বরং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দেখেই আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত| তারপর একের পর এক ঘটনার প্রবাহে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা| ১৯৭১ সালের নয় মাস দীর্ঘ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাধারণ ভাবেই অনেকগুলো অভিযোগ আনা সম্ভব| তার মধ্যে গণহত্যা, জেনেভা কনভেনশন অমান্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ এর অভিযোগ অন্যতম| শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ এর গণহত্যাই নয়, দীর্ঘ ৯ মাস ধরে যে হত্যাযজ্ঞ বজায় ছিলো তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো ধরনের অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এর সরকার করেছে বলে আমার মনে পড়ছেনা| একই ভাবে পরাজিত পাকিস্তান সরকার তাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের বিচারকার্য পরিচালনা করেছে বলে আমার জানা নেই| তাই মানবধিকারের চরম অবমাননা এবং গণহত্যার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে তো নয়ই, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সরকার উভয়ই এড়িয়ে গেছে| এতো বছরেও অভিযুক্ত সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো রকমের ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা না নেওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বর্তমান পাকিস্তান সরকারও এই বিষয়টিকে পরোক্ষভাবে নয় বরং প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে| বাংলাদেশের ভূখন্ডে যুদ্ধচলাকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কোনধরনের মানবাধিকার এবং জেনেভা প্রটোকল অনুসরণ করেনি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এর উদাহরণ| নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন এবং যুদ্ধকালীন বন্দীদের কোনো রকমের মানবিক বিবেচনা করা হয়নি, একই সাথে ছিলো নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ| এই ঘটনাগুলোর সুষ্ট কোনো তদন্ত স্বাধীনতার পরেও হয়নি, এবং এই অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেও কোনো আন্তর্জাতিক কূটনীতি দেখা যায়নি| বিজয়ের ঠিক ২ দিন আগে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে সংঘটিত বুদ্ধিজীবি গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে চরম কলংকিত একটি অধ্যায়| একটি দেশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যে নীল-নকশা, যে অমানবিক ও নৃশংস বুদ্ধিজীবি নিধন অভিযান চালানো হয়েছিল, তার থেকে এটা স্পস্ট যে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের কার্পণ্য ছিলোনা পাকিস্তানের| তাই ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাত থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান একই সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, জেনেভা প্রটোকল লঙ্ঘন সহ আরও বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, ৪০ বছর পরেও যার কোনো সুষ্ঠ তদন্ত কিংবা আন্তর্জতিক ভাবে বিচার হয়নি| বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে আমাদের বিরুদ্ধে, পরিকল্পিতভাবে ধংসস্তুপে পরিণত করা বাংলাদেশ যাতে কোনভাবেই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাড়াতে না পারে তার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সব কয়টি দাতা দেশে পাকিস্তান চরম তত্পরতা চালায়| স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া দূরে থাক, যুদ্ধে পরাজিত হয়েও আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কূটনৈতিক কার্যক্রম আমাদের সত্তার বিরুদ্ধে তাদের হিংস্র মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ| কিন্তু যে দেশ কর্তৃক এহেন নির্যাতন, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভাবে কার্যক্রম করা দূরে থাক, বাংলাদেশ সরকার উল্টো সম্প্রীতির হাত বাড়াচ্ছে| ইতিহাস কখনো পুরনো হয়না, তাই তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধপরবর্তী দেশ সামলানোর সাথে সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব না হলেও তার পরবর্তী সরকারগুলোর কি সমস্যা ছিলো, এটা একটা প্রশ্ন| শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ৪০ বছর পড়ে যখন বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো, তখনো পাকিস্তানের সেই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা দূরে থাক বরং আমরাই তাদের জামাই আদর করছি| যাদের জন্য আমাদের দেশের ৩০ লক্ষ্ মানুষ শহীদ হলো, ২ লক্ষ্ নারী ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার হলো, দেশ একটি ধংসস্তুপে পরিণত হলো, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ না এনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু?? পাকিস্তানের নাম সামনে আসলেই অনেকগুলো শব্দ পাশাপাশি মনে চলে আসে- যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, নির্যাতন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, জঙ্গি, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস... আরো আরো অনেক| এর কোনোটিই পাকিস্তানের প্রতি নরম মনোভাব জাগানিয়া নয়| যেই দেশটি প্রত্যক্ষভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত, ধংসপ্রায় অর্থনীতি, চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রবিন্দু তাদের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব তৈরী করার আকাংখা দেখলে আসলেই অবাক হতে হয়| শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও জঙ্গিদের প্রত্যক্ষ মদদ দেওয়ার অভিযোগে যারা অভিযুক্ত তাদের সাথে সবরকমের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা তো দূরে থাক বরং সম্প্রীতির আহব্বান করা হচ্ছে| যখন দেশের দাতাগোষ্ঠির সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো, আরব দেশগুলোর সাথে সরকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনায় যথেষ্ঠ সক্ষম, তখন পাকিস্তানের মতো একটি দেশের সাথে গায়ে পড়ে সম্পর্ক তৈরির কি যুক্তি থাকতে পারে?? বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যে দেশটি বিরোধিতা করে যাচ্ছে এবং সময় সুযোগ মতো ছোবল মেরে যাচ্ছে, তাদের সমর্থন করার কি যুক্তি থাকতে পারে আমি জানিনা| বর্তমানে বিজয়ের মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে দেশে আমন্ত্রণ করে এহেন মর্মান্তিক নিষ্ঠুর রসিকতার কি মানে থাকতে পারে?? তাহলে কি বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখন্ডে কিছু মানুষের (নাকি অমানুষের) পাকিস্তানি পতাকা দেখার জঘন্য কুরুচিমূলক বাসনা চরিতার্থ করার জন্য এ আয়োজন?? যে দেশ এখনও তাদের অমানুষিক বর্বর কর্মকান্ডের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি, তাদের জন্য আমাদের দেশের মাটিতে স্থান হয় কি করে?? আরও জানতে ইচ্ছে করে খেলার সময়ে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে যারা উল্লাস করে, গায়ে এঁকে যারা পাকিস্তানকে ফিরে পাবার জঘন্য নগ্ন-বাসনা সোল্লাসে দেখানোর সুযোগ পায় তারা কি এদেশের নাগরিক?? কোনো রাজনীতি নয়, বরং দেশের অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচারণ করা কি অযৌক্তিক?? তাই অনেকগুলো প্রশ্নের এখনও কোনো উত্তর মেলে না, কেন পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না?? কেন বাংলাদেশের সরকার তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে?? হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের স্বীকার একটি দেশ কেন তাদের চরম শত্রুর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে?? আর তার থেকেও যে প্রশ্নটা বেশি মনে আসে তা হলো- স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ডে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক পাকিস্তানের পতাকা উড়ায় কিংবা সমর্থন প্রদর্শন করে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ কেন আনা হবেনা???

Thursday, November 24, 2011

বিবর্তন-১ : একটি ধারণার সূচনা

বিবর্তন একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে প্রথম থেকেই আলোচিত-সমালোচিত| এই মতবাদটি নিয়ে যে বিপুল পরিমান আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে তা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সমালোচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝেও, এটিকে সব থেকে বেশি সমালোচনা ও অবজ্ঞার স্বীকার হতে হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে| তাই অভিকর্ষ-মহাকর্ষ সংক্রান্ত তত্ত্ব-মতবাদ কিংবা বহুল প্রচলিত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এর মতো বিবর্তনকে সাধারণ সমাজে এখনও মেনে নেওয়া হয়নি কিংবা বলা যায় মেনে নেওয়ার মতো একটি সাধারণ পরিবেশ তৈরী হয়নি| এর পেছনে অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বিবর্তন সম্পর্কে জানার অনীহা, তত্ত্বটি বোঝার বা উপলব্ধি করার মতো সাধারণ জ্ঞানের অভাব, সাধারণের উপযোগী ব্যাখ্যার অভাব এবং সবার উপরে ধর্মীয় সৃষ্টিতত্বের সাথে এর প্রকাশ্য বিরোধ| তাই ধাপে ধাপে এর অতীত থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রচলিত সামাজিক মতবাদের সাথে এর বিরোধের আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করবো|


বিবর্তন

প্রথমেই উল্লেখ্য যে, বিবর্তন তত্বের উদ্ভাবক হিসেবে মহান বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইন এর নাম যে পরিমান আলোচিত হয়েছে এবং জীবদ্দশায় তাকে যে পরিমান বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাতে একটি সত্য সবসময় ঢাকা পড়ে যায় আর তা হলো, প্রাণীজগতের বিবর্তনের ধারনাটি অনেক পুরনো এবং এই ধারণার উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ডারউইন নন, বরং এই ধারণা তার জন্মের অনেক আগেই পৃথিবীতে আলোচিত হয়েছে| তাই "বিবর্তন"-এটিকে ব্যাখ্যা করার আগে এই ধারণার উদ্ভাবক ও বাহকদের জানার চেষ্টা করবো|

প্রানিজগত যে বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে, এই ধারনাটি সর্ব প্রথম প্রস্তাব করেন প্রাচীন গ্রীস এর দার্শনিক Empedocles,কিন্তু খুব দ্রুতই এই ধারনাটি পরিত্যাক্ত হয় সে সময়ে| পরবর্তিতে দীর্ঘ সময় পড়ে ১৭০০ শতাব্দীর দিকে তত্কালীন প্রকৃতিবিদেরা অনুধাবন করেন যে, প্রাণীজগতের আপাত দৃষ্টিতে অপরিবর্তনশীল অবস্থা আসলে একটি ভ্রম| বরং এটি সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তিত হয়েই আজকের অবস্থায় এসেছে| বিভিন্ন সময়ে ৫ জন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী বিবর্তনের মতবাদটি নতুন ভাবে তুলে ধরার এবং যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে কাজ করেন| তারা হচ্ছেন, ফ্রান্সের Georges Louis de Buffon (১৭০৭-১৭৮৮) এবং Jean-Baptiste de Lamarck (১৭৪৪-১৮২৯), ইংলেন্ড এর Charles Lyell (১৭৯৭-১৮৭৫), Charles Darwin (১৮০৯-১৮৮২) এবং Alfred Russel Wallace (১৮২৩-১৯১৩)| তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ডারউইন এর জন্মের অনেক আগে থেকেই এই ধারণাটির পেছনে কাজ চলেছে| তাহলে শুধুমাত্র বিজ্ঞানী ডারউইন এর বিরুদ্ধাচারণ এতটা প্রকট কেন? কারণ হিসেবে বলা যায়, ডারউইন তার ও তার পূর্ববর্তী সময়ের কাজগুলোকে প্রমানসাপেক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নথিবদ্ধ করে বিবর্তনের ধারনাটিকে একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ অথবা তত্ত্বতে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছেন|

Buffon ছিলেন সর্বপ্রথম প্রকৃতিবিদ যিনি প্রস্তাব করেন, জীব জগতের বিবর্তন সম্ভব| কিন্তু তিনি তার এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমান কিংবা একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করে যেতে পারেননি|

Lamarck ছিলেন তার যোগ্য উত্তরসূরী| যিনি Buffon এর ধারণা ও কাজটি যেখানে অসম্পূর্ণ ছিলো সেখান থেকে কাজ শুরু করে এগিয়ে নিয়ে যান এবং তিনি জীবজগতের বিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন| তিনি এটি সর্বপ্রথম ১৮০১ সালে একটি বই হিসেবে প্রকাশ করেন এবং আরও বিস্তারিত ভাবে আর একটি বই প্রকাশ করেন ১৮০৯ সালে| Lamarck জীবের দৈহিক গঠনের উপর কাজ করেন এবং তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন| (মজার বিষয় হচ্ছে, ১৮০৯ সালেই Darwin এর জন্ম|) তিনি প্রানীদের দৈহিক গঠনের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি ধারণার প্রস্তাব করেন যে, যেসব প্রাণীর (যেমন-কুকুর এবং বিড়াল) দৈহিক গঠনের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান, তাদের পৃথিবীতে অবস্থানগত সময়সীমার মধ্যেও সাদৃশ্য আছে বা তারা প্রায় একই সময়সীমার মধ্যে পৃথিবীতে বিচরণ করে থাকে| তিনি আরও বলেছিলেন যে, দৈহিক ভাবে বৈসাদৃশ্য প্রাণীর (যেমন- ঘোড়া এবং কীট) পৃথিবীতে বিচরণের বা উত্পত্তির সময়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান| এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, যথেষ্ট সময়ের ব্যাবধানে এক ধরনের জীব অন্য ধরনের জীবে বিবর্তিত হতে পারে| তার মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবীতে কোনো প্রাণী সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়না, বরং তারা বিবর্তিত হয়ে অন্য ধরনের জীবে পরিণত হয়| কিন্তু পরবর্তিতে তার এই ধারনাটি ভ্রান্ত প্রমানিত হয়, এখন আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানি যে, সময়ের সাথে সাথে কোনো একটি বিশেষ প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়| এমন অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এদের কোনো বংশধরও নেই| তিনি আরও প্রস্তাব করেছিলেন যে, জীব জগতের বিবর্তন কোনো কারণ ছাড়াই ঘটে না, এর পেছনে থাকে সুনির্দিষ্ট কারণ অথবা লক্ষ্য| আর এভাবেই ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে সর্বোচ্চ সঠিক পর্যায়ে রুপান্তরিত হয় যেমন- মানুষ| কিন্তু তার এই ধারণাটিও ভ্রান্ত প্রমানিত হয়, এখন আধুনিক বিজ্ঞান মানুষ প্রজাতির বর্তমান পর্যায়কে সর্বোচ্চ সঠিক বলে নির্দিষ্ট করে কখনই একটি কীট এর বিবর্তনের সাথে এর তুলনা করে না| বরং সব প্রজাতির জীবেরই তাদের বিবর্তনের নির্দিষ্ট ধারা ও প্রক্রিয়া রয়েছে| Lamarck গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এর "Great Chain of Being" এই ধারনাটি যা কিনা St.Thomas Aquinas (১২২৫-১২৭৪) আরও এগিয়ে নিয়ে যান, এর মাধ্যমে কিছুটা অনুপ্রানিত ছিলেন| Lamarck সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী যিনি বিবর্তনকে একটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন|

Lyell একজন অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন যিনি পরবর্তিতে ভূতত্ত্ববিদ্যার দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি পৃথিবীর বয়স ও প্রানের উত্পত্তির সময়কাল নিয়ে কাজ শুরু করেন| তিনিই প্রথমে প্রাণীর প্র্স্তুরিভূত দেহবশেষ বা ফসিল নিয়ে কাজ করতে যেয়ে ধারণা করেন যে, মাটির নিচে বিভিন্ন স্তরে জমা হওয়া ফসিল এর সাথে এদের বিচরণের সময়সীমার মিল আছে| তিনি ধারণা করেন,, যে ফসিল মাটির উপরের দিকে স্তরে অবস্থিত তার থেকে মাটির আরও নিচের দিকের স্তরে অবস্থিত ফসিল এর বয়স বেশি এবং সেই প্রাণীর পৃথিবীতে বিচরণের সময়কালও বেশি পুরনো| এর পিছনে পৃথিবীর ভুস্তরের ধাপে ধাপে পরিবর্তন ও পরিশোধনের প্রভাব রয়েছে বলে বুঝতে পারেন| কিন্তু তার পক্ষে ভূতাত্ত্বিক সময়কাল যাচাই করা সম্ভবপর ছিলোনা প্রযুক্তির অভাবে| ১৯০০ শতাব্দীর দিকে প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভূস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সময়কাল নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া সফল হয়|

Charles Darwin বিবর্তনের ধারণাটির পেছনে প্রমান-তথ্য পর্যবেক্ষণ ও জোগাড় করতে H.M.S. Beagle নামের একটি জাহাজ নিয়ে দক্ষিন আমেরিকার Galapagos দীপপুঞ্জে যাত্রা করেন এবং যথেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করেন| পরবর্তিতে তিনি On the Origin of Species নামের একটি অসাধারণ বই প্রকাশ করেন যা জীবজগত সম্পর্কিত প্রচলিত ধারনাকে পরিবর্তন করে এবং যথেষ্ঠ বিতর্কের জন্ম দেয়| তাই দেখা যাচ্ছে যে, বিবর্তন- এই ধারনাটি Darwin আবিষ্কার করেননি, তার অনেক আগেই এই ধারণার উপরে কাজ হয়েছে| বরং Darwin বংশানুক্রমিক বিবর্তনের ধারণাটির উদ্ভাবক| তিনিই সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে, একটি প্রজাতি তার পূর্বপুরুষ থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়| এই ধারণার সাথে তিনি আর একটি যুগান্তকারী ধারণার উদ্ভাবক, সেটি হচ্ছে "প্রাকৃতিক নির্বচন", এটির একটি সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে, জীব তার পারিপার্শিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয় এবং একটি প্রজাতি থেকে শাখা-প্রশাখায় আরও প্রজাতি বিস্তার লাভ করে| তাই Darwin এর উদ্ভাবন হচ্ছে দুটি- ১. বংশানুক্রমিক বিবর্তন ও ২. প্রাকৃতিক নির্বচন| যার মধ্যে ২য় ধারনাটি অধিকাংশ সময় ভুল ভাবে ব্যাবহৃত এবং অধিকাংশ মানুষ এর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পোষণ করেনা|

Darwin একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখির (Finche) ২টি আলাদা বংশধর পর্যবেক্ষণ করেন| বংশানুক্রমিক বিবর্তন এই পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করা সম্ভব| তিনি লক্ষ্য করেন, ২টি বংশধরই একটি পূর্বপুরুষ থেকে সময়ের সাথে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছে| যাদের একটির আছে কিছুটা পাতলা বা হালকা চষ্ণু অন্যটার ভারী| তিনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ্য করেন যে, ভারী চষ্ণুর বংশধরটি গাছের শক্ত বীজ খেয়ে জীবন ধারণ করে আর পাতলা চষ্ণুর বংশধরটি গাছের নরম বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে| তার মানে সময়ের সাথে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির Finche থেকে খাদ্যাভাসের উপর ভিত্তি করে কিছুটা দৈহিক গঠনের পরিবর্তনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে ২টি আলাদা বৈশিষ্ট্যের বংশধর উত্পত্তি হয়েছে| এই বিবর্তনটি প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে| যেখানে নরম বীজ অপ্রতুল সেখানে পাতলা চষ্ণুর Finche এর সংখ্যাও কম এবং সেখানে ভারী চষ্ণুর Finche ভালোভাবে বংশ বিস্তার করেছে| আবার উল্টোটাও দেখা গেছে যেখানে শক্ত বীজ অপ্রতুল| তাই দেখা যাচ্ছে যে, পারিপার্শিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করেই প্রাকৃতিক ভাবে বিবর্তন ঘটে থাকে এবং এই বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হয়| ঠিক একই ভাবে প্রাণীজগতের অন্যান্য জীবও তাদের বাসস্থানের পরিবেশের উপর ভিত্তি করে বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হয়, তাদের এই দৈহিক পরিবর্তন ধাপে ধাপে ঘটে থাকে যা তাদের পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত|পরবর্তিতে আরও উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হবে|


তাহলে একটি ধারণা পাওয়া গেলো যে, বিবর্তন একটি সুপ্রাচীন ধারণা| আর এর উদ্ভাবক Darwin নন| বিবর্তন বর্তমানে শুধু ধারণা নয়, এটি একটি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত তত্ত্ব| তাহলে সরল ভাবে বলতে গেলে, বিবর্তন হচ্ছে জীবজগতের সময়ের সাথে ধাপে ধাপে পরিবর্তন| এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, কোনো প্রজতির শুধুমাত্র একটি প্রাণী বিবর্তিত হয়না, পুরো একটি অংশ বা দল বিবর্তিত হয়| আর তাদের এই বিবর্তন সম্পূর্ণভাবে তাদের পারিপার্শিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল, যা কিনা তাদের জীবন যাপনের ধরণ থেকে শুরু করে তাদের বংশবিস্তার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে| জৈবিক বিবর্তন সামাজিক, অর্থনৈতিক অথবা সাংস্কৃতিক বিবর্তন থেকে আলাদা| জৈবিক বিবর্তনকে কখনই সামাজিক বিবর্তনের সাথে তুলনা করা সঠিক নয়| জীবের জন্ম ও বিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা সময় সাপেক্ষ এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল| তাই একটি প্রজাতির ধাপে ধাপে বংশানুক্রমিক পরিবর্তন অনেকটা সময় জুড়ে থাকে, তাই বিভিন্ন সময়ের বংশধরদের ফসিল থেকেই এদের পরিবর্তনের মধ্যে সেতুবন্ধন করা সম্ভব|

পরবর্তিতে ধাপে ধাপে বিবর্তন তত্ত্ব ও এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় এবং এর সাথে সামাজিক প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ আলোচনা করা হবে|

Friday, October 14, 2011

বিবর্তন সম্পর্কে ১০টি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা এবং তার উত্তর

[ এই লেখাটার পেছনের উদ্দেশ্যটা বলছি, বেশ কিছুদিন আগে খুবই কাছের একজন আস্তিক বন্ধুর সাথে কিছু বিষয়ে কথা বলার সময় ধীরে ধীরে কথার প্রসঙ্গ বিবর্তনবাদের দিকে গড়ায়, স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহলী বন্ধুটি কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, তখন তার কিছু সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম, খুব সহজ ভাষায় ব্যাপারগুলো বর্ণনা করতে পারছিনা, বিবর্তন নিয়ে পড়ার পরেও সহজ ভাবে সেটি সেদিন বন্ধুকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়েছিলাম, তারপর থেকেই বিবর্তনের সম্পর্কে সাধারণ ভ্রান্ত ধারণাগুলো নিয়ে লেখা খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম| তারপরে আরও কিছু জিনিস নজরে এলো, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষ বিবর্তন সম্পর্কিত ব্যাপারে বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা ছড়াচ্ছে| শুধু তাইনা, কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে বেশ কিছু বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বক্তব্য নিয়েও ভ্রান্ত কিছু ভিডিও তৈরী করে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাই এই বিষয়টি নিয়ে লেখাটা লিখছি, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ও তথ্য সংযোজনকে স্বাগতম জানাই|]
বিবর্তনবাদ প্রথম থেকেই তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম ছিলো, এটি সৃষ্টির প্রথাগত ধারনাকে পরিবর্তন করে, একটি উপযুক্ত ও প্রমানসাপেক্ষ শক্তিশালী ধারণার জন্ম দিয়েছিলো| কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধ স্রোতের দাপটে মহান বিজ্ঞানী ডারউইন এর অসাধারণ এই কাজটি ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি ঠিকই কিন্তু মুক্তমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের চিন্তার নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছিলো| এত বছর পরেও অধিকাংশ মানুষ বিবর্তনের অতি চমৎকার ও সহজ ধারনাটিকে বুঝতে সক্ষম হয়নি বা বলতে গেলে বুঝতে চায়নি| এর পিছনের ইতিহাসে যাবোনা, শুধু খুবই প্রচলিত ও আলোচিত ১০ টি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে লিখবো| (সহজ করে লেখার চেষ্টা করেছি, জানিনা কতটুকু সফল|)
______________________________________________________________________
১ম প্রশ্ন: যদি মানুষ বানর থেকে আসে, তাহলে এখন বানর কেন মানুষে পরিণত হচ্ছেনা??
উত্তর: খুবই মজার একটা প্রশ্ন, তর্কে বিতর্কে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত| কিন্তু বিবর্তনবাদ সম্পর্কে এই প্রশ্নটি চরম ভাবে আলোচিত হলেও এটি মারাত্মক একটি ভুল| বিবর্তন কথাটি সহজভাবে বললে হয়, ধাপে ধাপে পরিবর্তন, কখনই হুট করে বিবর্তন হয়না, কোনো একটি প্রজাতির বিবর্তনের জন্য হাজার হাজার বছর লাগে| ডারউইন কখনই বলে যাননি, মানুষ বানর থেকে এসেছে| বানর গোত্রীয় প্রজাতির বিবর্তনের উধাহরণ বর্তমানের মানুষ| বানরগোত্রীয় ও বানর থেকে এই কথাটির সূক্ষ পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল তথ্য| মানুষ, বানর এবং বনমানুষ এরা সকলেই সমগোত্রীয়| মানুষ বানর থেকে নয়, বরং এমনই একটি সাধারণ প্রজাতি থেকে এসেছে, যা বানর কিংবা মানুষ কোনটাই ছিলনা, এরা মানুষের পূর্বপুরুষ যারা অতীতে কয়েক মিলিয়ন বছর পৃথিবীতে ছিলো| শুধু তাই নয়, বিগত ৭ মিলিয়ন বছর ধরে বেশ কিছু মানুষ ধরনের প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে, যাদের মধ্যে- Homo habilis, Homo erectus, and Homo neanderthalensis অন্যতম| এরা বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে, কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে টিকে আছে বর্তমানের মানুষ এবং আরও কিছু সমগোত্রীয়|


২য় প্রশ্ন: বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত ফসিল রেকর্ডে অনেক ফাঁক ফোকড় আছে, তাই ফসিল কি বিবর্তনের তত্ত্ব প্রমান করে???
উত্তর: এই প্রশ্নটির সূচনা হয় সাধারণ মানুষের ফসিল সম্পর্কিত অবজ্ঞার ও ভ্রান্ত তথ্যের কারণে| প্রথমেই জানা উচিত ফসিল কি? ফসিল হচ্ছে, প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত মৃতপ্রাণীর দেহবশেষ যা কিনা কালের আবর্তনে বিভিন্ন সময়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক চাপ ও তাপের প্রভাবে স্তরীভূত হয়ে থাকে| বিভিন্ন সময়ে খননের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত এই ফসিল নিয়ে তৈরী হয় ফসিল টেবিল| যা কিনা কোনো একটি বিশেষ প্রজাতির, বংশানুক্রমিক বিবর্তনের উধাহরণ বহন করে| এখন প্রশ্ন হচ্ছে যখন ফসিল হবার প্রক্রিয়াটি পুরোটাই প্রাকৃতিক, তখন একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণীর, পূর্বপুরুষের দেহবশেষ এর ফসিল হবার সম্ভাবনা কতটুকু?? সেটা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর-
১. সেই নির্দিষ্ট প্রাণীটির দেহকে খাদক অথবা শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রেহাই পেতে হবে|
২. তারপর সেটিকে কিছু নির্দিষ্ট চাপ ও তাপের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত হতে হবে যাতে সেটি ফসিলে পরিণত হবার আগেই হারিয়ে না যায়| এখানে পুরো সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক ও অকৃত্তিম|
৩. তারপর লক্ষ্য বছর ধরে মাটির নিচে চাপা থাকার পরে প্রাকৃতিক উপায়ে সেটি হয়তো মাটির উপরে উঠে আসবে অথবা খননকার্যের মাধ্যমে সেটির সন্ধান পাওয়া যাবে|
৪. এই বিপুল প্রাণীজগতের অজস্র ফসিল এর উদ্ধারের জন্য যারা কাজ করছে তাদের সংখ্যা অনেক কম|
এতগুলো বিরুদ্ধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীতে যত ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে তা বিবর্তনের জন্য কম তো নয়ই, বরং বিভিন্ন সময়ে প্রানীদের বিবর্তনের মধ্যবর্তী প্রজাতিরও ফসিল আবিষ্কৃত হয়ছে, যা আরও শক্ত ভাবে বিবর্তনের পক্ষে উধাহরণ স্থাপন করে| উদাহরণ হিসেবে Archaeopteryx কে নেওয়া যায়, যা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত অন্যতম প্রাচীন পাখিদের মধ্যে পরে, যার কংকাল সরীসৃপ প্রানীদের মতো কিন্তু এর ডানা এবং পালক ছিলো| যা কিনা পাখি এবং সরীসৃপ গোত্রীয় প্রানীদের মধ্যে বিবর্তনের উধাহরণ| Therapsids হচ্ছে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের মধ্যবর্তী স্তরের ফসিল একই ভাবে Tiktaalik হচ্ছে উভচর প্রানীদের বিবর্তনের মধ্যবর্তী ফসিল| বিশালাকায় তিমি মাছের বিবর্তনের ধারার মধ্যবর্তী অন্তত ৬ শ্রেনীর ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে, একই ভাবে বর্তমান আধুনিক মানুষের বিবর্তনের মধ্যবর্তী প্রায় ১২ টি স্তরের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে| তাই ফসিল বিবর্তনকে শুধু সমর্থনই করেনা, এটিকে সচিত্র প্রতিস্থাপন করে আমাদের অতীতকে আমাদের সামনে তুলে ধরে|



৩য় প্রশ্ন: যদি বিবর্তন বহু বছর ধরে ধাপে ধাপে ঘটে থাকে, তাহলে ফসিল রেকর্ডে সেটা প্রতিয়মান হয়না কেন??
উত্তর: ফসিল রেকর্ডে কিছু দ্রুত পরিবর্তন কখনই ধাপে ধাপে পরিবর্তন এর বিরুদ্ধে নয় বরং এটি বিজ্ঞানের ভাষায় punctuation এর একটি উদাহরণ| কোনো প্রজাতি একটি দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, কিন্তু একটি প্রজাতি থেকে আর একটি প্রজাতিতে পরিবর্তন ঘটে দ্রুত, যাকে বলা হয় punctuated equilibrium| এই পদ্ধতিতে দেখা গেছে, যদি কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়ে অন্য একটি প্রজাতি সৃষ্টি হয় তাতে বিবর্তন ঘটে দ্রুত, কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষের সংখ্যার থেকে তাদের সংখ্যা কম থাকায় এবং সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রজাতি তৈরী হওয়ার জন্য এদের মধ্যে পরিবর্তন হয় দ্রুত, এ কারণে ফসিল হিসেবে সংরক্ষিত হবার আগেই হয়তো এদের পরিবর্তন সাধিত হয়| এ কারণেই ফসিল রেকর্ডে দ্রুত পরিবর্তন দেখা যায় কখনো কখনো বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তারা তাদের পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য বহন করে| তাই দ্রুত পরিবর্তন কখনই বিবর্তনের বিরুদ্ধে নয় বরং এটি বিবর্তনের একটি ধারাকে প্রমান করে|


৪র্থ প্রশ্ন: কেউ কি বিবর্তন নিজের চোখে ঘটতে দেখেছে??
উত্তর: বর্তমান পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষেত্র বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে, প্রজাতির জীবন হতে শুরু করে জীবিকা সবই বিবর্তনের উধাহরণ| কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ফসিল রেকর্ড দিয়ে বিবর্তন প্রমান করা হয়না, বরং অজস্র প্রজাতির ফসিল থেকে ধারণকৃত তথ্য উপাত্ত ও DNA গবেষনার উপর ভিত্তি করে প্রচুর প্রমানের পরেই এই উপসংহারে আসা হয়| সাধারণ বিজ্ঞান এর বিভিন্ন শাখা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন উপশাখার মাধ্যমে বিবর্তন সম্পর্কে কাজ করা হয়েছে| বিভিন্ন প্রজাতির বংশানুক্রমিক পরিবর্তন বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণের পরেই এই ধরনের উপসংহারে আসা সম্ভবপর| কোনো জাদুকরী কুদরতির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান কাজ করেনা, বিজ্ঞান প্রমান সাপেক্ষ জ্ঞান, বিজ্ঞান নিজের ভুল নিজে খুঁজে বের করে এবং তা স্বীকার করে পরিবর্তনও বিজ্ঞানই করে, বিবর্তনও ঠিক সেরকমই একটি চলমান ধারা, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে| ভাইরাস কোষ কিংবা ব্যাকটেরিয়া কোষ এর বিবর্তন যথেষ্ট দ্রুত ঘটতে দেখা গেছে, যা আধুনিক মেডিকেল সাইন্স এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক|

৫ম প্রশ্ন: বিবর্তন রেন্ডম চান্স এর মাধ্যমে হয়, তাই এটি কি নির্ভরযোগ্য??
উত্তর: বিবর্তন কখনই রেন্ডম চান্স এর মাধ্যমে হয়না, এটি একটি ভুল ধারণা| এই সম্পর্কে রিচার্ড ডকিংসের একটা বর্ণনা আমার বেশ ভালো লাগে| যদি বলা হয় একটি ঘুর্নিঝড়কে একটি স্ক্রেপ ইয়ার্ড এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং অজস্র টুকরো থেকে এক হয়ে একটি বোয়িং বিমান তৈরী হবার চান্স কতটুকু?? তাহলে যেমন হাস্যকর শোনায়, বিবর্তন রেন্ডম চান্স এ ঘটে থাকে এটা ততটাই হাস্যকর শোনায়| Natural selection কখনই রেন্ডম নয়, তা কোনো চান্স এর মাধ্যমেও হয়না| বিবর্তন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন সময়ে দেহকে পরিবেশের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে, এটি অতীতের ভুল-ত্রুটি গুলোকে সংশোধন করতে থাকে, তাই ধাপে ধাপে একটি অতি চমৎকার ও জটিল নকশা তৈরী হয়| কিন্তু সেটা কখনই রেন্ডম নয়| যেমন মানুষের চোখের গঠন একদিনে হয়নি, রেন্ডম ঘটনাও নয়| পরিবেশ ও সময় উপযোগী করে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে, একই ভাবে হাতের তালু মুঠো করবার ক্ষমতা মানুষের মধ্যে যেমন দেখা যায় অন্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সেটা অনেক সময় অনুপস্থিত| এটা বিবর্তনের ফসল| বিবর্তন মানুষের দেহকে অন্য স্তন্যপায়ী প্রানীদের দেহ থেকে আলাদা এবং আধুনিক করেছে ধাপে ধাপে| মস্তিস্ক এর পরিবর্তনও হয়েছে ধাপে ধাপে|

৬ষ্ঠ প্রশ্ন: শুধুমাত্র একজন অসাধরণ সৃষ্টিকর্তাই পারেন দেহর মতো এমন একটি জটিল নকশা তৈরী করতে, বিবর্তনের পক্ষে একটি কোষ থেকে এত জটিল একটি নকশা সম্ভব কি??
উত্তর: সম্ভব| মানুষের চোখের উদাহরণ ধরি, প্রথম কথা হচ্ছে চোখের গঠন জটিল কিন্তু উল্টো, মানুষ যা দেখে তা প্রথমে সম্পূর্ণ উল্টো থাকে তারপর বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি মস্তিস্ক সঠিক করে এবং সোজা করে দেয়| তাই যখন চোখে আলো প্রবেশ করে তা কর্নিয়া, লেন্স, একুয়াস ফ্লুইড, ব্লাড ভেসেল, গেন্গ্লীয়ন সেল, হরাইজন্টাল সেল, বাইপোলার সেল ইত্যাদি অতিক্রম করে আলোক সংবেদনশীল রড এবং কোন এ পৌঁছে, যা নিউরাল ইমপালস তৈরী করে যেটা পরে ভিজুয়াল কর্টেক্স এ যায় যা কিনা মস্তিষ্কের পেছনে অবস্থিত সেটা এই সিগনালকে অর্থপূর্ণ ছবিতে পরিণত করে যা আমরা দেখতে পাই| যদি কোনো অসাধরণ সৃষ্টিকর্তাই দেহ বানাতেন তাহলে এত ঝামেলার কি দরকার ছিলো, আর ছবিটা উল্টো করে পাঠানোরই কি দরকার ছিলো?? তার থেকে বরং সোজাসুজি সব কিছু করলেই ঝামেলা থাকতনা| কিন্তু তা হয়নি, কারণ চোখের মতো আর সব অঙ্গই তাদের কাছে থাকা পদার্থ দিয়ে ধাপে ধাপে তৈরী হয়েছে, তাই এত ঝামলা| এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা তো নয়ই বরং খুবই নির্দিষ্ট ভাবে বিবর্তনকে সমর্থন করে| এভাবে প্রাণীজগতের সব প্রজাতির দেহই বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তৈরী| বিবর্তনের এটাই মজা|

৭ম প্রশ্ন: বিবর্তন শুধুই থিওরি, প্রমান কি??
উত্তর: বিজ্ঞান থিওরি থেকেই আসে, তবে কেউ থিওরি দিলেই সেটা মেনে নেওয়া হয়না| অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যুক্তি তর্কের উপর ভিত্তি করে তবেই কোনো উপসংহারে আসা হয়, যেমন নিউটন এর মাথায় আপেল বা কাঁঠাল পরলেই অভিকর্ষ আর মহাকর্ষ প্রমান হয়না, তার জন্য লাগে গাণিতিক প্রমান, যুক্তি, পর্যবেক্ষণ| তেমনি বিবর্তনের ধারণা কোনো গায়েবী আওয়াজ থেকে আসে নাই, ডারউইন বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে যে মহা বিপ্লবের সূচনা করে গেছেন, তা তার মৃত্যুর সাথেই থেমে যায়নি, বরং আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত বহু বছর আগে করে যাওয়া তার থিওরিকেই প্রমান করে চলেছে| অজস্র ফসিল প্রমান, প্রজাতির বংশানুক্রমিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে তৈরী করা চার্ট ইত্যাদি সবই বিবর্তনকে সমর্থন করে| এর পরেও বিশ্বাস করতে না চাইলে কিছু করার নেই, চোখের সামনেই সব উধাহরণ আছে|
৮ম প্রশ্ন: মানুষের বিবর্তন শুধুই ভ্রান্ত ধারণা ও নানা ভুলে ভর্তি, কেন মানবো??
উত্তর: মানুষের দৈহিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো বিবর্তনই ভুল ধারণা নয়, দৈহিক বিবর্তন নিয়েই সব ঝামেলা কিন্তু তাতেও কোনো ভুল নেই, বরং কিছু সন্দেহ ছিলো যা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়েছে প্রমান সাপেক্ষে| মানুষের দেহে নানাবিধ বিবর্তনের উদাহরণ উপস্থিত| দেহের মেরুদন্ডের সর্বশেষ অস্থিটি বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে, এপেন্ডিক্স মানুষের দেহে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় রয়েছে| মানুষের শরীরে এরকম বেশ কিছু উদাহরণ আছে-
১. পশম দাড়িয়ে যাওয়া [Goose Bumps- (Cutis Anserina)] : এটি শুধু মানুষের মধ্যেই না অনেক লোমশ প্রাণীর মধ্যে আরও ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, সাধারণত আত্মরক্ষার্তে দেহের পরিধি বাড়ানোর জন্য অনেক প্রাণীই যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি এটি ব্যাবহার করে থাকে| কিন্তু মানুষের দেহে ততটা দরকারী না হলেও, ভয় কিংবা শিরশিরে অনুভূতি হলেই আমাদের পশম দাড়িয়ে যায়|

২. Jacobson’s Organ-(Vomeronasal organ) : নাকের ভেতরের এই অঙ্গটি বিভিন্ন প্রজাতির প্রানীদের মধ্যে খাবারের ঘ্রাণ গ্রহনের পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রানীদের শরীর এর গন্ধ পেতে সাহায্য করে, যাতে তারা শারীরিক মিলনের মাধ্যমে জৈবিক কর্ম সম্পূর্ণ করতে পারে, মানুষ এর শরীরে এই অঙ্গটি থাকলেও বিবর্তনের মাধ্যমে সেটি এখন আর কোনো কাজে লাগেনা, ধারণা করা হয়, মানুষের পূর্বপুরুষরাও এই অঙ্গটি বিপরীত লিঙ্গের খোঁজ পেতে ব্যাবহার করে থাকতো|

৩. Junk DNA-(L-gulonolactone oxidase) : অতীতে এটি এনজাইম তৈরিতে ব্যাবহার হত যা দেহে ভিটামিন সি তৈরী করতে পারতো, কিন্তু বিবর্তনের ফলস্বরূপ এটি কার্যত এখন অকেজো, কিন্তু দেহে বিদ্যমান|

৪. Extra Ear Muscles-(Auriculares muscles) : বিভিন্ন প্রাণীর মতো আমাদের দেহেও এই অংশটি আছে, প্রাণীরা শব্দ ভালো করে শোনার জন্য কান নাড়াতে এটি ব্যাবহার করে, বিড়াল বা কুকুরকে হামেশাই করতে দেখা যায়| কিন্তু মানুষের মধ্যে হালকা নাড়ানো ছাড়া এটির আর কোনো কাজ নেই, এটিও বিবর্তনের ফল|

৫. Plantaris Muscle : পায়ের এই পেশিটি অনেক প্রাণী খাবার ধরতে ব্যাবহার করে থাকে, বানরদের মাঝে এটা দেখা যায়| কিন্তু মানুষের পায়ে এই পেশিটি থাকলেও কোনো কাজে লাগেনা| বিভিন্ন সময় দেহে পেশী অপারেশনের সময় ডক্টর এখান থেকে পেশী কেটে নেন| মানুষের দেহে এই পেশিটি এতই অপ্রয়োজনীয় যে শতকরা ৯ ভাগ মানুষ এটা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে|

৬. আক্কেল দাঁত (Wisdom Teeth) : প্রচলিত ধারণা এটি গজালে নাকি বুদ্ধি হয়, রসিকতা থাক| প্রাচীন যুগে এই দাঁতটি ব্যাবহার হত লতা পাতা খাবার জন্য, দ্রুত চর্বন ও শর্করা দ্রুত খেতে এটি ব্যাবহার করতো আদি মানবরা| কিন্তু বিবর্তনের ফলে অদরকারী হয়ে পরা অঙ্গটি এখনো দেহে বিদ্যমান ঠিকই কিন্তু বর্তমানে অনেক মানুষেরই এটি গজানো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বংশানুক্রমে|

৭. চোখের তৃতীয় পাতা (Third Eyelid) : কোনো বিড়ালকে কাছে থেকে চোখের পাতা ফেলতে দেখলে দেখা যায় যে, হালকা সাদা একটা অংশ চোখের মনির উপর দিয়ে চলে গেলো, এটা চোখের তৃতীয় পাতা| স্তন্যপায়ী প্রানীদের মধ্যে এই অংশটি বিরল হলেও পাখি, সরীসৃপ এদের মধ্যে স্বাভাবিক অংশ এটি| মানুষের মধ্যেও আছে এটি কারো কারো বেশ ভালো ভাবে দেখা যায়|

৮. Darwin’s Point-(plica semilunaris) : এই অংশটি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে দেখা যায়, মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, এটা প্রানীদের নির্দিষ্ট শব্দের প্রতি মনোযোগ দিতে সাহায্য করে কিন্তু মানুষের দেহে এর কোনো কাজ নেই| শতকরা ১০ ভাগ মানুষের দেহে স্পষ্ট দেখা যায়|

৯. Coccyx : মেরুদন্ডের এই অংশটি আগে লেজ হিসেবে ব্যাবহার হলেও বিবর্তনের ফলে এখন আর লেজ হিসেবে নয় বরং বিভিন্ন পেশির কাজে উঠা বসার সময় ব্যবহার হয়|

১০. Appendix : আগেও বলা হয়েছে, মানব দেহে এর কাজ নিয়ে বিভিন্ন মত আছে, সচারচর ব্যাবহার হয়না, অনেকে অপারেশন করে ফেলে দেন| ডারউইন এবং কিছু বিজ্ঞানীর মতে অতীতে যখন প্রচুর পরিমানে লতা পাতা খাবার হিসেবে গ্রহণ করতো আদি মানবেরা, তখন সেই বিপুল পরিমানের শর্করা হজম করতে এটি ব্যাবহার হত| এখন আর কোনো সঠিক ব্যাবহার খুঁজে পাওয়া যায়না|

৯ম প্রশ্ন : থার্মোডিনামিক্স এর ২য় সূত্র প্রমান করে বিবর্তন অসম্ভব, তাই না??
উত্তর: থার্মোডিনামিক্স এর ২য় সূত্রটি একটি বন্ধ ও আইসলেটেড সিস্টেম এর জন্য ব্যাবহার করা যায়, কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে সূর্য থেকে তাপ আসছে আর তাপ বাইরেও যাচ্ছে, তাই পৃথিবী কোনো বদ্ধ সিস্টেম না| তাপের আদান প্রদান এর উপর ভিত্তি করে তাপমাত্র বাড়ছে কমছে, তাই যতদিন সূর্য থাকবে ততদিন কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ না করেই বিবর্তন হবে|

১০ম প্রশ্ন : মানুষের মূল্যবোধের সাথে বিবর্তনের ধারণা সঙ্গতিপূর্ণ কি??
উত্তর: অবশ্যই| মানুষ সামাজিক প্রাণী, তার মূল্যবোধ আজকের যে পর্যায়ে আছে তা একদিনে তৈরী হয়নি, বরং ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ পেয়েছে| আগে মানুষের যেরকম মূল্যবোধ ছিলো সামাজিক পট পরিবর্তনের হাত ধরে বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ আজকের অবস্থানে এসেছে, এটাও কোনো অপরিবর্তনীয় অবস্থা নয়, ধীরে ধীরে ভবিষ্যতে এটাও পরিবর্তন হবে| তাই বিবর্তন চলমান একটি প্রক্রিয়া| তাই সমাজ ও মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল|
______________________________________________________________________
বিবর্তনকে মানা আর না মানার মধ্যে কিছুই নেই, না মেনে যারা থাকতে চায় তারা সত্যি অবজ্ঞা করে বাঁচতে চায়, যারা বিবর্তন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক এত অল্প পরিসর কখনই যথেষ্ট নয়, ইন্টারনেটে অজস্র পেপার দেওয়া আছে বিজ্ঞানীদের, অজস্র উদাহরণ আছে সচিত্র, দেখতে শুরু করলে জানতে শুরু করলে দারুন ভালো লাগবে| বিবর্তন চলমান একটি প্রক্রিয়া, এখনো কাজ চলছে, প্রতিদিন নিত্য নতুন তথ্য আবিষ্কার হচ্ছে, এগুলো সহজ ভাষায় সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সবার|

Monday, September 26, 2011

বিসর্জন




হালকা হালকা বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলগুলো দুলছে, আকাশেও সাদা সাদা মেঘ, বছরের এই সময়টা খুব ভালো লাগে হৈমন্তীর| মাটিতে শুয়ে আনমনে কি সুন্দর আকাশটা দেখা যায়, কখনো কখনো মেঘ দিয়ে কি সুন্দর হাতি-ঘোড়া, আরও কতকিছু যে তৈরী হয়ে যায়, সবাই কি তা বোঝে? যখন বিলের ধারে ঘুরঘুর করে তখন হঠাৎ কখনো একটা সাদা বক সাই করে উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে, আর ঠিক বিলের মাঝখানটায় টুক করে বসে খপ করে একটা মাছ ধরে নেয়| কত মজার মজার জিনিস দেখা যায় নদীর কাছের জঙ্গলটায়, যে না গেছে সে কি করে জানবে? একটা বড় গাছ অনেক দিন হলো ভেঙ্গে গেছে, অর্ধেকটা পাড় এর জল ছুইছুই, সেটার উপর বসে একলা একলা পা দোলাতে ভালই লাগে| হৈমন্তীর এই ভালো লাগা গুলো ওর মা বুঝলে তো|

মাকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ, সংসারের কাজ সামলাতে হিমশিম তো খেতেই হয়, তার উপরে এতগুলো মানুষের খাবার জোটাতে গেলে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়| মা তাই সকাল থেকেই হয়রান থাকে, আর ও সামনে গেলেই এটা ওটা কাজ ধরিয়ে দেবে, ও তাই সকাল বেলাতেই এক দৌড়ে নদীর পাড়| তার উপরে পূজো আসছে, গ্রামের বড় বাবুদের বাড়িতে হই হই ব্যাপার| অনেক বড় সামিয়ানা টানানো হয়েছে, রাত দিন কাজ চলছে, বড় বড় গাড়িতে বোঝাই করে জিনিস আসছে| ওরা ছোটরা দল বেঁধে দেখতে গেলে, গেটের দারোয়ানটা ঢুকতেই দিলনা| তাই তো বুদ্ধি করে ওরা পাশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিলো| ওদের চোখে বিশ্বাস হয়না, কত্তো বড় প্রতিমা, কি সুন্দর গায়ের রং| আর সবাই কি রকম দৌড়ে দৌড়ে সাজাচ্ছে| সে এক বিশাল ব্যাপার|

হৈমন্তীর মনে পরে, আগে এত অভাব ছিলনা ওদের| আসলে অভাব কি জিনিস মা কখনো বুঝতেই দেইনি| ওর দিদা বলতো, হেমন্তে জন্ম বলে ওর নাম রাখা হয়েছিল হৈমন্তী| আরও বলতো অনেক ধান কাটা হত তখন গ্রামে, কি সুন্দর মেলা চলতো| ওদের বাড়িতেও অনেক মজা হত| পুজোতে নাকি ওর বাবা সবার জন্য নতুন জামা আনতেন| ওকে বাড়িতে সবাই হেমু হেমু বলেই ডাকে| ওর মনে পরে, ওরা ছোটরা নতুন জামা পরে পুজোর দিন দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো| সাথে থাকতো মায়ের দেওয়া খুচরো টাকা, ওরা মাঝে মাঝে বাজি-পটকা কিনতো, কখনোবা খাবার জিনিস| তারপর সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যার সময় যখন বড় বাবুদের বাড়িতে আলো জ্বলতো তখন এক দৌড়ে ওখানে, বড় বড় প্রদীপের আলোয় প্রতিমার মুখটা কি সুন্দর লাগতো, দূর থেকে অবাক হয়ে দেখত ওরা| এভাবেই হই-হই, রই-রই করে পুজোর চারটা দিন পাড় হয়ে যেতো, টেরই পাওয়া যেতোনা| আর বিসর্জনের দিন নদীর পাড়, অনেক লোক, দূর্গা মায়ের বিদায়, মায়েদের চোখের জল, সেগুলো এখনো মনে পরে|

কিন্তু সব কিছু ঠিক থাকলেও, ওদের বাড়িটা ঠিক নেই, এখন আর আগের মতো পুজোয় নতুন জামা আসেনা, মায়ের হাতের নাড়ু মোয়া এখন আর চোখে দেখা হয়না, বাবার চোখটা ওদের সামনে আসলেই কেমন যেনো ছল ছল করে| বড় ভাই কাজের খোঁজে শহরে গেছে, ও পুজোতে বাড়ি আসেনা| এখন আগের মতো বাড়িতে রান্না হয়না, কখনো কখনো ওর খাওয়া হয়না, আর পুজোর সময়টা বাড়িতে সবাই কেমন যেনো মনমরা হয়ে থাকে| ছোট ভাই গুলো পুজোর আগ দিয়ে অনেক চেচায়, আবদার করে, তারপর এক সময় নিজেরাই ক্ষান্ত দেয়| আগে দল বেঁধে খেলতো, ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু ওর বন্ধুগুলো বাবা-মার সাথে একে একে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলো| ওর নিজের বুদ্ধিতে কুলোয়না, কেনইবা সবাই পরিচিত জায়গা ছেড়ে, আপন মানুষ ছেড়ে, অন্য অচেনা জায়গায় যায়| তাইতো এখন পুজোতে একা একাই ঘুরতে হয়|

দেখতে দেখতে এবারের পূজোও চলে এলো, বড় বাবুদের বাড়িতে সবাই এসেছে| দামি দামি, বড় বড় গাড়িতে করে অনেক লোকজন| ওর মতো অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে মেয়েও এসেছে দেখলো| সবার হাসি খুশি চেহারা দেখলে মজাই লাগে| ষষ্ঠীর দিন থেকে ঢাকের বাদ্য শুরু হয়, বাতাসে কি সুন্দর ঘ্রাণ, ধুপের ধোঁয়ায় দেখাই যায়না কিছু| ও মাঝে মাঝেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে, ভিতরে কত্তো আয়োজন, আর সব থেকে মজার কথা হলো, প্রতিমার সামনে কি সুন্দর করে সাজানো খাবারের থালা| সুন্দর গন্ধে এভাবেই পেট ভরে যায়| বাড়িতে আসে সন্ধ্যার পরে, মা দেখতে পেয়েই আচ্ছা করে কান মলে দিলো| সারাদিন ঘুরে বেড়ালে কি চলে, বাড়ির কাজটাও দেখতে হবে যে| হেমুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো, একে তো পুজোর সময়, সারাদিন পেটে কিছুই পরেনি, তার উপরে এরকম করলে কেমন লাগে? আর ও করবেই বা কি, বাড়িতে থাকলেই মন খারাপ হয়ে যায়, অভাব জিনিসটা এখন বেশ ভালই বুঝতে পারে ও| তা থেকে নদীর ধারের জঙ্গলের ওর প্রিয় জায়গাটাতেই ভালো, আকাশ দেখেই কি রকম সময় কেটে যায়|

দেখতে দেখতে এক এক করে, সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর দিন গুলো চলে যায়, আগের মতো ঘোরা হয়না, তবুও বাবুদের বাড়ির পুজোর আয়োজন চোখে পরে| নতুন জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় সবাই, চার পাশে দোকান সাজিয়ে বসে অনেকে| হেমু ঘুরে ঘুরে সব দেখে, কিন্তু আধ পেট খেয়ে কি এসব দেখে মন ভরে?

দশমীর দিন, দেবীর বিদায়ের প্রস্তুতিতে সবাই ব্যাস্ত| সকাল বেলাতে মায়ের কাছে একগাদা বকা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ, দশমীর দিনটাতে এভাবেই মন খারাপ থাকে, চারিদিকের হৈচৈ আজকেই শেষ হয়ে যাবে, এসব ভেবে হেমুর মন আরও খারাপ হয়ে যায়| খিদে ভুলে থাকার এই কটাদিন নেহায়েত মন্দ ছিলনা, সবার উপর অভিমান হয় খুব, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে একা|

বাবুদের বাড়ির প্রতিমা নিয়ে শেষ বিকেলে নদীর ধারে আসে সবাই, মায়ের বিদায়ের ক্ষণে মন খারাপ সবারই| দেখতে দেখতে প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যায়, মাটির প্রতিমা জলে ভেসে যেতে থাকে দূরে| বিসর্জন শেষে একে একে বাড়ির দিকে ফেরে সবাই| সন্ধ্যা হয়, অন্য দিনের চেয়ে সন্ধ্যার আলোটা বেশি গম্ভীর, হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়া পুজোর বাড়ি থেকে বিদায় নেয় সবাই| মন্ডপে টিমটিম করে জলতে থাকা শেষ প্রদীপের আলোটা শুধু মনে করিয়ে দিতে থাকে মাত্রই অতীত হয়ে যাওয়া জীবনের গল্পটা|

সেদিন আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেনি হৈমন্তী, অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি কোথাও| হন্যে হয়ে খুঁজেছিলো সবাই, মা কেঁদেছিলেন খুব| শেষমেষ অনেক পরে মাঝনদীতে ওর নিথর দেহ খুঁজে পেয়েছিলো নৌকার মাঝিরা, কেও বুঝতে পারেনি কি করে মারা গেলো হেমু, মা-বাবা শোকে স্তব্দ হয়ে গেলেন, গ্রামের লোকেরা ভাবলো বিসর্জন দেখতে গিয়ে জলে পরে গিয়েছিলো হয়তো, এত ভিড়ের মাঝে কেও দেখতে পায়নি|

কিন্তু কেও বুঝলোনা অনেক না বলা অভিমান আর পেটে খিদে নিয়ে, এই ছোট্ট মেয়েটা দশমীর দিন দেবীর বিসর্জনের সাথে সাথে নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিয়ে দিলো| অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের বার্তা নিয়ে দেবী এলেও সেটা হৈমন্তীর জীবনে পৌঁছেনি, বরং বাস্তব জীবনের কোলাহল আর প্রতিমুহুর্তের বেঁচে থাকার আকুতি  থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াটাই অনেক সহজ মনে হয়েছিল ওর| কেও বুঝলোনা, খেয়ে না খেয়ে, বেঁচে থাকার যুদ্ধে কখনো কখনো দেবীর জয় হয়না|

[
গত বুধবার সোনাবারু নামের মেয়েটির নাকি জন্মদিন ছিল, কিন্তু বাড়িতে ভাত খেতে না পেয়ে, ক্ষিদের জালায় ১৩ বছরের ছোট মেয়েটি আত্মহত্যা করে|
তোকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারলামনা, দুবেলা ভালো করে খেয়ে অন্যদের মতো হাসি খুশি ভাবে জীবন কাটাতে পারলিনা, অভিমান করে তাই জন্মদিনটাকেই বেছে নিলি চলে যাওয়ার জন্য| এটা আমাদের ব্যার্থতা, আর এই লজ্জা সাথে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকবো| তোর জন্যে এই লেখা|]
   

Monday, September 12, 2011

মন ভালো নেই


মন ভালো নেই, তাই আকাশের নীল ঝাপসা কালো
  সোনালী রোদ হারায় মেঘে,
মন ভালো নেই, তাই স্বপ্নগুলোর ডানা ভেঙ্গে
   দুঃস্বপ্ন মুক্তি খোঁজে,
মন ভালো নেই, তাই ফুলগুলো সব শুকনো পাতা
   বসন্ত লুকোয় শীতের বুকে,
মন ভালো নেই, তাই দিনগুলো সব রাত হয়ে যায়
   সময়টাও উল্টো চলে,
মন ভালো নেই, তাই ঘরের কোনেই বন্দী জীবন
   নিজের ছাঁয়াও সঙ্গী খোঁজে|

নারী পাচারকারী চক্র এবং আমার অভিজ্ঞতা


২৫ আগস্ট, ২০১১

সন্ধ্যা হয়েছে, মাঠ থেকে খেলে মাত্রই হোস্টেলের রুমে ঢুকেছি দেখলাম মুঠোফোন বাজছে, কিছুটা বিরক্তি নিয়েই অপরিচিত নাম্বারটা ধরলাম, ওপাশ থেকে লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত এক অফিসারের গলা শোনা গেলো, কেমন আছি, কিরকম চলছে এই বৃত্তান্তের ধকল কাটিয়ে চিন্তা করছি কখন আসল কথায় আসবে, তখনি বলে উঠলেন, আমাদের এখানে তিনজন ইলিগ্যাল ইমিগ্রান্ট ধরা পড়েছে, তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তার উপরে তিনজনই নারী, তাদের ভাষা এখানে কেও বুঝতে পারছেনা, তাই পুলিশ কাজ এগোতে পারছেনা, লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত হলাম আমি, তাই আমাকে বললেন সাথে যেতে, ভাষা বুঝে তাদের তদন্তে সাহায্য করতে হবে| আমি ভাবলাম ভাষা বোঝা না হয় হলো, কিন্তু দেশের বাইরে এসে পুলিশের ঝামেলায় না জড়ালেই হলো| সাত পাঁচ ভেবে বলে দিলাম পরের দিন সকালে চলে যাবো অফিসে| রাতে জিনিসটা নিয়ে কয়েকবার ভেবেও এটা মাথায় এলোনা, দেশ থেকে এত দূরে ভারতের উত্তরপ্রদেশে মেয়েগুলো এলো কি করে???

২৬ আগস্ট, ২০১১

পরের দিন সকালে গিয়ে কাজ হলোনা, আবার দুপুরে যেতে হলো, বসে রইলাম তার অফিসে কতক্ষণ, এরপর বললেন যেতে হবে প্রধান থানাতে, বাইকে চেঁপে চললাম তার সাথে, ঈদ এর মাত্র কদিন বাকি, বাজারে প্রচন্ড ভিড়, লোকজন কেনাকাটা করছে, এলাহাবাদের চক বাজারের ভেতরে কোতয়ালি থানা, সেদিন ছিলো শুক্রবার, ঈদ উপলক্ষে এরমধ্যেই অজস্র পুলিশ মোতায়েন করা, গিয়ে ঢুকলাম তদন্তকারী অফিসারের রুমে, দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ভালই দৌড়ের উপরে আছেন ভদ্রলোক, আমাদের নিয়ে গেলেন পাশের বিল্ডিঙ্গের ডিআইজি এর দপ্তরে, তখনি লক্ষ্য করলাম অল্প বয়সী তিনটা মেয়ে বসে আছে, সাথে মহিলা পুলিশ, ডিআইজি তখন বাইরের ডিউটিতে, আমাদের বলা হলো বসতে, প্রচন্ড গরমে বাইরের ঘরে বসে আছি, মেজাজ খারাপ হতে লাগলো, সাহায্য করতে এসে কি বিশ্রী অবস্থা, এরই মধ্যে অফিসার কয়েকবার এসে অনুরোধ করে গেলেন না যাওয়ার জন্য, তারপর ঘন্টা তিনেক পরে একই সাথে ডিআইজি, মেজিস্ট্রেট, এসপি আরও বড়কর্তারা এসে হাজির, ডাক পড়লো আমার ভিতরে, মেজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তা আর একজন লেখককে নিয়ে বসলেন, আমাকে বললেন মেয়েদের একে একে সবাইকে নিজের নাম-ঠিকানা পরিচয় থেকে শুরু করে বিস্তারিত ঘটনা জিজ্ঞেস করতে, ভালো করে মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করলাম, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই কম বয়স, ততক্ষণে জেনে গেছি তিনজনকেই বাংলাদেশ থেকে এখানে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, চরম অত্যাচারের পর এরা কোনভাবে পুলিশের হাতে ধরা পরে নারী নিকেতন এ আসে|

তিনজনকেই একে একে জিজ্ঞেস করলাম সব কিছু, খুঁটিনাটি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার পরে মোটামুটি বক্তব্য দাড়ালো একই রকম-(নাম-পরিচয় ও ঠিকানা প্রকাশ করছিনা)

"তিনজনই ঢাকার কোনো গার্মেন্টস বা স্পিনিং কারখানায় কাজ করতো, এদের সবাইকেই অল্প পরিচিত অন্য আরেকজন মেয়ে ভালো কাজ দাওয়ার নাম করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়, তারপর খাবারের সাথে ওষুধ মিশিয়ে দাওয়া হয়, অজ্ঞান অথবা নেশা অবস্থায় তিনজনকেই বর্ডার পার করানো হয়, তারপর সেখান থেকে কোলকাতা, সেখানে একজন মহিলার বাসায় এদের রাখার পরে, সুবিধেমতো আবার ওষুধের প্রয়োগ করে ট্রেনে করে এদের নিয়ে আসা হয় এলাহাবাদে, এখানে একজন একজন করে তিনজনকেই বিভিন্নভাবে নিয়ে এসে বিক্রি করে দাওয়া হয় পতিতালয়ে, সেখানে একজন মহিলার অধীনে অনেকদিন ছিলো, জোর করে প্রতিদিন ১০-১২ এর অধিক মানুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে বাধ্য করা হত, সকাল ৮ টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো এই অত্যাচার| আর কথা না শুনতে চাইলে মারধর তো আছেই| ২ জনের বয়স ১৮ এবং একজনের ১৭ বলে জানালো ওরা|"

কথাগুলো ওদের মুখ থেকে শুনে চলেছি, এদিকে একের পর এক কাগজে কলম চালাচ্ছি, জবানবন্ধি তৈরী করছি, কিন্তু একসময় সত্তি মনে হলো কেও যেনো কানে গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে, পুলিশের পুরো জেরাটা করতে হচ্ছে আমাকে, সাথে উঠে আসছে অত্যাচারের বর্ণনা, একসময় মনে হলো না এলেই হয়তো ভালো করতাম| ততক্ষণে বেশ কয়েকদফা জবানবন্ধি নেওয়া হয়ে গেছে, মেজিস্ট্রেট চলে গেলেন কাগজে সই করে, আমাকে বলে গেলেন শেষ পর্যন্ত বসে সব কাগজে সই করে, জবানবন্দি যাচাই করে সবার টিপসই নিয়ে, আবার জবানবন্দি গুলোকে হিন্দিতে রূপান্তর করে দিয়ে যেতে| এরই মধ্যে মহিলা পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, অনেক সাহস করে এদের মধ্যে একজন, কারো মাধ্যমে ফোনে খবর দেয় থানাতে, তার খবরের ভিত্তিতেই পুলিশ হানা দেয়, উদ্ধার করে এই তিনজনকে| এদিকে কাজ চলছে, মাঝে মাঝে মেয়েগুলো দু-চারটা কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তাদের বার বার একই প্রশ্ন, ঈদ এর আগে বাড়ি যেতে পারবে তো?? আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারলামনা, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন পাশে বসে থাকা এসপি, বললেন কি হয়েছে, প্রশ্ন শোনার পরে তিনিও চুপ করে রইলেন, তারপরে আমতা আমতা করে বললেন, কি আর বলা যাবে বলো, এই কেস তো আমাদের হাতের না, ইন্টারপোল তারপর দু দেশের এম্বাসীর হাতে চলে যাবে এরপরে| জেনেও মিথ্যে বললাম, বললাম ওদের হয়ে যাবে, ঈদের আগেই যাবে দেশে, চিন্তা করোনা| তখন বুঝলাম কখনো কখনো মিথ্যে বলাটা আসলেই কষ্টের কাজ| ততক্ষণে আমি চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে পালানোর, প্রায় ৬ ঘন্টা ধরে বসে আছি এখানে| তারপর ঘন্টা সাতেক পরে একগাদা কাগজে সই করে, সব কাজ শেষ করে বের হলাম| তার আগে ওখানে বসে বসে শুনেছি পালের গোদাদের ধরার জন্য ঐদিন রাতেই পুলিশের হানা দাওয়ার প্ল্যান| শুনে এলাম তিনজনকেই এখানের আইনি কাজ শেষ হলে দিল্লি পাঠানো হবে, তখন দুই দেশের মধ্যে আইনি কাজ চলবে হস্তান্তরের| অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে বের হয়ে এলাম| পিছনে রেখে এলাম কিছু উত্সুক চেহারা, আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলা তিনটি মানুষ|

ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে আটটা ছুই ছুই করছে, সারাদিনে পেটে সরকারী চা ছাড়া কিছুই পড়েনি, এর মধ্যে ফেরত এলাম লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর অফিসে, কথা হচ্ছিলো কিছু অফিসারের সাথে, সেখান থেকে বের হয়ে এলো আরও কিছু তথ্য, ভারতীয় বর্ডার সংলগ্ন দেশ গুলো থেকে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় অনেক মেয়ে, এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন শহরে, বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়, ভালো চাকরি বা ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, তারপর এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় পতিতালয়ে| এছাড়াও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মেয়ে শিশু জন্মের পরে হত্যা করা হয়, সেখানে মেয়ে সংখ্যায় এতই কম যে পুরুষদের বিয়ে হচ্ছেনা, তাই বাংলাদেশের বর্ডার সংলগ্ন জায়গাগুলো থেকে গরিব পরিবারের মেয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে মোটা টাকা দিয়ে, তাদের কে একই সাথে একাধিক পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি কখনো কখনো ৪/৫ জন পুরুষের সাথেও থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এরকম অনেক মেয়ে পালিয়ে আসতে যেয়ে খুন হয়ে যায়| এক অফিসার বললেন যারা পালাতে সক্ষম হয় তাদের ফেরত দিতে গেলে দেখা যায় তাদের পরিবারই খুশিনা, দারিদ্রের এমনি কষ্ট যে নিজের সন্তান ফিরে আসলেও টাকা আর পাবেনা এই দুঃখ থেকে যায়| সবার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে এই চক্র, তারপরও কোনো পদক্ষেপ নেই|

ইন্টেলিজেন্সের অফিস থেকে ফেরত আসছি আর মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এতদিন পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভিতে এরকম খবর অনেক দেখতাম, দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে যাওয়ায় চোখ এড়িয়েও যেত, কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতার পর পুরো সমাজ ব্যেবস্থাটাই একটু অন্যরকম লাগছে| নারী অপহরণ এবং নির্যাতনের এরকম ভয়াবহ রূপ সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিন দুঃস্বপ্নের ভেতরে তাড়া করে ফিরবে| দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী হওয়া সত্তেও দেশের নারী পাচার রোধে কতটুকু অগ্রসর হয়েছে আইন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়|

মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন| নারী পাচার ও নারী নির্যাতন রোধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার ও সমাজ সচেতনতা খুবই জরুরি| আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশগুলোতে দারিদ্রের কবলে আক্রান্ত পরিবারগুলো থেকে মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়, দেশের অজস্র সমস্যার সাথে এই বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখাটা একান্তই জরুরি| মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত রোধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও গভীর পর্যবেক্ষণ ও সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম গুলোতে নিয়মিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলোর কার্যক্রম জরুরি| শুধু ভারতেই নয় কিছুদিন আগে চাকরির নামে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ গুলোতে যৌনদাসী হিসেবে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কাহিনীও নজরে এসেছে| শুধু সরকার নয়, সভ্য সমাজের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই কর্তব্য নারী পাচার এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো|

"সেই তিনটি মেয়ে কোথায় ঈদ করলো কোনদিনও আর জানা হবেনা|"

হিমালয়কন্যা : অনুরাধা কৈরালা


উপস্থাপিকার কন্ঠসর তখন আবেগে রুদ্ধপ্রায়, অডিটরিয়ামের কয়েক হাজার গন্যমান্য ব্যাক্তি তখন উঠে দাড়িয়েছেন শ্রদ্ধায়, টিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষের চোখ অশ্রুসজল, করতালিতে কেঁপে উঠছে পুরো অডিটরিয়াম, ধীর পায়ে তিনি উঠে এলেন মঞ্চে, উপস্থাপিকা আবেগে জরিয়ে ধরলেন তাকে, সম্মানিত অথিতি তার বক্তব্যে তুলে ধরলেন নারী-পাচারের চরম কিছু অংশ, সবাইকে অনুরোধ করলেন, প্রত্যেকটা মেয়েকে নিজের সন্তান হিসেবে চিন্তা করে তাদের কষ্ট অনুধাবন করতে, যেনো নিজের মধ্যে জাগ্রত হয় আত্মশক্তি, যেনো পুরো সমাজ রুখে দাড়ায় মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, নমস্কার জানিয়ে যখন কথা শেষ করলেন, তখন আবার পুরো অডিটরিয়ামের দর্শক উঠে দাড়িয়েছেন, টপ টপ করে চোখ থেকে জল পরছে তখন অনেকেরই, করতালিতে আবার কেঁপে উঠলো পুরো হল| এই দৃশ্য CNN Hero 2010 Award অনুষ্ঠানের| শ্রদ্ধেয় সেই নারীর নাম "অনুরাধা কৈরালা"|

১৯৯৩ সাল থেকে শুরু, অনুরাধা কৈরালা প্রতিষ্ঠা করেন "Maiti Nepal", একটি সাধারণ সংস্থা কিন্তু অসাধারণ একটি লক্ষ্য, নারী-শিশু নির্যাতন, পাচার রোধ এবং নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন| হিমালয়ের পাদদেশের ছোট্ট দেশ নেপাল, যার স্বর্গীয় সৌন্দর্য অজস্র পর্যটককে কাছে টানে, কিন্তু স্বর্গেও যেমন থাকে গড়ল, তেমনি এখানেও আছে কিছু অন্ধকার অধ্যায়| ভারত-নেপাল সীমানা দিয়ে পাচার হচ্ছে মানুষ| তারপরে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্বিষহ অন্ধকার এক জীবনে| নাম না জানা অজস্র নারী শিকার হচ্ছে নারী-পাচারের মতো ঘৃণ্য একটি অপরাধের| এসব নারীকে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে তারা শিকার হচ্ছে অমানবিক নির্যাতনের| অনুরাধা কৈরালা একটি নাম, একটি সাধারণ মানুষ, রুখে দাড়ালেন তিনি এর বিরুদ্ধে|

সেই থেকে যুদ্ধ শুরু, তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি ১২,০০০ এর বেশি মেয়েকে যৌনদাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করেছে, ৪৫,০০০ এর বেশি নারী-শিশুকে বাচিয়েছে পাচারের হাত থেকে, তার একার উদ্যোগে তিনি এক অসম যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এই ঘৃণ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে| নেপালের পাচারকারী চক্রের কাছে তিনি পরিচিত "Terminator" নামে| তার সহযোগিতায় নেপাল পুলিশ ৬৮৮ জন অপরাধীকে ধরতে ও সাজা প্রদানে সক্ষম হয়েছে| তার এই অসম সাহসী উদ্যোগ নতুন জীবন দিয়েছে অজস্র মেয়েকে, শুধু তাই নয়, যারা এইডস এ আক্রান্ত হয়ে এখানে আসে, তাদের পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে|

তার সংস্থার কিছু নারীর অভিজ্ঞতা শোনা যায় তাদের মুখ থেকে, যাদের অনেককেই ১০ বছরেরও কম বয়সে বিক্রি করে দেওয়া হয়, সেই বয়সেই তারা শিকার হয় পাশবিক নির্যাতনের, প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩৫ জন মানুষের হাতে নির্যাতিত হয়ে যখন তারা মৃত্যুর অপেক্ষায়, তখন অনুরাধা কৈরালার অসম সাহসী উদ্যোগের সাহায্যে তারা নতুন করে বাঁচতে শেখে|

অনুরাধা কৈরালা নিজেও তুলে ধরেন কিছু অভিজ্ঞতা, যেখানে নেপালে সাধারণ দাহকার্যের জন্য নেওয়া হয় ৮৫০ নেপালি রুপি, সেখানে এইডস এ আক্রান্ত কোনো নারী মারা গেলে তার দাহকার্য সম্পন্ন করতে দিতে হয় ৮,০০০ নেপালি রুপি| অনুরাধা অশ্রুসজল চোখে বলেন, যেখানে সমাজে নারী অধিকার নিয়ে এত তোরজোর চলছে, সেখানে তার মৃত্যুর পরে যদি এইভাবে অবহেলার শিকার হতে হয়, এটা কেমন সমাজ???

অনুরাধা কৈরালার কথা লিখতে বসলে কোনো বিশেষণ যথেষ্ট নয়, এই পরম শ্রদ্ধেয় নারী ভূষিত হয়েছেন ৩০ টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে, যার মধ্যে CNN Hero 2010 Award, 2010 Shinning World Compassion Award , 2010 Virag Social Service Award, 2010, “National Ideal Mother Award 2066” by Shishu Sewa Samittee, 2009 Outstanding Management Award, 2007 German UNIFEM Prize, 2007 Queen Sofia Silver Medal, 2006 The Peace Abbey, Courage of Conscience Sherborne, MA, USA, 2005 Eurasia Reiyukai Award, 2005 Rastriya Nari Samaan ইত্যাদি অন্যতম| এছাড়াও তিনি ২ বার নির্বাচিত হয়েছেন Most Influential Women of Nepal by Boss Reader's choice|

শুধু নারী-শিশুদের অধিকারের জন্যই নয়, সমাজ সেবাতেও তিনি রেখেছেন দৃষ্টান্তমূলক অবদান, নেপালের সরকারের পক্ষ থেকে তিনি আলোচনায় বসেছেন মাও বাদীদের সাথে, এছাড়াও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি ও সভায় অংশগ্রহন করেছেন, এর মধ্যে-

১.2008 The Global Initiative to fight Human Trafficking; Vienna Forum to Fight Human Trafficking, Vienna, Austria
২.7th International Congress on AIDS in Asia and the Pacific (7th ICAAP) Kobe, Japan July 2005
৩. 2003 Path breaking strategies in Global Fight against Sex Trafficking Washington D.C, USA, Feb 2003
৪.2000 Regional Co-operation Meeting, Action against Trafficking & Sexual Exploitation of Children (ATSEC) – Dhaka, Bangladesh
৫.1999 First Meeting of the NGO Planning Committee for the UN World Conference against Racism, Racial Discrimination, Xenophobia and Related Intolerance – Geneva, Switzerland
অন্যতম|

পেশায় ইংরেজি শিক্ষিকা অনুরাধা কৈরালার প্রতিষ্ঠিত "Maiti Nepal", শুধু একটি সংস্থার নাম নয়, এটি অজস্র নারীর জন্য জীবনের আশার প্রতীক| বর্তমানে ৩ টি prevention home, ৯ টি transit home, ২ টি hospice এবং একটি উচ্চবিদ্যালয় নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান অবিরাম কাজ করে চলেছে অসহায় নারী-শিশুদের জন্য| বিভিন্ন অঞ্চলে জনসচেতনতা সৃষ্টি, জনসংযোগ, উদ্ধার অভিযান, পুনর্বাসন, নারী-শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সহায়তা প্রদান এর মাধ্যমে তিনি অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন নারীদের জন্য| পাচাকারীদের বিরুদ্ধে তার এই যুদ্ধ জারি রয়েছে তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে|

সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত একজন অসাধারণ সমাজ সেবিকা হিসেবে, একজন প্রতিবাদী যিনি রুখে দাড়িয়েছেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা, তার সংস্থার মেয়েদের কাছে তিনি বড় বোন, তার স্নেহ যত্নে অসংখ্য নারী-শিশু ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো জীবন| যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে নারী-শিশু নির্যাতন ও পাচার রোধ করতে, সেখানে একা তিনি অসীম সাহসে রুখে দাড়িয়েছেন এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, তিনি প্রমান করেছেন, দৃঢ় মনোবল আর সদিচ্ছা থাকলে একজন মানুষই পারে পুরো সমাজকে বদলে দিতে| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১০ সারা বিশ্বের আরও ১০ জন এরকম যোদ্ধার সাথে CNN Hero 2010 Award এ ভূষিত অনুরাধা কৈরালার যুদ্ধ এখনো চলছে, শুধু পাচারকারীদের বিরুদ্ধেই নয়, ঘুনে ধরা এক সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে, যেখানে নারীকে মানুষ নয়, ভোগ পণ্য হিসেবে ব্যাবহার করে সভ্য সমাজ ব্যাবস্থার স্লোগান দেয় অনেক মুখোশধারী|

আজকে এই লেখার মাধ্যমে এই মহিয়সী নারীর প্রতি সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই|

সাধু গ্রেগরীর বকুলতলা


দিনটা ছিলো বুধবার| ব্রাদার হোবার্ট সকাল থেকেই চিন্তিত, একটু পর পরই ব্যালকনিতে যাচ্ছেন আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন| দেশের অবস্থা ভালো না, কখন কি ঘটে যায় কিছুই বলা যাচ্ছেনা| আবার এদিকে সকাল থেকেই মিলিটারির জীপ এদিক ওদিকে ঘুরছে, মাত্র ৬ দিন আগেই পাশের শাঁখারী বাজারে ওরা যে বিভৎস হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তিনি সেটা জানেন| কিন্তু তার চিন্তা অন্যখানে, স্কুলের কম্পাউন্ডের ভেতরে বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, তার উপরে তিনি নিজে স্কুলের তিনজন শিক্ষক আর তাদের পরিবারকে লুকিয়ে রেখেছেন উপরের ঘরে| কি যে হয় কিছুই বলা যাচ্ছেনা|

ব্রাদার রবার্ট এলেন, তাকে দেখেই ব্রাদার হোবার্ট বাইরের খবর জিজ্ঞেস করলেন| ব্রাদার রবার্ট মাথা নেড়ে বললেন, "নাহ তেমন কিছু জানা যায়নি| তবে মেইন গেট টা খোলা যাবেনা, যেভাবেই হোক স্কুলের ভেতরে কাওকে আসতে দাওয়া যাবেনা|" হোবার্ট চিন্তা মগ্ন হয়ে বললেন, "কেও কি শুনবে এই কথা?" ব্রাদার রবার্ট এর কপালেও চিন্তার ভাঁজ, তিনিও জানেন গেট বন্ধ করে কি আর এদের আটকে রাখা যাবে? তাও বললেন," কেন নয়, এটা মিশনারি প্রপার্টি, এটাতে নিশ্চয় ওরা আসার সাহস পাবেনা|" ব্রাদার রবার্ট মাথা নাড়লেন, ব্যালকনি থেকে ফিরে আসতে গিয়ে চমকে উঠলেন, দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে, ভারী আওয়াজ তুলে সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বড় মিলিটারি ট্রাক চলে গেলো, ট্রাকের উপরে মেশিনগান এর নলটাতে সূর্যের আলোটাও যেনো ভয় পেয়ে চমকে উঠছে|

মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্রাদার রবার্ট কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না| এতগুলো পরিবার, সহায় সম্বল ছেড়ে শুধু প্রাণ বাঁচাতে এখানে চলে এসেছে| স্কুলের দার্জিলিং বিল্ডিংটার নিচে ভিত সন্ত্রস্ত পরিবারের মানুষগুলো দিশে হারা| গুলির শব্দ এরাও শুনেছে, তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন তিনি| অভয় দিতে চেষ্টা করলেন, নিজেও জানেন যেই দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে এরা যাচ্ছে তা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেও দূর করতে পারবেনা| বুকের সামনে ঝোলানো বড় ক্রসটা মুঠোতে আঁকড়ে ধরলেন তিনি|


ব্রাদার হোবার্ট কথা বলছিলেন সূত্রধর স্যার আর পল স্যারের সাথে, যে করেই হোক সুযোগ পেলেই সবাইকে অন্য কথাও সরিয়ে ফেলতে হবে| এখানে আর মোটেও ভালো ঠেকছেনা, সকাল থেকেই কয়েকবার মিলিটারি জীপ ঘুরে গেছে| বলা যায়না ওদের কাছে খবর থাকতেও পারে| সূত্রধর স্যার বললেন, "মনে হয়না ওরা এতটা সাহস করবে, মিশনারি স্কুল এটা, এটাতে হামলা চালানো মানে তো অনেক বড় একটা ঘটনা|" পল স্যার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বল খেলার বড় মাঠটার দিকে, কি শুনশান জায়গাটা| অথচ দুপুরের এই সময়টাতে ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো, সাধু গ্রেগরীর ডানপিটে ছেলেগুলো দৌড়াতেও পারে, বড় হলের অজস্ত্র চ্যাম্পিয়নস কাপ আর শীল্ড গুলোর দিকে তার চোখ আটকে যায়| নিজের অজান্তেই কেন জানি তার সবকিছু খাপ ছাড়া, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে| পালমা স্যার শান্ত শিষ্ট মানুষ, পিছনে হাত রেখে একটু ঝুঁকে হাটেন| তিনিও উপর থেকে নিচে নেমে এলেন, কারো মুখে কথা নেই, শূন্য দৃষ্টির বিভিন্ন বয়সের মানুষ গুলো যারা অজস্ত্র ছেলেকে জীবনের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, তারাই আজ পথ খুঁজতে হিম-শিম খাচ্ছেন|

ব্রাদার রবার্ট বাস্কেটবল কোর্টটা হয়ে হল রুমের দিকে ফিরছিলেন, যান্ত্রিক শব্দে থমকে দাড়ালেন| মনে হলো গাড়িটা স্কুলের গেটটার সামনে দাড়ালো, ক্রসটা মনের অজান্তেই হাতের মুঠোয় চলে এলো তার| বিড় বিড় করছেন,"গড, স্যেভ আস"| যেমন থেমেছিলো তেমনি গাড়িটা আবার চলতে লাগলো, রবার্ট হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, কপালের ঘামটা মুছে এগিয়ে চলা শুরু করেছেন হল রুমের দিকে| বকুল তলাটা পাড় হয়েছেন, তখনি আবার ভারী যান্ত্রিক শব্দটা ঠিক গেটের সামনে থামলো| মাথা তুলে গেট এর দিকে তাকালেন, জলপাই রঙের ট্রাক আর তার উপরে কুচ কুচে কালো রঙের নলটা চিনতে তার দেরি হলোনা| মন্ত্র মুগ্ধের মতো তিনি গেটের দিকে এগিয়ে চললেন, ইউনিফর্ম পরা একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "দরওয়াজা খোলো, হুকুম হেয়, আন্দর আনে দো"| ফেস ফেসে আওয়াজে রবার্ট কোনমতে বললেন, "দিস ইজ আ মিশনারী প্রপার্টি, উই হেভ নো রিলেশন উইদ এনি পলিটিকাল ইন্সিদেন্তস, হয়ার ইজ ইউর সিনিয়র?" এবার গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন পেছনের জীপ থেকে নেমে এলো একজন, গেটের সামনে এসে বললো, "ব্রাদার, ডোন্ট ওরি, জাস্ট আ রুটিন চ্যেক, উই উইল নট ডু এনিথিং রং"| কোনো উপায় নেই, বুঝতে পারলেন| এদিকে জিপের শব্দে বাকি সবাইকে উপরে যেতে বলে বাইরে এসে দাড়িয়েছেন ব্রাদার হোবার্টও, আস্তে আস্তে তিনিও গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন, ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে জনা দশেক মিলিটারি স্কুলের জলের কলটার সামনে পজিশন নিয়েছে, দেখলেন ব্রাদার রবার্ট এর সামনে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে কথা বলছে অফিসার| অবাক হলেন, এত দশাসই চেহারার ব্রাদার রবার্টকে কেন জানি আর্মি অফিসারটার সামনে অনেক জরসর লাগছে| তাকে এগিয়ে যেতে দেখে অফিসারটা নিজেই এগিয়ে এলো, হাসি মুখে বললো, "ব্রাদার, দিজ প্লেস ইজ নাইস, বাট উই গট ইনফরমেশন, সাম পিপল আর হাইডিং ইনসাইড ইউর স্কুল", হোবার্ট কিছু বলার আগেই অফিসার হুকুম দিলো," সার্চ ইনসাইড"|


মিনিট দশেক পরে বকুল তলায় দাড়িয়ে আছে জনা বিশেক মানুষ, সবার সামনে দাড়িয়ে আছেন সৌম্য ভদ্র চেহারার তিনজন গম্ভীর মানুষ, সাথেই ভিত চেহারার দুজন তরুণ, অফিসার ব্রাদারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললোনা, জোরে হুকুম দিলো, "টেইক দেম অল"| ব্রাদার হোবার্ট হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন, এরা নিরীহ মানুষ, এদেরকে গ্রেফতার করার কোনো কারণ নেই| ব্রাদার কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসার| রবার্ট একবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, "ইউ কান্ট ডু দিস, হয়ার উইল ইউ টেইক দেম"| কর্কশ গলায় মাথা না ঘুরিয়েই অফিসার জবাব দিলো," দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস"| ততক্ষণে পিঠমোড়া বেঁধে ট্রাকে তোলা হচ্ছে সবাইকে, সূত্রধর স্যার যাওয়ার আগে ব্রাদারকে তার হাতের ঘড়িটা খুলে দিলেন কি মনে করে যেনো, পিঠে ধাক্কা মেরে তোলা হলো তাদেরও, খুব শান্ত চোখে ব্রাদার হোবার্ট এর দিকে তাকালেন পালমা স্যার| গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ব্রাদার দুজনেই দৌড়ে গাড়ির পেছন পেছন অনেকটা গেলেন| তারপর একরাশ কালো ধুয়া আর সব কিছুই আগের মতো শুনশান|


দিনটা ছিলো বুধবার, ৩১ শে মার্চ, ১৯৭১| খ্যাতনামা সেইন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে ওই দিন দুপুরে অনেকের সাথে, স্যার এন.সি.সূত্রধর, স্যার পল পালমা, স্যার ডি.এন.পাল চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সুবল ও উত্পল কে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী তত্কালীন জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পে| ব্রাদার হোবার্ট ও ব্রাদার রবার্ট এর অনেক চেষ্টা সত্তেও ঐদিন রাতেই সবার সাথে এই তিন শিক্ষক ও ছেলে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্থানি মিলিটারি| সেই বকুল তলাটা এখনো আছে, ঠিক তার নিচে লাল রঙের শহীদ মিনারটা| সাদা পাথরে, কালো কালিতে লেখা সবার নাম| স্বাধীনতার পরে সেই স্কুলের ছাত্র তাজউদ্দিন আহমেদ হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী| এখন বদলে গেছে অনেক কিছুই, দার্জিলিং বিল্ডিংটা এখন আর ব্যাবহার করা হয়না, নতুন বিল্ডিং হয়েছে, খেলার মাঠটাও বদলেছে| কিন্তু আছে সেই অতি প্রাচীন হলরুম আর সেই জলের কল| নুনে ধরা দেয়ালে পুরনো পুরনো গন্ধ| আর আছে সেই বকুল গাছ, তার নিচে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা লাল শহীদ মিনার|




আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর দানব


বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড, দেশের সাধারণ জনগনের মানবাধিকার এর বিষয়টিতে একটি বড়সড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে| দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগনের নজরে এসেছে, তাতে আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা প্রসঙ্গে আরেকবার বেশ ভালো ভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে বলে মনে হয়| আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে দেশের পুলিশ ও রেপিড একশন ব্যাটালিয়ন (RAB) এর কার্যক্রম সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে| দেশের সাপ্রতিক কিছু ঘটনায় বর্তমানে দেশে পুলিশের কার্যক্রম তাদের অতীত ইতিহাসকে ছাড়িয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে অবলোকন করা গেছে| বাংলাদেশ যখন দুর্নীতির দায়ে বারংবার বিশ্বে এক নাম্বারে স্থান পাচ্ছিলো তখনও বিভিন্ন কমিটির রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা গেছে, দেশের সর্বচ্চো দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এই পুলিশ| তত্কালীন ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশের ভাবমূর্তি বদলানোর জন্য তখন তাদের পোশাক পরিবর্তন করলেও এসব দুর্নীতির প্রশ্নে ছিলো চুপ, কোনো ধরনের কমিটির মাধ্যমে এই অভিযোগ গুলো যাচাই করার নুন্যতম প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি| পোশাক বদল হলে কি হবে, পোশাক যে পরিধান করছে সে অপরিবর্তনীয় থাকায় যেই লাউ, সেই কদুই থেকে গেছে|

তত্কালীন ক্ষমতাসীন সরকার আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি রোধ করতে এবং জঙ্গি দমনের লক্ষে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে গঠন করে RAB| বিভিন্ন সামরিক বাহিনী থেকে সদস্য সংযোজন করে গঠন করা এই বিশেষ বাহিনী উন্নত ট্রেনিং ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাঠে নামে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে| তখনকার ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনা এলাকায় বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো, এই জায়গাগুলোতে ঝটিকা কিছু অভিযানের মাধ্যমে RAB বিশেষ সাফল্য দেখায়| বেশ কিছু স্মাগলিং রিং এবং চরমপন্থী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অপারেশন সত্তি প্রশংসাযোগ্য| কিন্তু সমস্যা তৈরী হয় তার পরে, তত্কালীন সরকার সামাজিক ভাবে আইন শৃখলা পরিস্থিতি ঠিক করতে ব্যার্থ হয়ে, বিভিন্ন ভাবে RAB ও পুলিশকে দিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটাকেই একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করে| RAB এর ক্ষমতা বাড়িয়ে দাওয়া হয় বহুগুন, এবং একের পর এক ক্রস ফায়ার এর ঘটনায় সন্ত্রাসীর মৃত্যু হতে থাকে| তত্কালীন পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ জনগণ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই পথকে সমর্থন দিলেও, এর আরেকটি দিক চোখ এড়িয়ে যায়| বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়ানো ছেটানো ভাবে কিছু অপ্রাসঙ্গিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা চোখে পরলেও দেশের সুশীল জনগণ চোখ বুজে সেটা সহ্য করে যান এই ভেবে যে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তো হাফ ছেড়ে বাঁচা যাচ্ছে| স্কুলের বাচ্চাদের স্কুল বাস থেকে নামিয়ে প্রচন্ড রোদে কান ধরে উঠা বসা করানো, কোনো ভুল বোঝা বুঝিতে কাউকে অযথা পেটানো কিংবা কোনো অপারেশনে নিরীহ মানুষের মৃত্যু তখন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সকল দিক থেকেই| একের পর এক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা চোখে পরলেও এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া তো দুরে থাক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ধামা চাপা দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে| তখন সুশীল সমাজের কারো কারো এরকম বক্তব্য ছিলো যে সন্ত্রাসীদের আবার কিসের মানবাধিকার?

কিন্তু এই ধরনের বিছিন্ন কিছু ঘটনা আসলে ভবিষ্যতের যে মানবাধিকারের চরম বিপর্যয়ের ঘটনার হাতছানি ছিলো মাত্র, তা আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে| বরং RAB এর মতো দুর্দান্ত ও সক্রিয় একটি বাহিনী থাকায় আমরা অনেকেই খুশি হয়েছি| এই সংস্থাটির কার্যক্রম জঙ্গি দমনে ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখলেও, একই সাথে লাগামহীন বিচার বহির্ভুতু হত্যাকান্ডের জন্য প্রশ্নের উর্ধে নয়| আর সরকারী ভাবে এই ঘটনা গুলোর প্রতি কোনধরনের আইনি কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি, এমনকি এখন পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য সেরকম ভাবে কাওকে দোষীসাব্যস্থ করে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি|

এইবার দেখা যাক শুরু থেকে RAB এর কিছু কার্যক্রমের তথ্য, Amnesty International এর পরিসংখানের ভিত্তিতে প্রতিষ্টার পর থেকে RAB ৭০০ রও বেশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ২০০ বর্তমান সরকারের আমলে| কিন্তু এই হত্যাকান্ড গুলোর প্রায় সবকটাতেই যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তা হয়েছে RAB এর পক্ষ থেকে নয়তো সরকারের পক্ষ থেকে, কোনটাতেই তদন্ত প্রতিবেদন ও প্রমানাদি জনগনের সামনে প্রকাশ করা হয়নি, সাধারণ ভাবে কোনটাতেই কোনো বাহিনীর কর্মরত সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি| আর বেশিরভাগ হত্যাকান্ডকে ক্রস ফায়ার অথবা বন্দুক যুদ্ধের নামে সাজানো হয়েছে| দুক্ষজনক হলেও সত্তি, RAB এর হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কালে সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র কি করে আসলো বা সেই অস্র দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সে গুলি করার সময় কখন পেলো এই নিয়ে কারো মনেই কোনো প্রশ্ন জাগেনি| শুধুমাত্র জানুয়ারি ২০১০- জুন ২০১১ এর মধ্যে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আহত বা নিহত মানুষের সংখ্যা হচ্ছে কোস্টগার্ডের হাতে ২ জন, পুলিশের হাতে ৪৯ জন এবং RAB এর হাতে ১৩১ জন যার মধ্যে নিহত হয়েছেন RAB এর হাতে ৯৩ জন, পুলিশের হাতে ৩০ জন এবং ২ জন অন্যানদের হাতে|

RAB এর বিভিন্ন অপারেশনের দিকে যদি দেখা যায় তাহলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, জানুয়ারি ২০১০- জুন ২০১১ এই সময়ের মধ্যে তাদের হাতে আহত অথবা নিহত মানুষের সংখ্যা বিভিন্ন বিভাগ ভিত্তিতে, ঢাকা- ৯২ জন, খুলনা- ৪২ জন, রাজশাহী- ২১ জন, বরিশাল- ১৩ জন, চট্রগাম - ১১ জন, সিলেট- ২ জন এবং রংপুরে ১ জন| কিন্তু কোনো হত্যাকান্ডেরই সঠিক ভাবে বিচার বিভাগীয় কোনো তদন্ত হয়নি, সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে কোনো চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি|

এবার কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার দিকে তাকাই,
১.৩ জুন, ২০১১ নরসিংদিতে রহিমা খাতুন নামে একজন মহিলা মাথায় গুলিবিদ্ধ হন, RAB এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তার স্বামীকে গ্রেফতার করার সময় ভুল বোঝা বুঝিতে এই ঘটনা ঘটে, গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি|

২.জুন ২০১০ এ ঢাকাতে গার্মেন্টস কর্মীদের এক প্রতিবাদে RAB মারধর করে, কিন্তু এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি|

৩.২৩ মার্চ, ২০১১ ঝালকাঠিতে লিমন হোসাইন নামক ১৬ বছরের এক যুবক পায়ে গুলিবিদ্ধ হন| সাংঘাতিক আঘাতের কারণে পরবর্তিতে তার পা কেটে বাদ দিতে হয়| এই ঘটনার সুষ্ট কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি| RAB এর পক্ষ থেকে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধের সময় লিমন মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে বারবার ইচ্ছাকৃত ভাবে লিমনকে সন্ত্রাসীদের সাথে সংযুক্ত করার অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে| এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জনগনের জন্য প্রকাশ করা হয়নি|

৪.নাসির আহমেদ,আসাদুল হক শাহীন মারা গেছেন RAB এর ক্রস ফায়ারে|

৫.মোহাম্মদ ইদ্রিস মারা গেছেন পুলিশের অত্যাচারে|

৬.সাংবাদিক মাসুম ফকির ২২ অক্টোবর, ২০০৯ RAB এর হাতে গ্রেফতার হন, পরবর্তিতে অত্যাচারের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন|

৭.২৪ অক্টোবর,২০০৯ রবিউল ইসলাম খুলনাতে RAB এর হাতে গ্রেফতার হন| তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অমানবিক অত্যাচার করা হয়|

৮.১৬ মার্চ,২০১০ আসাদুজ্জামান রুবেল কে গুলি করে হত্যা করে RAB, কিন্তু পবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় তার সাথে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যোগসূত্র ছিলো না|

৯.কিছুদিন আগে পুলিশের গাড়ি থেকে উগ্র জনতার হাতে নামিয়ে দেওয়া এক যুবক কে পিটিয়ে হত্যা করার দৃশ্য মোবাইল ফোন এর বদৌলতে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র বিশেষ করে ইন্টারনেট এ|

১০.কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণকে সেগুনবাগিচা নাট্যমঞ্চের সামনে থেকে রাতের বেলা তুলে নিয়ে ছিনতাইকারী অভিযোগে অত্যাচারের পর প্রায় পঙ্গু করে দেয় পুলিশ, পরবর্তিতে যার সাথে তার সহপাঠি বা আত্মীয় দেখা করতে গেলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি| পরে তদন্তে প্রকাশ পায় সে তার বোনের বাসা থেকে হলে ফিরছিলো| এর দায়ভার অস্বীকার করে পুলিশ|

অনেক ঘটনার মাঝে থেকে উপরে উল্লেখিত এই কয়টি ঘটনা শুধুমাত্র নমুনা বিশেষ| এই ঘটনা গুলোর না হয়েছে কোনো সুষ্ট তদন্ত, না হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ| এভাবেই একের পর এক বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড ও হত্যা কান্ড থেকে পার পেয়ে গেছে দেশের পুলিশ ও RAB| RAB এর হাতে গ্রেফতারকৃত অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন চরম অমানবিক শারীরিক অত্যাচারের| যার মধ্যে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা থেকে শুরু করে বৈদ্দুতিক শক পর্যন্ত ছিলো| এই ঘটনা গুলোর কোনটাতেই সাক্ষ্য প্রমান থাকা সত্তেও কোনো ধরনের তদন্ত হয়নি|

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সভ্য স্বাধীন দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর যাই হউক না কেন, দেশের সকল আইনের উর্ধে নয়| তাদের হাতে গ্রেফতার কৃতরা সন্ত্রাসী হউক আর সাধারণ নাগরিক হউক তারাও আইনের অধীনে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুষ্ট তদন্তের অধিকার রাখে| আমরা আমাদের লাগামহীন সামাজিক ও আইন শৃঙ্খলার অধপতন ঠেকাতে যদি দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড অব্যাহত করতে দেই, তারই সাথে যদি এই কাজগুলোর কোনো ধরনের সুষ্ঠ তদন্ত না হয়, সরকারের তরফ থেকে যদি এর দায়ভার অস্বীকার করা হয়, তাহলে আমরা আস্তে আস্তে গল্পের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর দানব এর মতই একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দেশে তৈরী করবো, যার প্রভাব ধীরে ধীরে আমদের সাধারণ সমাজে আরও ভয়াবহ হবে|তাই আর যাই হউক না কেন, কোনভাবেই এই বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ডকে সমর্থন করা যায় না|

২০১০ সালে, উইকিলিকস এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্রিটিশ পুলিশদের মাধ্যমে ট্রেনিং ও এই বিষয় গুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কিছু গোপনীয় চুক্তি ও পদক্ষেপ প্রকাশিত হলে নড়ে চড়ে বসেন কর্তারা| তার পরেই ব্রিটেন ভবিষ্যতে আর ট্রেনিং কার্যক্রম চালাবেনা বলে ঘোষণা দেয়| এরই সাথে Austria, Belgium, China, Czech Republic, Italy, Poland, Russian Federation, Slovakia, Turkey and USA এইসব দেশ থেকে যে প্রচুর অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে RAB এবং পুলিশের জন্য সে দিকেও নজর পরে মানবাধিকার সংগঠন গুলোর| Amnesty International এর মতে, যে সংস্থা একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এই দেশ গুলোর উপরেও বর্তায়|

বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম নির্বাচনী ইশতেহার ছিলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড বিচার বিভাগীয় তদন্তের আওতায় আনা এবং সুষ্ট ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, যার কোনো ফলপ্রসু উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি| আগে তো RAB ছিলো এখন তার সাথে সাথে দেশের পুলিশও ক্রস ফায়ারে হত্যাকান্ডকে তাদের ফ্যাশনে পরিণত করতে চলেছে, তার সাথে গ্রেফতার এর পরে সন্ত্রাসীকে উগ্র জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়াটা এখন তাদের ট্রেডমার্ক স্টাইল এ পরিণত হয়েছে| একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনভাবেই বিচার বহির্ভূত হত্যা কান্ডকে সমর্থন করা যায়না, আর বিনা বিচারে হত্যা কোনভাবেই দেশের আইন শৃঙ্খলার উন্নতি করতে পারেনা| সরকার, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনভাবেই এই ঘটনা গুলোর দায় এড়িয়ে যেতে পারেনা| নয়তো তাদের তৈরী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে তাদের উপরই চরাও হবেনা তা বলা যায় কি?

সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড ও হত্যাকান্ড অতি সত্তর বন্ধ করে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ তদন্ত কমিটি গঠন করে সচ্ছ তদন্ত জরুরি| একই সাথে এর কার্যক্রম সাধারণ জনগনের সামনে উন্মুক্ত করাটাও সরকারের ও বিচার বিভাগের দায় বদ্ধতার মধ্যে পড়ে| দোষীদের বিচার ও আক্রান্তদের সাহায্য ও সহযোগিতা এবং এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য সঠিক সিদ্বান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অতি জরুরি| মানবাধিকার চরম লঙ্ঘনের অভিযোগে এরই মধ্যে Amnesty International বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এছাড়াও আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারী সংস্থা থেকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আশংকা ব্যাক্ত করা হয়েছে, U.S Department of State: Human Rights Report 2011-এ দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় গুলোকে এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে|

বহু বছর ধরে এই ঘটনা গুলো নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে, অতি পুরাতন প্রশ্ন "রক্ষকই ভক্কক" নিয়ে জনসাধারণ অনেক মাথা ঘামিয়েছে, কিন্তু যদি এই সমস্যা গুলো নিয়ে জনসচেতনতা তৈরী না হয় তাহলে যে দানব তৈরী হচ্ছে দিনে দিনে তার দানবিকতা ভবিষ্যতে কতদূর পর্যন্ত গড়াবে তার কথা কে বলতে পারেন? আজকে যেই বন্দুকের নল সন্ত্রাসীদের দিকে তাক করা হচ্ছে, তা যে কদিন পড়ে আমার বা আপনার দিকে তাক করা হবেনা তা গ্যারান্টি দিয়ে কে বলতে পারে?



http://www.amnesty.org/en/news-and-updates/report/bangladesh-government-must-act-now-stop-police-unlawful-killings-2011-08-23

http://www.amnesty.org/en/library/asset/ASA13/005/2011/en/c18ad74b-75fe-4b15-b043-5982eebdb27d/asa130052011en.pdf

http://www.extrajudicialkilling.info/

http://www.guardian.co.uk/world/2011/jan/26/bangladesh-death-squad-killings-britain