Friday, December 16, 2011

আত্মত্যাগ

ভারী আওয়াজ তুলে সাঁজোয়া গাড়ির বহরটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দিকে আসছে, গাড়ির উপরে বসানো মেশিনগান আর সেনাদের বন্দুকের চকচকে বেয়নেটগুলো আলো-আঁধারীতে এক নারকীয় আবহ তৈরী করছে| নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতা কায়েম করার এক পৈশাচিক আনন্দে তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চোখ হায়েনার মতো জ্বলন্ত| বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে- শুরু করেছে "অপারেশন সার্চলাইট" নামক পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে জঘন্যতম গণহত্যা| গাড়ির বহরটা তখন ঢুকছে ছাত্র হল গুলোর দিকে, আর রাস্তার ভিত পলায়নপর মানুষগুলোর দিকে চলছে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ, এরই মাঝে বহরের প্রথম গাড়িটার সামনে এসে দাড়ালো এক তরুণী| গুম গুম শব্দ তুলে চাকার নিচে পিষে ফেলতে এগিয়ে এলো ধাতব যন্ত্রটা, আর ঠিক তখন প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে উড়ে গেলো যন্ত্রদানব, মুহুর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল| বুকে বিস্ফোরক বেঁধে সাঁজোয়া গাড়ির নিচে আত্মাহুতি দিয়ে প্রথম প্রতিরোধের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা| ঠিক কতটা সাহস আর মাটির জন্য ভালোবাসা থাকলে এভাবে আত্মত্যাগ করা যায় তা পৃথিবীর কোনো বর্ণমালা লিখে বোঝাতে পারবেনা, কোনো ভাষা পারবেনা এই সাহসিকতার বর্ণনা দিতে, কোনো বিশেষণে দেওয়া যাবেনা এর তুলনা| গ্রামের বড় মাঠটা পেড়িয়ে আসার চেষ্টায় মরিয়া পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী, এপাশ থেকে আমরণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা| গুলি, মর্টার, গ্রেনেড এর শব্দে তখন চারিদিক বিভীষিকাময়| বারবার পেছাতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা| মাটি কাঁমড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিযোদ্ধারা, মাঝখানের জায়গাটুকুতে মাইন পেঁতে রেখেছে তারা| এরই মধ্যে পাকিস্তানিদের সাহায্যে এগিয়ে এলো ভারী ট্যাঙ্ক| ঘর্ঘর যান্ত্রিক শব্দ তুলে মৃত্যুদূতের মতো মাঠ পেড়িয়ে আসতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে, আর তার আড়ালে এগিয়ে আসতে থাকলো পাকিস্তানি সৈন্যরা| মর্টার এর প্রচন্ড শেলিং আর ট্যাঙ্কের সামনে পিছু হটতে বাধ্য মুক্তিযোদ্ধারা, ভরসা শুধু একটু দূরের পেঁতে রাখা মাইন| কিন্তু মাইন বিস্ফোরিত হলনা, ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসতে থাকলো, এখান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার একটাই মানে পুরো এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের দখল| হঠাৎ পাশ থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো কে যেনো, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী ১০ বছরের লালু| বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে সেদিন যে বীরত্বগাঁথা লালু রচনা করে গিয়েছিলো তা বর্ণনা করার সামর্থ্য কার আছে? মাত্র ১০ বছরের শিশুর আত্মত্যাগে সেদিন যে আগুন জলে উঠেছিলো সহযোদ্ধাদের মনে, তার সামনে দাড়াতে পারেনি পাকিস্তানি সেনারা, কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো সব প্রতিরোধ, মুক্ত হয়েছিল অঞ্চল| মাটির মূল্য সেই শিশুটির থেকে ভালো আর কে জানে? ৩রা ডিসেম্বর, ভোরবেলা নবীগঞ্জ থানা মুক্ত করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো ৫নং সেক্টরের কোম্পানী কমান্ডার, মুর্শেদ ইউ জামান রশিদ এর নেতৃত্বে ৩৬ সদস্যের মুক্তিবাহিনী, তার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড চার্জ করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য একজন, একটি গুলি এসে মাথায় লাগে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেই অকুতোভয় কিশোরের| শহীদ হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব| শ্রমিক পিতার সন্তান ধ্রুব স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেনি, কৈশোরের চাঞ্চল্যের জীবন ছেড়ে হাতে নিতে হয়েছিল বন্দুক-গ্রেনেড, লড়তে হয়েছিল নরপিচাশদের সাথে| নিজে আত্মত্যাগ করে আমাদের সুযোগ করে দিয়ে গেছে টকটকে লাল সূর্যের আভায় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার| জামালপুর জেলার সদর উপজেলার ইটাইল ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের কাছাকাছি এক স্কুল ঘরে রাতের বেলা গোপন মিটিংয়ে জমায়েত হয়েছে পাকিস্তানিদের দোসর এদেশের শান্তি বাহিনীর কিছু সদস্য, এখবর পেয়েই আর অপেক্ষা করেনি হালু| কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হালু তখন সবেই যুদ্ধশেষে গ্রামে ফিরেছে| রাতের বেলা একাই চলে গিয়েছিলো ওদের প্রতিরোধ করতে, গভীর রাতে শোনা গিয়েছিলো গোলাগুলির আওয়াজ|পরের দিন সকালে মাঠের পাশে পাওয়া গিয়েছিলো কিছু রাজাকারের লাশ| শুধু পাওয়া যায়নি হালু'কে| ১৬ই ডিসেম্বরের মাত্র কয়েকদিন আগে এভাবেই হারিয়ে গেলো মাত্র ১৫/১৬ বছরের অসীম সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হেলাল উদ্দিন| না, বহু বছর পরেও তার খোঁজ মেলেনি| ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে সেদিন প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা, সাভারের উপকন্ঠে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম| কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ভারী মেশিনগানের সামনে অবস্থানগত কারণে বেকায়দায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ| ভারী মেশিনগান বন্ধ করতে না পারলে এগোনো যাচ্ছেনা, এই বার্তাটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে অন্য দলটির দিকে এগিয়ে যেতে গেলো কিশোর টিটো| সাথে সাথে একঝাঁক বুলেট এসে মাটিতে শুইয়ে দিলো ওকে| বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে, ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ হলো গোলাম দস্তগীর টিটো| সেদিন কিশোর সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে পাগলপ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সব নিয়ম ভেঙ্গে অতিমানবীয় ভাবে পরাস্ত করেছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে| মৃত্যুর আগে টিটো বলেছিলো, "বাচ্চু ভাই, আমাকে বাচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই"| না, টিটো বাঁচেনি, দেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত করে দিয়ে সেদিন ও চলে গিয়েছিলো| বুকে একঝাঁক বুলেট নিয়ে স্বাধীন দেশে, সাভারের ডেইরি ফার্মের কাছে শুয়ে আছে টিটো| "স্বাধীনতা"-শব্দটা কতটা শক্তিশালী, কতটা গভীর| ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া না পাওয়া এরকম অজস্র শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা| রক্তস্নাত দেশের মাটির প্রতিটি শস্যকনা শহীদদের স্বপ্নের কথা বলে, বাতাস প্রতিনিয়ত গেয়ে যায় তাদের না গাওয়া গান| ৩০ লক্ষ্ শুধু একটি সংখ্যা বা হিসেব না, ৩০ লক্ষ্ মানুষের না দেখা বিজয়, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা সব| ৩০ লক্ষ্ শহীদের অস্তিত্বের অংশীদার আমরা সবাই| এরকম অসংখ্য বীরসন্তানের প্রানের বিনিময়ে যে কষ্টার্জিত বিজয়, তা শুধু কাগজে-কলমে নয়, এ বিজয় দেশের প্রতিটি মানুষের প্রানের সাথে মিশে আছে| তাই কোনো স্মৃতিফলকে তাদের নাম থাকুক বা না থাকুক, আমাদের কাছে তারা গল্পের স্পার্টাকাস-একিলিসের থেকেও অনেক বড় বীরসন্তান| প্রমিথিউসের মতো তারাও ছিনিয়ে এনেছিলো স্বাধীনতার লাল সূর্য| বছরের পর বছর বহু ঘটনা ঘটবে, নষ্ট রাজনীতি হবে, ইতিহাস বদলে দেওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা হবে, কারণ কিছু মানুষ ভুলে যাবে শহীদের নাম মুছে দেওয়া হয়তো যায় কিন্তু মুছে দেওয়া যায়না তাদের দেখা স্বপ্ন, তাদের চেতনা| তাই বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আজকের ভোরের সূর্যটা তাদের বুকের রক্তেই আরও রাঙ্গা হয়ে উঠবে, আর আমরা তাদের চোখে দেখা স্বপ্নকে পূরণ করতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবো|

1 comment:

  1. ধন্যবাদ, আপনাকে শহীদ হেলালকে নিয়ে লেখার জন্য ।
    শহীদ হেলালের স্বজনরা সবাই স্চ্ছল । অথচ তার স্মৃতি রক্ষার্থে কিছুই করা হয়নি ।
    দয়াকরে আপনার কন্ট্রাক নাম্বারটা দিবেন ।

    ti.tazul@yahoo.com

    ReplyDelete