Monday, September 12, 2011

সাধু গ্রেগরীর বকুলতলা


দিনটা ছিলো বুধবার| ব্রাদার হোবার্ট সকাল থেকেই চিন্তিত, একটু পর পরই ব্যালকনিতে যাচ্ছেন আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন| দেশের অবস্থা ভালো না, কখন কি ঘটে যায় কিছুই বলা যাচ্ছেনা| আবার এদিকে সকাল থেকেই মিলিটারির জীপ এদিক ওদিকে ঘুরছে, মাত্র ৬ দিন আগেই পাশের শাঁখারী বাজারে ওরা যে বিভৎস হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তিনি সেটা জানেন| কিন্তু তার চিন্তা অন্যখানে, স্কুলের কম্পাউন্ডের ভেতরে বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, তার উপরে তিনি নিজে স্কুলের তিনজন শিক্ষক আর তাদের পরিবারকে লুকিয়ে রেখেছেন উপরের ঘরে| কি যে হয় কিছুই বলা যাচ্ছেনা|

ব্রাদার রবার্ট এলেন, তাকে দেখেই ব্রাদার হোবার্ট বাইরের খবর জিজ্ঞেস করলেন| ব্রাদার রবার্ট মাথা নেড়ে বললেন, "নাহ তেমন কিছু জানা যায়নি| তবে মেইন গেট টা খোলা যাবেনা, যেভাবেই হোক স্কুলের ভেতরে কাওকে আসতে দাওয়া যাবেনা|" হোবার্ট চিন্তা মগ্ন হয়ে বললেন, "কেও কি শুনবে এই কথা?" ব্রাদার রবার্ট এর কপালেও চিন্তার ভাঁজ, তিনিও জানেন গেট বন্ধ করে কি আর এদের আটকে রাখা যাবে? তাও বললেন," কেন নয়, এটা মিশনারি প্রপার্টি, এটাতে নিশ্চয় ওরা আসার সাহস পাবেনা|" ব্রাদার রবার্ট মাথা নাড়লেন, ব্যালকনি থেকে ফিরে আসতে গিয়ে চমকে উঠলেন, দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে, ভারী আওয়াজ তুলে সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বড় মিলিটারি ট্রাক চলে গেলো, ট্রাকের উপরে মেশিনগান এর নলটাতে সূর্যের আলোটাও যেনো ভয় পেয়ে চমকে উঠছে|

মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্রাদার রবার্ট কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না| এতগুলো পরিবার, সহায় সম্বল ছেড়ে শুধু প্রাণ বাঁচাতে এখানে চলে এসেছে| স্কুলের দার্জিলিং বিল্ডিংটার নিচে ভিত সন্ত্রস্ত পরিবারের মানুষগুলো দিশে হারা| গুলির শব্দ এরাও শুনেছে, তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন তিনি| অভয় দিতে চেষ্টা করলেন, নিজেও জানেন যেই দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে এরা যাচ্ছে তা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেও দূর করতে পারবেনা| বুকের সামনে ঝোলানো বড় ক্রসটা মুঠোতে আঁকড়ে ধরলেন তিনি|


ব্রাদার হোবার্ট কথা বলছিলেন সূত্রধর স্যার আর পল স্যারের সাথে, যে করেই হোক সুযোগ পেলেই সবাইকে অন্য কথাও সরিয়ে ফেলতে হবে| এখানে আর মোটেও ভালো ঠেকছেনা, সকাল থেকেই কয়েকবার মিলিটারি জীপ ঘুরে গেছে| বলা যায়না ওদের কাছে খবর থাকতেও পারে| সূত্রধর স্যার বললেন, "মনে হয়না ওরা এতটা সাহস করবে, মিশনারি স্কুল এটা, এটাতে হামলা চালানো মানে তো অনেক বড় একটা ঘটনা|" পল স্যার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বল খেলার বড় মাঠটার দিকে, কি শুনশান জায়গাটা| অথচ দুপুরের এই সময়টাতে ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো, সাধু গ্রেগরীর ডানপিটে ছেলেগুলো দৌড়াতেও পারে, বড় হলের অজস্ত্র চ্যাম্পিয়নস কাপ আর শীল্ড গুলোর দিকে তার চোখ আটকে যায়| নিজের অজান্তেই কেন জানি তার সবকিছু খাপ ছাড়া, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে| পালমা স্যার শান্ত শিষ্ট মানুষ, পিছনে হাত রেখে একটু ঝুঁকে হাটেন| তিনিও উপর থেকে নিচে নেমে এলেন, কারো মুখে কথা নেই, শূন্য দৃষ্টির বিভিন্ন বয়সের মানুষ গুলো যারা অজস্ত্র ছেলেকে জীবনের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, তারাই আজ পথ খুঁজতে হিম-শিম খাচ্ছেন|

ব্রাদার রবার্ট বাস্কেটবল কোর্টটা হয়ে হল রুমের দিকে ফিরছিলেন, যান্ত্রিক শব্দে থমকে দাড়ালেন| মনে হলো গাড়িটা স্কুলের গেটটার সামনে দাড়ালো, ক্রসটা মনের অজান্তেই হাতের মুঠোয় চলে এলো তার| বিড় বিড় করছেন,"গড, স্যেভ আস"| যেমন থেমেছিলো তেমনি গাড়িটা আবার চলতে লাগলো, রবার্ট হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, কপালের ঘামটা মুছে এগিয়ে চলা শুরু করেছেন হল রুমের দিকে| বকুল তলাটা পাড় হয়েছেন, তখনি আবার ভারী যান্ত্রিক শব্দটা ঠিক গেটের সামনে থামলো| মাথা তুলে গেট এর দিকে তাকালেন, জলপাই রঙের ট্রাক আর তার উপরে কুচ কুচে কালো রঙের নলটা চিনতে তার দেরি হলোনা| মন্ত্র মুগ্ধের মতো তিনি গেটের দিকে এগিয়ে চললেন, ইউনিফর্ম পরা একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "দরওয়াজা খোলো, হুকুম হেয়, আন্দর আনে দো"| ফেস ফেসে আওয়াজে রবার্ট কোনমতে বললেন, "দিস ইজ আ মিশনারী প্রপার্টি, উই হেভ নো রিলেশন উইদ এনি পলিটিকাল ইন্সিদেন্তস, হয়ার ইজ ইউর সিনিয়র?" এবার গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন পেছনের জীপ থেকে নেমে এলো একজন, গেটের সামনে এসে বললো, "ব্রাদার, ডোন্ট ওরি, জাস্ট আ রুটিন চ্যেক, উই উইল নট ডু এনিথিং রং"| কোনো উপায় নেই, বুঝতে পারলেন| এদিকে জিপের শব্দে বাকি সবাইকে উপরে যেতে বলে বাইরে এসে দাড়িয়েছেন ব্রাদার হোবার্টও, আস্তে আস্তে তিনিও গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন, ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে জনা দশেক মিলিটারি স্কুলের জলের কলটার সামনে পজিশন নিয়েছে, দেখলেন ব্রাদার রবার্ট এর সামনে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে কথা বলছে অফিসার| অবাক হলেন, এত দশাসই চেহারার ব্রাদার রবার্টকে কেন জানি আর্মি অফিসারটার সামনে অনেক জরসর লাগছে| তাকে এগিয়ে যেতে দেখে অফিসারটা নিজেই এগিয়ে এলো, হাসি মুখে বললো, "ব্রাদার, দিজ প্লেস ইজ নাইস, বাট উই গট ইনফরমেশন, সাম পিপল আর হাইডিং ইনসাইড ইউর স্কুল", হোবার্ট কিছু বলার আগেই অফিসার হুকুম দিলো," সার্চ ইনসাইড"|


মিনিট দশেক পরে বকুল তলায় দাড়িয়ে আছে জনা বিশেক মানুষ, সবার সামনে দাড়িয়ে আছেন সৌম্য ভদ্র চেহারার তিনজন গম্ভীর মানুষ, সাথেই ভিত চেহারার দুজন তরুণ, অফিসার ব্রাদারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললোনা, জোরে হুকুম দিলো, "টেইক দেম অল"| ব্রাদার হোবার্ট হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন, এরা নিরীহ মানুষ, এদেরকে গ্রেফতার করার কোনো কারণ নেই| ব্রাদার কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসার| রবার্ট একবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, "ইউ কান্ট ডু দিস, হয়ার উইল ইউ টেইক দেম"| কর্কশ গলায় মাথা না ঘুরিয়েই অফিসার জবাব দিলো," দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস"| ততক্ষণে পিঠমোড়া বেঁধে ট্রাকে তোলা হচ্ছে সবাইকে, সূত্রধর স্যার যাওয়ার আগে ব্রাদারকে তার হাতের ঘড়িটা খুলে দিলেন কি মনে করে যেনো, পিঠে ধাক্কা মেরে তোলা হলো তাদেরও, খুব শান্ত চোখে ব্রাদার হোবার্ট এর দিকে তাকালেন পালমা স্যার| গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ব্রাদার দুজনেই দৌড়ে গাড়ির পেছন পেছন অনেকটা গেলেন| তারপর একরাশ কালো ধুয়া আর সব কিছুই আগের মতো শুনশান|


দিনটা ছিলো বুধবার, ৩১ শে মার্চ, ১৯৭১| খ্যাতনামা সেইন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে ওই দিন দুপুরে অনেকের সাথে, স্যার এন.সি.সূত্রধর, স্যার পল পালমা, স্যার ডি.এন.পাল চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সুবল ও উত্পল কে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী তত্কালীন জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পে| ব্রাদার হোবার্ট ও ব্রাদার রবার্ট এর অনেক চেষ্টা সত্তেও ঐদিন রাতেই সবার সাথে এই তিন শিক্ষক ও ছেলে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্থানি মিলিটারি| সেই বকুল তলাটা এখনো আছে, ঠিক তার নিচে লাল রঙের শহীদ মিনারটা| সাদা পাথরে, কালো কালিতে লেখা সবার নাম| স্বাধীনতার পরে সেই স্কুলের ছাত্র তাজউদ্দিন আহমেদ হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী| এখন বদলে গেছে অনেক কিছুই, দার্জিলিং বিল্ডিংটা এখন আর ব্যাবহার করা হয়না, নতুন বিল্ডিং হয়েছে, খেলার মাঠটাও বদলেছে| কিন্তু আছে সেই অতি প্রাচীন হলরুম আর সেই জলের কল| নুনে ধরা দেয়ালে পুরনো পুরনো গন্ধ| আর আছে সেই বকুল গাছ, তার নিচে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা লাল শহীদ মিনার|




1 comment: