Friday, October 14, 2011

বিবর্তন সম্পর্কে ১০টি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা এবং তার উত্তর

[ এই লেখাটার পেছনের উদ্দেশ্যটা বলছি, বেশ কিছুদিন আগে খুবই কাছের একজন আস্তিক বন্ধুর সাথে কিছু বিষয়ে কথা বলার সময় ধীরে ধীরে কথার প্রসঙ্গ বিবর্তনবাদের দিকে গড়ায়, স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহলী বন্ধুটি কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, তখন তার কিছু সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম, খুব সহজ ভাষায় ব্যাপারগুলো বর্ণনা করতে পারছিনা, বিবর্তন নিয়ে পড়ার পরেও সহজ ভাবে সেটি সেদিন বন্ধুকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়েছিলাম, তারপর থেকেই বিবর্তনের সম্পর্কে সাধারণ ভ্রান্ত ধারণাগুলো নিয়ে লেখা খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম| তারপরে আরও কিছু জিনিস নজরে এলো, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষ বিবর্তন সম্পর্কিত ব্যাপারে বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা ছড়াচ্ছে| শুধু তাইনা, কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে বেশ কিছু বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বক্তব্য নিয়েও ভ্রান্ত কিছু ভিডিও তৈরী করে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাই এই বিষয়টি নিয়ে লেখাটা লিখছি, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ও তথ্য সংযোজনকে স্বাগতম জানাই|]
বিবর্তনবাদ প্রথম থেকেই তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম ছিলো, এটি সৃষ্টির প্রথাগত ধারনাকে পরিবর্তন করে, একটি উপযুক্ত ও প্রমানসাপেক্ষ শক্তিশালী ধারণার জন্ম দিয়েছিলো| কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধ স্রোতের দাপটে মহান বিজ্ঞানী ডারউইন এর অসাধারণ এই কাজটি ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি ঠিকই কিন্তু মুক্তমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের চিন্তার নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছিলো| এত বছর পরেও অধিকাংশ মানুষ বিবর্তনের অতি চমৎকার ও সহজ ধারনাটিকে বুঝতে সক্ষম হয়নি বা বলতে গেলে বুঝতে চায়নি| এর পিছনের ইতিহাসে যাবোনা, শুধু খুবই প্রচলিত ও আলোচিত ১০ টি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে লিখবো| (সহজ করে লেখার চেষ্টা করেছি, জানিনা কতটুকু সফল|)
______________________________________________________________________
১ম প্রশ্ন: যদি মানুষ বানর থেকে আসে, তাহলে এখন বানর কেন মানুষে পরিণত হচ্ছেনা??
উত্তর: খুবই মজার একটা প্রশ্ন, তর্কে বিতর্কে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত| কিন্তু বিবর্তনবাদ সম্পর্কে এই প্রশ্নটি চরম ভাবে আলোচিত হলেও এটি মারাত্মক একটি ভুল| বিবর্তন কথাটি সহজভাবে বললে হয়, ধাপে ধাপে পরিবর্তন, কখনই হুট করে বিবর্তন হয়না, কোনো একটি প্রজাতির বিবর্তনের জন্য হাজার হাজার বছর লাগে| ডারউইন কখনই বলে যাননি, মানুষ বানর থেকে এসেছে| বানর গোত্রীয় প্রজাতির বিবর্তনের উধাহরণ বর্তমানের মানুষ| বানরগোত্রীয় ও বানর থেকে এই কথাটির সূক্ষ পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল তথ্য| মানুষ, বানর এবং বনমানুষ এরা সকলেই সমগোত্রীয়| মানুষ বানর থেকে নয়, বরং এমনই একটি সাধারণ প্রজাতি থেকে এসেছে, যা বানর কিংবা মানুষ কোনটাই ছিলনা, এরা মানুষের পূর্বপুরুষ যারা অতীতে কয়েক মিলিয়ন বছর পৃথিবীতে ছিলো| শুধু তাই নয়, বিগত ৭ মিলিয়ন বছর ধরে বেশ কিছু মানুষ ধরনের প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে, যাদের মধ্যে- Homo habilis, Homo erectus, and Homo neanderthalensis অন্যতম| এরা বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে, কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে টিকে আছে বর্তমানের মানুষ এবং আরও কিছু সমগোত্রীয়|


২য় প্রশ্ন: বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত ফসিল রেকর্ডে অনেক ফাঁক ফোকড় আছে, তাই ফসিল কি বিবর্তনের তত্ত্ব প্রমান করে???
উত্তর: এই প্রশ্নটির সূচনা হয় সাধারণ মানুষের ফসিল সম্পর্কিত অবজ্ঞার ও ভ্রান্ত তথ্যের কারণে| প্রথমেই জানা উচিত ফসিল কি? ফসিল হচ্ছে, প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত মৃতপ্রাণীর দেহবশেষ যা কিনা কালের আবর্তনে বিভিন্ন সময়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক চাপ ও তাপের প্রভাবে স্তরীভূত হয়ে থাকে| বিভিন্ন সময়ে খননের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত এই ফসিল নিয়ে তৈরী হয় ফসিল টেবিল| যা কিনা কোনো একটি বিশেষ প্রজাতির, বংশানুক্রমিক বিবর্তনের উধাহরণ বহন করে| এখন প্রশ্ন হচ্ছে যখন ফসিল হবার প্রক্রিয়াটি পুরোটাই প্রাকৃতিক, তখন একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণীর, পূর্বপুরুষের দেহবশেষ এর ফসিল হবার সম্ভাবনা কতটুকু?? সেটা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর-
১. সেই নির্দিষ্ট প্রাণীটির দেহকে খাদক অথবা শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রেহাই পেতে হবে|
২. তারপর সেটিকে কিছু নির্দিষ্ট চাপ ও তাপের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত হতে হবে যাতে সেটি ফসিলে পরিণত হবার আগেই হারিয়ে না যায়| এখানে পুরো সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক ও অকৃত্তিম|
৩. তারপর লক্ষ্য বছর ধরে মাটির নিচে চাপা থাকার পরে প্রাকৃতিক উপায়ে সেটি হয়তো মাটির উপরে উঠে আসবে অথবা খননকার্যের মাধ্যমে সেটির সন্ধান পাওয়া যাবে|
৪. এই বিপুল প্রাণীজগতের অজস্র ফসিল এর উদ্ধারের জন্য যারা কাজ করছে তাদের সংখ্যা অনেক কম|
এতগুলো বিরুদ্ধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীতে যত ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে তা বিবর্তনের জন্য কম তো নয়ই, বরং বিভিন্ন সময়ে প্রানীদের বিবর্তনের মধ্যবর্তী প্রজাতিরও ফসিল আবিষ্কৃত হয়ছে, যা আরও শক্ত ভাবে বিবর্তনের পক্ষে উধাহরণ স্থাপন করে| উদাহরণ হিসেবে Archaeopteryx কে নেওয়া যায়, যা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত অন্যতম প্রাচীন পাখিদের মধ্যে পরে, যার কংকাল সরীসৃপ প্রানীদের মতো কিন্তু এর ডানা এবং পালক ছিলো| যা কিনা পাখি এবং সরীসৃপ গোত্রীয় প্রানীদের মধ্যে বিবর্তনের উধাহরণ| Therapsids হচ্ছে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের মধ্যবর্তী স্তরের ফসিল একই ভাবে Tiktaalik হচ্ছে উভচর প্রানীদের বিবর্তনের মধ্যবর্তী ফসিল| বিশালাকায় তিমি মাছের বিবর্তনের ধারার মধ্যবর্তী অন্তত ৬ শ্রেনীর ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে, একই ভাবে বর্তমান আধুনিক মানুষের বিবর্তনের মধ্যবর্তী প্রায় ১২ টি স্তরের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে| তাই ফসিল বিবর্তনকে শুধু সমর্থনই করেনা, এটিকে সচিত্র প্রতিস্থাপন করে আমাদের অতীতকে আমাদের সামনে তুলে ধরে|



৩য় প্রশ্ন: যদি বিবর্তন বহু বছর ধরে ধাপে ধাপে ঘটে থাকে, তাহলে ফসিল রেকর্ডে সেটা প্রতিয়মান হয়না কেন??
উত্তর: ফসিল রেকর্ডে কিছু দ্রুত পরিবর্তন কখনই ধাপে ধাপে পরিবর্তন এর বিরুদ্ধে নয় বরং এটি বিজ্ঞানের ভাষায় punctuation এর একটি উদাহরণ| কোনো প্রজাতি একটি দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, কিন্তু একটি প্রজাতি থেকে আর একটি প্রজাতিতে পরিবর্তন ঘটে দ্রুত, যাকে বলা হয় punctuated equilibrium| এই পদ্ধতিতে দেখা গেছে, যদি কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়ে অন্য একটি প্রজাতি সৃষ্টি হয় তাতে বিবর্তন ঘটে দ্রুত, কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষের সংখ্যার থেকে তাদের সংখ্যা কম থাকায় এবং সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রজাতি তৈরী হওয়ার জন্য এদের মধ্যে পরিবর্তন হয় দ্রুত, এ কারণে ফসিল হিসেবে সংরক্ষিত হবার আগেই হয়তো এদের পরিবর্তন সাধিত হয়| এ কারণেই ফসিল রেকর্ডে দ্রুত পরিবর্তন দেখা যায় কখনো কখনো বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তারা তাদের পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য বহন করে| তাই দ্রুত পরিবর্তন কখনই বিবর্তনের বিরুদ্ধে নয় বরং এটি বিবর্তনের একটি ধারাকে প্রমান করে|


৪র্থ প্রশ্ন: কেউ কি বিবর্তন নিজের চোখে ঘটতে দেখেছে??
উত্তর: বর্তমান পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষেত্র বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে, প্রজাতির জীবন হতে শুরু করে জীবিকা সবই বিবর্তনের উধাহরণ| কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ফসিল রেকর্ড দিয়ে বিবর্তন প্রমান করা হয়না, বরং অজস্র প্রজাতির ফসিল থেকে ধারণকৃত তথ্য উপাত্ত ও DNA গবেষনার উপর ভিত্তি করে প্রচুর প্রমানের পরেই এই উপসংহারে আসা হয়| সাধারণ বিজ্ঞান এর বিভিন্ন শাখা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন উপশাখার মাধ্যমে বিবর্তন সম্পর্কে কাজ করা হয়েছে| বিভিন্ন প্রজাতির বংশানুক্রমিক পরিবর্তন বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণের পরেই এই ধরনের উপসংহারে আসা সম্ভবপর| কোনো জাদুকরী কুদরতির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান কাজ করেনা, বিজ্ঞান প্রমান সাপেক্ষ জ্ঞান, বিজ্ঞান নিজের ভুল নিজে খুঁজে বের করে এবং তা স্বীকার করে পরিবর্তনও বিজ্ঞানই করে, বিবর্তনও ঠিক সেরকমই একটি চলমান ধারা, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে| ভাইরাস কোষ কিংবা ব্যাকটেরিয়া কোষ এর বিবর্তন যথেষ্ট দ্রুত ঘটতে দেখা গেছে, যা আধুনিক মেডিকেল সাইন্স এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক|

৫ম প্রশ্ন: বিবর্তন রেন্ডম চান্স এর মাধ্যমে হয়, তাই এটি কি নির্ভরযোগ্য??
উত্তর: বিবর্তন কখনই রেন্ডম চান্স এর মাধ্যমে হয়না, এটি একটি ভুল ধারণা| এই সম্পর্কে রিচার্ড ডকিংসের একটা বর্ণনা আমার বেশ ভালো লাগে| যদি বলা হয় একটি ঘুর্নিঝড়কে একটি স্ক্রেপ ইয়ার্ড এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং অজস্র টুকরো থেকে এক হয়ে একটি বোয়িং বিমান তৈরী হবার চান্স কতটুকু?? তাহলে যেমন হাস্যকর শোনায়, বিবর্তন রেন্ডম চান্স এ ঘটে থাকে এটা ততটাই হাস্যকর শোনায়| Natural selection কখনই রেন্ডম নয়, তা কোনো চান্স এর মাধ্যমেও হয়না| বিবর্তন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন সময়ে দেহকে পরিবেশের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে, এটি অতীতের ভুল-ত্রুটি গুলোকে সংশোধন করতে থাকে, তাই ধাপে ধাপে একটি অতি চমৎকার ও জটিল নকশা তৈরী হয়| কিন্তু সেটা কখনই রেন্ডম নয়| যেমন মানুষের চোখের গঠন একদিনে হয়নি, রেন্ডম ঘটনাও নয়| পরিবেশ ও সময় উপযোগী করে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে, একই ভাবে হাতের তালু মুঠো করবার ক্ষমতা মানুষের মধ্যে যেমন দেখা যায় অন্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সেটা অনেক সময় অনুপস্থিত| এটা বিবর্তনের ফসল| বিবর্তন মানুষের দেহকে অন্য স্তন্যপায়ী প্রানীদের দেহ থেকে আলাদা এবং আধুনিক করেছে ধাপে ধাপে| মস্তিস্ক এর পরিবর্তনও হয়েছে ধাপে ধাপে|

৬ষ্ঠ প্রশ্ন: শুধুমাত্র একজন অসাধরণ সৃষ্টিকর্তাই পারেন দেহর মতো এমন একটি জটিল নকশা তৈরী করতে, বিবর্তনের পক্ষে একটি কোষ থেকে এত জটিল একটি নকশা সম্ভব কি??
উত্তর: সম্ভব| মানুষের চোখের উদাহরণ ধরি, প্রথম কথা হচ্ছে চোখের গঠন জটিল কিন্তু উল্টো, মানুষ যা দেখে তা প্রথমে সম্পূর্ণ উল্টো থাকে তারপর বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি মস্তিস্ক সঠিক করে এবং সোজা করে দেয়| তাই যখন চোখে আলো প্রবেশ করে তা কর্নিয়া, লেন্স, একুয়াস ফ্লুইড, ব্লাড ভেসেল, গেন্গ্লীয়ন সেল, হরাইজন্টাল সেল, বাইপোলার সেল ইত্যাদি অতিক্রম করে আলোক সংবেদনশীল রড এবং কোন এ পৌঁছে, যা নিউরাল ইমপালস তৈরী করে যেটা পরে ভিজুয়াল কর্টেক্স এ যায় যা কিনা মস্তিষ্কের পেছনে অবস্থিত সেটা এই সিগনালকে অর্থপূর্ণ ছবিতে পরিণত করে যা আমরা দেখতে পাই| যদি কোনো অসাধরণ সৃষ্টিকর্তাই দেহ বানাতেন তাহলে এত ঝামেলার কি দরকার ছিলো, আর ছবিটা উল্টো করে পাঠানোরই কি দরকার ছিলো?? তার থেকে বরং সোজাসুজি সব কিছু করলেই ঝামেলা থাকতনা| কিন্তু তা হয়নি, কারণ চোখের মতো আর সব অঙ্গই তাদের কাছে থাকা পদার্থ দিয়ে ধাপে ধাপে তৈরী হয়েছে, তাই এত ঝামলা| এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা তো নয়ই বরং খুবই নির্দিষ্ট ভাবে বিবর্তনকে সমর্থন করে| এভাবে প্রাণীজগতের সব প্রজাতির দেহই বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তৈরী| বিবর্তনের এটাই মজা|

৭ম প্রশ্ন: বিবর্তন শুধুই থিওরি, প্রমান কি??
উত্তর: বিজ্ঞান থিওরি থেকেই আসে, তবে কেউ থিওরি দিলেই সেটা মেনে নেওয়া হয়না| অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যুক্তি তর্কের উপর ভিত্তি করে তবেই কোনো উপসংহারে আসা হয়, যেমন নিউটন এর মাথায় আপেল বা কাঁঠাল পরলেই অভিকর্ষ আর মহাকর্ষ প্রমান হয়না, তার জন্য লাগে গাণিতিক প্রমান, যুক্তি, পর্যবেক্ষণ| তেমনি বিবর্তনের ধারণা কোনো গায়েবী আওয়াজ থেকে আসে নাই, ডারউইন বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে যে মহা বিপ্লবের সূচনা করে গেছেন, তা তার মৃত্যুর সাথেই থেমে যায়নি, বরং আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত বহু বছর আগে করে যাওয়া তার থিওরিকেই প্রমান করে চলেছে| অজস্র ফসিল প্রমান, প্রজাতির বংশানুক্রমিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে তৈরী করা চার্ট ইত্যাদি সবই বিবর্তনকে সমর্থন করে| এর পরেও বিশ্বাস করতে না চাইলে কিছু করার নেই, চোখের সামনেই সব উধাহরণ আছে|
৮ম প্রশ্ন: মানুষের বিবর্তন শুধুই ভ্রান্ত ধারণা ও নানা ভুলে ভর্তি, কেন মানবো??
উত্তর: মানুষের দৈহিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো বিবর্তনই ভুল ধারণা নয়, দৈহিক বিবর্তন নিয়েই সব ঝামেলা কিন্তু তাতেও কোনো ভুল নেই, বরং কিছু সন্দেহ ছিলো যা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়েছে প্রমান সাপেক্ষে| মানুষের দেহে নানাবিধ বিবর্তনের উদাহরণ উপস্থিত| দেহের মেরুদন্ডের সর্বশেষ অস্থিটি বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে, এপেন্ডিক্স মানুষের দেহে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় রয়েছে| মানুষের শরীরে এরকম বেশ কিছু উদাহরণ আছে-
১. পশম দাড়িয়ে যাওয়া [Goose Bumps- (Cutis Anserina)] : এটি শুধু মানুষের মধ্যেই না অনেক লোমশ প্রাণীর মধ্যে আরও ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, সাধারণত আত্মরক্ষার্তে দেহের পরিধি বাড়ানোর জন্য অনেক প্রাণীই যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি এটি ব্যাবহার করে থাকে| কিন্তু মানুষের দেহে ততটা দরকারী না হলেও, ভয় কিংবা শিরশিরে অনুভূতি হলেই আমাদের পশম দাড়িয়ে যায়|

২. Jacobson’s Organ-(Vomeronasal organ) : নাকের ভেতরের এই অঙ্গটি বিভিন্ন প্রজাতির প্রানীদের মধ্যে খাবারের ঘ্রাণ গ্রহনের পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রানীদের শরীর এর গন্ধ পেতে সাহায্য করে, যাতে তারা শারীরিক মিলনের মাধ্যমে জৈবিক কর্ম সম্পূর্ণ করতে পারে, মানুষ এর শরীরে এই অঙ্গটি থাকলেও বিবর্তনের মাধ্যমে সেটি এখন আর কোনো কাজে লাগেনা, ধারণা করা হয়, মানুষের পূর্বপুরুষরাও এই অঙ্গটি বিপরীত লিঙ্গের খোঁজ পেতে ব্যাবহার করে থাকতো|

৩. Junk DNA-(L-gulonolactone oxidase) : অতীতে এটি এনজাইম তৈরিতে ব্যাবহার হত যা দেহে ভিটামিন সি তৈরী করতে পারতো, কিন্তু বিবর্তনের ফলস্বরূপ এটি কার্যত এখন অকেজো, কিন্তু দেহে বিদ্যমান|

৪. Extra Ear Muscles-(Auriculares muscles) : বিভিন্ন প্রাণীর মতো আমাদের দেহেও এই অংশটি আছে, প্রাণীরা শব্দ ভালো করে শোনার জন্য কান নাড়াতে এটি ব্যাবহার করে, বিড়াল বা কুকুরকে হামেশাই করতে দেখা যায়| কিন্তু মানুষের মধ্যে হালকা নাড়ানো ছাড়া এটির আর কোনো কাজ নেই, এটিও বিবর্তনের ফল|

৫. Plantaris Muscle : পায়ের এই পেশিটি অনেক প্রাণী খাবার ধরতে ব্যাবহার করে থাকে, বানরদের মাঝে এটা দেখা যায়| কিন্তু মানুষের পায়ে এই পেশিটি থাকলেও কোনো কাজে লাগেনা| বিভিন্ন সময় দেহে পেশী অপারেশনের সময় ডক্টর এখান থেকে পেশী কেটে নেন| মানুষের দেহে এই পেশিটি এতই অপ্রয়োজনীয় যে শতকরা ৯ ভাগ মানুষ এটা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে|

৬. আক্কেল দাঁত (Wisdom Teeth) : প্রচলিত ধারণা এটি গজালে নাকি বুদ্ধি হয়, রসিকতা থাক| প্রাচীন যুগে এই দাঁতটি ব্যাবহার হত লতা পাতা খাবার জন্য, দ্রুত চর্বন ও শর্করা দ্রুত খেতে এটি ব্যাবহার করতো আদি মানবরা| কিন্তু বিবর্তনের ফলে অদরকারী হয়ে পরা অঙ্গটি এখনো দেহে বিদ্যমান ঠিকই কিন্তু বর্তমানে অনেক মানুষেরই এটি গজানো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বংশানুক্রমে|

৭. চোখের তৃতীয় পাতা (Third Eyelid) : কোনো বিড়ালকে কাছে থেকে চোখের পাতা ফেলতে দেখলে দেখা যায় যে, হালকা সাদা একটা অংশ চোখের মনির উপর দিয়ে চলে গেলো, এটা চোখের তৃতীয় পাতা| স্তন্যপায়ী প্রানীদের মধ্যে এই অংশটি বিরল হলেও পাখি, সরীসৃপ এদের মধ্যে স্বাভাবিক অংশ এটি| মানুষের মধ্যেও আছে এটি কারো কারো বেশ ভালো ভাবে দেখা যায়|

৮. Darwin’s Point-(plica semilunaris) : এই অংশটি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে দেখা যায়, মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, এটা প্রানীদের নির্দিষ্ট শব্দের প্রতি মনোযোগ দিতে সাহায্য করে কিন্তু মানুষের দেহে এর কোনো কাজ নেই| শতকরা ১০ ভাগ মানুষের দেহে স্পষ্ট দেখা যায়|

৯. Coccyx : মেরুদন্ডের এই অংশটি আগে লেজ হিসেবে ব্যাবহার হলেও বিবর্তনের ফলে এখন আর লেজ হিসেবে নয় বরং বিভিন্ন পেশির কাজে উঠা বসার সময় ব্যবহার হয়|

১০. Appendix : আগেও বলা হয়েছে, মানব দেহে এর কাজ নিয়ে বিভিন্ন মত আছে, সচারচর ব্যাবহার হয়না, অনেকে অপারেশন করে ফেলে দেন| ডারউইন এবং কিছু বিজ্ঞানীর মতে অতীতে যখন প্রচুর পরিমানে লতা পাতা খাবার হিসেবে গ্রহণ করতো আদি মানবেরা, তখন সেই বিপুল পরিমানের শর্করা হজম করতে এটি ব্যাবহার হত| এখন আর কোনো সঠিক ব্যাবহার খুঁজে পাওয়া যায়না|

৯ম প্রশ্ন : থার্মোডিনামিক্স এর ২য় সূত্র প্রমান করে বিবর্তন অসম্ভব, তাই না??
উত্তর: থার্মোডিনামিক্স এর ২য় সূত্রটি একটি বন্ধ ও আইসলেটেড সিস্টেম এর জন্য ব্যাবহার করা যায়, কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে সূর্য থেকে তাপ আসছে আর তাপ বাইরেও যাচ্ছে, তাই পৃথিবী কোনো বদ্ধ সিস্টেম না| তাপের আদান প্রদান এর উপর ভিত্তি করে তাপমাত্র বাড়ছে কমছে, তাই যতদিন সূর্য থাকবে ততদিন কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ না করেই বিবর্তন হবে|

১০ম প্রশ্ন : মানুষের মূল্যবোধের সাথে বিবর্তনের ধারণা সঙ্গতিপূর্ণ কি??
উত্তর: অবশ্যই| মানুষ সামাজিক প্রাণী, তার মূল্যবোধ আজকের যে পর্যায়ে আছে তা একদিনে তৈরী হয়নি, বরং ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ পেয়েছে| আগে মানুষের যেরকম মূল্যবোধ ছিলো সামাজিক পট পরিবর্তনের হাত ধরে বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ আজকের অবস্থানে এসেছে, এটাও কোনো অপরিবর্তনীয় অবস্থা নয়, ধীরে ধীরে ভবিষ্যতে এটাও পরিবর্তন হবে| তাই বিবর্তন চলমান একটি প্রক্রিয়া| তাই সমাজ ও মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল|
______________________________________________________________________
বিবর্তনকে মানা আর না মানার মধ্যে কিছুই নেই, না মেনে যারা থাকতে চায় তারা সত্যি অবজ্ঞা করে বাঁচতে চায়, যারা বিবর্তন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক এত অল্প পরিসর কখনই যথেষ্ট নয়, ইন্টারনেটে অজস্র পেপার দেওয়া আছে বিজ্ঞানীদের, অজস্র উদাহরণ আছে সচিত্র, দেখতে শুরু করলে জানতে শুরু করলে দারুন ভালো লাগবে| বিবর্তন চলমান একটি প্রক্রিয়া, এখনো কাজ চলছে, প্রতিদিন নিত্য নতুন তথ্য আবিষ্কার হচ্ছে, এগুলো সহজ ভাষায় সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সবার|