Monday, September 12, 2011

নারী পাচারকারী চক্র এবং আমার অভিজ্ঞতা


২৫ আগস্ট, ২০১১

সন্ধ্যা হয়েছে, মাঠ থেকে খেলে মাত্রই হোস্টেলের রুমে ঢুকেছি দেখলাম মুঠোফোন বাজছে, কিছুটা বিরক্তি নিয়েই অপরিচিত নাম্বারটা ধরলাম, ওপাশ থেকে লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত এক অফিসারের গলা শোনা গেলো, কেমন আছি, কিরকম চলছে এই বৃত্তান্তের ধকল কাটিয়ে চিন্তা করছি কখন আসল কথায় আসবে, তখনি বলে উঠলেন, আমাদের এখানে তিনজন ইলিগ্যাল ইমিগ্রান্ট ধরা পড়েছে, তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তার উপরে তিনজনই নারী, তাদের ভাষা এখানে কেও বুঝতে পারছেনা, তাই পুলিশ কাজ এগোতে পারছেনা, লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত হলাম আমি, তাই আমাকে বললেন সাথে যেতে, ভাষা বুঝে তাদের তদন্তে সাহায্য করতে হবে| আমি ভাবলাম ভাষা বোঝা না হয় হলো, কিন্তু দেশের বাইরে এসে পুলিশের ঝামেলায় না জড়ালেই হলো| সাত পাঁচ ভেবে বলে দিলাম পরের দিন সকালে চলে যাবো অফিসে| রাতে জিনিসটা নিয়ে কয়েকবার ভেবেও এটা মাথায় এলোনা, দেশ থেকে এত দূরে ভারতের উত্তরপ্রদেশে মেয়েগুলো এলো কি করে???

২৬ আগস্ট, ২০১১

পরের দিন সকালে গিয়ে কাজ হলোনা, আবার দুপুরে যেতে হলো, বসে রইলাম তার অফিসে কতক্ষণ, এরপর বললেন যেতে হবে প্রধান থানাতে, বাইকে চেঁপে চললাম তার সাথে, ঈদ এর মাত্র কদিন বাকি, বাজারে প্রচন্ড ভিড়, লোকজন কেনাকাটা করছে, এলাহাবাদের চক বাজারের ভেতরে কোতয়ালি থানা, সেদিন ছিলো শুক্রবার, ঈদ উপলক্ষে এরমধ্যেই অজস্র পুলিশ মোতায়েন করা, গিয়ে ঢুকলাম তদন্তকারী অফিসারের রুমে, দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ভালই দৌড়ের উপরে আছেন ভদ্রলোক, আমাদের নিয়ে গেলেন পাশের বিল্ডিঙ্গের ডিআইজি এর দপ্তরে, তখনি লক্ষ্য করলাম অল্প বয়সী তিনটা মেয়ে বসে আছে, সাথে মহিলা পুলিশ, ডিআইজি তখন বাইরের ডিউটিতে, আমাদের বলা হলো বসতে, প্রচন্ড গরমে বাইরের ঘরে বসে আছি, মেজাজ খারাপ হতে লাগলো, সাহায্য করতে এসে কি বিশ্রী অবস্থা, এরই মধ্যে অফিসার কয়েকবার এসে অনুরোধ করে গেলেন না যাওয়ার জন্য, তারপর ঘন্টা তিনেক পরে একই সাথে ডিআইজি, মেজিস্ট্রেট, এসপি আরও বড়কর্তারা এসে হাজির, ডাক পড়লো আমার ভিতরে, মেজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তা আর একজন লেখককে নিয়ে বসলেন, আমাকে বললেন মেয়েদের একে একে সবাইকে নিজের নাম-ঠিকানা পরিচয় থেকে শুরু করে বিস্তারিত ঘটনা জিজ্ঞেস করতে, ভালো করে মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করলাম, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই কম বয়স, ততক্ষণে জেনে গেছি তিনজনকেই বাংলাদেশ থেকে এখানে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, চরম অত্যাচারের পর এরা কোনভাবে পুলিশের হাতে ধরা পরে নারী নিকেতন এ আসে|

তিনজনকেই একে একে জিজ্ঞেস করলাম সব কিছু, খুঁটিনাটি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার পরে মোটামুটি বক্তব্য দাড়ালো একই রকম-(নাম-পরিচয় ও ঠিকানা প্রকাশ করছিনা)

"তিনজনই ঢাকার কোনো গার্মেন্টস বা স্পিনিং কারখানায় কাজ করতো, এদের সবাইকেই অল্প পরিচিত অন্য আরেকজন মেয়ে ভালো কাজ দাওয়ার নাম করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়, তারপর খাবারের সাথে ওষুধ মিশিয়ে দাওয়া হয়, অজ্ঞান অথবা নেশা অবস্থায় তিনজনকেই বর্ডার পার করানো হয়, তারপর সেখান থেকে কোলকাতা, সেখানে একজন মহিলার বাসায় এদের রাখার পরে, সুবিধেমতো আবার ওষুধের প্রয়োগ করে ট্রেনে করে এদের নিয়ে আসা হয় এলাহাবাদে, এখানে একজন একজন করে তিনজনকেই বিভিন্নভাবে নিয়ে এসে বিক্রি করে দাওয়া হয় পতিতালয়ে, সেখানে একজন মহিলার অধীনে অনেকদিন ছিলো, জোর করে প্রতিদিন ১০-১২ এর অধিক মানুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে বাধ্য করা হত, সকাল ৮ টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো এই অত্যাচার| আর কথা না শুনতে চাইলে মারধর তো আছেই| ২ জনের বয়স ১৮ এবং একজনের ১৭ বলে জানালো ওরা|"

কথাগুলো ওদের মুখ থেকে শুনে চলেছি, এদিকে একের পর এক কাগজে কলম চালাচ্ছি, জবানবন্ধি তৈরী করছি, কিন্তু একসময় সত্তি মনে হলো কেও যেনো কানে গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে, পুলিশের পুরো জেরাটা করতে হচ্ছে আমাকে, সাথে উঠে আসছে অত্যাচারের বর্ণনা, একসময় মনে হলো না এলেই হয়তো ভালো করতাম| ততক্ষণে বেশ কয়েকদফা জবানবন্ধি নেওয়া হয়ে গেছে, মেজিস্ট্রেট চলে গেলেন কাগজে সই করে, আমাকে বলে গেলেন শেষ পর্যন্ত বসে সব কাগজে সই করে, জবানবন্দি যাচাই করে সবার টিপসই নিয়ে, আবার জবানবন্দি গুলোকে হিন্দিতে রূপান্তর করে দিয়ে যেতে| এরই মধ্যে মহিলা পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, অনেক সাহস করে এদের মধ্যে একজন, কারো মাধ্যমে ফোনে খবর দেয় থানাতে, তার খবরের ভিত্তিতেই পুলিশ হানা দেয়, উদ্ধার করে এই তিনজনকে| এদিকে কাজ চলছে, মাঝে মাঝে মেয়েগুলো দু-চারটা কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তাদের বার বার একই প্রশ্ন, ঈদ এর আগে বাড়ি যেতে পারবে তো?? আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারলামনা, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন পাশে বসে থাকা এসপি, বললেন কি হয়েছে, প্রশ্ন শোনার পরে তিনিও চুপ করে রইলেন, তারপরে আমতা আমতা করে বললেন, কি আর বলা যাবে বলো, এই কেস তো আমাদের হাতের না, ইন্টারপোল তারপর দু দেশের এম্বাসীর হাতে চলে যাবে এরপরে| জেনেও মিথ্যে বললাম, বললাম ওদের হয়ে যাবে, ঈদের আগেই যাবে দেশে, চিন্তা করোনা| তখন বুঝলাম কখনো কখনো মিথ্যে বলাটা আসলেই কষ্টের কাজ| ততক্ষণে আমি চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে পালানোর, প্রায় ৬ ঘন্টা ধরে বসে আছি এখানে| তারপর ঘন্টা সাতেক পরে একগাদা কাগজে সই করে, সব কাজ শেষ করে বের হলাম| তার আগে ওখানে বসে বসে শুনেছি পালের গোদাদের ধরার জন্য ঐদিন রাতেই পুলিশের হানা দাওয়ার প্ল্যান| শুনে এলাম তিনজনকেই এখানের আইনি কাজ শেষ হলে দিল্লি পাঠানো হবে, তখন দুই দেশের মধ্যে আইনি কাজ চলবে হস্তান্তরের| অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে বের হয়ে এলাম| পিছনে রেখে এলাম কিছু উত্সুক চেহারা, আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলা তিনটি মানুষ|

ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে আটটা ছুই ছুই করছে, সারাদিনে পেটে সরকারী চা ছাড়া কিছুই পড়েনি, এর মধ্যে ফেরত এলাম লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর অফিসে, কথা হচ্ছিলো কিছু অফিসারের সাথে, সেখান থেকে বের হয়ে এলো আরও কিছু তথ্য, ভারতীয় বর্ডার সংলগ্ন দেশ গুলো থেকে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় অনেক মেয়ে, এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন শহরে, বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়, ভালো চাকরি বা ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, তারপর এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় পতিতালয়ে| এছাড়াও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মেয়ে শিশু জন্মের পরে হত্যা করা হয়, সেখানে মেয়ে সংখ্যায় এতই কম যে পুরুষদের বিয়ে হচ্ছেনা, তাই বাংলাদেশের বর্ডার সংলগ্ন জায়গাগুলো থেকে গরিব পরিবারের মেয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে মোটা টাকা দিয়ে, তাদের কে একই সাথে একাধিক পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি কখনো কখনো ৪/৫ জন পুরুষের সাথেও থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এরকম অনেক মেয়ে পালিয়ে আসতে যেয়ে খুন হয়ে যায়| এক অফিসার বললেন যারা পালাতে সক্ষম হয় তাদের ফেরত দিতে গেলে দেখা যায় তাদের পরিবারই খুশিনা, দারিদ্রের এমনি কষ্ট যে নিজের সন্তান ফিরে আসলেও টাকা আর পাবেনা এই দুঃখ থেকে যায়| সবার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে এই চক্র, তারপরও কোনো পদক্ষেপ নেই|

ইন্টেলিজেন্সের অফিস থেকে ফেরত আসছি আর মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এতদিন পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভিতে এরকম খবর অনেক দেখতাম, দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে যাওয়ায় চোখ এড়িয়েও যেত, কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতার পর পুরো সমাজ ব্যেবস্থাটাই একটু অন্যরকম লাগছে| নারী অপহরণ এবং নির্যাতনের এরকম ভয়াবহ রূপ সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিন দুঃস্বপ্নের ভেতরে তাড়া করে ফিরবে| দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী হওয়া সত্তেও দেশের নারী পাচার রোধে কতটুকু অগ্রসর হয়েছে আইন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়|

মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন| নারী পাচার ও নারী নির্যাতন রোধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার ও সমাজ সচেতনতা খুবই জরুরি| আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশগুলোতে দারিদ্রের কবলে আক্রান্ত পরিবারগুলো থেকে মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়, দেশের অজস্র সমস্যার সাথে এই বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখাটা একান্তই জরুরি| মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত রোধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও গভীর পর্যবেক্ষণ ও সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম গুলোতে নিয়মিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলোর কার্যক্রম জরুরি| শুধু ভারতেই নয় কিছুদিন আগে চাকরির নামে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ গুলোতে যৌনদাসী হিসেবে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কাহিনীও নজরে এসেছে| শুধু সরকার নয়, সভ্য সমাজের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই কর্তব্য নারী পাচার এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো|

"সেই তিনটি মেয়ে কোথায় ঈদ করলো কোনদিনও আর জানা হবেনা|"

1 comment:

  1. Its really shameful when one see's such incidents happening on a daily basis and nothing really being done to stop it.Its one thing to read it on the paper, another thing to actually face such a situation as you have.And you really cant do anything cause the matter always ends up in the official backwaters of 2 governments and even if the girls are able to return home, they have to face the scorn of a bigoted society.We need someone like Anuradha Koirala who will stand up for these unfortunate girls of Bangladesh.More and more people need to know about whats happening out there.

    ReplyDelete