Monday, September 26, 2011

বিসর্জন




হালকা হালকা বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলগুলো দুলছে, আকাশেও সাদা সাদা মেঘ, বছরের এই সময়টা খুব ভালো লাগে হৈমন্তীর| মাটিতে শুয়ে আনমনে কি সুন্দর আকাশটা দেখা যায়, কখনো কখনো মেঘ দিয়ে কি সুন্দর হাতি-ঘোড়া, আরও কতকিছু যে তৈরী হয়ে যায়, সবাই কি তা বোঝে? যখন বিলের ধারে ঘুরঘুর করে তখন হঠাৎ কখনো একটা সাদা বক সাই করে উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে, আর ঠিক বিলের মাঝখানটায় টুক করে বসে খপ করে একটা মাছ ধরে নেয়| কত মজার মজার জিনিস দেখা যায় নদীর কাছের জঙ্গলটায়, যে না গেছে সে কি করে জানবে? একটা বড় গাছ অনেক দিন হলো ভেঙ্গে গেছে, অর্ধেকটা পাড় এর জল ছুইছুই, সেটার উপর বসে একলা একলা পা দোলাতে ভালই লাগে| হৈমন্তীর এই ভালো লাগা গুলো ওর মা বুঝলে তো|

মাকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ, সংসারের কাজ সামলাতে হিমশিম তো খেতেই হয়, তার উপরে এতগুলো মানুষের খাবার জোটাতে গেলে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়| মা তাই সকাল থেকেই হয়রান থাকে, আর ও সামনে গেলেই এটা ওটা কাজ ধরিয়ে দেবে, ও তাই সকাল বেলাতেই এক দৌড়ে নদীর পাড়| তার উপরে পূজো আসছে, গ্রামের বড় বাবুদের বাড়িতে হই হই ব্যাপার| অনেক বড় সামিয়ানা টানানো হয়েছে, রাত দিন কাজ চলছে, বড় বড় গাড়িতে বোঝাই করে জিনিস আসছে| ওরা ছোটরা দল বেঁধে দেখতে গেলে, গেটের দারোয়ানটা ঢুকতেই দিলনা| তাই তো বুদ্ধি করে ওরা পাশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিলো| ওদের চোখে বিশ্বাস হয়না, কত্তো বড় প্রতিমা, কি সুন্দর গায়ের রং| আর সবাই কি রকম দৌড়ে দৌড়ে সাজাচ্ছে| সে এক বিশাল ব্যাপার|

হৈমন্তীর মনে পরে, আগে এত অভাব ছিলনা ওদের| আসলে অভাব কি জিনিস মা কখনো বুঝতেই দেইনি| ওর দিদা বলতো, হেমন্তে জন্ম বলে ওর নাম রাখা হয়েছিল হৈমন্তী| আরও বলতো অনেক ধান কাটা হত তখন গ্রামে, কি সুন্দর মেলা চলতো| ওদের বাড়িতেও অনেক মজা হত| পুজোতে নাকি ওর বাবা সবার জন্য নতুন জামা আনতেন| ওকে বাড়িতে সবাই হেমু হেমু বলেই ডাকে| ওর মনে পরে, ওরা ছোটরা নতুন জামা পরে পুজোর দিন দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো| সাথে থাকতো মায়ের দেওয়া খুচরো টাকা, ওরা মাঝে মাঝে বাজি-পটকা কিনতো, কখনোবা খাবার জিনিস| তারপর সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যার সময় যখন বড় বাবুদের বাড়িতে আলো জ্বলতো তখন এক দৌড়ে ওখানে, বড় বড় প্রদীপের আলোয় প্রতিমার মুখটা কি সুন্দর লাগতো, দূর থেকে অবাক হয়ে দেখত ওরা| এভাবেই হই-হই, রই-রই করে পুজোর চারটা দিন পাড় হয়ে যেতো, টেরই পাওয়া যেতোনা| আর বিসর্জনের দিন নদীর পাড়, অনেক লোক, দূর্গা মায়ের বিদায়, মায়েদের চোখের জল, সেগুলো এখনো মনে পরে|

কিন্তু সব কিছু ঠিক থাকলেও, ওদের বাড়িটা ঠিক নেই, এখন আর আগের মতো পুজোয় নতুন জামা আসেনা, মায়ের হাতের নাড়ু মোয়া এখন আর চোখে দেখা হয়না, বাবার চোখটা ওদের সামনে আসলেই কেমন যেনো ছল ছল করে| বড় ভাই কাজের খোঁজে শহরে গেছে, ও পুজোতে বাড়ি আসেনা| এখন আগের মতো বাড়িতে রান্না হয়না, কখনো কখনো ওর খাওয়া হয়না, আর পুজোর সময়টা বাড়িতে সবাই কেমন যেনো মনমরা হয়ে থাকে| ছোট ভাই গুলো পুজোর আগ দিয়ে অনেক চেচায়, আবদার করে, তারপর এক সময় নিজেরাই ক্ষান্ত দেয়| আগে দল বেঁধে খেলতো, ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু ওর বন্ধুগুলো বাবা-মার সাথে একে একে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলো| ওর নিজের বুদ্ধিতে কুলোয়না, কেনইবা সবাই পরিচিত জায়গা ছেড়ে, আপন মানুষ ছেড়ে, অন্য অচেনা জায়গায় যায়| তাইতো এখন পুজোতে একা একাই ঘুরতে হয়|

দেখতে দেখতে এবারের পূজোও চলে এলো, বড় বাবুদের বাড়িতে সবাই এসেছে| দামি দামি, বড় বড় গাড়িতে করে অনেক লোকজন| ওর মতো অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে মেয়েও এসেছে দেখলো| সবার হাসি খুশি চেহারা দেখলে মজাই লাগে| ষষ্ঠীর দিন থেকে ঢাকের বাদ্য শুরু হয়, বাতাসে কি সুন্দর ঘ্রাণ, ধুপের ধোঁয়ায় দেখাই যায়না কিছু| ও মাঝে মাঝেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে, ভিতরে কত্তো আয়োজন, আর সব থেকে মজার কথা হলো, প্রতিমার সামনে কি সুন্দর করে সাজানো খাবারের থালা| সুন্দর গন্ধে এভাবেই পেট ভরে যায়| বাড়িতে আসে সন্ধ্যার পরে, মা দেখতে পেয়েই আচ্ছা করে কান মলে দিলো| সারাদিন ঘুরে বেড়ালে কি চলে, বাড়ির কাজটাও দেখতে হবে যে| হেমুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো, একে তো পুজোর সময়, সারাদিন পেটে কিছুই পরেনি, তার উপরে এরকম করলে কেমন লাগে? আর ও করবেই বা কি, বাড়িতে থাকলেই মন খারাপ হয়ে যায়, অভাব জিনিসটা এখন বেশ ভালই বুঝতে পারে ও| তা থেকে নদীর ধারের জঙ্গলের ওর প্রিয় জায়গাটাতেই ভালো, আকাশ দেখেই কি রকম সময় কেটে যায়|

দেখতে দেখতে এক এক করে, সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর দিন গুলো চলে যায়, আগের মতো ঘোরা হয়না, তবুও বাবুদের বাড়ির পুজোর আয়োজন চোখে পরে| নতুন জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় সবাই, চার পাশে দোকান সাজিয়ে বসে অনেকে| হেমু ঘুরে ঘুরে সব দেখে, কিন্তু আধ পেট খেয়ে কি এসব দেখে মন ভরে?

দশমীর দিন, দেবীর বিদায়ের প্রস্তুতিতে সবাই ব্যাস্ত| সকাল বেলাতে মায়ের কাছে একগাদা বকা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ, দশমীর দিনটাতে এভাবেই মন খারাপ থাকে, চারিদিকের হৈচৈ আজকেই শেষ হয়ে যাবে, এসব ভেবে হেমুর মন আরও খারাপ হয়ে যায়| খিদে ভুলে থাকার এই কটাদিন নেহায়েত মন্দ ছিলনা, সবার উপর অভিমান হয় খুব, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে একা|

বাবুদের বাড়ির প্রতিমা নিয়ে শেষ বিকেলে নদীর ধারে আসে সবাই, মায়ের বিদায়ের ক্ষণে মন খারাপ সবারই| দেখতে দেখতে প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যায়, মাটির প্রতিমা জলে ভেসে যেতে থাকে দূরে| বিসর্জন শেষে একে একে বাড়ির দিকে ফেরে সবাই| সন্ধ্যা হয়, অন্য দিনের চেয়ে সন্ধ্যার আলোটা বেশি গম্ভীর, হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়া পুজোর বাড়ি থেকে বিদায় নেয় সবাই| মন্ডপে টিমটিম করে জলতে থাকা শেষ প্রদীপের আলোটা শুধু মনে করিয়ে দিতে থাকে মাত্রই অতীত হয়ে যাওয়া জীবনের গল্পটা|

সেদিন আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেনি হৈমন্তী, অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি কোথাও| হন্যে হয়ে খুঁজেছিলো সবাই, মা কেঁদেছিলেন খুব| শেষমেষ অনেক পরে মাঝনদীতে ওর নিথর দেহ খুঁজে পেয়েছিলো নৌকার মাঝিরা, কেও বুঝতে পারেনি কি করে মারা গেলো হেমু, মা-বাবা শোকে স্তব্দ হয়ে গেলেন, গ্রামের লোকেরা ভাবলো বিসর্জন দেখতে গিয়ে জলে পরে গিয়েছিলো হয়তো, এত ভিড়ের মাঝে কেও দেখতে পায়নি|

কিন্তু কেও বুঝলোনা অনেক না বলা অভিমান আর পেটে খিদে নিয়ে, এই ছোট্ট মেয়েটা দশমীর দিন দেবীর বিসর্জনের সাথে সাথে নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিয়ে দিলো| অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের বার্তা নিয়ে দেবী এলেও সেটা হৈমন্তীর জীবনে পৌঁছেনি, বরং বাস্তব জীবনের কোলাহল আর প্রতিমুহুর্তের বেঁচে থাকার আকুতি  থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াটাই অনেক সহজ মনে হয়েছিল ওর| কেও বুঝলোনা, খেয়ে না খেয়ে, বেঁচে থাকার যুদ্ধে কখনো কখনো দেবীর জয় হয়না|

[
গত বুধবার সোনাবারু নামের মেয়েটির নাকি জন্মদিন ছিল, কিন্তু বাড়িতে ভাত খেতে না পেয়ে, ক্ষিদের জালায় ১৩ বছরের ছোট মেয়েটি আত্মহত্যা করে|
তোকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারলামনা, দুবেলা ভালো করে খেয়ে অন্যদের মতো হাসি খুশি ভাবে জীবন কাটাতে পারলিনা, অভিমান করে তাই জন্মদিনটাকেই বেছে নিলি চলে যাওয়ার জন্য| এটা আমাদের ব্যার্থতা, আর এই লজ্জা সাথে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকবো| তোর জন্যে এই লেখা|]
   

Monday, September 12, 2011

মন ভালো নেই


মন ভালো নেই, তাই আকাশের নীল ঝাপসা কালো
  সোনালী রোদ হারায় মেঘে,
মন ভালো নেই, তাই স্বপ্নগুলোর ডানা ভেঙ্গে
   দুঃস্বপ্ন মুক্তি খোঁজে,
মন ভালো নেই, তাই ফুলগুলো সব শুকনো পাতা
   বসন্ত লুকোয় শীতের বুকে,
মন ভালো নেই, তাই দিনগুলো সব রাত হয়ে যায়
   সময়টাও উল্টো চলে,
মন ভালো নেই, তাই ঘরের কোনেই বন্দী জীবন
   নিজের ছাঁয়াও সঙ্গী খোঁজে|

নারী পাচারকারী চক্র এবং আমার অভিজ্ঞতা


২৫ আগস্ট, ২০১১

সন্ধ্যা হয়েছে, মাঠ থেকে খেলে মাত্রই হোস্টেলের রুমে ঢুকেছি দেখলাম মুঠোফোন বাজছে, কিছুটা বিরক্তি নিয়েই অপরিচিত নাম্বারটা ধরলাম, ওপাশ থেকে লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত এক অফিসারের গলা শোনা গেলো, কেমন আছি, কিরকম চলছে এই বৃত্তান্তের ধকল কাটিয়ে চিন্তা করছি কখন আসল কথায় আসবে, তখনি বলে উঠলেন, আমাদের এখানে তিনজন ইলিগ্যাল ইমিগ্রান্ট ধরা পড়েছে, তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তার উপরে তিনজনই নারী, তাদের ভাষা এখানে কেও বুঝতে পারছেনা, তাই পুলিশ কাজ এগোতে পারছেনা, লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচিত হলাম আমি, তাই আমাকে বললেন সাথে যেতে, ভাষা বুঝে তাদের তদন্তে সাহায্য করতে হবে| আমি ভাবলাম ভাষা বোঝা না হয় হলো, কিন্তু দেশের বাইরে এসে পুলিশের ঝামেলায় না জড়ালেই হলো| সাত পাঁচ ভেবে বলে দিলাম পরের দিন সকালে চলে যাবো অফিসে| রাতে জিনিসটা নিয়ে কয়েকবার ভেবেও এটা মাথায় এলোনা, দেশ থেকে এত দূরে ভারতের উত্তরপ্রদেশে মেয়েগুলো এলো কি করে???

২৬ আগস্ট, ২০১১

পরের দিন সকালে গিয়ে কাজ হলোনা, আবার দুপুরে যেতে হলো, বসে রইলাম তার অফিসে কতক্ষণ, এরপর বললেন যেতে হবে প্রধান থানাতে, বাইকে চেঁপে চললাম তার সাথে, ঈদ এর মাত্র কদিন বাকি, বাজারে প্রচন্ড ভিড়, লোকজন কেনাকাটা করছে, এলাহাবাদের চক বাজারের ভেতরে কোতয়ালি থানা, সেদিন ছিলো শুক্রবার, ঈদ উপলক্ষে এরমধ্যেই অজস্র পুলিশ মোতায়েন করা, গিয়ে ঢুকলাম তদন্তকারী অফিসারের রুমে, দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ভালই দৌড়ের উপরে আছেন ভদ্রলোক, আমাদের নিয়ে গেলেন পাশের বিল্ডিঙ্গের ডিআইজি এর দপ্তরে, তখনি লক্ষ্য করলাম অল্প বয়সী তিনটা মেয়ে বসে আছে, সাথে মহিলা পুলিশ, ডিআইজি তখন বাইরের ডিউটিতে, আমাদের বলা হলো বসতে, প্রচন্ড গরমে বাইরের ঘরে বসে আছি, মেজাজ খারাপ হতে লাগলো, সাহায্য করতে এসে কি বিশ্রী অবস্থা, এরই মধ্যে অফিসার কয়েকবার এসে অনুরোধ করে গেলেন না যাওয়ার জন্য, তারপর ঘন্টা তিনেক পরে একই সাথে ডিআইজি, মেজিস্ট্রেট, এসপি আরও বড়কর্তারা এসে হাজির, ডাক পড়লো আমার ভিতরে, মেজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তা আর একজন লেখককে নিয়ে বসলেন, আমাকে বললেন মেয়েদের একে একে সবাইকে নিজের নাম-ঠিকানা পরিচয় থেকে শুরু করে বিস্তারিত ঘটনা জিজ্ঞেস করতে, ভালো করে মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করলাম, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই কম বয়স, ততক্ষণে জেনে গেছি তিনজনকেই বাংলাদেশ থেকে এখানে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, চরম অত্যাচারের পর এরা কোনভাবে পুলিশের হাতে ধরা পরে নারী নিকেতন এ আসে|

তিনজনকেই একে একে জিজ্ঞেস করলাম সব কিছু, খুঁটিনাটি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার পরে মোটামুটি বক্তব্য দাড়ালো একই রকম-(নাম-পরিচয় ও ঠিকানা প্রকাশ করছিনা)

"তিনজনই ঢাকার কোনো গার্মেন্টস বা স্পিনিং কারখানায় কাজ করতো, এদের সবাইকেই অল্প পরিচিত অন্য আরেকজন মেয়ে ভালো কাজ দাওয়ার নাম করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়, তারপর খাবারের সাথে ওষুধ মিশিয়ে দাওয়া হয়, অজ্ঞান অথবা নেশা অবস্থায় তিনজনকেই বর্ডার পার করানো হয়, তারপর সেখান থেকে কোলকাতা, সেখানে একজন মহিলার বাসায় এদের রাখার পরে, সুবিধেমতো আবার ওষুধের প্রয়োগ করে ট্রেনে করে এদের নিয়ে আসা হয় এলাহাবাদে, এখানে একজন একজন করে তিনজনকেই বিভিন্নভাবে নিয়ে এসে বিক্রি করে দাওয়া হয় পতিতালয়ে, সেখানে একজন মহিলার অধীনে অনেকদিন ছিলো, জোর করে প্রতিদিন ১০-১২ এর অধিক মানুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে বাধ্য করা হত, সকাল ৮ টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো এই অত্যাচার| আর কথা না শুনতে চাইলে মারধর তো আছেই| ২ জনের বয়স ১৮ এবং একজনের ১৭ বলে জানালো ওরা|"

কথাগুলো ওদের মুখ থেকে শুনে চলেছি, এদিকে একের পর এক কাগজে কলম চালাচ্ছি, জবানবন্ধি তৈরী করছি, কিন্তু একসময় সত্তি মনে হলো কেও যেনো কানে গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে, পুলিশের পুরো জেরাটা করতে হচ্ছে আমাকে, সাথে উঠে আসছে অত্যাচারের বর্ণনা, একসময় মনে হলো না এলেই হয়তো ভালো করতাম| ততক্ষণে বেশ কয়েকদফা জবানবন্ধি নেওয়া হয়ে গেছে, মেজিস্ট্রেট চলে গেলেন কাগজে সই করে, আমাকে বলে গেলেন শেষ পর্যন্ত বসে সব কাগজে সই করে, জবানবন্দি যাচাই করে সবার টিপসই নিয়ে, আবার জবানবন্দি গুলোকে হিন্দিতে রূপান্তর করে দিয়ে যেতে| এরই মধ্যে মহিলা পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, অনেক সাহস করে এদের মধ্যে একজন, কারো মাধ্যমে ফোনে খবর দেয় থানাতে, তার খবরের ভিত্তিতেই পুলিশ হানা দেয়, উদ্ধার করে এই তিনজনকে| এদিকে কাজ চলছে, মাঝে মাঝে মেয়েগুলো দু-চারটা কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তাদের বার বার একই প্রশ্ন, ঈদ এর আগে বাড়ি যেতে পারবে তো?? আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারলামনা, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন পাশে বসে থাকা এসপি, বললেন কি হয়েছে, প্রশ্ন শোনার পরে তিনিও চুপ করে রইলেন, তারপরে আমতা আমতা করে বললেন, কি আর বলা যাবে বলো, এই কেস তো আমাদের হাতের না, ইন্টারপোল তারপর দু দেশের এম্বাসীর হাতে চলে যাবে এরপরে| জেনেও মিথ্যে বললাম, বললাম ওদের হয়ে যাবে, ঈদের আগেই যাবে দেশে, চিন্তা করোনা| তখন বুঝলাম কখনো কখনো মিথ্যে বলাটা আসলেই কষ্টের কাজ| ততক্ষণে আমি চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে পালানোর, প্রায় ৬ ঘন্টা ধরে বসে আছি এখানে| তারপর ঘন্টা সাতেক পরে একগাদা কাগজে সই করে, সব কাজ শেষ করে বের হলাম| তার আগে ওখানে বসে বসে শুনেছি পালের গোদাদের ধরার জন্য ঐদিন রাতেই পুলিশের হানা দাওয়ার প্ল্যান| শুনে এলাম তিনজনকেই এখানের আইনি কাজ শেষ হলে দিল্লি পাঠানো হবে, তখন দুই দেশের মধ্যে আইনি কাজ চলবে হস্তান্তরের| অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে বের হয়ে এলাম| পিছনে রেখে এলাম কিছু উত্সুক চেহারা, আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলা তিনটি মানুষ|

ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে আটটা ছুই ছুই করছে, সারাদিনে পেটে সরকারী চা ছাড়া কিছুই পড়েনি, এর মধ্যে ফেরত এলাম লোকাল ইন্টেলিজেন্স এর অফিসে, কথা হচ্ছিলো কিছু অফিসারের সাথে, সেখান থেকে বের হয়ে এলো আরও কিছু তথ্য, ভারতীয় বর্ডার সংলগ্ন দেশ গুলো থেকে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় অনেক মেয়ে, এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন শহরে, বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়, ভালো চাকরি বা ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, তারপর এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় পতিতালয়ে| এছাড়াও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মেয়ে শিশু জন্মের পরে হত্যা করা হয়, সেখানে মেয়ে সংখ্যায় এতই কম যে পুরুষদের বিয়ে হচ্ছেনা, তাই বাংলাদেশের বর্ডার সংলগ্ন জায়গাগুলো থেকে গরিব পরিবারের মেয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে মোটা টাকা দিয়ে, তাদের কে একই সাথে একাধিক পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি কখনো কখনো ৪/৫ জন পুরুষের সাথেও থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এরকম অনেক মেয়ে পালিয়ে আসতে যেয়ে খুন হয়ে যায়| এক অফিসার বললেন যারা পালাতে সক্ষম হয় তাদের ফেরত দিতে গেলে দেখা যায় তাদের পরিবারই খুশিনা, দারিদ্রের এমনি কষ্ট যে নিজের সন্তান ফিরে আসলেও টাকা আর পাবেনা এই দুঃখ থেকে যায়| সবার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে এই চক্র, তারপরও কোনো পদক্ষেপ নেই|

ইন্টেলিজেন্সের অফিস থেকে ফেরত আসছি আর মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এতদিন পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভিতে এরকম খবর অনেক দেখতাম, দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে যাওয়ায় চোখ এড়িয়েও যেত, কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতার পর পুরো সমাজ ব্যেবস্থাটাই একটু অন্যরকম লাগছে| নারী অপহরণ এবং নির্যাতনের এরকম ভয়াবহ রূপ সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিন দুঃস্বপ্নের ভেতরে তাড়া করে ফিরবে| দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী হওয়া সত্তেও দেশের নারী পাচার রোধে কতটুকু অগ্রসর হয়েছে আইন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়|

মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন| নারী পাচার ও নারী নির্যাতন রোধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার ও সমাজ সচেতনতা খুবই জরুরি| আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশগুলোতে দারিদ্রের কবলে আক্রান্ত পরিবারগুলো থেকে মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়, দেশের অজস্র সমস্যার সাথে এই বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখাটা একান্তই জরুরি| মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত রোধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও গভীর পর্যবেক্ষণ ও সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম গুলোতে নিয়মিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলোর কার্যক্রম জরুরি| শুধু ভারতেই নয় কিছুদিন আগে চাকরির নামে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ গুলোতে যৌনদাসী হিসেবে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কাহিনীও নজরে এসেছে| শুধু সরকার নয়, সভ্য সমাজের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই কর্তব্য নারী পাচার এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো|

"সেই তিনটি মেয়ে কোথায় ঈদ করলো কোনদিনও আর জানা হবেনা|"

হিমালয়কন্যা : অনুরাধা কৈরালা


উপস্থাপিকার কন্ঠসর তখন আবেগে রুদ্ধপ্রায়, অডিটরিয়ামের কয়েক হাজার গন্যমান্য ব্যাক্তি তখন উঠে দাড়িয়েছেন শ্রদ্ধায়, টিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষের চোখ অশ্রুসজল, করতালিতে কেঁপে উঠছে পুরো অডিটরিয়াম, ধীর পায়ে তিনি উঠে এলেন মঞ্চে, উপস্থাপিকা আবেগে জরিয়ে ধরলেন তাকে, সম্মানিত অথিতি তার বক্তব্যে তুলে ধরলেন নারী-পাচারের চরম কিছু অংশ, সবাইকে অনুরোধ করলেন, প্রত্যেকটা মেয়েকে নিজের সন্তান হিসেবে চিন্তা করে তাদের কষ্ট অনুধাবন করতে, যেনো নিজের মধ্যে জাগ্রত হয় আত্মশক্তি, যেনো পুরো সমাজ রুখে দাড়ায় মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, নমস্কার জানিয়ে যখন কথা শেষ করলেন, তখন আবার পুরো অডিটরিয়ামের দর্শক উঠে দাড়িয়েছেন, টপ টপ করে চোখ থেকে জল পরছে তখন অনেকেরই, করতালিতে আবার কেঁপে উঠলো পুরো হল| এই দৃশ্য CNN Hero 2010 Award অনুষ্ঠানের| শ্রদ্ধেয় সেই নারীর নাম "অনুরাধা কৈরালা"|

১৯৯৩ সাল থেকে শুরু, অনুরাধা কৈরালা প্রতিষ্ঠা করেন "Maiti Nepal", একটি সাধারণ সংস্থা কিন্তু অসাধারণ একটি লক্ষ্য, নারী-শিশু নির্যাতন, পাচার রোধ এবং নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন| হিমালয়ের পাদদেশের ছোট্ট দেশ নেপাল, যার স্বর্গীয় সৌন্দর্য অজস্র পর্যটককে কাছে টানে, কিন্তু স্বর্গেও যেমন থাকে গড়ল, তেমনি এখানেও আছে কিছু অন্ধকার অধ্যায়| ভারত-নেপাল সীমানা দিয়ে পাচার হচ্ছে মানুষ| তারপরে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্বিষহ অন্ধকার এক জীবনে| নাম না জানা অজস্র নারী শিকার হচ্ছে নারী-পাচারের মতো ঘৃণ্য একটি অপরাধের| এসব নারীকে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে তারা শিকার হচ্ছে অমানবিক নির্যাতনের| অনুরাধা কৈরালা একটি নাম, একটি সাধারণ মানুষ, রুখে দাড়ালেন তিনি এর বিরুদ্ধে|

সেই থেকে যুদ্ধ শুরু, তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি ১২,০০০ এর বেশি মেয়েকে যৌনদাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করেছে, ৪৫,০০০ এর বেশি নারী-শিশুকে বাচিয়েছে পাচারের হাত থেকে, তার একার উদ্যোগে তিনি এক অসম যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এই ঘৃণ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে| নেপালের পাচারকারী চক্রের কাছে তিনি পরিচিত "Terminator" নামে| তার সহযোগিতায় নেপাল পুলিশ ৬৮৮ জন অপরাধীকে ধরতে ও সাজা প্রদানে সক্ষম হয়েছে| তার এই অসম সাহসী উদ্যোগ নতুন জীবন দিয়েছে অজস্র মেয়েকে, শুধু তাই নয়, যারা এইডস এ আক্রান্ত হয়ে এখানে আসে, তাদের পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে|

তার সংস্থার কিছু নারীর অভিজ্ঞতা শোনা যায় তাদের মুখ থেকে, যাদের অনেককেই ১০ বছরেরও কম বয়সে বিক্রি করে দেওয়া হয়, সেই বয়সেই তারা শিকার হয় পাশবিক নির্যাতনের, প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩৫ জন মানুষের হাতে নির্যাতিত হয়ে যখন তারা মৃত্যুর অপেক্ষায়, তখন অনুরাধা কৈরালার অসম সাহসী উদ্যোগের সাহায্যে তারা নতুন করে বাঁচতে শেখে|

অনুরাধা কৈরালা নিজেও তুলে ধরেন কিছু অভিজ্ঞতা, যেখানে নেপালে সাধারণ দাহকার্যের জন্য নেওয়া হয় ৮৫০ নেপালি রুপি, সেখানে এইডস এ আক্রান্ত কোনো নারী মারা গেলে তার দাহকার্য সম্পন্ন করতে দিতে হয় ৮,০০০ নেপালি রুপি| অনুরাধা অশ্রুসজল চোখে বলেন, যেখানে সমাজে নারী অধিকার নিয়ে এত তোরজোর চলছে, সেখানে তার মৃত্যুর পরে যদি এইভাবে অবহেলার শিকার হতে হয়, এটা কেমন সমাজ???

অনুরাধা কৈরালার কথা লিখতে বসলে কোনো বিশেষণ যথেষ্ট নয়, এই পরম শ্রদ্ধেয় নারী ভূষিত হয়েছেন ৩০ টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে, যার মধ্যে CNN Hero 2010 Award, 2010 Shinning World Compassion Award , 2010 Virag Social Service Award, 2010, “National Ideal Mother Award 2066” by Shishu Sewa Samittee, 2009 Outstanding Management Award, 2007 German UNIFEM Prize, 2007 Queen Sofia Silver Medal, 2006 The Peace Abbey, Courage of Conscience Sherborne, MA, USA, 2005 Eurasia Reiyukai Award, 2005 Rastriya Nari Samaan ইত্যাদি অন্যতম| এছাড়াও তিনি ২ বার নির্বাচিত হয়েছেন Most Influential Women of Nepal by Boss Reader's choice|

শুধু নারী-শিশুদের অধিকারের জন্যই নয়, সমাজ সেবাতেও তিনি রেখেছেন দৃষ্টান্তমূলক অবদান, নেপালের সরকারের পক্ষ থেকে তিনি আলোচনায় বসেছেন মাও বাদীদের সাথে, এছাড়াও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি ও সভায় অংশগ্রহন করেছেন, এর মধ্যে-

১.2008 The Global Initiative to fight Human Trafficking; Vienna Forum to Fight Human Trafficking, Vienna, Austria
২.7th International Congress on AIDS in Asia and the Pacific (7th ICAAP) Kobe, Japan July 2005
৩. 2003 Path breaking strategies in Global Fight against Sex Trafficking Washington D.C, USA, Feb 2003
৪.2000 Regional Co-operation Meeting, Action against Trafficking & Sexual Exploitation of Children (ATSEC) – Dhaka, Bangladesh
৫.1999 First Meeting of the NGO Planning Committee for the UN World Conference against Racism, Racial Discrimination, Xenophobia and Related Intolerance – Geneva, Switzerland
অন্যতম|

পেশায় ইংরেজি শিক্ষিকা অনুরাধা কৈরালার প্রতিষ্ঠিত "Maiti Nepal", শুধু একটি সংস্থার নাম নয়, এটি অজস্র নারীর জন্য জীবনের আশার প্রতীক| বর্তমানে ৩ টি prevention home, ৯ টি transit home, ২ টি hospice এবং একটি উচ্চবিদ্যালয় নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান অবিরাম কাজ করে চলেছে অসহায় নারী-শিশুদের জন্য| বিভিন্ন অঞ্চলে জনসচেতনতা সৃষ্টি, জনসংযোগ, উদ্ধার অভিযান, পুনর্বাসন, নারী-শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সহায়তা প্রদান এর মাধ্যমে তিনি অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন নারীদের জন্য| পাচাকারীদের বিরুদ্ধে তার এই যুদ্ধ জারি রয়েছে তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে|

সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত একজন অসাধারণ সমাজ সেবিকা হিসেবে, একজন প্রতিবাদী যিনি রুখে দাড়িয়েছেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা, তার সংস্থার মেয়েদের কাছে তিনি বড় বোন, তার স্নেহ যত্নে অসংখ্য নারী-শিশু ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো জীবন| যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে নারী-শিশু নির্যাতন ও পাচার রোধ করতে, সেখানে একা তিনি অসীম সাহসে রুখে দাড়িয়েছেন এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, তিনি প্রমান করেছেন, দৃঢ় মনোবল আর সদিচ্ছা থাকলে একজন মানুষই পারে পুরো সমাজকে বদলে দিতে| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১০ সারা বিশ্বের আরও ১০ জন এরকম যোদ্ধার সাথে CNN Hero 2010 Award এ ভূষিত অনুরাধা কৈরালার যুদ্ধ এখনো চলছে, শুধু পাচারকারীদের বিরুদ্ধেই নয়, ঘুনে ধরা এক সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে, যেখানে নারীকে মানুষ নয়, ভোগ পণ্য হিসেবে ব্যাবহার করে সভ্য সমাজ ব্যাবস্থার স্লোগান দেয় অনেক মুখোশধারী|

আজকে এই লেখার মাধ্যমে এই মহিয়সী নারীর প্রতি সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই|

সাধু গ্রেগরীর বকুলতলা


দিনটা ছিলো বুধবার| ব্রাদার হোবার্ট সকাল থেকেই চিন্তিত, একটু পর পরই ব্যালকনিতে যাচ্ছেন আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন| দেশের অবস্থা ভালো না, কখন কি ঘটে যায় কিছুই বলা যাচ্ছেনা| আবার এদিকে সকাল থেকেই মিলিটারির জীপ এদিক ওদিকে ঘুরছে, মাত্র ৬ দিন আগেই পাশের শাঁখারী বাজারে ওরা যে বিভৎস হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তিনি সেটা জানেন| কিন্তু তার চিন্তা অন্যখানে, স্কুলের কম্পাউন্ডের ভেতরে বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, তার উপরে তিনি নিজে স্কুলের তিনজন শিক্ষক আর তাদের পরিবারকে লুকিয়ে রেখেছেন উপরের ঘরে| কি যে হয় কিছুই বলা যাচ্ছেনা|

ব্রাদার রবার্ট এলেন, তাকে দেখেই ব্রাদার হোবার্ট বাইরের খবর জিজ্ঞেস করলেন| ব্রাদার রবার্ট মাথা নেড়ে বললেন, "নাহ তেমন কিছু জানা যায়নি| তবে মেইন গেট টা খোলা যাবেনা, যেভাবেই হোক স্কুলের ভেতরে কাওকে আসতে দাওয়া যাবেনা|" হোবার্ট চিন্তা মগ্ন হয়ে বললেন, "কেও কি শুনবে এই কথা?" ব্রাদার রবার্ট এর কপালেও চিন্তার ভাঁজ, তিনিও জানেন গেট বন্ধ করে কি আর এদের আটকে রাখা যাবে? তাও বললেন," কেন নয়, এটা মিশনারি প্রপার্টি, এটাতে নিশ্চয় ওরা আসার সাহস পাবেনা|" ব্রাদার রবার্ট মাথা নাড়লেন, ব্যালকনি থেকে ফিরে আসতে গিয়ে চমকে উঠলেন, দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে, ভারী আওয়াজ তুলে সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বড় মিলিটারি ট্রাক চলে গেলো, ট্রাকের উপরে মেশিনগান এর নলটাতে সূর্যের আলোটাও যেনো ভয় পেয়ে চমকে উঠছে|

মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্রাদার রবার্ট কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না| এতগুলো পরিবার, সহায় সম্বল ছেড়ে শুধু প্রাণ বাঁচাতে এখানে চলে এসেছে| স্কুলের দার্জিলিং বিল্ডিংটার নিচে ভিত সন্ত্রস্ত পরিবারের মানুষগুলো দিশে হারা| গুলির শব্দ এরাও শুনেছে, তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন তিনি| অভয় দিতে চেষ্টা করলেন, নিজেও জানেন যেই দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে এরা যাচ্ছে তা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেও দূর করতে পারবেনা| বুকের সামনে ঝোলানো বড় ক্রসটা মুঠোতে আঁকড়ে ধরলেন তিনি|


ব্রাদার হোবার্ট কথা বলছিলেন সূত্রধর স্যার আর পল স্যারের সাথে, যে করেই হোক সুযোগ পেলেই সবাইকে অন্য কথাও সরিয়ে ফেলতে হবে| এখানে আর মোটেও ভালো ঠেকছেনা, সকাল থেকেই কয়েকবার মিলিটারি জীপ ঘুরে গেছে| বলা যায়না ওদের কাছে খবর থাকতেও পারে| সূত্রধর স্যার বললেন, "মনে হয়না ওরা এতটা সাহস করবে, মিশনারি স্কুল এটা, এটাতে হামলা চালানো মানে তো অনেক বড় একটা ঘটনা|" পল স্যার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বল খেলার বড় মাঠটার দিকে, কি শুনশান জায়গাটা| অথচ দুপুরের এই সময়টাতে ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো, সাধু গ্রেগরীর ডানপিটে ছেলেগুলো দৌড়াতেও পারে, বড় হলের অজস্ত্র চ্যাম্পিয়নস কাপ আর শীল্ড গুলোর দিকে তার চোখ আটকে যায়| নিজের অজান্তেই কেন জানি তার সবকিছু খাপ ছাড়া, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে| পালমা স্যার শান্ত শিষ্ট মানুষ, পিছনে হাত রেখে একটু ঝুঁকে হাটেন| তিনিও উপর থেকে নিচে নেমে এলেন, কারো মুখে কথা নেই, শূন্য দৃষ্টির বিভিন্ন বয়সের মানুষ গুলো যারা অজস্ত্র ছেলেকে জীবনের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, তারাই আজ পথ খুঁজতে হিম-শিম খাচ্ছেন|

ব্রাদার রবার্ট বাস্কেটবল কোর্টটা হয়ে হল রুমের দিকে ফিরছিলেন, যান্ত্রিক শব্দে থমকে দাড়ালেন| মনে হলো গাড়িটা স্কুলের গেটটার সামনে দাড়ালো, ক্রসটা মনের অজান্তেই হাতের মুঠোয় চলে এলো তার| বিড় বিড় করছেন,"গড, স্যেভ আস"| যেমন থেমেছিলো তেমনি গাড়িটা আবার চলতে লাগলো, রবার্ট হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, কপালের ঘামটা মুছে এগিয়ে চলা শুরু করেছেন হল রুমের দিকে| বকুল তলাটা পাড় হয়েছেন, তখনি আবার ভারী যান্ত্রিক শব্দটা ঠিক গেটের সামনে থামলো| মাথা তুলে গেট এর দিকে তাকালেন, জলপাই রঙের ট্রাক আর তার উপরে কুচ কুচে কালো রঙের নলটা চিনতে তার দেরি হলোনা| মন্ত্র মুগ্ধের মতো তিনি গেটের দিকে এগিয়ে চললেন, ইউনিফর্ম পরা একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "দরওয়াজা খোলো, হুকুম হেয়, আন্দর আনে দো"| ফেস ফেসে আওয়াজে রবার্ট কোনমতে বললেন, "দিস ইজ আ মিশনারী প্রপার্টি, উই হেভ নো রিলেশন উইদ এনি পলিটিকাল ইন্সিদেন্তস, হয়ার ইজ ইউর সিনিয়র?" এবার গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন পেছনের জীপ থেকে নেমে এলো একজন, গেটের সামনে এসে বললো, "ব্রাদার, ডোন্ট ওরি, জাস্ট আ রুটিন চ্যেক, উই উইল নট ডু এনিথিং রং"| কোনো উপায় নেই, বুঝতে পারলেন| এদিকে জিপের শব্দে বাকি সবাইকে উপরে যেতে বলে বাইরে এসে দাড়িয়েছেন ব্রাদার হোবার্টও, আস্তে আস্তে তিনিও গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন, ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে জনা দশেক মিলিটারি স্কুলের জলের কলটার সামনে পজিশন নিয়েছে, দেখলেন ব্রাদার রবার্ট এর সামনে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে কথা বলছে অফিসার| অবাক হলেন, এত দশাসই চেহারার ব্রাদার রবার্টকে কেন জানি আর্মি অফিসারটার সামনে অনেক জরসর লাগছে| তাকে এগিয়ে যেতে দেখে অফিসারটা নিজেই এগিয়ে এলো, হাসি মুখে বললো, "ব্রাদার, দিজ প্লেস ইজ নাইস, বাট উই গট ইনফরমেশন, সাম পিপল আর হাইডিং ইনসাইড ইউর স্কুল", হোবার্ট কিছু বলার আগেই অফিসার হুকুম দিলো," সার্চ ইনসাইড"|


মিনিট দশেক পরে বকুল তলায় দাড়িয়ে আছে জনা বিশেক মানুষ, সবার সামনে দাড়িয়ে আছেন সৌম্য ভদ্র চেহারার তিনজন গম্ভীর মানুষ, সাথেই ভিত চেহারার দুজন তরুণ, অফিসার ব্রাদারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললোনা, জোরে হুকুম দিলো, "টেইক দেম অল"| ব্রাদার হোবার্ট হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন, এরা নিরীহ মানুষ, এদেরকে গ্রেফতার করার কোনো কারণ নেই| ব্রাদার কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসার| রবার্ট একবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, "ইউ কান্ট ডু দিস, হয়ার উইল ইউ টেইক দেম"| কর্কশ গলায় মাথা না ঘুরিয়েই অফিসার জবাব দিলো," দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস"| ততক্ষণে পিঠমোড়া বেঁধে ট্রাকে তোলা হচ্ছে সবাইকে, সূত্রধর স্যার যাওয়ার আগে ব্রাদারকে তার হাতের ঘড়িটা খুলে দিলেন কি মনে করে যেনো, পিঠে ধাক্কা মেরে তোলা হলো তাদেরও, খুব শান্ত চোখে ব্রাদার হোবার্ট এর দিকে তাকালেন পালমা স্যার| গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ব্রাদার দুজনেই দৌড়ে গাড়ির পেছন পেছন অনেকটা গেলেন| তারপর একরাশ কালো ধুয়া আর সব কিছুই আগের মতো শুনশান|


দিনটা ছিলো বুধবার, ৩১ শে মার্চ, ১৯৭১| খ্যাতনামা সেইন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে ওই দিন দুপুরে অনেকের সাথে, স্যার এন.সি.সূত্রধর, স্যার পল পালমা, স্যার ডি.এন.পাল চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সুবল ও উত্পল কে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী তত্কালীন জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পে| ব্রাদার হোবার্ট ও ব্রাদার রবার্ট এর অনেক চেষ্টা সত্তেও ঐদিন রাতেই সবার সাথে এই তিন শিক্ষক ও ছেলে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্থানি মিলিটারি| সেই বকুল তলাটা এখনো আছে, ঠিক তার নিচে লাল রঙের শহীদ মিনারটা| সাদা পাথরে, কালো কালিতে লেখা সবার নাম| স্বাধীনতার পরে সেই স্কুলের ছাত্র তাজউদ্দিন আহমেদ হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী| এখন বদলে গেছে অনেক কিছুই, দার্জিলিং বিল্ডিংটা এখন আর ব্যাবহার করা হয়না, নতুন বিল্ডিং হয়েছে, খেলার মাঠটাও বদলেছে| কিন্তু আছে সেই অতি প্রাচীন হলরুম আর সেই জলের কল| নুনে ধরা দেয়ালে পুরনো পুরনো গন্ধ| আর আছে সেই বকুল গাছ, তার নিচে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা লাল শহীদ মিনার|




আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর দানব


বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড, দেশের সাধারণ জনগনের মানবাধিকার এর বিষয়টিতে একটি বড়সড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে| দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগনের নজরে এসেছে, তাতে আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা প্রসঙ্গে আরেকবার বেশ ভালো ভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে বলে মনে হয়| আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে দেশের পুলিশ ও রেপিড একশন ব্যাটালিয়ন (RAB) এর কার্যক্রম সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে| দেশের সাপ্রতিক কিছু ঘটনায় বর্তমানে দেশে পুলিশের কার্যক্রম তাদের অতীত ইতিহাসকে ছাড়িয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে অবলোকন করা গেছে| বাংলাদেশ যখন দুর্নীতির দায়ে বারংবার বিশ্বে এক নাম্বারে স্থান পাচ্ছিলো তখনও বিভিন্ন কমিটির রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা গেছে, দেশের সর্বচ্চো দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এই পুলিশ| তত্কালীন ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশের ভাবমূর্তি বদলানোর জন্য তখন তাদের পোশাক পরিবর্তন করলেও এসব দুর্নীতির প্রশ্নে ছিলো চুপ, কোনো ধরনের কমিটির মাধ্যমে এই অভিযোগ গুলো যাচাই করার নুন্যতম প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি| পোশাক বদল হলে কি হবে, পোশাক যে পরিধান করছে সে অপরিবর্তনীয় থাকায় যেই লাউ, সেই কদুই থেকে গেছে|

তত্কালীন ক্ষমতাসীন সরকার আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি রোধ করতে এবং জঙ্গি দমনের লক্ষে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে গঠন করে RAB| বিভিন্ন সামরিক বাহিনী থেকে সদস্য সংযোজন করে গঠন করা এই বিশেষ বাহিনী উন্নত ট্রেনিং ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাঠে নামে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে| তখনকার ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনা এলাকায় বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো, এই জায়গাগুলোতে ঝটিকা কিছু অভিযানের মাধ্যমে RAB বিশেষ সাফল্য দেখায়| বেশ কিছু স্মাগলিং রিং এবং চরমপন্থী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অপারেশন সত্তি প্রশংসাযোগ্য| কিন্তু সমস্যা তৈরী হয় তার পরে, তত্কালীন সরকার সামাজিক ভাবে আইন শৃখলা পরিস্থিতি ঠিক করতে ব্যার্থ হয়ে, বিভিন্ন ভাবে RAB ও পুলিশকে দিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটাকেই একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করে| RAB এর ক্ষমতা বাড়িয়ে দাওয়া হয় বহুগুন, এবং একের পর এক ক্রস ফায়ার এর ঘটনায় সন্ত্রাসীর মৃত্যু হতে থাকে| তত্কালীন পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ জনগণ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই পথকে সমর্থন দিলেও, এর আরেকটি দিক চোখ এড়িয়ে যায়| বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়ানো ছেটানো ভাবে কিছু অপ্রাসঙ্গিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা চোখে পরলেও দেশের সুশীল জনগণ চোখ বুজে সেটা সহ্য করে যান এই ভেবে যে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তো হাফ ছেড়ে বাঁচা যাচ্ছে| স্কুলের বাচ্চাদের স্কুল বাস থেকে নামিয়ে প্রচন্ড রোদে কান ধরে উঠা বসা করানো, কোনো ভুল বোঝা বুঝিতে কাউকে অযথা পেটানো কিংবা কোনো অপারেশনে নিরীহ মানুষের মৃত্যু তখন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সকল দিক থেকেই| একের পর এক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা চোখে পরলেও এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া তো দুরে থাক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ধামা চাপা দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে| তখন সুশীল সমাজের কারো কারো এরকম বক্তব্য ছিলো যে সন্ত্রাসীদের আবার কিসের মানবাধিকার?

কিন্তু এই ধরনের বিছিন্ন কিছু ঘটনা আসলে ভবিষ্যতের যে মানবাধিকারের চরম বিপর্যয়ের ঘটনার হাতছানি ছিলো মাত্র, তা আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে| বরং RAB এর মতো দুর্দান্ত ও সক্রিয় একটি বাহিনী থাকায় আমরা অনেকেই খুশি হয়েছি| এই সংস্থাটির কার্যক্রম জঙ্গি দমনে ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখলেও, একই সাথে লাগামহীন বিচার বহির্ভুতু হত্যাকান্ডের জন্য প্রশ্নের উর্ধে নয়| আর সরকারী ভাবে এই ঘটনা গুলোর প্রতি কোনধরনের আইনি কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি, এমনকি এখন পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য সেরকম ভাবে কাওকে দোষীসাব্যস্থ করে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি|

এইবার দেখা যাক শুরু থেকে RAB এর কিছু কার্যক্রমের তথ্য, Amnesty International এর পরিসংখানের ভিত্তিতে প্রতিষ্টার পর থেকে RAB ৭০০ রও বেশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ২০০ বর্তমান সরকারের আমলে| কিন্তু এই হত্যাকান্ড গুলোর প্রায় সবকটাতেই যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তা হয়েছে RAB এর পক্ষ থেকে নয়তো সরকারের পক্ষ থেকে, কোনটাতেই তদন্ত প্রতিবেদন ও প্রমানাদি জনগনের সামনে প্রকাশ করা হয়নি, সাধারণ ভাবে কোনটাতেই কোনো বাহিনীর কর্মরত সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি| আর বেশিরভাগ হত্যাকান্ডকে ক্রস ফায়ার অথবা বন্দুক যুদ্ধের নামে সাজানো হয়েছে| দুক্ষজনক হলেও সত্তি, RAB এর হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কালে সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র কি করে আসলো বা সেই অস্র দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সে গুলি করার সময় কখন পেলো এই নিয়ে কারো মনেই কোনো প্রশ্ন জাগেনি| শুধুমাত্র জানুয়ারি ২০১০- জুন ২০১১ এর মধ্যে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আহত বা নিহত মানুষের সংখ্যা হচ্ছে কোস্টগার্ডের হাতে ২ জন, পুলিশের হাতে ৪৯ জন এবং RAB এর হাতে ১৩১ জন যার মধ্যে নিহত হয়েছেন RAB এর হাতে ৯৩ জন, পুলিশের হাতে ৩০ জন এবং ২ জন অন্যানদের হাতে|

RAB এর বিভিন্ন অপারেশনের দিকে যদি দেখা যায় তাহলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, জানুয়ারি ২০১০- জুন ২০১১ এই সময়ের মধ্যে তাদের হাতে আহত অথবা নিহত মানুষের সংখ্যা বিভিন্ন বিভাগ ভিত্তিতে, ঢাকা- ৯২ জন, খুলনা- ৪২ জন, রাজশাহী- ২১ জন, বরিশাল- ১৩ জন, চট্রগাম - ১১ জন, সিলেট- ২ জন এবং রংপুরে ১ জন| কিন্তু কোনো হত্যাকান্ডেরই সঠিক ভাবে বিচার বিভাগীয় কোনো তদন্ত হয়নি, সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে কোনো চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি|

এবার কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার দিকে তাকাই,
১.৩ জুন, ২০১১ নরসিংদিতে রহিমা খাতুন নামে একজন মহিলা মাথায় গুলিবিদ্ধ হন, RAB এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তার স্বামীকে গ্রেফতার করার সময় ভুল বোঝা বুঝিতে এই ঘটনা ঘটে, গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি|

২.জুন ২০১০ এ ঢাকাতে গার্মেন্টস কর্মীদের এক প্রতিবাদে RAB মারধর করে, কিন্তু এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি|

৩.২৩ মার্চ, ২০১১ ঝালকাঠিতে লিমন হোসাইন নামক ১৬ বছরের এক যুবক পায়ে গুলিবিদ্ধ হন| সাংঘাতিক আঘাতের কারণে পরবর্তিতে তার পা কেটে বাদ দিতে হয়| এই ঘটনার সুষ্ট কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি| RAB এর পক্ষ থেকে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধের সময় লিমন মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে বারবার ইচ্ছাকৃত ভাবে লিমনকে সন্ত্রাসীদের সাথে সংযুক্ত করার অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে| এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জনগনের জন্য প্রকাশ করা হয়নি|

৪.নাসির আহমেদ,আসাদুল হক শাহীন মারা গেছেন RAB এর ক্রস ফায়ারে|

৫.মোহাম্মদ ইদ্রিস মারা গেছেন পুলিশের অত্যাচারে|

৬.সাংবাদিক মাসুম ফকির ২২ অক্টোবর, ২০০৯ RAB এর হাতে গ্রেফতার হন, পরবর্তিতে অত্যাচারের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন|

৭.২৪ অক্টোবর,২০০৯ রবিউল ইসলাম খুলনাতে RAB এর হাতে গ্রেফতার হন| তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অমানবিক অত্যাচার করা হয়|

৮.১৬ মার্চ,২০১০ আসাদুজ্জামান রুবেল কে গুলি করে হত্যা করে RAB, কিন্তু পবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় তার সাথে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যোগসূত্র ছিলো না|

৯.কিছুদিন আগে পুলিশের গাড়ি থেকে উগ্র জনতার হাতে নামিয়ে দেওয়া এক যুবক কে পিটিয়ে হত্যা করার দৃশ্য মোবাইল ফোন এর বদৌলতে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র বিশেষ করে ইন্টারনেট এ|

১০.কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণকে সেগুনবাগিচা নাট্যমঞ্চের সামনে থেকে রাতের বেলা তুলে নিয়ে ছিনতাইকারী অভিযোগে অত্যাচারের পর প্রায় পঙ্গু করে দেয় পুলিশ, পরবর্তিতে যার সাথে তার সহপাঠি বা আত্মীয় দেখা করতে গেলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি| পরে তদন্তে প্রকাশ পায় সে তার বোনের বাসা থেকে হলে ফিরছিলো| এর দায়ভার অস্বীকার করে পুলিশ|

অনেক ঘটনার মাঝে থেকে উপরে উল্লেখিত এই কয়টি ঘটনা শুধুমাত্র নমুনা বিশেষ| এই ঘটনা গুলোর না হয়েছে কোনো সুষ্ট তদন্ত, না হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ| এভাবেই একের পর এক বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড ও হত্যা কান্ড থেকে পার পেয়ে গেছে দেশের পুলিশ ও RAB| RAB এর হাতে গ্রেফতারকৃত অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন চরম অমানবিক শারীরিক অত্যাচারের| যার মধ্যে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা থেকে শুরু করে বৈদ্দুতিক শক পর্যন্ত ছিলো| এই ঘটনা গুলোর কোনটাতেই সাক্ষ্য প্রমান থাকা সত্তেও কোনো ধরনের তদন্ত হয়নি|

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সভ্য স্বাধীন দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর যাই হউক না কেন, দেশের সকল আইনের উর্ধে নয়| তাদের হাতে গ্রেফতার কৃতরা সন্ত্রাসী হউক আর সাধারণ নাগরিক হউক তারাও আইনের অধীনে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুষ্ট তদন্তের অধিকার রাখে| আমরা আমাদের লাগামহীন সামাজিক ও আইন শৃঙ্খলার অধপতন ঠেকাতে যদি দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড অব্যাহত করতে দেই, তারই সাথে যদি এই কাজগুলোর কোনো ধরনের সুষ্ঠ তদন্ত না হয়, সরকারের তরফ থেকে যদি এর দায়ভার অস্বীকার করা হয়, তাহলে আমরা আস্তে আস্তে গল্পের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর দানব এর মতই একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দেশে তৈরী করবো, যার প্রভাব ধীরে ধীরে আমদের সাধারণ সমাজে আরও ভয়াবহ হবে|তাই আর যাই হউক না কেন, কোনভাবেই এই বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ডকে সমর্থন করা যায় না|

২০১০ সালে, উইকিলিকস এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্রিটিশ পুলিশদের মাধ্যমে ট্রেনিং ও এই বিষয় গুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কিছু গোপনীয় চুক্তি ও পদক্ষেপ প্রকাশিত হলে নড়ে চড়ে বসেন কর্তারা| তার পরেই ব্রিটেন ভবিষ্যতে আর ট্রেনিং কার্যক্রম চালাবেনা বলে ঘোষণা দেয়| এরই সাথে Austria, Belgium, China, Czech Republic, Italy, Poland, Russian Federation, Slovakia, Turkey and USA এইসব দেশ থেকে যে প্রচুর অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে RAB এবং পুলিশের জন্য সে দিকেও নজর পরে মানবাধিকার সংগঠন গুলোর| Amnesty International এর মতে, যে সংস্থা একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এই দেশ গুলোর উপরেও বর্তায়|

বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম নির্বাচনী ইশতেহার ছিলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড বিচার বিভাগীয় তদন্তের আওতায় আনা এবং সুষ্ট ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, যার কোনো ফলপ্রসু উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি| আগে তো RAB ছিলো এখন তার সাথে সাথে দেশের পুলিশও ক্রস ফায়ারে হত্যাকান্ডকে তাদের ফ্যাশনে পরিণত করতে চলেছে, তার সাথে গ্রেফতার এর পরে সন্ত্রাসীকে উগ্র জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়াটা এখন তাদের ট্রেডমার্ক স্টাইল এ পরিণত হয়েছে| একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনভাবেই বিচার বহির্ভূত হত্যা কান্ডকে সমর্থন করা যায়না, আর বিনা বিচারে হত্যা কোনভাবেই দেশের আইন শৃঙ্খলার উন্নতি করতে পারেনা| সরকার, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনভাবেই এই ঘটনা গুলোর দায় এড়িয়ে যেতে পারেনা| নয়তো তাদের তৈরী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে তাদের উপরই চরাও হবেনা তা বলা যায় কি?

সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড ও হত্যাকান্ড অতি সত্তর বন্ধ করে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ তদন্ত কমিটি গঠন করে সচ্ছ তদন্ত জরুরি| একই সাথে এর কার্যক্রম সাধারণ জনগনের সামনে উন্মুক্ত করাটাও সরকারের ও বিচার বিভাগের দায় বদ্ধতার মধ্যে পড়ে| দোষীদের বিচার ও আক্রান্তদের সাহায্য ও সহযোগিতা এবং এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য সঠিক সিদ্বান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অতি জরুরি| মানবাধিকার চরম লঙ্ঘনের অভিযোগে এরই মধ্যে Amnesty International বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এছাড়াও আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারী সংস্থা থেকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আশংকা ব্যাক্ত করা হয়েছে, U.S Department of State: Human Rights Report 2011-এ দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় গুলোকে এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে|

বহু বছর ধরে এই ঘটনা গুলো নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে, অতি পুরাতন প্রশ্ন "রক্ষকই ভক্কক" নিয়ে জনসাধারণ অনেক মাথা ঘামিয়েছে, কিন্তু যদি এই সমস্যা গুলো নিয়ে জনসচেতনতা তৈরী না হয় তাহলে যে দানব তৈরী হচ্ছে দিনে দিনে তার দানবিকতা ভবিষ্যতে কতদূর পর্যন্ত গড়াবে তার কথা কে বলতে পারেন? আজকে যেই বন্দুকের নল সন্ত্রাসীদের দিকে তাক করা হচ্ছে, তা যে কদিন পড়ে আমার বা আপনার দিকে তাক করা হবেনা তা গ্যারান্টি দিয়ে কে বলতে পারে?



http://www.amnesty.org/en/news-and-updates/report/bangladesh-government-must-act-now-stop-police-unlawful-killings-2011-08-23

http://www.amnesty.org/en/library/asset/ASA13/005/2011/en/c18ad74b-75fe-4b15-b043-5982eebdb27d/asa130052011en.pdf

http://www.extrajudicialkilling.info/

http://www.guardian.co.uk/world/2011/jan/26/bangladesh-death-squad-killings-britain

ইরম চানু শর্মিলা : এক লৌহমানবীর গল্প


আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্র নিয়ে সব থেকে জন প্রিয় বাক্য হচ্ছে- “Democracy is the government of the people, by the people, for the people”| গণতন্ত্র নিয়ে ধারণা থাকুক আর নাই থাকুক কিন্তু লিঙ্কনের এই বাক্য তার জীবদ্দশায় শোনেনি এমন মানুষ কম আছে,মোদ্দা কোথায় এখন পর্যন্ত গনতন্ত্র পৃথিবীতে সব থেকে সার্থক ও জনপ্রিয় শাসন ব্যাবস্থা| সাদা বাংলায় জনগনের সরকার| জনগণ তার গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাকে ক্ষমতায় পাঠায় দেশ ও দশের দেখা শোনা করার জন্য, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই, জনপ্রতিনিধিদের তখন জন কম ক্ষমতা বেশি প্রিয় হয়ে যায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে আইন দিয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করতেই ব্যাস্ত হয়ে পরেন তারা|জনগনের দুর্ভোগ শুরু হয় সেখান থেকেই|

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, বর্তমান বিশ্বে সংবাদ মাধ্যম সাধারম জনগনের চোখ ও কানের কাজ করে, তারা যা দেখায় আমরা দেখি, তারা যা শোনায় আমরা শুনি, কিন্তু এখানেও সমস্যা থেকে যায়, আজকাল তারা তাই দেখায় যা দেখিয়ে তাদের লাভ, তারা তাই শোনায় যা শুনিয়ে তাদের মন ভরে, তাদের কাছে লাভ নেই তাই অনেক কিছুই গুরুত্ব পায়না, তাই আমাদেরও চোখ ও কান এড়িয়ে যায়| রাজনৈতিক নেতাদের আন্দোলন এর গরম গরম খবর তো প্রতিদিন আসে, তা নিয়ে আমরা চায়ের কাপে ঝড় তুলে গণতন্ত্রের চর্চা করি, কিন্তু আসেনা অনেক কিছুই| পৃথিবীতে অনেক বিপ্লবী বছরের পর বছর সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন, কিন্তু অনেকের কথাই আমরা জানিনা| এই ব্যাস্ত নাগরিক জীবনে সবার কথা জানার সময় কোথায়? এই বলে এড়িয়ে যাই আমরা, কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা কিন্তু থেমে থাকেনা|

ইরম চানু শর্মিলা- মনিপুরের লৌহমানবী, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের একটি আইনের প্রতিবাদে, এই ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে তার অনশনের ১১ বছর পূর্ণ হবে| আপোষহীন এই নারী তার প্রতিবাদী অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ ১১ বছর ধরে, আমরা অনেকেই জানিনা তার ব্যাপারে, তারপরও তিনি থেমে নেই| কি নিয়ে এই দীর্ঘ অনশন? ভারত সরকারের Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অধীনে জারিকৃত ক্ষমতাবলে সামরিক বাহিনী কোনো প্রমান ছাড়াই শুধু মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গুলি চালাতে পারে যে কারো উপর| আদিবাসীদের উপর অত্যাচারে এক চরম রাস্তা সংযোজন করে এই আইন| এরই হাত ধরে ২ নভেম্বর,২০০০ সালের এক সকালে ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্ফল ভ্যালি এর আদিবাসী শহর মালম এ বাসের জন্য অপেক্ষাকৃত সাধারণ জনগনের উপর গুলি চালায় আসাম রাইফেলস বাহিনীর কিছু সদস্য| এই ঘটনায় প্রাণ হারায় ১০ জন নিরীহ আদিবাসী, যাদের মধ্যে ৬২ বছরের বৃদ্ধা  Leisangbam Ibetomi এবং ১৯৮৮ সালে ভারতের National Child Bravery Award বিজয়ী ১৮ বছরের Sinam Chandramani অন্যতম| এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অপসারণের দাবিতে অহিংস অনশনে বসেন শর্মিলা| দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১০ টি বছর কিন্তু আপোষ করেননি তিনি কোনো অবস্থাতেই|

জনগনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর অহিংস উপায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার গণতন্ত্র দেয়, কিন্তু সরকার দেয় কি?? তাই তথাকথিত জনগনের বন্ধু পুলিশ অনশনে বসার ৩ দিনের মাথায় ভারতীয় পেনাল কোড, ৩০৯ ধারার অধীনে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়, পড়ে তাকে কোর্টে হাজির করা হয়, ৩০৯ ধারার অধীনে গ্রেফতারকৃতদের সর্বচ্চো শাস্তি ১ বছর কারাদন্ডের বেশি নয়, তাই শর্মিলাকে অনবরত নিয়মিত ভাবে এই ধারার অধীনে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, নেওয়া হয়েছে থানায়, কিন্তু তাই বলে থেমে যায়নি তার আন্দোলন, চরম শারীরিক অসুস্থতার শিকার হয়েও তিনি দৃঢ় অটল|

এই আইনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা জাগানোর লক্ষে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন অনেক জায়গা, ২০০৬ সালে আসেন দিল্লিতে, প্রতিবাদ কার্যক্রম ও অনশন জারি রাখেন, দিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ৬ অক্টোবর, ২০০০৬ এ| এই আন্দোলনের সময়ে দিল্লিতে তার সাথে সাক্ষাত করেন নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী, তিনি আশ্বাস দেন তার এই অনশনের কথা তিনি United Nations Human Right Council এর কাছে তুলে ধরবেন|আন্তর্জাতিক ভাবে তার এই অনশন আন্দোলকে তখন সীকৃতি দিয়েছে অনেকেই|

ইরম চানু শর্মিলা ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়, ২০০৫ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয় গোহাটির একটি নারীবাদী সংস্থা, ২০০৭ সালে তাকে ভূষিত করা হয় Gwangju Prize For Human Right-এ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি পুরস্কার পান ২০১০ সালে, ১২ তম Signature Woman of Substance Award (Assam) দেওয়া হয় ২০১০ সালে, আজীবন সম্মাননা পুরস্কার সহ নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই নারী, কোনো পুরস্কার তিনি নিজে গ্রহণ করতে যাননি, এসব নিয়ে মাথা ব্যাথাও নেই তার| তার প্রতিবাদ যে সাধারণ মানুষের খুব সাধারণ একটি অধিকার নিয়ে, তা হলো বেঁচে থাকার অধিকার|

২৮ নভেম্বর ২০১০ সালে, ইউরোপিয়ান সংসদ সদস্য ও গ্রিন পার্টি এর নেত্রী কেইথ টেলর তার আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করে ভারতীয় সরকারের তত্কালীন ক্ষমতাসীনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, আরও অনেকেই তখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এই আন্দোলনকে, ভারতীয় সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে জবাবদিহি করতে হয়, কিন্তু প্রতিবারই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে এবং আইন অপসারণে কাজ চলছে বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অনশনের আন্দোলনের আওয়াজ জনপ্রতিনিধিদের কানে পৌছায়না|

ইরম চানু শর্মিলার এই অসমসাহসী আন্দোলনের সাথে তখন জাগ্রত হয়েছেন অনেক আদিবাসী, আদিবাসী সংগঠন গুলো তখন জন সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাই বলে অত্যাচার থেমে যায়নি| ১০ জুলাই, ২০০৪-এ মনোরমা দেবী নামের একজন আদিবাসী নারী অপহৃত হন আসাম রাইফেলস এর বাহিনীর হাতে, পরে তাকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করে হত্যার পর লাশ ফেলে দেওয়া হয়| এই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ জুলাই,২০০৪ একদল অসমসাহসী প্রতিবাদী আদিবাসী নারী "কান্গ্লা ফোর্ট" এর সামনে বস্ত্র ত্যাগ করে নগ্ন হয়ে "Indian Army Rape Us"! লেখা প্লেকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন| এই ঘটনা ও চিত্র আন্তর্জাতিক ভাবে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরী হয়| Ima Momonleima নামের সাহসী বৃদ্ধা নেতৃত্ব দেন এই প্রতিবাদের|

সবসময় নানাভাবে উপেক্ষা করা আর অত্যাচারিত এই আদিবাসীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো সাহায্য পৌছে না বললেই চলে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই দরিদ্র সাধারণ মানুষগুলোর প্রতিবাদ সরকারের কানে পৌছে কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ থকেই যায়| তাই প্রায় ১১ বছর ধরে চলা ইরম চানু শর্মিলার অনশন আন্দোলনের কোনো প্রভাব সরকারে উপর দেখা যায়না| একজন সাধারণ কয়েদির সাথে দেখা করতে গেলে কিছু সরকারী কাগজ পূরণ করলেই চলে, কিন্তু শর্মিলার সাথে দেখা করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হয়, এই অনুমতিপত্র সরকারী ভেলকি বাজিতে অধিকাংশ সময় গুম হয়ে যায়| একজন সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করাটাও কতটা কঠিন কাজ হয়তো এটাতেই প্রমান পাওয়া যায়|

প্রতিবাদের ভাষা সারা পৃথিবীতে এক, প্রতিবাদের কোনো আলাদা জাত নেই, নেই কোনো একক রাজনৈতিক পন্থা, মতাদর্শের ভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ সবসময় এক সুর তলে| তাই গণতন্ত্রের সংগা নতুন করে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় আমাদের মতো দুর্ভাগা দেশগুলোতে আমরা কাদের হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দেই? আমদের দেশেও অনশন প্রতিবাদ হয়, আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা বাতানুকুল জায়গায় বসে কয়েক ঘন্টার ছোট্ট অনশন করেন, তাদের জন্য আনা হয় ভালো খাবার, সুস্বাদু ফলের রস, অনশন ভাঙ্গলেই উদর পূর্তির ব্যাবস্থা, তাই অনেকেই প্রতিবাদীর মুখোশটা টুক করে পরে ফেলেন, আর আমাদের নেতাদের সামনে থাকে টিভি ক্যামেরা- মাইক্রোফোন, আমাদের বাগ্মী নেতারা হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের মুন্ডুপাত করেন, মুখে বক্তৃতার ফেনা তুলে গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়ান, তারপর সময় শেষে গণতন্ত্রের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে বাড়ি যান আর আরামের ঢেকুর তুলে বলেন, যা বাব্বা জনগনের জন্য শালা যা একটা ঝক্কি গেলনা!!! আমাদের চোখ তাদের দিকেই আটকে থাকে, আমরা তাদের কথাতেই মিছিল করি, আমরা গণতন্ত্রের বুলি আউড়াই, আমরা ছাত্র রাজনীতি করি দেশের জন্য আর সুযোগ পেলেই নেতার আদেশে বিপথগামীদের আচ্ছা করে ধোলাই দেই| এই না হলে প্রতিবাদ, এই না  হলে গণতন্ত্র| আর ইরম চানু শর্মিলার মতো নিরবে নিভৃতে অনেকেই জীবন উত্সর্গ করেন সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য, একটি সত্যিকারের মহান আদর্শের জন্য, ভালো ভাবে মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস যোগানোর জন্য|

ইরম চানু শর্মিলার মতো মানুষ গুলোর প্রতিবাদের ভাষা যতই সরল হোক না কেন তা একদিন প্রচন্ড শক্ত আঘাত হানবেই শোষকের প্রাসাদের দেয়ালে, যারা গণতন্ত্রের নামে সাজানো তাসের ঘরে বসে সাধারণ মানুষকে জব্দ করে শোষণ করার নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজেন, তাদের হিসেব সেদিন দিতে হবেই| সত্যিকারের গণতন্ত্র সে দিনই আসবে, ইতিহাস বিপ্লবীদের ভোলে না|

বার্মা সোলজার : একজন আপোষহীন যোদ্ধার কথা


"HBO Documentary Films " এর কাজগুলো আমার সবসময় পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে, এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্যচিত্রটি দেখার পর লেখার ইচ্ছে হলো| সামরিক জান্তার শোষণ ও ভয়াবহ অত্যাচার এবং জাতিগত বিদ্বেষে জর্জরিত দেশ বার্মা বর্তমানে মায়ানমার, ৪০ বছররেও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে অগুনিত মানুষ, বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ও চরম মানবিক বিপর্যয়ে আক্রান্ত এই দেশটির কথা অনেক আগে থেকে শুনে আসলেও এতটা ভালো ভাবে জানার উপায় হয়নি কখনই, সামরিক সরকারের অধীনে থাকা এই দেশটি থেকে কোনো ধরনের তথ্য কিংবা তথ্যচিত্র দেশের বাইরে যাওয়াটা খুবই কঠিন এবং ধরা পড়লে শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ, তাই চরম সাহসিকতার সাথে এই কাজটি করেছেন কিছু মানুষ|


Myo Myint নামের একজন যুদ্ধাহত সৈনিকের দৃষ্টিতে এবং সাহায্যে তৈরী করা তথ্যচিত্রটি বার্মার মানবিক বিপর্যয়ের চরম নিদর্শন হয়ে থাকবে, একজন প্রকৌশলী হিসেবে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময় স্থল মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানোর পর অব্যাহতি নেন তিনি, তারপর ধীরে ধীরে দেশের চরম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কাজে জড়িয়ে পরেন, তার মুখেই শোনা যায় তার সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন সময়ের লোমহর্ষক বর্ণনাগুলো|


পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশটিতে সামরিক অত্যাচারে দিনের পর দিন চরম মানবিক বিপর্যয়ে জীবন যাপন করে চলেছে মানুষ, প্রাকৃতিক সম্পদশালী এই দেশটিতে শুধুমাত্র সামরিক শাসনের প্রভাবে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে এটি পরিণত হয়েছে পৃথিবীর সবথকে দরিদ্র দেশগুলোর একটি, আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোর মতো এখানেও নুন্যতম মানবিক সাহায্য অপ্রতুল, বাইরের বিশ্ব থেকে কোনো ধরনের জরুরি সাহায্য নিষিদ্ধ, দেশটি বর্তমানে সাস্থ্য সুবিধের দিক থেকে তলার দিকে অবস্থান করছে, যদিও এটি বৃহৎ দেশগুলোর তালিকায় ৪০ তম এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়াতে এর অবস্থান ২য় স্থানে, জনসংখ্যার দিক থেকে এটি জনবহুল দেশের তালিকায় ২৪তম, দেশটিতে নানাবিধ সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের নুন্যতম জীবনযাত্রার মান না থাকা সত্তেও দেশের সরকারের অধীনে আছে পৃথিবীর ১২তম বৃহৎ সক্রিয় সামরিক বাহিনী, সামরিক বাহিনী দেশটির সব, উচ্চপদে থাকা সামরিক কর্মকর্তাদের অধীনে দেশটির অধিকাংশ ক্ষমতা, শুধুমাত্র তাদের পরিবার উচ্চশিক্ষা হতে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে পারে, দেশটিতে ব্যাবসা বানিজ্য হতে শুরু করে সব কিছুই সামরিক বাহিনীর অধীনে|


জেনারেল নে উইন ১৯৬২ সালের পর থেকে দেশকে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে গড়ে তুলতে যেয়ে তৈরী করেন এক অভাবনীয় ক্ষমতাশালী ও নিষ্ঠুর সামরিক শাসনতন্ত্র, যার অধীনে ২৬ বছর চলা শাসনে দেশটিতে তার বিরুদ্ধে ওঠা যেকোনো আওয়াজ কে দমন করা হয়েছে নিষ্ঠুর ভাবে চিরতরে, মানুষ এর সভ্যতার ইতিহাসে চরম অবমাননা আর অত্যাচারের ইতিহাস লিখা হলে আমার মনে হয় বার্মা প্রথম সারিতে থাকবে, দেশের ইতিহাসকে সামরিক বাহিনীর উপযুক্ত করে তৈরী করা হয়েছে যাতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন মানিশিকতা নিয়ে বড় হয়, বার্মা সামরিক বাহিনী এখনো পৃথিবীতে শিশুসৈন্য ব্যাবহারে অন্যতম এবং এদের বাহিনীতে নিযুক্ত ১৬ বছরেরও কম বয়সী শিশুর সংখ্যা অনেক, সর্বপরি শিশুদের সামরিক বাহিনীতে ব্যাবহার করাতে পৃথিবীতে প্রথমদিকের দেশ গুলোর একটি, দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা গুলোর মধ্যে শিশুশ্রম ও মানুষ পাচার অন্যতম|


Myo Myint এর জবানিতে উঠে এসেছে তার অবলোকন করা সামরিক বাহিনীর চরম অত্যাচার এর দৃশ্যাবলী, নির্বিচারে হত্যা ও সাধারণ মানুষকে মাইন ক্ষেত্রর এর উপর দিয়ে হেটে যেতে বাধ্য করাটা খুবই সাধারণ কাজ গুলোর মধ্যে পরে, আর এখানেও সামরিক বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে নারী ধর্ষণ তো আছেই, দেশটিতে শুধুমাত্র সামরিক সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ বই পরার অপরাধে যেতে হয় জেলে, তাই বই পাওয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার, তার স্মৃতি থেকে আরও উঠে আসে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে তার সক্রিয় আন্দোলনে যোগদানের তথ্যগুলো. ১৯৮৮ সালের আন্দোলনে সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করার সময় পুলিশের আক্রমনে একদিনেই মারা যায় ছাত্র সংগঠনের ২০০রও বেশি ছাত্র, সেই আন্দোলনের দিনগুলোতে ৩০০০ লোকের মৃত্যু ও ১০০০ লোকের গ্রেফতার এর হদিস মেলে|


Myo Myint পরবর্তিতে সক্রিয় ভাবে যোগদান করেন Aung San Suu Kyi এর রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহবন্ধী করে রাখা এই আপসহীন লৌহমানবীর সঙ্গে থেকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনে, সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য নজরে পরে যান তিনি এবং সামরিক গোয়েন্দাদের হাতে বন্ধী হয়ে প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হন, পরবর্তিতে ১৫ বছরের জন্য জেলে যান, যার মধ্যে সাড়ে ৪ বছর ছিলেন সলিটারিতে, আবার ৪ মাসের বেশি সময় ধরে একটানা ছিলেন সলিটারি কনফাইনমেন্ট এ, চরম মানসিক চাপে তখন কার দিন গুলোর কথা যখন বর্ণনা করেছেন, যেকোনো মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট| সাজাকালীন সময়ের ১৯৮৯-১৯৯৯ এই ১০ বছর সব ধরনের যোগাযোগ তার জন্য নিষিদ্ধ ছিলো, যুদ্ধাহত হবার পরও বিন্দুমাত্র মানবিক বিবেচনা পাননি তিনি|


তার বর্ণনাতেই উঠে আসে সামরিক জান্তার প্রাচুর্যের কথা, জেনারেলের মেয়ের বিয়েতে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সমমানের উপহার সামগ্রীর কথা, বিয়ের খরচ যা কিনা দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য সেবার খরচের থেকে ৩ গুন বেশি|  


অসাধারণ মনোবলের অধিকারী এই বিপ্লবী তার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন শরণার্থী শিবিরে, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভাই-বোন এমনকি পুরো পরিবার থেকে আলাদা ছিলেন, তারপরও নিজের দেশ ছেড়ে বাইরে যাননি বরং বিভিন্ন ভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সহযোগিতা করে গেছেন, সাইক্লোন নার্গিস এর ধংসাত্মক ছোবলের পর দেশের সরকার বাইরের বিশ্বের মানবিক সাহায্য অগ্রাহ্য করলে চরম মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয় বার্মার উপকূলবর্তী মানুষ, তারপরও দেশে জনগনের কথা চিন্তা না করে সরকার নতুন সংবিধান তৈরী করে সামরিক ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করে|


সর্বোপরি একজন অসাধারণ দৃঢ় মনোবলের মানুষের জীবন যুদ্ধ নিয়ে তৈরী করা এই তথ্যচিত্রটি যেকোনো বিবেকবান মানুষের মনে নাড়া দিবে, আর সবার দৃষ্টির অগোচরে থাকা একটি দেশ বার্মা আর তার ভিতরে অসম যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিকামী মানুষের এই অভূতপূর্ব আন্দোলন সত্তি কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা, তথ্যচিত্রটির শেষ দিকে এসে জীবনের কিছু চরম অভিজ্ঞতার কথা যখন বর্ণনা করেছেন তখন সত্তি চিন্তা শক্তি লোপ পায়, বর্তমানে অনেক সংগ্রামের পর নিজের ভাই এর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্টে অবস্থানরত এই বিপ্লবী সত্তি নমস্য|


পৃথিবীতে শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবেই, মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগে প্রতিদিন নতুন করে তৈরী হবে মানব সভ্যতার ইতিহাস, আর এভাবেই মানুষ মুক্তির স্বপ্ন বুনে চলে, শোষণহীন সমাজ ব্যাবস্থার জন্য অজস্র বিপ্লবী লড়ে চলেছেন তাদের আপন আপন ক্ষেত্রে, Myo Myint তাদের জন্য এমনকি সমগ্র সভ্য মানব সমাজের জন্য জলন্ত উধাহরণ হয়ে থাকবেন, তার এই দৃঢ় মনোবল অনেকের জীবনে চলার পথে সঙ্গী হয়ে থাকবে বলে আসা রাখি|

রাজা যায়,রাজা আসে



(২৫ শে মার্চ ১৯৭১ - ২৫ শে মার্চ ২০১১, ব্যাবধান ৪০ বছর)

মিরপুর স্টেডিয়াম, চাঁদ তারা খচিত পতাকা উড়ে,ললনার নরম কোমল গালে তার প্রতিচ্ছবি,যুবকের দৃপ্ত কন্ঠে পাকিস্তানের জয়ের আহ্ববান,কানে বাজে "পাক সার জামিন সাদ বাদ",ভাবি ভুল শুনলাম আবার শোনার চেষ্টা করি নাহ ঠিকই শুনলাম মনে হলো ...চারপাশের সব নিঃশব্দ হয়ে যায় চোখে ভাসে মিরপুর বধ্যভূমি,নাম না জানা হাজারো ভাই-বোনের মৃতদেহ,চোখ থেকে সবার অলক্ষ্যে কয়েক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে...

দেশ আয়োজন করে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এর,দেশবাসী খুশি হয়,বিনোদনের আনন্দে মেতে ওঠে সবাই,খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভুলে যায় নিজের অস্তিত্ব...নিজের দেশ হেরে যায় কষ্ট লাগে খেলা দেখার ইচ্ছা করেনা,অনেকে আশায় নতুন করে বুক বাধে "আর রে আমাদের পাকিস্তান আছেনা"...অবাক হই হয়তো কিছুটা চমকে উঠি আর তা দেখে কেউ বলে ওঠে "আর রে ভাই খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন নাতো"....আমি হেসে বলি "না ভাই মেশাইনা"..মনে পড়ে ১৬ বছরের ছিলো মনে হয় ছেলেটি বয়সটা ঠিক মনে নেই,বুকে মাইন বেঁধে শুয়ে পরেছিলো সাজোয়া গাড়ির নিচে,ভাবি ওর হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিলো লাল সবুজের পতাকা ওড়ানোর....

নতুন প্রজন্ম আমাকে দেখতে পারেনা হঠাৎ করেই যেনো অনেক আলাদা হয়ে যাই ভিড়ের মাঝে ,কেউ বলে ওঠে "পুরনোকে আকড়ে ধরে রাখতে চাইনা,যা হয়েছে অনেক বছর আগে হয়েছে,এখন নতুন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে"...আমিও সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা,ত্রিশ লক্ষ্য শহীদের রক্তসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ক্লান্ত হই ,মনে হয় দেশটাও তো ৪০ বছরের পুরনো হয়ে গেলো তাও তো আকড়ে ধরে আছি...

বঙ্গ ললনা হেসে খিলখিল,পাকিস্তানের সুদর্শন ছেলেরা আসে,হেসে কথা বলে,হৃদয় জয় করে নেয়,স্বপ্ন দেখায় নতুন ভবিষ্যতের...চোখে ভেসে ওঠে অসংখ্য ললনার রক্তাক্ত দেহ,পাশবিক নির্যাতনে ক্ষত বিক্ষত মুখ-শরীর,ভয়ে কেঁপে উঠি আমার মুখের হাসি মুছে যায় ...
 কেউ "Racist" বলে,সব ভুলে নাকি উন্নতির জন্য একসাথে কাজ করতে হবে,এরকম একপেশে মানসিকতা নাকি আর চলবেনা....মনে পড়ে "১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর জহির রায়হান তার নিঁখোজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি".. তার বোন আজও কেঁদে ফেরে...

আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করি,মানুষ হাসে,বলে পুরনো সংকীর্ণ মানসিকতা...নিজের পুরনো ঘরে,পুরনো হয়ে যাওয়া আমার মানসিকতা নিয়ে বসে থাকি,পাশের বাড়িতে পাকিস্তানের বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে ওরা .. আমি শুনেও না শোনার ভান করি ...মনে পড়ে "কিসের ভয় যখন বুকের রক্তে লিখেছি একটি নাম বাংলাদেশ"....যখন শেকড় থেকে পচন শুরু হয় তখন গোটা অস্তিত্ব হারানোর ভয় হয় ...

সরকার যায় সরকার আসে শ্লোগান বদলায়...যেই "জয় বাংলা" শ্লোগান এ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী লড়েছিলো তা হয়ে যায় দলীয় সম্পদ....তাই কখনো বলতে হয় "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ"...আবার পালা বদল হয় রাস্তা কাঁপে জয় বাংলায় কিন্তু সেটা শুধুই দলীয় আবেগ....ইতিহাস বদলায় বছরে বছরে তাই সঠিক ইতিহাস জানতে চায় না কেউ,তাই নিজের অস্তিত্বকে যারা মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলো তাদের নামে জয় জয়কার করি,যুদ্ধপরাধীদের বিচার হয় কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়না,তারা ধর্মের নামে সহানুভূতি জড়ো করে,তারপর সুযুগ বুঝে নতুন প্রজন্মের মাঝে  মিশিয়ে দেয় বিষাক্ত নিঃশ্বাস...

তাই আজ দীর্ঘ ৪০ বছর পরে ২৫ শে মার্চের গভীর রাতে একটা গান মনে পরে "রাজা যায়,রাজা আসে...রানীরাও আসে যায়"বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস...

দুঃস্বপ্ন


স্মৃতিরা ঘোরে আসে পাশে অশরীরী হয়ে,
মাথার ভেতরে প্রেতাত্মার দির্ঘনিশাস,
দুস্বপ্ন বাস্তব হয়ে গিলে খেতে চায় সরল অস্তিত্ব,
রাতের ঘুম সেও হয়ে যায় দোজখের অগ্নিকুন্ড
বাস্তব ধুসর হয়ে হারিয়ে যায় চোখের পলকে
ধংসস্তুপে জেগে ওঠা ঘাস ফুলের মতো,
অতীত গুলো রঙ্গিন অনেক,
তাও ঘুন পোকাদের সাথে যুদ্ধ করে বেচে থাকা
কিছু আকড়ে ধরার ব্যার্থ চেষ্টা,
মাটির সোদা গন্ধে হঠাৎ মনে পরা তুমি,
বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে যেতে
হঠাৎ লোভী হয়ে উঠি,
আবার নতুন করে বাচতে ইচ্ছা করে,
মানুষ না স্মৃতির ফসিল হয়ে ....