Thursday, November 24, 2011

বিবর্তন-১ : একটি ধারণার সূচনা

বিবর্তন একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে প্রথম থেকেই আলোচিত-সমালোচিত| এই মতবাদটি নিয়ে যে বিপুল পরিমান আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে তা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সমালোচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝেও, এটিকে সব থেকে বেশি সমালোচনা ও অবজ্ঞার স্বীকার হতে হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে| তাই অভিকর্ষ-মহাকর্ষ সংক্রান্ত তত্ত্ব-মতবাদ কিংবা বহুল প্রচলিত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এর মতো বিবর্তনকে সাধারণ সমাজে এখনও মেনে নেওয়া হয়নি কিংবা বলা যায় মেনে নেওয়ার মতো একটি সাধারণ পরিবেশ তৈরী হয়নি| এর পেছনে অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বিবর্তন সম্পর্কে জানার অনীহা, তত্ত্বটি বোঝার বা উপলব্ধি করার মতো সাধারণ জ্ঞানের অভাব, সাধারণের উপযোগী ব্যাখ্যার অভাব এবং সবার উপরে ধর্মীয় সৃষ্টিতত্বের সাথে এর প্রকাশ্য বিরোধ| তাই ধাপে ধাপে এর অতীত থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রচলিত সামাজিক মতবাদের সাথে এর বিরোধের আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করবো|


বিবর্তন

প্রথমেই উল্লেখ্য যে, বিবর্তন তত্বের উদ্ভাবক হিসেবে মহান বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইন এর নাম যে পরিমান আলোচিত হয়েছে এবং জীবদ্দশায় তাকে যে পরিমান বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাতে একটি সত্য সবসময় ঢাকা পড়ে যায় আর তা হলো, প্রাণীজগতের বিবর্তনের ধারনাটি অনেক পুরনো এবং এই ধারণার উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ডারউইন নন, বরং এই ধারণা তার জন্মের অনেক আগেই পৃথিবীতে আলোচিত হয়েছে| তাই "বিবর্তন"-এটিকে ব্যাখ্যা করার আগে এই ধারণার উদ্ভাবক ও বাহকদের জানার চেষ্টা করবো|

প্রানিজগত যে বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে, এই ধারনাটি সর্ব প্রথম প্রস্তাব করেন প্রাচীন গ্রীস এর দার্শনিক Empedocles,কিন্তু খুব দ্রুতই এই ধারনাটি পরিত্যাক্ত হয় সে সময়ে| পরবর্তিতে দীর্ঘ সময় পড়ে ১৭০০ শতাব্দীর দিকে তত্কালীন প্রকৃতিবিদেরা অনুধাবন করেন যে, প্রাণীজগতের আপাত দৃষ্টিতে অপরিবর্তনশীল অবস্থা আসলে একটি ভ্রম| বরং এটি সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তিত হয়েই আজকের অবস্থায় এসেছে| বিভিন্ন সময়ে ৫ জন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী বিবর্তনের মতবাদটি নতুন ভাবে তুলে ধরার এবং যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে কাজ করেন| তারা হচ্ছেন, ফ্রান্সের Georges Louis de Buffon (১৭০৭-১৭৮৮) এবং Jean-Baptiste de Lamarck (১৭৪৪-১৮২৯), ইংলেন্ড এর Charles Lyell (১৭৯৭-১৮৭৫), Charles Darwin (১৮০৯-১৮৮২) এবং Alfred Russel Wallace (১৮২৩-১৯১৩)| তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ডারউইন এর জন্মের অনেক আগে থেকেই এই ধারণাটির পেছনে কাজ চলেছে| তাহলে শুধুমাত্র বিজ্ঞানী ডারউইন এর বিরুদ্ধাচারণ এতটা প্রকট কেন? কারণ হিসেবে বলা যায়, ডারউইন তার ও তার পূর্ববর্তী সময়ের কাজগুলোকে প্রমানসাপেক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নথিবদ্ধ করে বিবর্তনের ধারনাটিকে একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ অথবা তত্ত্বতে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছেন|

Buffon ছিলেন সর্বপ্রথম প্রকৃতিবিদ যিনি প্রস্তাব করেন, জীব জগতের বিবর্তন সম্ভব| কিন্তু তিনি তার এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমান কিংবা একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করে যেতে পারেননি|

Lamarck ছিলেন তার যোগ্য উত্তরসূরী| যিনি Buffon এর ধারণা ও কাজটি যেখানে অসম্পূর্ণ ছিলো সেখান থেকে কাজ শুরু করে এগিয়ে নিয়ে যান এবং তিনি জীবজগতের বিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন| তিনি এটি সর্বপ্রথম ১৮০১ সালে একটি বই হিসেবে প্রকাশ করেন এবং আরও বিস্তারিত ভাবে আর একটি বই প্রকাশ করেন ১৮০৯ সালে| Lamarck জীবের দৈহিক গঠনের উপর কাজ করেন এবং তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন| (মজার বিষয় হচ্ছে, ১৮০৯ সালেই Darwin এর জন্ম|) তিনি প্রানীদের দৈহিক গঠনের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি ধারণার প্রস্তাব করেন যে, যেসব প্রাণীর (যেমন-কুকুর এবং বিড়াল) দৈহিক গঠনের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান, তাদের পৃথিবীতে অবস্থানগত সময়সীমার মধ্যেও সাদৃশ্য আছে বা তারা প্রায় একই সময়সীমার মধ্যে পৃথিবীতে বিচরণ করে থাকে| তিনি আরও বলেছিলেন যে, দৈহিক ভাবে বৈসাদৃশ্য প্রাণীর (যেমন- ঘোড়া এবং কীট) পৃথিবীতে বিচরণের বা উত্পত্তির সময়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান| এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, যথেষ্ট সময়ের ব্যাবধানে এক ধরনের জীব অন্য ধরনের জীবে বিবর্তিত হতে পারে| তার মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবীতে কোনো প্রাণী সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়না, বরং তারা বিবর্তিত হয়ে অন্য ধরনের জীবে পরিণত হয়| কিন্তু পরবর্তিতে তার এই ধারনাটি ভ্রান্ত প্রমানিত হয়, এখন আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানি যে, সময়ের সাথে সাথে কোনো একটি বিশেষ প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়| এমন অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এদের কোনো বংশধরও নেই| তিনি আরও প্রস্তাব করেছিলেন যে, জীব জগতের বিবর্তন কোনো কারণ ছাড়াই ঘটে না, এর পেছনে থাকে সুনির্দিষ্ট কারণ অথবা লক্ষ্য| আর এভাবেই ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে সর্বোচ্চ সঠিক পর্যায়ে রুপান্তরিত হয় যেমন- মানুষ| কিন্তু তার এই ধারণাটিও ভ্রান্ত প্রমানিত হয়, এখন আধুনিক বিজ্ঞান মানুষ প্রজাতির বর্তমান পর্যায়কে সর্বোচ্চ সঠিক বলে নির্দিষ্ট করে কখনই একটি কীট এর বিবর্তনের সাথে এর তুলনা করে না| বরং সব প্রজাতির জীবেরই তাদের বিবর্তনের নির্দিষ্ট ধারা ও প্রক্রিয়া রয়েছে| Lamarck গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এর "Great Chain of Being" এই ধারনাটি যা কিনা St.Thomas Aquinas (১২২৫-১২৭৪) আরও এগিয়ে নিয়ে যান, এর মাধ্যমে কিছুটা অনুপ্রানিত ছিলেন| Lamarck সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী যিনি বিবর্তনকে একটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন|

Lyell একজন অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন যিনি পরবর্তিতে ভূতত্ত্ববিদ্যার দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি পৃথিবীর বয়স ও প্রানের উত্পত্তির সময়কাল নিয়ে কাজ শুরু করেন| তিনিই প্রথমে প্রাণীর প্র্স্তুরিভূত দেহবশেষ বা ফসিল নিয়ে কাজ করতে যেয়ে ধারণা করেন যে, মাটির নিচে বিভিন্ন স্তরে জমা হওয়া ফসিল এর সাথে এদের বিচরণের সময়সীমার মিল আছে| তিনি ধারণা করেন,, যে ফসিল মাটির উপরের দিকে স্তরে অবস্থিত তার থেকে মাটির আরও নিচের দিকের স্তরে অবস্থিত ফসিল এর বয়স বেশি এবং সেই প্রাণীর পৃথিবীতে বিচরণের সময়কালও বেশি পুরনো| এর পিছনে পৃথিবীর ভুস্তরের ধাপে ধাপে পরিবর্তন ও পরিশোধনের প্রভাব রয়েছে বলে বুঝতে পারেন| কিন্তু তার পক্ষে ভূতাত্ত্বিক সময়কাল যাচাই করা সম্ভবপর ছিলোনা প্রযুক্তির অভাবে| ১৯০০ শতাব্দীর দিকে প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভূস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সময়কাল নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া সফল হয়|

Charles Darwin বিবর্তনের ধারণাটির পেছনে প্রমান-তথ্য পর্যবেক্ষণ ও জোগাড় করতে H.M.S. Beagle নামের একটি জাহাজ নিয়ে দক্ষিন আমেরিকার Galapagos দীপপুঞ্জে যাত্রা করেন এবং যথেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করেন| পরবর্তিতে তিনি On the Origin of Species নামের একটি অসাধারণ বই প্রকাশ করেন যা জীবজগত সম্পর্কিত প্রচলিত ধারনাকে পরিবর্তন করে এবং যথেষ্ঠ বিতর্কের জন্ম দেয়| তাই দেখা যাচ্ছে যে, বিবর্তন- এই ধারনাটি Darwin আবিষ্কার করেননি, তার অনেক আগেই এই ধারণার উপরে কাজ হয়েছে| বরং Darwin বংশানুক্রমিক বিবর্তনের ধারণাটির উদ্ভাবক| তিনিই সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে, একটি প্রজাতি তার পূর্বপুরুষ থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়| এই ধারণার সাথে তিনি আর একটি যুগান্তকারী ধারণার উদ্ভাবক, সেটি হচ্ছে "প্রাকৃতিক নির্বচন", এটির একটি সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে, জীব তার পারিপার্শিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয় এবং একটি প্রজাতি থেকে শাখা-প্রশাখায় আরও প্রজাতি বিস্তার লাভ করে| তাই Darwin এর উদ্ভাবন হচ্ছে দুটি- ১. বংশানুক্রমিক বিবর্তন ও ২. প্রাকৃতিক নির্বচন| যার মধ্যে ২য় ধারনাটি অধিকাংশ সময় ভুল ভাবে ব্যাবহৃত এবং অধিকাংশ মানুষ এর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পোষণ করেনা|

Darwin একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখির (Finche) ২টি আলাদা বংশধর পর্যবেক্ষণ করেন| বংশানুক্রমিক বিবর্তন এই পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করা সম্ভব| তিনি লক্ষ্য করেন, ২টি বংশধরই একটি পূর্বপুরুষ থেকে সময়ের সাথে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছে| যাদের একটির আছে কিছুটা পাতলা বা হালকা চষ্ণু অন্যটার ভারী| তিনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ্য করেন যে, ভারী চষ্ণুর বংশধরটি গাছের শক্ত বীজ খেয়ে জীবন ধারণ করে আর পাতলা চষ্ণুর বংশধরটি গাছের নরম বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে| তার মানে সময়ের সাথে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির Finche থেকে খাদ্যাভাসের উপর ভিত্তি করে কিছুটা দৈহিক গঠনের পরিবর্তনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে ২টি আলাদা বৈশিষ্ট্যের বংশধর উত্পত্তি হয়েছে| এই বিবর্তনটি প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে| যেখানে নরম বীজ অপ্রতুল সেখানে পাতলা চষ্ণুর Finche এর সংখ্যাও কম এবং সেখানে ভারী চষ্ণুর Finche ভালোভাবে বংশ বিস্তার করেছে| আবার উল্টোটাও দেখা গেছে যেখানে শক্ত বীজ অপ্রতুল| তাই দেখা যাচ্ছে যে, পারিপার্শিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করেই প্রাকৃতিক ভাবে বিবর্তন ঘটে থাকে এবং এই বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হয়| ঠিক একই ভাবে প্রাণীজগতের অন্যান্য জীবও তাদের বাসস্থানের পরিবেশের উপর ভিত্তি করে বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হয়, তাদের এই দৈহিক পরিবর্তন ধাপে ধাপে ঘটে থাকে যা তাদের পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত|পরবর্তিতে আরও উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হবে|


তাহলে একটি ধারণা পাওয়া গেলো যে, বিবর্তন একটি সুপ্রাচীন ধারণা| আর এর উদ্ভাবক Darwin নন| বিবর্তন বর্তমানে শুধু ধারণা নয়, এটি একটি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত তত্ত্ব| তাহলে সরল ভাবে বলতে গেলে, বিবর্তন হচ্ছে জীবজগতের সময়ের সাথে ধাপে ধাপে পরিবর্তন| এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, কোনো প্রজতির শুধুমাত্র একটি প্রাণী বিবর্তিত হয়না, পুরো একটি অংশ বা দল বিবর্তিত হয়| আর তাদের এই বিবর্তন সম্পূর্ণভাবে তাদের পারিপার্শিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল, যা কিনা তাদের জীবন যাপনের ধরণ থেকে শুরু করে তাদের বংশবিস্তার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে| জৈবিক বিবর্তন সামাজিক, অর্থনৈতিক অথবা সাংস্কৃতিক বিবর্তন থেকে আলাদা| জৈবিক বিবর্তনকে কখনই সামাজিক বিবর্তনের সাথে তুলনা করা সঠিক নয়| জীবের জন্ম ও বিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা সময় সাপেক্ষ এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল| তাই একটি প্রজাতির ধাপে ধাপে বংশানুক্রমিক পরিবর্তন অনেকটা সময় জুড়ে থাকে, তাই বিভিন্ন সময়ের বংশধরদের ফসিল থেকেই এদের পরিবর্তনের মধ্যে সেতুবন্ধন করা সম্ভব|

পরবর্তিতে ধাপে ধাপে বিবর্তন তত্ত্ব ও এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় এবং এর সাথে সামাজিক প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ আলোচনা করা হবে|