Friday, December 16, 2011

আত্মত্যাগ

ভারী আওয়াজ তুলে সাঁজোয়া গাড়ির বহরটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দিকে আসছে, গাড়ির উপরে বসানো মেশিনগান আর সেনাদের বন্দুকের চকচকে বেয়নেটগুলো আলো-আঁধারীতে এক নারকীয় আবহ তৈরী করছে| নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতা কায়েম করার এক পৈশাচিক আনন্দে তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চোখ হায়েনার মতো জ্বলন্ত| বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে- শুরু করেছে "অপারেশন সার্চলাইট" নামক পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে জঘন্যতম গণহত্যা| গাড়ির বহরটা তখন ঢুকছে ছাত্র হল গুলোর দিকে, আর রাস্তার ভিত পলায়নপর মানুষগুলোর দিকে চলছে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ, এরই মাঝে বহরের প্রথম গাড়িটার সামনে এসে দাড়ালো এক তরুণী| গুম গুম শব্দ তুলে চাকার নিচে পিষে ফেলতে এগিয়ে এলো ধাতব যন্ত্রটা, আর ঠিক তখন প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে উড়ে গেলো যন্ত্রদানব, মুহুর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল| বুকে বিস্ফোরক বেঁধে সাঁজোয়া গাড়ির নিচে আত্মাহুতি দিয়ে প্রথম প্রতিরোধের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা| ঠিক কতটা সাহস আর মাটির জন্য ভালোবাসা থাকলে এভাবে আত্মত্যাগ করা যায় তা পৃথিবীর কোনো বর্ণমালা লিখে বোঝাতে পারবেনা, কোনো ভাষা পারবেনা এই সাহসিকতার বর্ণনা দিতে, কোনো বিশেষণে দেওয়া যাবেনা এর তুলনা| গ্রামের বড় মাঠটা পেড়িয়ে আসার চেষ্টায় মরিয়া পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী, এপাশ থেকে আমরণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা| গুলি, মর্টার, গ্রেনেড এর শব্দে তখন চারিদিক বিভীষিকাময়| বারবার পেছাতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা| মাটি কাঁমড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিযোদ্ধারা, মাঝখানের জায়গাটুকুতে মাইন পেঁতে রেখেছে তারা| এরই মধ্যে পাকিস্তানিদের সাহায্যে এগিয়ে এলো ভারী ট্যাঙ্ক| ঘর্ঘর যান্ত্রিক শব্দ তুলে মৃত্যুদূতের মতো মাঠ পেড়িয়ে আসতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে, আর তার আড়ালে এগিয়ে আসতে থাকলো পাকিস্তানি সৈন্যরা| মর্টার এর প্রচন্ড শেলিং আর ট্যাঙ্কের সামনে পিছু হটতে বাধ্য মুক্তিযোদ্ধারা, ভরসা শুধু একটু দূরের পেঁতে রাখা মাইন| কিন্তু মাইন বিস্ফোরিত হলনা, ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসতে থাকলো, এখান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার একটাই মানে পুরো এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের দখল| হঠাৎ পাশ থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো কে যেনো, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী ১০ বছরের লালু| বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে সেদিন যে বীরত্বগাঁথা লালু রচনা করে গিয়েছিলো তা বর্ণনা করার সামর্থ্য কার আছে? মাত্র ১০ বছরের শিশুর আত্মত্যাগে সেদিন যে আগুন জলে উঠেছিলো সহযোদ্ধাদের মনে, তার সামনে দাড়াতে পারেনি পাকিস্তানি সেনারা, কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো সব প্রতিরোধ, মুক্ত হয়েছিল অঞ্চল| মাটির মূল্য সেই শিশুটির থেকে ভালো আর কে জানে? ৩রা ডিসেম্বর, ভোরবেলা নবীগঞ্জ থানা মুক্ত করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো ৫নং সেক্টরের কোম্পানী কমান্ডার, মুর্শেদ ইউ জামান রশিদ এর নেতৃত্বে ৩৬ সদস্যের মুক্তিবাহিনী, তার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড চার্জ করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য একজন, একটি গুলি এসে মাথায় লাগে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেই অকুতোভয় কিশোরের| শহীদ হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব| শ্রমিক পিতার সন্তান ধ্রুব স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেনি, কৈশোরের চাঞ্চল্যের জীবন ছেড়ে হাতে নিতে হয়েছিল বন্দুক-গ্রেনেড, লড়তে হয়েছিল নরপিচাশদের সাথে| নিজে আত্মত্যাগ করে আমাদের সুযোগ করে দিয়ে গেছে টকটকে লাল সূর্যের আভায় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার| জামালপুর জেলার সদর উপজেলার ইটাইল ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের কাছাকাছি এক স্কুল ঘরে রাতের বেলা গোপন মিটিংয়ে জমায়েত হয়েছে পাকিস্তানিদের দোসর এদেশের শান্তি বাহিনীর কিছু সদস্য, এখবর পেয়েই আর অপেক্ষা করেনি হালু| কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হালু তখন সবেই যুদ্ধশেষে গ্রামে ফিরেছে| রাতের বেলা একাই চলে গিয়েছিলো ওদের প্রতিরোধ করতে, গভীর রাতে শোনা গিয়েছিলো গোলাগুলির আওয়াজ|পরের দিন সকালে মাঠের পাশে পাওয়া গিয়েছিলো কিছু রাজাকারের লাশ| শুধু পাওয়া যায়নি হালু'কে| ১৬ই ডিসেম্বরের মাত্র কয়েকদিন আগে এভাবেই হারিয়ে গেলো মাত্র ১৫/১৬ বছরের অসীম সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হেলাল উদ্দিন| না, বহু বছর পরেও তার খোঁজ মেলেনি| ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে সেদিন প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা, সাভারের উপকন্ঠে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম| কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ভারী মেশিনগানের সামনে অবস্থানগত কারণে বেকায়দায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ| ভারী মেশিনগান বন্ধ করতে না পারলে এগোনো যাচ্ছেনা, এই বার্তাটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে অন্য দলটির দিকে এগিয়ে যেতে গেলো কিশোর টিটো| সাথে সাথে একঝাঁক বুলেট এসে মাটিতে শুইয়ে দিলো ওকে| বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে, ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ হলো গোলাম দস্তগীর টিটো| সেদিন কিশোর সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে পাগলপ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সব নিয়ম ভেঙ্গে অতিমানবীয় ভাবে পরাস্ত করেছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে| মৃত্যুর আগে টিটো বলেছিলো, "বাচ্চু ভাই, আমাকে বাচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই"| না, টিটো বাঁচেনি, দেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত করে দিয়ে সেদিন ও চলে গিয়েছিলো| বুকে একঝাঁক বুলেট নিয়ে স্বাধীন দেশে, সাভারের ডেইরি ফার্মের কাছে শুয়ে আছে টিটো| "স্বাধীনতা"-শব্দটা কতটা শক্তিশালী, কতটা গভীর| ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া না পাওয়া এরকম অজস্র শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা| রক্তস্নাত দেশের মাটির প্রতিটি শস্যকনা শহীদদের স্বপ্নের কথা বলে, বাতাস প্রতিনিয়ত গেয়ে যায় তাদের না গাওয়া গান| ৩০ লক্ষ্ শুধু একটি সংখ্যা বা হিসেব না, ৩০ লক্ষ্ মানুষের না দেখা বিজয়, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা সব| ৩০ লক্ষ্ শহীদের অস্তিত্বের অংশীদার আমরা সবাই| এরকম অসংখ্য বীরসন্তানের প্রানের বিনিময়ে যে কষ্টার্জিত বিজয়, তা শুধু কাগজে-কলমে নয়, এ বিজয় দেশের প্রতিটি মানুষের প্রানের সাথে মিশে আছে| তাই কোনো স্মৃতিফলকে তাদের নাম থাকুক বা না থাকুক, আমাদের কাছে তারা গল্পের স্পার্টাকাস-একিলিসের থেকেও অনেক বড় বীরসন্তান| প্রমিথিউসের মতো তারাও ছিনিয়ে এনেছিলো স্বাধীনতার লাল সূর্য| বছরের পর বছর বহু ঘটনা ঘটবে, নষ্ট রাজনীতি হবে, ইতিহাস বদলে দেওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা হবে, কারণ কিছু মানুষ ভুলে যাবে শহীদের নাম মুছে দেওয়া হয়তো যায় কিন্তু মুছে দেওয়া যায়না তাদের দেখা স্বপ্ন, তাদের চেতনা| তাই বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আজকের ভোরের সূর্যটা তাদের বুকের রক্তেই আরও রাঙ্গা হয়ে উঠবে, আর আমরা তাদের চোখে দেখা স্বপ্নকে পূরণ করতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবো|

Tuesday, December 6, 2011

কিছু সাধারণ প্রশ্ন

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মনের মধ্যে বেশ কিছু অতি সাধারণ প্রশ্নের উদয় হয়, যা কোনভাবেই রাজনৈতিক চিন্তা-ধারণা প্রসূত নয় বরং একজন বাংলাদেশী হিসেবে কিছু মৌলিক চিন্তা মাত্র| এই প্রশ্নগুলোর উত্তর স্বাধীনতার এতো বছর পরেও পাওয়া যায়না বরং এতো বছর পরেও এই প্রশ্নগুলো করতে হয় দেখে কিছুটা অবাক হই| বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বর্তমানে চলাকালীন প্রতিযোগিতার সময় প্রশ্নগুলো আরও বেশি করে উঁকি দেয়| বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান চেষ্টা করেছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে আমাদের মুছে দিতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান কখনই পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন দেশের অংশ হিসেবে মনে করেনি, বরং সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শোষণ ও নির্যাতন বজায় ছিলো| একটি স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান কখনই পারতপক্ষে স্বাধীন ছিলো না| বরং রাজনৈতিক শোষণ থেকে শুরু করে সামাজিক শোষণ সব দিকেই পূর্ব পাকিস্তান জর্জরিত ছিলো| এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকেও কোনো রকমের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি| এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং তাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গুলিবর্ষণ| অন্য ইতিহাস ঘাটার কোনো দরকার দেখি না বরং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দেখেই আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত| তারপর একের পর এক ঘটনার প্রবাহে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা| ১৯৭১ সালের নয় মাস দীর্ঘ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাধারণ ভাবেই অনেকগুলো অভিযোগ আনা সম্ভব| তার মধ্যে গণহত্যা, জেনেভা কনভেনশন অমান্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ এর অভিযোগ অন্যতম| শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ এর গণহত্যাই নয়, দীর্ঘ ৯ মাস ধরে যে হত্যাযজ্ঞ বজায় ছিলো তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো ধরনের অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এর সরকার করেছে বলে আমার মনে পড়ছেনা| একই ভাবে পরাজিত পাকিস্তান সরকার তাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের বিচারকার্য পরিচালনা করেছে বলে আমার জানা নেই| তাই মানবধিকারের চরম অবমাননা এবং গণহত্যার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে তো নয়ই, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সরকার উভয়ই এড়িয়ে গেছে| এতো বছরেও অভিযুক্ত সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো রকমের ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা না নেওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বর্তমান পাকিস্তান সরকারও এই বিষয়টিকে পরোক্ষভাবে নয় বরং প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে| বাংলাদেশের ভূখন্ডে যুদ্ধচলাকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কোনধরনের মানবাধিকার এবং জেনেভা প্রটোকল অনুসরণ করেনি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এর উদাহরণ| নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন এবং যুদ্ধকালীন বন্দীদের কোনো রকমের মানবিক বিবেচনা করা হয়নি, একই সাথে ছিলো নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ| এই ঘটনাগুলোর সুষ্ট কোনো তদন্ত স্বাধীনতার পরেও হয়নি, এবং এই অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেও কোনো আন্তর্জাতিক কূটনীতি দেখা যায়নি| বিজয়ের ঠিক ২ দিন আগে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে সংঘটিত বুদ্ধিজীবি গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে চরম কলংকিত একটি অধ্যায়| একটি দেশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যে নীল-নকশা, যে অমানবিক ও নৃশংস বুদ্ধিজীবি নিধন অভিযান চালানো হয়েছিল, তার থেকে এটা স্পস্ট যে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের কার্পণ্য ছিলোনা পাকিস্তানের| তাই ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাত থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান একই সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, জেনেভা প্রটোকল লঙ্ঘন সহ আরও বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, ৪০ বছর পরেও যার কোনো সুষ্ঠ তদন্ত কিংবা আন্তর্জতিক ভাবে বিচার হয়নি| বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে আমাদের বিরুদ্ধে, পরিকল্পিতভাবে ধংসস্তুপে পরিণত করা বাংলাদেশ যাতে কোনভাবেই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাড়াতে না পারে তার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সব কয়টি দাতা দেশে পাকিস্তান চরম তত্পরতা চালায়| স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া দূরে থাক, যুদ্ধে পরাজিত হয়েও আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কূটনৈতিক কার্যক্রম আমাদের সত্তার বিরুদ্ধে তাদের হিংস্র মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ| কিন্তু যে দেশ কর্তৃক এহেন নির্যাতন, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভাবে কার্যক্রম করা দূরে থাক, বাংলাদেশ সরকার উল্টো সম্প্রীতির হাত বাড়াচ্ছে| ইতিহাস কখনো পুরনো হয়না, তাই তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধপরবর্তী দেশ সামলানোর সাথে সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব না হলেও তার পরবর্তী সরকারগুলোর কি সমস্যা ছিলো, এটা একটা প্রশ্ন| শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ৪০ বছর পড়ে যখন বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো, তখনো পাকিস্তানের সেই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা দূরে থাক বরং আমরাই তাদের জামাই আদর করছি| যাদের জন্য আমাদের দেশের ৩০ লক্ষ্ মানুষ শহীদ হলো, ২ লক্ষ্ নারী ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার হলো, দেশ একটি ধংসস্তুপে পরিণত হলো, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ না এনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু?? পাকিস্তানের নাম সামনে আসলেই অনেকগুলো শব্দ পাশাপাশি মনে চলে আসে- যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, নির্যাতন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, জঙ্গি, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস... আরো আরো অনেক| এর কোনোটিই পাকিস্তানের প্রতি নরম মনোভাব জাগানিয়া নয়| যেই দেশটি প্রত্যক্ষভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত, ধংসপ্রায় অর্থনীতি, চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রবিন্দু তাদের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব তৈরী করার আকাংখা দেখলে আসলেই অবাক হতে হয়| শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও জঙ্গিদের প্রত্যক্ষ মদদ দেওয়ার অভিযোগে যারা অভিযুক্ত তাদের সাথে সবরকমের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা তো দূরে থাক বরং সম্প্রীতির আহব্বান করা হচ্ছে| যখন দেশের দাতাগোষ্ঠির সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো, আরব দেশগুলোর সাথে সরকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনায় যথেষ্ঠ সক্ষম, তখন পাকিস্তানের মতো একটি দেশের সাথে গায়ে পড়ে সম্পর্ক তৈরির কি যুক্তি থাকতে পারে?? বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যে দেশটি বিরোধিতা করে যাচ্ছে এবং সময় সুযোগ মতো ছোবল মেরে যাচ্ছে, তাদের সমর্থন করার কি যুক্তি থাকতে পারে আমি জানিনা| বর্তমানে বিজয়ের মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে দেশে আমন্ত্রণ করে এহেন মর্মান্তিক নিষ্ঠুর রসিকতার কি মানে থাকতে পারে?? তাহলে কি বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখন্ডে কিছু মানুষের (নাকি অমানুষের) পাকিস্তানি পতাকা দেখার জঘন্য কুরুচিমূলক বাসনা চরিতার্থ করার জন্য এ আয়োজন?? যে দেশ এখনও তাদের অমানুষিক বর্বর কর্মকান্ডের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি, তাদের জন্য আমাদের দেশের মাটিতে স্থান হয় কি করে?? আরও জানতে ইচ্ছে করে খেলার সময়ে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে যারা উল্লাস করে, গায়ে এঁকে যারা পাকিস্তানকে ফিরে পাবার জঘন্য নগ্ন-বাসনা সোল্লাসে দেখানোর সুযোগ পায় তারা কি এদেশের নাগরিক?? কোনো রাজনীতি নয়, বরং দেশের অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচারণ করা কি অযৌক্তিক?? তাই অনেকগুলো প্রশ্নের এখনও কোনো উত্তর মেলে না, কেন পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না?? কেন বাংলাদেশের সরকার তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে?? হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের স্বীকার একটি দেশ কেন তাদের চরম শত্রুর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে?? আর তার থেকেও যে প্রশ্নটা বেশি মনে আসে তা হলো- স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ডে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক পাকিস্তানের পতাকা উড়ায় কিংবা সমর্থন প্রদর্শন করে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ কেন আনা হবেনা???