Friday, December 7, 2012

অক্ষয় কিছু মুহূর্ত

একটি ছবি হাজারো বাক্যের থেকে বেশি শক্তিশালী। ছবি স্থির-মৌন হতে পারে, কিন্তু তার প্রকাশ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং তীব্র। একটিও শব্দ ব্যয় না করে অজস্র শব্দের তৈরী গভীর অনুভূতি তৈরী করতে সক্ষম। কোন কোন ছবি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হই, কখনও আবেগে আপ্লুত হই আবার কখনওবা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আমাদের সত্ত্বা। আমি তাই চিত্রগ্রাহকদের শ্রদ্ধা করি। আবার ঈর্ষা করি কারণ তাদের মতো নিরব থেকে অসংখ্য কথা বলে যাওয়ার নিপুন ক্ষমতা আমার নেই।


পেশার জন্যে হোক কিংবা ভালো লাগার কারণেই হোক, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে যন্ত্রের সহজলভ্যতায় চিত্রগ্রাহক এর সংখ্যা বেড়েছে। অজস্র রঙ্গিন ঝকঝকে ছবির ভিড়ে দুর্দান্ত কিছু মুহূর্ত প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে। মুগ্ধতা সেসব মানুষের জন্য, তাদের অনবদ্য-অন্তর্ভেদী দৃষ্টির জন্য, খুব সাধারণ মুহুর্তের মাঝে থেকেও অসাধারণত্ব খুঁজে বের করার ক্ষমতার জন্য।


পৃথিবীর ইতিহাসে এমনই কিছু মুহুর্তের স্থিরচিত্র অমর-অক্ষয় হয়ে স্থান করে নিয়েছে, এরকমই অসাধারণ কিছু মানুষের জন্য। মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে-বিশ্বকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। এরকম শক্তিশালী কিছু ছবির মাঝে থেকে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কয়েকটি রয়েছে, যেই ছবিগুলো এখনও যতবার দেখি আমাকে বাকরুদ্ধ করে রাখে। এই ছবিগুলোর পেছনের ইতিহাসও ঠিক ততোটাই শক্তিশালী।


১.
kevin-carter-vulture

ছবিসূত্র- কেভিন কার্টার, নিউইয়র্ক টাইমস

১৯৯৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত সুদানে জাতিসংঘের খাদ্যবিতরন কেন্দ্র থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরত্বে এই মুহুর্তটি ধারণ করেন চিত্রগ্রাহক কেভিন কার্টার। এই ছবিটি নিউইয়র্ক টাইমস এ ছাপা হলে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় শিউরে উঠে তৎকালীন সমাজ। ছবির মৃতপ্রায় শিশুটি কোনমতে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল খাদ্যবিতরন কেন্দ্রের দিকে আর পেছনে তার মৃত্যুপ্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলো শকুনটি। পরবর্তিতে শিশুটির ভাগ্যে কি হয়েছিল তা জানা যায়নি। মর্মস্পর্শী এই ছবির কারণে ১৯৯৪ সালে কেভিন পুলিতজার পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই শিশুটির জন্য কিছু না করার কারণে কেভিন প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুখীন হন এবং আত্মগ্লানিতে ভুগে তার তিন মাস পরে আত্মহত্যা করেন।


২.
0,,15751521_303,00

ছবিসূত্র- নিক উত্, এসোসিয়েটেড প্রেস

ভিয়েতনাম যুদ্ধের নৃশংসতার এই মুহুর্তটি মুঠোবন্ধী করেন চিত্রগ্রাহক নিক উত্। ৮ই জুন, ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর নাপ্লাম বোমা হামলায় আক্রান্ত ও দগ্ধ হয়ে ভিয়েতনামের তরাং বাং গ্রামের নিকটবর্তী রাস্তায় দৌড়ে পালাচ্ছিল আহত-আতংকিত এই শিশুরা। ছবির মধ্যবর্তী কিম ফুক নামের শিশুটি নাপ্লাম বোমার কারণে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে তার জ্বলন্ত বস্ত্র খুলে ফেলে। এসোসিয়েটেড প্রেসে ছাপা হওয়া এই ছবিটি নিককে পুলিতজার পুরস্কার এনে দেয়। চিত্রগ্রাহক নিক আহত শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং পরবর্তী জীবনে তার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।


৩.
child-1561

ছবিসূত্র- রশিদ তালুকদার

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সেই বিক্ষুব্ধ সময়ের দুর্দান্ত এই মুহুর্তটি উঠে আসে চিত্রগ্রাহক রশিদ তালুকদার এর ক্যামেরায়। ঢাকার রাজপথ কাঁপানো জনতার মিছিলের ঠিক সামনে এই ছোট্ট শিশুটির তীব্র স্লোগানে সেদিন অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং চিত্রগ্রাহক নিজেই। জনতার দাবি ও মুক্তির আন্দোলন ঠিক কতোটা গভীর ও শক্তিশালী ছিলো যে তা স্পর্শ করেছিল নির্ভয় এই শিশুটিকেও। ছবিটি রশিদ তালুকদারের অন্যতম সেরা একটি কাজ।


৪.
6a00d8341c2c7653ef01156efbe86d970c-800wi

ছবিসূত্র- এডওয়ার্ড থমাস এডামস, এসোসিয়েটেড প্রেস

দক্ষিন ভিয়েতনামের জাতীয় পুলিশপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নগুয়েন ন্গক পিস্তলের গুলিতে ভিয়েতকং অফিসার নগুয়েন ভ্যান লম্ কহত্যা করেন সায়গনের রাজপথে। দিনটি ছিলো ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮। মুহুর্তটি ধারণ করেন চিত্রগ্রাহক এডি এডামস। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম শক্তিশালী একটি ছবি। এই ছবিটি ছাপা হলে সারা বিশ্বে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ছবিটি ছাপা হয় এসোসিয়েটেড প্রেসের পক্ষ থেকে এবং ১৯৬৯ সালে এডামসকে পুলিতজার পুরস্কার প্রদান করা হয়।


৫.
enhanced-buzz-wide-4701-1338497429-4

ছবিসূত্র- জেফ ওয়াইডেনার, এসোসিয়েটেড প্রেস

৪ঠা জুন, ১৯৮৯ এর রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরে, এদিন চীনের তিয়ানানমেন স্কয়ারের প্রতিবাদকারীদের সম্পূর্ণ স্তব্ধ করতে প্রধান স্কয়ারের দিকে এগোতে থাকে প্রায় ২৫টি ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের পথ রুদ্ধ করতে সবার আতঙ্কিত দৃষ্টির সামনে, পূর্ব-পশ্চিম কোণের রাস্তা দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকা সাজোয়া গাড়িগুলোর সামনে হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন একজন সাধারণ মানুষ। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়া মানুষটির দুই হাতে
বাজারের ব্যাগ।
এই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্ধী করেন চিত্রগ্রাহক জেফ ওয়াইডেনার। তাঁর এই ছবিটি "ট্যাঙ্ক ম্যান" নামে পরিচিত। অন্যায়ের প্রতি একজন সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ছবিটি বিশেষভাবে পরিচিত।


৬.
enhanced-buzz-wide-20872-1338324598-18

ছবিসূত্র- এসোসিয়েটেড প্রেস

১৯৬৮, মেক্সিকো অলিম্পিকের পুরস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে "ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট" এর মাধ্যমে সেসময়ের বর্ণবাদী অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতিবাদ-আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছেন ১৬ অক্টোবর সকালে ২০০ মিটার দৌড়ে ১৯.৮৩ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড তৈরী করে প্রথম স্থান অধিকার করা টমি স্মিথ এবং একইসাথে ২০.১০ সেকেন্ড সময়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করা তারই বন্ধু জন কার্লোস। সাথে ব্যাজ বুকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়াবিদ পিটার নর্মান, তার সময় ছিলো ২০.০৬ সেকেন্ড। পরে এই প্রতিবাদের জন্য ক্রীড়াবিদ দুজনকেই বহিঃস্কার করা হয় এবং পরবর্তিতে নানা ধরনের অপমান সইতে হয়। অনবদ্য এই ছবিটি বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি জ্বলন্ত প্রতীক।


৭.
966942-vancouver-riots


ছবিসূত্র- রিচার্ড ল্যাম

ভ্যাঙ্কুবার এ স্ট্যানলি কাপের ফাইনালের পরে হঠাৎ শুরু হওয়া দাঙ্গায়, দাঙ্গা পুলিশের শিল্ড এর ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান এলেক্স থমাস। মারামারি, টিয়ার গ্যাস, দাঙ্গা পুলিশ, জ্বলন্ত গাড়ি এসব কিছুর মাঝে আতংকিত প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিচ্ছেন স্কট জনস। ২০১১ সালে চিত্রগ্রাহক রিচার্ড ল্যাম এর এই ছবিটি সহিংসতার বিরুদ্ধে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে সারা পৃথিবীতে আলোচিত হয় এবং খ্যাতি অর্জন করে।

_______________________________________________________________________________

অজস্র অসাধারণ ছবি থেকে এই সাতটি ছবি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে। ছবিগুলো যতবার দেখেছি ততবার আবেগআপ্লুত হয়েছি। প্রত্যেকটি ছবির আলাদা আলাদা তাৎপর্য এবং বিশেষ আবেগ রয়েছে, যা হৃদয় স্পর্শ করে করে। এধরনের অসংখ্য চিত্রগ্রাহক যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে দুঃসাহসিকতার সাথে কাজ করে চলেছেন তাদের শ্রদ্ধা। মৌন থেকেও অনুভূতির ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম এরকম আরও ছবি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করুক।

Tuesday, December 4, 2012

মুক্ত ও স্বাধীন ইন্টারনেট এর জন্য


Pledge to support a free and open Internet


“A free and open world depends on a free and open Internet. Governments alone, working behind closed doors, should not direct its future.The billions of people around the globe who use the Internet should have a voice.”




ইন্টারনেট আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট এর কারণে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি আমাদের জীবন যাপনের যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে তার বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু উদ্ভাবনের শুরু থেকে এই ইন্টারনেটের অসাধারণ শক্তিকে ভয় পেয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার। বারবার ইন্টারনেটের উপরে বিধিনিষেধ এর শেকল পড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। মূলত ইন্টারনেটের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের যুক্তি দেখিয়ে বারংবার চেষ্টা করা হয়েছে তথ্যের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এই ইন্টারনেটকে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিস্থিতিতে নিয়ে আসার। বিগত বছরগুলোতে ইন্টারনেট মানবাধিকার পরিস্থিতি হতে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। উইকিলিক্স এর মতো প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতিবাজ অত্যাচারী সরকারগুলোর হাজার হাজার গোপন নথি জনসমক্ষে ফাঁস করে দেয়া শুরু করে তখন বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশে বিভিন্ন আন্দোলনে যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে তখনও সরকারগুলো তথ্যের অবাধ সরবরাহের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো সবসময়ই মুক্ত এবং স্বাধীন একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য। বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করে চেষ্টা করেছে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করার, চেষ্টা করেছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত জগতে হস্তক্ষেপ করার।


ইন্টারনেট আমাদের মানবসভ্যতাকে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই দিয়েছে। তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে নিজেদের তথ্য সংক্রান্ত অধিকার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সংরক্ষণ করার। বর্তমান বিশ্বে নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে অন্তত সাধারণ নাগরিক হিসেবে এতটুকু বোঝা সম্ভব সাধারণ জনগনের এই মুক্ত স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্র ইন্টারনেট এখন অনেক সরকারেরই চক্ষুশুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ অনেকবার নেমে এসেছে। ইউটিউব বন্ধ করে অসংখ্য মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যদি আন্তর্জাতিকভাবেই আইন করে এই ক্ষমতা সরকারের কাছে তুলে দেয়া হয় যে, সরকার যখন খুশি নিজের মতো করে অধিকার খাটিয়ে ইন্টারনেট এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে তাহলে বুঝতে বাকি থাকেনা কি অপেক্ষা করছে সামনে।


‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স (ডব্লিউসিআইটি)’ শীর্ষক সভায় ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সোমবার দুবাইতে আলোচনায় বসেছে ১৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা। প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে যাচ্ছে গুগলের মতো নানা প্রতিষ্ঠান। যখন অনলাইনে সক্রিয় দুই বিলিয়ন মানুষের অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার-অনধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের ক্ষমতা গুটিকয়েক মানুষের হাতে চলে আসে তখন সেটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হবেই।


মুক্ত ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে নানা দেশের সরকার বিধিনিষেধ জারি করে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন ৪২টি দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ ইন্টারনেট কার্যক্রম ফিল্টার করে, শুধু তাই নয়, গত দুবছরে বিশ্বে প্রায় ১৯টি আইন করা হয়েছে অনলাইনে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। The International Telecommunication Union (ITU) ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রনের এরকমই কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে এবারও সভায় বসেছে। শুধু তাই নয় কিছু প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে, সরকারের কাছে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে দেশের অভ্যন্তরীণ ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার এবং এতে উপস্থাপিত সকল তথ্য নিজের ইচ্ছামত ফিল্টার/সেন্সর করার। অনেক সুবিধা এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে ব্যবহার করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এমনকি দিতে হতে পারে অতিরিক্ত খরচ।


ইন্টারনেট ব্যবহার নীতিমালার আলোচনার ক্ষেত্রে শুধু সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে একচেটিয়া ক্ষমতা থাকতে পারেনা। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এরকম ভাবে কোন সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বিশ্বের যেকোন দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে মেনে নেয়া অনুচিত। ইন্টারনেট সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্তে এর ব্যবহারকারীদের মতামতও গ্রহণ করা উচিত। তাই গুগল তাদের ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো গুগল এর হোমপেজে ইতিমধ্যেই এটি লক্ষ্য করেছেন।

তাই অনুরোধ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের, নিজেদের মূল্যবান সময়ের কিছু মুহূর্ত খরচ করে এই পিটিশনটি সমর্থন করুন। সারা বিশ্বের ব্যবহারকারীরা এক হলে অবশ্যই আশা করা যায় যে, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার আগে সরকারগুলো দ্বিতীয়বার অন্তত চিন্তা করবে।


দরকারী লিঙ্কগুলো-

A free and open world depends on a free and open web.

What's at stake?

"Pledge to support a free and open Internet"

Past Actions

Friday, November 30, 2012

জীবনযুদ্ধ

শ্বেতশুভ্র চুল-দাড়ির বর্ষীয়ান মানুষটি তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে। হালকা শীতের সকালে সামনের গাছটায় ছোট্ট দুটো চড়ুই পাখির ঝগড়া। ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু করে কাঁপে গাছের শুকনো পাতা। রাস্তা দিয়ে রোজকার মতো আজকেও ব্যতিব্যস্ত মানুষের দল ছুটে চলে অনির্দিষ্ট পথে। এসব কিছুই তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে পারেনা আজকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু ভাবেন, ভেবে চলেন, মাথার ভেতরে অজস্র স্মৃতিরা যুদ্ধ করে, ফিরে ফিরে আসে। নিজের অজান্তেই একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় যান্ত্রিক জীবনের কোলাহলমুখরতায়।


ছোট্ট নাতনীটি পাশ ঘেঁষে বসে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দাদুর পায়ে লাগানো সাদা ব্যান্ডেজ এর দিকে। গোড়ালির কাছটায় লাল ছোপ। তিনি মুখ তুলে তাকান, নাতনীর অবাক বিস্ময় তাকে একটু হলেও স্পর্শ করে। ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকিয়ে নিজেও মাথা নাড়েন একটু একটু।

"এখানে কি হয়েছে দাদু?"

এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা থাকলেও, সত্যি উত্তরটা তার দেয়ার ইচ্ছে নেই। তিনি চুপ করে থাকেন, নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।



তার চোখে ভাসে, ৭১ এর আগস্টের ২ তারিখ।

নোয়াবাদী রেললাইনের পূর্বপাশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সেদিন যে ১১ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি আক্রমন করেছিল, তিনি ছিলেন তাদেরই একজন। তখন তিনি টগবগে যুবক। সেদিন যুদ্ধের শুরু থেকে ঘন্টা তিনেক তিনি আর হাবিলদার নবী মিলে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। এরইমাঝে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া একটি মর্টার শেল তাদের সামনে এসে পড়ে। প্রচন্ড শব্দে মুহূর্তেই বড় একটা গর্ত করে দেয় মাটিতে। বিস্ফোরণের সাথে সাথে স্প্লিন্টার ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে। তার পায়েও এসে বেঁধে কয়েকটা। কিন্তু মর্টার চালানোর ফাঁকে আর খেয়াল ছিলোনা ওতো। যখন খেয়াল হলো তখন দেখেন রক্তে ভিজে গেছে মাটি, আর গোড়ালিটা ভেঙ্গে বিচূর্ণ হয়ে গেছে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান।

সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে নিয়ে যায় আগরতলা হাসপাতালে। জ্ঞান ছিলোনা কয়েকদিন। সেসময় হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। গোড়ালির এরকম অবস্থায় চিকিৎসা সহজ ছিলোনা মোটেও। পরে একে একে বেশ কয়েকটা জায়গায় চিকিৎসা হয়েছিল। সর্বশেষে ছিলেন রামগড়ে। হাসপাতালে থাকতেই শোনেন দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা। ভারতীয় সৈনিকেরা এসেছিল শুভেচ্ছা জানাতে। অশ্রুসজল হয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের কথা শুনে।

...............ঠিক মনে হয় সেদিনের কথা।

কথাগুলো মনে পড়তেই অজান্তে দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তার দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকে।



যুদ্ধ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। সেই স্বাধীন দেশে মলিন পোশাকে তিনি এখন পায়ের যন্ত্রনায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন। আশেপাশের লোক ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ভাবে কোন ভিক্ষুক হয়তো, এখনই হাত পাতবে এসে। স্বাধীন দেশে রাজাকার হয়েছে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী। তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছে বঙ্গভবনে। তিনি রাষ্ট্রপতির মুখের উপর বলে এসেছিলেন, রাজাকার রাষ্ট্রপতির সাথে হাত মেলাবেন না। কথাটা মনে পড়তেই এতো কষ্টের মাঝে হাসি পায় তার। রাজাকাররা গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা লাগিয়ে ঘোরে, সার্টিফিকেটের জোরে অনেকেই হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সবই দেখেন, সবই বোঝেন।

প্রচন্ড কষ্ট আর বুক ভরা অভিমান নিয়ে তার মনে হয়, নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন না হয়ে দেশটা ভিয়েতনামের মতো যদি ৬ বছরে স্বাধীন হতো, তা হলে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারতো, স্বাধীনতার মানে কী।


ডান পা টা আস্তে করে সরাতে গিয়ে ব্যথায় মুখ কুঁচকে যায় তার। সেই ৭১ এর স্প্লিন্টারগুলো আজও রয়ে গেছে গোড়ালির ভেতরে। একের পর এক সাতটা অপারেশন হয়েছে পায়ে, কিন্তু তাও কিছু হয়নি। সুচিকিৎসার অভাবে গোড়ালির ভেতরে এখন ইনফেকশন। তাই একদিন পর পর চলে ড্রেসিং। রক্তে ভিজে থাকে জায়গাটা। টাকার অভাবে কোনমতে ধার করে চলে চিকিৎসা। সুতীব্র যন্ত্রনা নিয়ে তবুও তো স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকা !!


৪১টা বছর ধরে এভাবেই যুদ্ধের ক্ষত বয়ে নিয়ে চলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান, যেভাবে ক্ষত বুকে নিয়ে বেঁচে আছে তাঁর মাতৃভূমি। তিনি জানেন স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ হলেও, জীবনযুদ্ধে এখনও বাকি আছে অনেকটা পথ।



মূল- রাজাকার কীভাবে প্রেসিডেন্ট হন?

কৃতজ্ঞতা- সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক[/fn]



Tuesday, November 13, 2012

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন

গত কিছুদিন ধরে জামায়েতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবির সারাদেশে যে সহিংসতা-তান্ডব চালিয়েছে তার সচিত্র খবরগুলো দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি।

বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জন করতে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে যে পরিমান ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার সমতুল্য আর কোন ইতিহাস পৃথিবীর বুকে এখনও রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এই দেশের সাধারণ মানুষ লড়াই করেছিল পাকিস্তানের সুশিক্ষিত ভারী সমরাস্ত্র সজ্জিত সেনাবাহিনীর নরপশুদের বিরুদ্ধে। এই লড়াই এই দুই পক্ষের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো আর দশটা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এই ইতিহাসকেও বিশ্লেষণ করাটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের দেশের জনগনকে লড়তে হয়েছে এ দেশীয় কিছু বেজন্মার বিরুদ্ধেও। যারা এদেশের আলো-হাওয়াতে পরিপুষ্ট হয়ে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন করেছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। এই রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস গোষ্ঠী পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করতে গিয়ে গলায় ছুরি চালিয়েছিল এদেশের জনগনের। গনিমতের মাল সাপ্লাই এর দায়িত্ব নিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পগুলোতে। কারণ পবিত্র যুদ্ধের নামে সব জায়েজ।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক মদদপুষ্ট এই দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর কর্মকান্ডের সময় হিটলার বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো গোলাম আজম, সাইদী, নিজামী এসব ষড়যন্ত্রকারী দেশদ্রোহীর কাছে দীক্ষা নিতে আসতেন। পাকিস্তানি বাহিনী যখন বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত ভাবে ধ্বংস করে যাচ্ছিল, যখন সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়া দেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে তাকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে নারকীয় তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের আশির্বাদপুষ্ট এই রাজাকারবাহিনী এদেশের মানুষকে হত্যা করার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবেই মেধাশুন্য করে চিরদিনের মতো বিকলাঙ্গ করে দেয়ার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বিধর্মী ও কাফের হত্যার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত এই খুনির দল যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে পরিকল্পনার ছক অনুযায়ী দেশের বুদ্ধিজীবি ও প্রথম সারির আন্দোলনকারীদের হত্যা করে তাদের স্মৃতি দেশের মানচিত্র থেকে মুছে দেয়ার কর্ম সম্পাদন শুরু করে। তাদের চরম আঘাত ছিলো ১৪ই ডিসেম্বরের মাত্র এক রাতের মাঝে দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবিকে বধ্যভূমিতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা। তাদের এই পরিকল্পনার প্রধান কারণ ছিলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী শুভ বুদ্ধির অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোকে হত্যা করে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলাদেশের রক্তস্নাত জন্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রাখা, যাতে স্বাধীন ভূখন্ড অর্জনের পরেও বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে না পারে। স্বাধীনতার পরে যেসব মানুষের হাতে দেশকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হতো তাদের হত্যা করে বাংলাদেশের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে এবং দেশের নতুন প্রজন্ম যেন সত্যিকারের ইতিহাস সম্পর্কে সবসময় সাংঘর্ষিক মতবাদ এবং ধোঁয়াশার মাঝে থাকে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে তারা। বাংলাদেশের সাধারণ জনগনের কাছে পাকিস্তানিদের হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার দিনটি ১৬ই ডিসেম্বর হলেও, নীল নকশার বাস্তবায়নে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট এই দেশদ্রোহী রাজাকারবাহিনী অশুভ শক্তির যে বীজ বপন করে তারও নিরব জন্ম এই দিনটিতেই। সরব যুদ্ধের শেষ ১৬ই ডিসেম্বর হলেও নিরব যুদ্ধের শুরুও এই দিনটিই। মুক্তবুদ্ধি চর্চার জায়গাটিতে শুন্যস্থান তৈরী করে দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে পরিকল্পিতভাবে তারা বিক্ষুব্ধ একটি ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে দ্বন্দ-বিক্ষুব্ধ অনেকগুলো বছর। একদিকে যেমন ছিলো যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশের সামগ্রিক পুনর্গঠন এর চাপ অন্যদিকে ছিল বহির্বিশ্বে পাকিস্তান কর্তৃক অপপ্রচারের চাপ। একইসাথে দেশে তখন বিভিন্ন শ্রেণীতে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছিল। রাজনৈতিক পরিমন্ডলের সাথে সামরিক বাহিনীর স্নায়ুযুদ্ধ ছিলো এমনই একটি। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সুযোগসন্ধানীর কোন অভাব তখন ছিলোনা। আর যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত জীবনে তখন রাজনৈতিক-কূটনৈতিক আলোচনা বাতুলতা মাত্র। দেশের এই সময়টি ছিল দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে স্বর্ণখনির মতো। তারা পরিকল্পনামাফিক তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে গেছে নিরবে আর তাতে জড়িয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলে। আর দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ক্ষমতার দ্বন্দ তাদের এনে দিয়েছিল সেই অবারিত সুযোগ।

ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শেকলে আবার আবদ্ধ করে যায় খুনি সেনা সদস্যরা। আর সুবর্ণসুযোগ উন্মোচিত হয় দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে। তাদের নিরব উত্থান তখন যথেষ্ট সুসংহত। একটি স্বাধীন মানচিত্র পাওয়ার সাথে সাথেই এই মানচিত্রের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, গদি নিয়ে খামচা খামচির কারণে সেদিকে খুব একটা নজর না দিলেও তখন আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসেছিল কিন্তু এই স্বাধীনতাবিরোধীরাই। দেশের চার কান্ডারিকে হত্যা করে কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়েছিল সে সময়ে। সংবিধান পরিবর্তন করে যখন দেশের নব্য শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতা বিরোধীদের পরিকল্পনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায় তখন আসলে চিন্তা করতে কষ্ট হয় ঠিক কি কারণে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল এই দেশের মানুষগুলো। দেশের রাজনীতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে দ্বিধাবিভক্ত সমাজকে আরও বিভক্ত করে দেয়া এই পরিকল্পনারই অংশমাত্র। স্বাধীনতা পরবর্তিতে ৭৫ এর পরে দেশকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেকগুলো সরকার যেগুলো পারতপক্ষে কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেনা। দেশের সার্বভৌমত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্র এই মূল চেতনাগুলো এই সরকারগুলো বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট ছিলোনা কখনোই। অবশ্য পরিকল্পনাতেই ছিলোনা এই ধারনাগুলো। বরং স্বাধীনতাবিরোধীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র এবং অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছিল আমাদের দেশ। দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান তাদেরকে এই সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাজনৈতিকভাবেই। আর দিন যত এগিয়েছে রাজনীতি আর ধর্মের লেবাসে এরা নিজেদের শক্তিশালী মহীরুহতে পরিণত করেছে। দেশের ইতিহাস ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়েছে যাতে বুদ্ধিজীবি হত্যার মাধ্যমে যে বিকলাঙ্গকরণ প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছিল তার ধারা আরও শক্তিশালী হয়।

ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে সমাজকে-জাতিকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে এবং স্বাধীনতা বিরোধীরা তাতে সফল হয়েছে। দেশকে নিরবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলা স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান কোন সময়ই থেমে থাকেনি। আর তাদের এই পরিকল্পনা সার্থক হয়েছিল যখন দেশের জনগনই তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতার আসনে বসিয়েছিল। যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর দায়িত্ব অর্পণ করেছিল একদা এই পতাকাকে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন করে দেয়া পশুগুলোকেই। তাই সেসময়ে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার বুকে লাথি মারার সাহস দেখিয়েছিল তারা। আসলে লাথি মেরেছিল আমদের বুকে। তাদের মুখে তখন নুরানী ছাপ, ধর্মের ব্যবসা করে অনেকদুর এগিয়ে যাওয়া সেই পশুগুলো মুখোশের আড়ালে তাদের শদন্ত নিয়ে ঘোরাফেরা করে। সাধারণ জনগণ তাদের চিনতে ব্যর্থ হয়, যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে।

সাম্প্রদায়িকতা আর বিভক্তির কূটচালে রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট শক্তিশালী দল এখন জামায়েতে ইসলামী আর তাদের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির। ধর্মীয় লেবাসে খুনিদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড এই অপশক্তির শেকড় আজ অনেক গভীরে। এই শেকড় এনে দিয়েছে তাদের শক্তি॥ দেশের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের সংহত অবস্থান। তাদের বিষবাষ্পে আক্রান্ত সমাজ পূর্বের মতোই দ্বিধাবিভক্ত। দেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু হত্যা-নির্যাতন, দেশের সাংস্কৃতিক চেতনার বিরুদ্ধে একের পর এক আঘাত এসবই এর প্রমান। বিগত সরকারের আমলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের শক্তির পূর্ণ ক্ষমতা প্রদর্শন করে দেশকে রক্তাক্ত করেছে অসংখ্যবার। আজকে আবার যখন পূর্ণশক্তিতে এরা দেশে তান্ডবলীলা সম্পন্ন করে তখন বোঝা উচিত আরেকটি পাকিস্তান গড়ার স্বপ্নে বিভোর চক্রটির ক্ষমতা কতখানি। এদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পুনর্বাসন করে শাসক জিয়া যেই প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় আজকে তার হাতে গড়া বিএনপি যুদ্ধপরাধী গোষ্ঠীর একটি অংশমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরগাছার মতো শুরু করলেও আজ ডানপন্থী দলটিকে প্রায় পুরো গ্রাস করে নিয়েছে এরা। অবশ্য পরগাছার বৈশিষ্ট্যও এটাই। বিএনপির যেকোন সমাবেশে যেকোন কর্মসূচিতে সর্বাগ্রে থাকে জামায়েতে ইসলামী। আজকে দেশে লাগাতর অরাজকতা সৃষ্টির জন্য যে ক্ষমতার প্রয়োজন তা এদের আছে এবং তারা বারংবার সেটা ভালোভাবে প্রমান করেছে।

রগকাটা আর জবাই করে হত্যা করার রাজনীতি করে ঘৃণিত ইসলামী ছাত্র শিবির এর সমর্থক আজকে নেহায়েত কম নয়। ইসলাম মানলে শিবির করা উচিত এরকম ধারনায় উদ্বুদ্ধ সংগ্রামী শিবিরকর্মীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বিগত বছরগুলোতে। আরও আশঙ্কাজনক কারণ এদের অনেকেই তরুণ, এরা ইসলাম আর খুনি শিবিরকে একত্রে মিলিয়ে ফেলে। দেশের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন সগর্বে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় আর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায় জামায়েতের মদদপুষ্ট এই অপশক্তির পুনর্জাগরণ দেশের জন্য একটি অশনিসংকেত হয়ে ছিল অনেকদিন ধরেই আজকে তারা সেটা ভালভাবেই জানান দিয়েছে। যখন বারবার অভিযোগ উঠেছে এই দলটি যুদ্ধপরাধীদের বিচার বানচালের জন্যই অরাজকতা সৃষ্টি করছে তখন বিরক্তিতে ভ্রুকুঞ্চিত করেছে অনেকেই। কিন্তু আজকে যখন এটা প্রমাণিত সত্য তখন আর এই অভিযোগকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দুষ্ট রাখল বালকের মতো বাঘ এলো, বাঘ এলো চিৎকারে বিরক্ত আমরা যখন নিজেদের স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্নে বিভোর তখন বাঘ এসেছে নিরবে, থাবা বসিয়েছে গভীরে আর এর ক্ষতচিহ্ন আমাদের সামনে জ্বলজ্বলে। একইভাবে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠগুলোতে পরিকল্পিতভাবে তারা যেই ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়েছিল তাতে অনেকেই যোগ দিয়েছে আর এই প্রজন্ম এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিপদজ্জনক একটি রাস্তায় অগ্রসরমান। জামায়েত আর শিবির এদেশের ধর্মভীরু মানুষের সবথেকে দুর্বল জায়গাটি নিয়ে চক্রান্ত করেছে আর তাতে তারা পুরোপুরি সফল। আজকে যখন দেশের প্রধান মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে বারবার সহিংস ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে এই অপশক্তি ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন দেশের সাধারণ জনগণ ভুলে যায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই জায়গাতেই সাধারণ মুসল্লিরা জুতোপেটা করেছিল গোলাম আজমকে। আজকে দিকভ্রান্ত সাধারণ মানুষ তাদের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য নিয়ে সন্দিহান| ঠিক এতোটাই জঘন্যভাবে আমাদের মূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে জামায়েতে ইসলামী আর ইসলামী ছাত্রশিবির।


আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা জামায়েতে ইসলামীর কূটনীতির কাছে তাদের শিশুতোষ আচরণ নিয়ে আবারও দ্বন্দে লিপ্ত। তারা রমনার বটমূলে বোমা হামলা থেকে শুরু করে রামুর সাম্প্রদায়িক হামলা সব কিছুর জন্য একে অপরকে দোষ দিয়ে খালাস। দেশের বিরোধী দলীয় নেত্রী সরকার দলের প্রধানমন্ত্রীকে এসব সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য দায়ী করেন আর সরকার দলের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতে শিবিরকে প্রতিহত করা নাকি তাদের কর্তব্য নয়। আর দ্বিদলীয় পরিবারতন্ত্রের পুরনো এসব কোলাহলের মাঝে তারা ভুলে যান যদি রাজনীতি করার জন্য দেশটাই অবশিষ্ট না থাকে তাহলে গলার জোরে বক্তৃতা করবেন কোথায় দাঁড়িয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি দেশের প্রধান দুটো বিরোধীদলই নিজেদের স্বার্থে যে কালসাপকে দুধ-কলা দিয়ে পুষে এসেছে সেই কালসাপ আজকে অজগরে পরিণত হয়ে তাদেরকে পুরো গিলে নিতে সক্ষম। আর এরপরেও ডিম আগে না মুরগি আগে জাতীয় তর্কে সময় নষ্ট করে চলেছে সবাই। যখন নিজেদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীরা তখন আমরা পূর্বের মতোই দ্বিধা-বিভক্ত এবং অসহায়।


আজকে যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তা দিয়েই তাকে পিটিয়ে আধমরা করে দেয়া হয় কিংবা রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় তখন বুঝতে হয় দেশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত গুন্ডারাও কতো অসহায়। ক্ষীনকায় ছাত্রদের পেটে আর পাছায় লাথি মেরে অভ্যস্ত পুলিশ সদস্যরা আজকে দৈত্যের হাতে নিতান্ত শিশু। যখন পত্রিকায় খবর ছাপা হয় সমগ্র দেশে অরাজকতা তৈরিতে বদ্ধপরিকর জামায়েত আর ছাত্রশিবির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য তখন আমরা আহা উহু করে বিব্রতবোধ করি। কেউ কেউ আবার গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে এদের রাজনৈতিক কর্মসূচি হালাল করতে নামে। কিন্তু সবাই একটা মূল কথা ভুলে যাই, যদি এসব বোলচাল চালানোর মতো দেশটাই আমাদের না থাকে, যদি দেশের অখন্ডতা, বাংলাদেশী হিসেবে সামাজিক ঐক্য, অসাম্প্রদায়িকতাই না থাকে তাহলে গণতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্র, তাতে কোন পার্থক্য আসবেনা। আর শুধু তাই নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধীরা, অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ যেই গোষ্ঠী তারা দেশকে আর যাই হোক স্বর্গ বানাতে সক্ষম হলেও তাদের সমর্থন করা জাতি হিসেবে মৃত্যুর সমতুল্য।


আজকে জাতি একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও যে প্রশ্নটি আমাদের মাঝে বিভক্তি এনে দেয় আজকে এই প্রশ্নটির সুরাহা হওয়া সত্যিই বড় প্রয়োজন। আজকে নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন আমরা কি আমাদের মূল্যবান স্বাধীনতার স্বপক্ষে নাকি বিপক্ষে? আমরা কি স্বাধীনতা রক্ষার্থে চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত নাকি বিভক্ত হয়ে পরাধীনতার শেকল পড়তে উদ্যত? আমরা কি অসাম্প্রদায়িক জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর নাকি ধর্মের নামে বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আগ্রহী? আমরা কি ঐক্যবদ্ধভাবে জামায়েতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত নাকি তাদের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে এগিয়ে যাচ্ছি?


এই প্রশ্নগুলোর কোন সুরাহাই হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ব্যক্তি অবস্থান থেকে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবো। আজকে দ্বিধাবিভক্ত থাকার সময় আর নেই, আজকে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। আমাদের আজকে নির্ধারণ করতে হবে আমরা কি আবার একবার ঐক্যবদ্ধভাবে আরেকটা ৭১ গড়ে তুলতে সক্ষম কিনা। আমি বিশ্বাস করি, ৭১ আমাদের চেতনায়, আমাদের মননে। একে মুছে দিতে সক্ষম হয়নি ঐ যুদ্ধাপরাধীরা, স্বাধীনতা বিরোধীরা। তাই আজকে আর একবার একসাথে উঠে দাঁড়াতে হবে। জাতি হিসেবে হয়তো আমাদের ব্যর্থতা অনেক, অর্জন স্বল্প। কিন্তু সেসবই আমাদের। যখন আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আঘাত আসে তখন আর এসব বিবেচনায় বিভক্ত থাকার বিলাসিতা আমাদের মানায় না। ঐক্যবদ্ধ আজ আমাদের হতেই হবে, নয়তো পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কখনোই ক্ষমা করবেনা।


আর ঠিক এ কারণেই আমি খুশি। যখন আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখনই হয়তো আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হই। আজ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উত্থানে আমরা একটি বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছি। একের পর এক আঘাতে আমাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। আমরা ঘুরে দাঁড়াবোই। পাল্টা আঘাতে গুড়িয়ে যাবে সব চক্রান্ত এ শুধু আমার বিশ্বাস না, এ আমি জানি।

“নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে। বেশি দূরে হ’তে পারেনা। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈ:। কেটে যাবে।”- আনোয়ার পাশা।






Friday, October 26, 2012

সেই আড্ডা

স্কুলে থাকাকালীন খুব একটা বেশি আড্ডা হতোনা। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ফলাফল বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে সময়টা ছিল এক্কেবারে ফাঁকা তখন ধুমিয়ে আড্ডা দেয়া হতো। পুরনো ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদের উপরে উঁচু একচিলতে জায়গায় বসে চলতো সেই মহাড্ডা। সবে বিঁড়ি ধরেছি তখন, বিষয়বস্তুহীন সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ধুম্রশলাকা জ্বালিয়ে চরম ভাব নিতাম। কতো কি নিয়েই না চলতো কথোপকথন। মোড়ের পুরির দোকানে আলু কম কি বেশি, এই থেকে শুরু করে আম্রিকার গুষ্ঠিশুদ্ধ আলাপে চলে আসতো। বেশ বড়সড় একটা দল ছিলো তখন। কেউ গান গাইতো, কেউবা নিজের একদম নতুন ব্যর্থ ভাব বিনিময়ের কাহিনী শোনাত। হতো সবই। তারপরে রাত বাড়তেই গুটিগুটি পায়ে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতো। আড্ডার শুরুতে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের হাঁটাটা যত দ্রুত থাকতো, ফেরার পথে থাকতো ততোটাই ধীর। সেই দিনগুলো চলে গেল খুব দ্রুত। এখনও মনে পড়ে সেই নোনায় ধরা ছাদ, তাতে গাদাগাদি করে বসে থাকা, মন কষাকষি। কখনো ঐ ছোট্ট ছাদেই লর্ডসের ক্রিকেট, কিংবা রঙ্গিন ঘুড়ি। পাশের বাসার মেয়েটির সাথে একটু চোখাচোখি, সলজ্জ হাসি। এসবই অতীত।

কলেজের প্রথমবর্ষে থাকাকালীন আড্ডার রেশটা তখনও ভালোভাবে আসেনি। নটরডেম এর হঠাৎ চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া যাওয়া জীবন, সাথে "জীবনে দৌড় ছাড়া কিছু নেই" এর প্রথম উপলব্ধি। তখন কোনমতে ক্লাস শেষ করে বাসায় আসতে পারলেই যেন বাঁচা যেত। তার উপরে সাপ্তাহিক পরীক্ষা, স্যার এর পড়া আরও আরও কতো কি! কিন্তু তবুও ধীরে ধীরে আড্ডা জমলো। তাছাড়া উপায়ই বা কি? এক ক্লাস শেষ হয়ে আরেক ক্লাস শুরুর মাঝের যে কিছু মুহূর্ত মাত্র, ঐটুকু সময়েই কি কথাই না বলতাম আমরা! আর ছিলো মধ্যবিরতির সেই মূল্যবান দশ-পনের মিনিট। প্রাণখুলে আড্ডা হতো। ছোট ছোট দলে কিংবা মাত্র দু-তিনজনে। বন্ধুত্ব গাড় হচ্ছিলো এভাবেই।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয়বর্ষ। ততদিনে শিখে গেছি কি করে সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে চলতে হয়। পরীক্ষা আছে? তাতে কি, ওতো থাকবেই। পড়া আছে? তাতেই বা কি, ওরকম তো থাকেই। তখন আমরা মাত্র স্বাধীন। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্লান্ত-শ্রান্ত আমরা তখন আড্ডা দিতাম রাস্তার মোড়ের চা-সিগারেটের দোকানে কিংবা আরামবাগ কলোনিতে বন্ধুর মেসের ছোট্ট একটা ঘরে। কখনো হেঁটে যেতাম বেইলি রোড পর্যন্ত, কখনও বা রিকশায় টি.এস.সি। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল খুব খুব দ্রুত। কলেজে উঠার আগে কেউ একজন বলেছিল, "দেখো, কলেজের দুইবছর চোখের পলকে চলে যাবে"। সত্যিই তাই! আড্ডায় উজির মেরে মাত্রই রাজাকে কব্জা করে এনেছি তখন দেখলাম হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল। সবাই খুব মনোযোগী হয়ে উঠলো, ফালতু সময় নষ্ট করার মতো হাতে বাড়ন্ত সময় কারো কাছেই আর রইলো না। স্রোতের টানে আমিও হাবুডুবু খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। জীবনের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে আমি হাঁফিয়ে উঠতাম কখনো কখনো। তখন ছুটে যেতাম আরামবাগ কলোনির সেই ছোট্ট ঘরে, যেখানে তিন চারজন মানুষ তাদের মূল্যহীন জীবনের কিছু মূল্যবান সময় হেলায় নষ্ট করে দিতাম। তারপরে আবার সেই দৌড়,দৌড়।

এরপরে বদলে গেল সবকিছু। দেশ ছেড়ে আরেকদেশে পড়তে গিয়ে দেখলাম, আশেপাশের মানুষগুলো ঠিক আগের মতো নয়। চলনে-বলনে কাছাকাছি হলেও এরা আমার মতো নয়। এরা জীবনকে চেনে অঙ্কের হিসেবে, নিক্তিতে মেপে নেয় সময়। এরা আড্ডাকে ফালতু সময় নষ্ট বলে মনে করে! কখনও একসাথে বসলেও ঘুরেফিরে প্রকৌশলী হয়ে মোটা অঙ্কের মাইনের একটা চাকরি ছাড়া এদের আর কোন কিছু নিয়েই কথা বলার থাকেনা। জীবন যান্ত্রিক, বুঝতে সময় লাগেনা মোটেও। তবুও খুঁজে নিলাম গুটিকয়েক আমার মতো ফাঁকিবাজ মানুষকে যারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাজে বকে যেতে পারে অনায়াসে, বিনা ক্লেশে। ধীরে ধীরে ঐ নতুন পরিবেশেও মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধটা আর যুদ্ধ রইলোনা।

তখন আড্ডা হতো ছাত্রাবাসের অনির্দিষ্ট কোন ঘরে, যখন যেমন। ঘর হতে দুরে এসে অপরিচিতের আপন হতে সময় লাগেনা। তাই দুই টাকার সিঙ্গারার সাথে চা হোক কিংবা শুধু চাটনি, আমরা লেগে থাকতাম, তর্ক করতাম, অযথা চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু প্রথমবর্ষ চলে যেতেই আবার ছিটকে গেল একেকজন, ছাত্রাবাসগুলোর একেক অংশে। তখন দল ছোট হয়ে কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, তাতে নতুন মুখ যোগ দিতো কদাচিৎ। আমরা তখনও রাজা-উজির মারতাম। গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায় কিংবা ভলিবলের মাঠে, কখনোবা বাস্কি-গ্রাউন্ড। যেই রাতগুলোতে বিদ্যুৎ থাকতো না সেই রাতগুলোতে চলে যেতাম ছাদে কিংবা যমুনার উপরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সেতুতে। সেই রাতগুলোতে আমরা যান্ত্রিকতা ছেড়ে স্বপ্নবিলাসী হয়ে উঠতাম। আমাদের ভেতরের দ্বিতীয় স্বত্তারা সব বের হয়ে আসতো কবি, গায়ক,তার্কিক কিংবা শুধুই শ্রোতা হিসেবে। হোক না মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যই।

সব বদলে যায়। তাই পরিচিত মুখগুলো বদলে গেল। সবাই জীবনকে সাজানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। জীবনের তাগিদে জীবনকে দেয়ার মতো ফুসরত কারো কাছেই আর রইলোনা। সবাই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে একজন একজন করে সৈনিক হয়ে গেল। আমি তখনও হতে পারিনি কিছুই। তাই সময়ের অভাব ছিলোনা আমার। আমি তখনও হেঁটে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায়, ভলিবলের মাঠে, বাস্কি-গ্রাউন্ডে কিংবা ভাঙ্গা সেতুতে, একা। এক সময় এই অধ্যায়েরও শেষ হলো। আমি পরাজিত আর একাই থেকে গেলাম।

দেশে ফিরে আর আগের মত আড্ডা জমেনা। সবাই ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে। "আমরা" থেকে সবাই এখন "আমি" কে নিয়ে ব্যস্ত। রাস্তায় এখন হাঁটা দায়। গলির মুখে দাঁড়ালেও ধুলো আর ধোঁয়ার চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমার আড্ডা দেয়ার পুরনো জায়গাগুলো আর নেই, নেই পুরনো মুখগুলোও। সরল থেকে জীবনের জটিল সমীকরণগুলো মেলাতে মেলাতে গোপনে কখন নিজেরাই জটিল হয়ে গেছি। তাই কদাচিৎ একসাথে হলেও আমরা এখন আর আগের মতো গান গাইনা, হুল্লোড় করিনা। আমাদের অনির্দিষ্ট হাঁটার পথগুলোর দৈর্ঘ্য এখন অনেক কম।

বাড়ির ছাদে উঠা নিষেধ! তাই টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে ইট আর লোহার জঙ্গলের মাঝে যে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায় সেটাই প্রাকৃতিক বিনোদন।আকাশচুম্বী দালান বানাতে গিয়ে আকাশটাই আজ ঢেকে গেছে, চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। যন্ত্র দিয়ে ঘেরা জীবন যান্ত্রিক হবে এটাই অবশ্যম্ভাবী। তাই সব কিছুর পেছনে আমরা শক্ত কারণ খুঁজি। অহেতুক কিছু করার মতো ছেলেমানুষী আমাদের আর পোষায় না।

আমি তারপরেও নিয়ম করে অহেতুক আড্ডা দিই। গভীর রাতে, তারাদের সাথে, একা।

Tuesday, October 23, 2012

অতীতের সন্ধানে কজন বোহেমিয়ান

এক মধ্যরাতে দীপ্রর ফোন থেকেই ঘটনার শুরু। মরমী সাধক লালনের জন্মউৎসবে যোগ দিতে কুষ্টিয়া যাওয়া হবে এটাই তার ইচ্ছা। আমিও কোন ধুনফুন না করে এক কথায় রাজি। তবে দুজনের মাথাতেই অন্যচিন্তা, যখন যাওয়া হচ্ছেই তখন শুধু কুষ্টিয়াতেই হয়তো সফর সীমাবদ্ধ থাকবেনা। তাহলে কি আগে থেকেই ঠিক করা হবে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, নাহ সেটাও পছন্দসই সিদ্ধান্ত হলোনা দুজনেরই। গিয়েই দেখা যাক পথ চলতে চলতে ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ হয় আমাদের এই অনির্দিষ্ট যাত্রা। ভবঘুরে-যাযাবর হওয়ার স্বাদ, নাহয় জীবনে একবার আস্বাদন করেই দেখা যাক। সাথে যোগ দিলো অভিজিৎ আর পার্থ।

আমি আর দীপ্র ছোট্ট দুখানা ঝোলা ঝুলিয়ে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করছি বাকি দুজনের জন্য। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করানোর পর বুয়েটের হল থেকে শেষপর্যন্ত অভিজিৎ আর পার্থ হাজির, তবে সাথে কোন ব্যাগ-ফ্যাগ নেই। অভিজিৎ এর অফিসে ছুটি মাত্র একদিনের তাই পরেরদিন সকালেই ফেরৎ আসতে হবে আর পার্থ নাকি খাঁটি বোহেমিয়ান হয়ে ঘুরে বেড়াবে তাই এক কাপড়েই ভরসা!

গাবতলী গিয়ে কুষ্টিয়ার কোন ভালো পরিবহনের এর টিকিট পাওয়া যাচ্ছেনা। শেষমেষ হন্তদন্ত হয়ে একটা স্বল্প পরিচিতি কিংবা অপরিচিত বাসের টিকিট পাওয়া গেল তাও ঠিক সামনের চারটা সিট। আমাদের তাতেই চলবে। কিন্তু বাস খুঁজে বের করতে গিয়ে যখন তার টিকির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা তখন হেলপারের কাছ থেকেই জ্ঞান নিতে হলো যে, বাসের অগ্রভাগে লেখা ইংরেজির এস আর ডি দিয়ে "সুমন ডিলাক্স"ই একমাত্র বোঝা উচিত ছিলো!! তবে এটা ঠিক এই প্রথমবার দেশের কোন একটা পরিবহনে স্পিডমিটার এর কাঁটা ঠিক কাজ করতে দেখলাম! কোন অযাচিত ঝামেলা ছাড়াই পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে ঠিক ভোরবেলা হালকা কুয়াশায় ঢাকা, কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে গেলাম।চলতে চলতেই শহরে ঢোকার কিছুটা আগে খোকসার পরেই সাতসকালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউলদের দেখা মিললো।

অনেকে ছেউড়িয়ার উদ্দেশ্যে ভ্যানে চেপেছেন কেউবা হেঁটেই চলেছেন।সাধক লালনের জন্মবার্ষিকীর দিনটি ছিলো বুধবার, এই উপলক্ষে মেলা দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছিলাম রাতের বেলা গানের আসরে যোগ দিবো। তাই সকালটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কাঙ্গাল হরিনাথের ছাপাখানা আর মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ি দেখার জন্য ছিলো।

[b]আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে ![/b]

প্রথমেই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জনপ্রতি পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে পার হলাম গরাই নদী। সেখান থেকে আবার শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নসিমনে করে প্রায় ১০ কি.মি। কুঠিবাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই দূর থেকে প্রধান ভবনটি চোখে পড়ে। সাদামাটা ধরনের বাড়ি কিন্তু এখনও বোঝা সম্ভব অতীতে একসময় যথেষ্ঠ জৌলুসপূর্ণ ছিলো। বাড়িটি এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বিশেষ জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। রবি ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের কিছু ছবি আর কিছু চিত্রকর্মের নকল দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আছে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তার সবগুলোতেই অতি উৎসাহী দর্শকরা নিজেদের নাম আবার কেউ কেউ "করিম+সাথী" এরকম করে দাগ কেটে রেখে গেছে। অবাক হলাম এদের বুদ্ধি দেখে আর রক্ষনাবেক্ষনের এরকম দশা দেখে।

2
[কুঠিবাড়ির অগ্রভাগ]

উপরে ছাদে দুটো ধাতুর তৈরী নৌকা রাখা আছে, নিচের ঘরে আছে একটা পালকি। সবকিছুতেই যত্নের দারুন অভাব। তবে দোতলার বারান্দার একাংশে দাঁড়ালে সামনে থেকে অনেকদুর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, আশপাশও অনেকটা চোখে পড়ে। এখনও বাগান কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সাথে আছে কয়েকটা পুকুর, বাঁধানো ঘাট।

1
[দোতলার বারান্দা থেকে]

বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকের যে প্রধান ঘাট তার একপাশে স্থানীয় গায়কদলের গানের আসর চলছে, দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সেখানে। এই ঘাটেই রবি ঠাকুরের বজরাটি এনে রাখা হয়েছে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ পেছনের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। গাছের ছায়ার নিচে, মৃদুমন্দ বাতাস, চারিদিক এই সকালবেলাতেও নিস্তব্দ। দারুন একটা পরিবেশ। প্রশান্তিতে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

3
[পুকুর পাড়ে]

44
[সেই বজরা]

[b]অরূপের রূপের ফাঁদে....[/b]

এরপরে ব্যাটারিচালিত ছোট্ট গাড়িতে করে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। তবে বাড়ি খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হলো, অনেকেই বুঝতে পারলেননা কোথায় যেতে চাচ্ছি। পরে স্থানীয় একজনকে প্রশ্ন করতেই নিজে আমাদের সাথে এসে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

কাঙ্গাল হরিনাথ "ফকিরচাঁদ বাউল" হিসেবেও পরিচিত ছিলেন, ভালো নাম ছিলো "হরিনাথ মজুমদার"। কুষ্টিয়া জেলার এই কৃতিসন্তান লালনের একজন শিষ্যও ছিলেন। "কাঙ্গাল ফকির চন্দ্র দল" নামে তাঁর একটি বাউল দলও ছিলো একসময়। তাঁর করা বিভিন্ন গান এবং সুরের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রের কাজে। এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষটিই ইংরেজ শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র ছাপানো শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পৃষ্টপোষকতায়। "সংবাদ প্রভাকর" নামের এই সংবাদপত্রটিই সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র। এটি প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তিতে আট বছরের ব্যবধানে এটি দৈনিক সংবাদপত্রে রুপান্তরিত হয়। তৎকালীন সমাজে এর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যচর্চা এই সংবাদপত্রের মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের নীলকুঠি ও সাহেবদের নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সংবাদ প্রকাশিত হতো এখানে।

ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটির চরম ভগ্নদশা দেখে আমরা চারজনই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ছাপাখানাটি ধ্বসে পড়েছে স্থানে স্থানে। কোনমতে টিকে আছে মূল কাঠামোটি। দরজাগুলো ভেঙ্গে গেছে। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে আমরা বাংলার প্রথম ছাপার যন্ত্রটি দেখার চেষ্টা করছি তখন। পেছনের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। তিনি আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করার একপর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি কাঙ্গাল হরিনাথের নাতি। আমাদের উৎসাহ দেখে নিজেই তালা খুলে নিয়ে গেলেন ছাপাখানাটি দেখাতে। তার কাছ থেকে জানলাম আরও কিছু তথ্য আর হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলাম অতীতকে।

4
[ছাপাখানার সামনের দেয়াল]

5
[ভগ্নদশা]

কাঙ্গাল হরিনাথ এই যন্ত্রটি কিনে নেন মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে কোলকাতা থেকে। দুটো ছাপার যন্ত্র তখন আসছিলো কোলকাতায়। পথে ডাকাতের কবলে পড়ে
বেহাত হয়ে যায়। নানা হাত ঘুরে স্থান পায় হরিনাথের ছাপাখানাতে। সেসময় কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রায় অর্ধশতাধিক নীলকুঠি ছিলো। আর তার প্রধান দপ্তর ছিলো এখানে। হরিনাথ তখন ইংরেজদের নানা অত্যাচারের খবর তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ছাপাখানার উপরে বোমাবর্ষণ করা হলে ছাদ ধ্বসে পড়ে। এরপরে কোনমতে সেটি ঠিক করা হয়। পরবর্তিতে নানা সময়ে এটি সংস্কার ও সংরক্ষণের নানা প্রতিশ্রুতি আসলেও কোন কিছুই হয়নি, শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ছবি তোলা ছাড়া। এই ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্রটি জাদুঘরেও নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনি ঘুরে দেখালেন আগেকার যন্ত্রটি, অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স। জানতে পারলাম মীর মশাররফ হোসেনের "বিষাদসিন্ধু" এই ছাপাখানাতেই ছাপানো হয়েছিল সর্বপ্রথম। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন হরিনাথের একজন গুনমুগ্ধ ভক্ত। হরিনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কয়েকবার এসেছিলেন।

6
[ছাপার যন্ত্রটি]

7
[যন্ত্রাংশ সাথে ভিত্তিপ্রস্তরের দুখন্ড]

8
[অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স]

9
[পুরনো কাগজ]

একপর্যায়ে তিনি নিয়ে এলেন কাঙ্গাল হরিনাথের নিজ হাতে লেখা গানের একটি পান্ডুলিপি। এই সেই বিখ্যাত গান "দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমায়" যা সত্যজিৎ রায় তাঁর "পথের পাঁচালি" চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এই বিখ্যাত গানটির আসল পান্ডুলিপিটি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ। এটিও সংরক্ষণের কোন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়নি।

11
[গানের পান্ডুলিপি]

10
[কাঙ্গাল হরিনাথের সমাধিস্থান]

এই উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ, একজন গুনী বাউলসাধক, সুরকার এবং গায়ক, একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীর জন্মস্থান থেকে তাঁর ধ্বসে পড়া অতীতচিহ্ন দেখে যখন আমরা ফিরে আসছি তখন সবার মন কিছুটা হলেও ভারাক্রান্ত ছিলো। কানে বাজছে তাঁর নাতির কথাগুলো, "সবাই তো আসে, ছবি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কেউ রক্ষা করার জন্য কিছুই করেনা বাবা"। আমাদের অতীতকে আমরা মর্যাদা দিতে শিখিনি।

এরপরে যাওয়া হলো মীর মশাররফ হোসেন এর জন্মভিটায়। সেটি এখন বিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হয়েছে। পাশে একতলায় একটি ছোট জাদুঘর, তাতে তাঁর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী। পুরনো কোন স্থাপত্য আর নেই এখন।

[b]তিন পাগলের হলো মেলা ....[/b]

রাতের বেলা গেলাম লালনের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে। ঢোকার মুখেই মানুষের প্রচন্ড ভিড়ে অবাক হলাম। বাংলালিংকের সৌজন্যে চলছে মেলা। আর তাতে মাঠের পাশে বড় স্ক্রিনে বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন। পুরো মাঠ জুড়ে অসংখ্য দোকান। তাতে শিকড়ের মহৌষধী থেকে শুরু করে দা-খুন্তি সব বিক্রি হচ্ছে। বুঝলাম মানুষের আগ্রহ লালনের সাধনায় নয় বরং নিজের সাংসারিক জীবন সাধনায়। অসাম্প্রদায়িক লালনের আখড়ার সামনে ধর্মব্যবসায়ীদের ভিড়ও লক্ষ্য করার মতো। ধর্মই মনে হয় এমন একটি জিনিস যা জায়গাভেদে সবক্ষেত্রেই পণ্য হিসেবে বেশ ভালো বিক্রি হয়। কিছু বিকলাঙ্গ মানুষকে দেখিয়ে টাকা তুলছে একদল আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেক মানুষ, কেউ কেউ নিজের মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবিও তুলে নিচ্ছে! মানুষের বিকলাঙ্গতা যে দর্শনের বস্তু হতে পারে সে সম্পর্কে নতুন করে ধারণা হলো। এরকম নানা কিসিমের মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত হতে বেশিক্ষণ লাগেনা। শেষপর্যন্ত ভিড় ঠেলে ঢুকলাম প্রধান অংশে। দেখলাম সাধক লালনের সমাধিস্থল। এরপরে ঘুরে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম বাউলদের গান। এখানে কেউ টানছে ধুম্রশলাকা, কেউ কল্কি। কেউ এখানে ভবের পাগল, কেউবা ভাবের। এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম। অনুভূতির বাণিজ্যিকিকরণ আমাদের থেকে ভালো করে কেউ করতে পারে কি?

14
[প্রবেশদ্বার]

12
[সমাধিস্থল]

13
[মেলায় আগত সন্ন্যাসীরা]


[b]পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন....[/b]

পরের দিন ভোরে অভিজিৎ বিদায় নিলো। বাকি আমরা তিনজন চেপে বসলাম বাসে, নাটোরের উদ্দেশ্যে। বনলতা সেনকে খোঁজার আগ্রহ তো আছেই তার সাথে আছে রানী ভবানীর রাজবাড়ি আর চলনবিল দেখার আগ্রহ। ঘন্টা দুয়েক পরে নেমে পড়লাম নাটোর শহর ঢোকার মুখে। সেখান থেকে অটোরিক্সা করে রানী ভবানীর রাজবাড়ি।

রাজবাড়ি ঢোকার মুখেই বিশাল একটা পুকুর। তার শান বাঁধানো ঘাটে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। ছায়া-সুশীতল ঘাট, নিস্তরঙ্গ জল। তার পাশেই শিবমন্দির।কম করে হলেও ৩০০ বছরের পুরনো। তার সাথেও বড় পুকুর। চারিদিকে গাছপালায় ঢাকা, ছায়া ছায়া। মন্দিরের ভেতরে গমগম করছে জটাধারী সন্ন্যাসীর গলা, লাল বস্ত্র, তিলক কপালে, মন্ত্র আউড়ে যাচ্ছেন।

15
[প্রথম পুকুর]

16
[শিব মন্দির]

মন্দিরের পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে সামনে পরে কাচারী বাড়ি। এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। চারিদিকে অযত্নের ছাপ। কোন রক্ষনাবেক্ষণ নেই বোঝাই যাচ্ছে। এই রাজবাড়ি রানীর মৃত্যুর পরে তার দুই ছেলের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। একপাশে বড় ছেলের জমিদারি অন্যপাশে ছোট ছেলের। বাড়িগুলো জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। টিকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করা হয়নি। অনেকগুলো বাড়ি পুরোপুরি ধ্বসে গেছে। এখানেও দেয়ালে নানা ধরনের লেখা। বোঝাই যাচ্ছে অতি উৎসাহীদের কাজ। বাড়িটি ঘিরে বড় বড় পাঁচটি পুকুর, অসংখ্য গাছ। কোনমতে টিকে থাকা বিশাল দালানগুলোতে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে দারুন সব কাজ। কোনায় কোনায় যুগলদের ফিসফাস, হঠাৎ সামনে পড়ে যাওয়ায় বিব্রত আমরা।

17
[কাচারী বাড়ি]

18
[কাচারী বাড়ির বারান্দা থেকে সামনের পুকুর]

19
[লোহার সিড়ির ভগ্নদশা]

20
[কিছু মর্কটের ভালোবাসার আহ্ববান]

21
[ভেঙ্গে পড়া বাড়ির একাংশ]

22
[পুরাতন কুয়ো]

23
[ছোট জমিদারের দালানের একাংশ]

24
[দালানের পেছনের ঝর্না]

রাজবাড়ির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত রানী ভবানীর মহলটি। পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মাটিতে অনেকটা দেবে গেছে প্রায় পুরো জায়গাটি। ভাঙ্গা দেয়ালে বাসিন্দাদের জামা কাপড় শুকোতে দেয়া হয়েছে। হাঁস-মুরগি আর ছাগল চড়ে বেরাচ্ছে এদিক সেদিক। বিন্দুমাত্র রক্ষনাবেক্ষণ নেই। বড় জমিদারের দালানটি এখনও টিকে আছে সব থেকে ভালো অবস্থায়। তাই বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর আফসোস করলাম। দরজার কপাটের ফাঁক দিয়ে ভেতরের ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। প্রবেশাধিকার নেই তাই ভেতরটা এখনও টিকে আছে দেখে ভালো লাগলো। সামনের মাঠে স্থানীয়দের ক্রিকেট খেলার জায়গা। যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজবাড়িটি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো কোন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা এভাবে অরক্ষিতভাবে ব্যবহার করা হয় বলে আমাদের জানা ছিলোনা।

25
[রানীর মহলের অবস্থা]

26
[বড় জমিদারের মহলের ভেতরে, কপাটের ফাঁক দিয়ে তোলা]

27
[বড় জমিদারের মহল সামনের রাস্তা থেকে, মাঠে স্থানীয়রা ক্রিকেট খেলছে]

বের হয়ে আসার সময় টিকিট কাউন্টারে প্রশ্ন করলাম টাকা নেয়া হচ্ছে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে কিন্তু কোন যত্ন নেই কেন? তাদের সোজা উত্তর, "আমাদের বলে লাভ নেই, অফিসে বলুন"। অফিসের দেয়ালে লেখা পাঠাগার, কিন্তু ভেতরে একটা টেবিল আর কখানা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই! একটা ক্রোধ জন্মালো
মনের মধ্যে অযথাই।

সেখান থেকে গেলাম নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা চেখে দেখার জন্য। তবে সেটারও খুব একটা সুবিধাজনক স্বাদ পেলামনা। এবার যাত্রা চলন বিলের উদ্দেশ্যে। বাসে করে নাটোর মাদ্রসা মোড় থেকে প্রায় আধাঘন্টার দুরত্ব। ভর দুপুরে নামলাম শিঙ্গা মোড়। সেখান থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে গেলাম বিলের নৌকা ঘাটে। মাত্র ৮০ টাকায় ঠিক করা হলো একটা ছিপ নৌকা। মাঝি বয়সে তরুণ, হাসিখুশি দারুন ব্যবহার। ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো বিলের এদিক সেদিক। প্রচন্ড রোদে প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়ে উঠলো পরিবেশ। চারিদিকে জল তার মাঝে মাঝে একটা দুটো গ্রাম। নৌকাই এখানের প্রধান বাহন। চারিদিকে ধান লাগানো হয়েছে। মাঝি জানালো সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ এর সংযোগ আছে, আছে ক্যাবল টিভির সংযোগ। হাসিমুখে জানালেন ঢাকা শহরে কাজ করেছিলেন ৭ বছর, তার থেকে অনেক ভালো আছেন এখন নিজের গ্রামে।

28
[নৌকা থেকে]

29
[বিলের অগভীর জায়গায় শস্যের ক্ষেত্]

30
[বিলের মাঝখানে একটুকরো চর]

31
[নৌকার মাঝি]

32
[পেতে রাখা মাছ ধরার জাল]

প্রচুর মাছ ধরা হয় এখানে। মৌসুমে ৭০-৮০ মন মাছ উঠে এক এক নৌকায়। এখন ধান চাষ করা হচ্ছে। আর কদিন পরেই জল এসে উচ্চতা বেড়ে গেলে জেগে উঠা ছোট ছোট চর ঢেকে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরার জাল লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমাদের নৌকার দিকে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি। একটা ছোট চরে নেমে পড়লাম অল্প কিছুক্ষণের জন্য। জায়গাটা দারুন সুন্দর। চারপাশে জল তার মাঝখানে একটুখানি মাটি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুরে বেড়ানো হলো নৌকায় আর মাঝির সাথে চললো নানা বিষয়ে গল্প। মাঝির একটাই কথা, শহরের মানুষ যে দূষণে থাকে তার থেকে তারা অনেক ভালো আছেন, শান্তিতে আছেন। দুপুরে তাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্যও বললেন কয়েকবার। বিল দেখা শেষ করে এবার আবার ফিরে এলাম নাটোর শহরে। রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ধরে যেতে হবে জয়পুরহাট। উদ্দেশ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দর্শন। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো জয়পুরহাট থেকেই আমাদের জন্য সুবিধা হবে। শেষ বিকেলের আলোয় ট্রেনে চেপে বসলাম। আরেকটি দিনের জন্য কিছুটা বিষাদগ্রস্ত মন নিয়েই যাত্রা শেষ হলো, নতুন গন্তব্যে রওনা হলাম।


রাতের দিকে পৌঁছালাম জয়পুরহাট শহরে। সেখানে হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারের খোঁজে বের হলাম। দারুন আতিথেয়তায় খাবার খেলাম, অসাধারণ রান্না। অনেকদিন পর ফরমালিনমুক্ত খাবার খেয়ে যারপরনাই খুশি আমরা। পরের দিন সকালে রওনা হবো পাহাড়পুরে।

সকালে নাস্তার পরে ঘুরে এলাম জয়পুরহাট সুগার মিলস। যতদূর জানি এটাই এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্বয়ংসম্পূর্ন চিনির কল। আখ মাড়াই করে এখানে চিনি তৈরী করা হয়। আখের ছোবরা দিয়েই জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। জায়গায় জায়গায় আখের ক্ষেত। কারখানাতে ঢোকা গেলনা। ৩৫ বছর ধরে গার্ডপোস্টে চাকরি করা মানুষটি শোনালেন এই কারখানার নানা কাহিনী। দুঃখ প্রকাশ করলেন কারখানা বন্ধ থাকায় ঘুরিয়ে দেখাতে পারলেননা বলে। জানা গেল প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতির মধ্য দিয়েই চলছে। ৪১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই কারখানাটি সঠিক পরিচালনা এবং সংরক্ষণ জরুরি।

দুপুরে রওনা হলাম পাহাড়পুরের উদ্দেশ্যে। ১০০ টাকা ভাড়ায় অটোরিক্সা করে প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরে পৌঁছালাম সেখানে। পথে অসাধারণ সবুজের মেলা।চারপাশে শস্যের ক্ষেত, নীল আকাশ, মন উদাস করা বাতাস। ছোট ছোট গ্রাম, শিশুদের খেলা। অনেকদিন পরে গ্রামের রাস্তায় চলতে গিয়ে মন নিজের অজান্তেই নানা স্মৃতিচারণ শুরু করলো।

[b]জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক....[/b]

পাহাড়পুর বিহারটি অতীতকাল থেকেই বেশ অযত্নে রয়েছে। বৌদ্ধ শাসকদের হটিয়ে সেন রাজারা যখন দখল করে তখন তারাও এটিকে যত্ন করেনি। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে বারবার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর নানা অংশ। তারপরেও কোনমতে টিকে আছে এখন।

33
[ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সামনে থেকে]

পাহাড়পুরে যখন ঢুকলাম তখন সূর্য মাথার উপরে। রোদ মাথায় নিয়েই ঘুরতে শুরু করলাম। অতিথি বাংলোর অংশটুকু বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিহারের ধবংসাবশেষ বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। তিন স্তরে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠা যায়। দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। অবাক হলাম বিহারের উপরে এক কোনে দর্শনার্থীরা মুত্র বিসর্জন করতে করতে মুত্রাগার বানিয়ে ফেলেছে দেখে। প্রাচীন স্থাপত্যের এহেন অবমাননা ভাবতেও কষ্ট লাগে। অনেক জায়গাতেই খাবারের প্যাকেট ফেলে রাখা হয়েছে, রয়েছে পানির ব্যবহৃত বোতল। এখানেও রক্ষনাবেক্ষনের অভাব। তারই মাঝে কিছু মর্কট চেষ্টা করছে দেয়াল বেয়ে একদম উপরে উঠার জন্য। অশ্রাব্য ভাষা বিনিময়ে তাদের ফুর্তি দেখে মনে হলো এটা তাদের পিকনিক গ্রাউন্ড।

34
[দেয়ালের কাজ]

35
[নানা ধরনের প্রতিকৃতি]

36
[জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা]

37
[বিহারের ভেতরের একাংশ]

38
[বিহারের পেছনদিকে]

39
[বিহারের বিস্তৃতি]

পাহাড়পুর জাদুঘরটি বেশ সমৃদ্ধ। শুধু এখান থেকে পাওয়া জিনিসেই নয় সাথে রাখা আছে আশেপাশের নানা অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রাচীন সামগ্রী। অধিকাংশই প্রাচীন পাথরের বড় বড় পৌরানিক দেব-দেবীর মূর্তি কিংবা কাহিনীর বর্ণনা। অসম্ভব নিঁখুত এসব কাজ দেখে বেশ সময় কেটে গেল।

এরপরে আমরা ঠিক করলাম খুঁজে বের করবো "হলুদ বিহার" নামের জায়গাটিকে। এ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলোনা। তাই স্থানীয় মানুষের মাধ্যমেই খুঁজে খুঁজে যেতে হলো। পাহাড়পুর বাজার থেকে শ্যালোইঞ্জিন চালিত টেম্পো ভাড়া করলাম ২০০ টাকা দিয়ে। এরা আমাদের নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে এখানে। যাওয়ার পথ গ্রামের ভেতর দিয়ে। খুবই খারাপ অবস্থা রাস্তার। এক মুহূর্ত স্থির বসে থাকা যাচ্ছেনা। শরীর ব্যথা হয়ে গেল ঘন্টা দেড়েক এর যাত্রায়। তবে আশেপাশের প্রত্যন্ত গ্রাম দেখে বেশ অন্যরকম অনুভূতি হলো। টেম্পো চললো "কুলি" নামক জায়গা পর্যন্ত সেখান থেকে আবার গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। "বদলগাছি" পর্যন্ত বাসে করে এসে "কুলি" মোড় থেকে টেম্পু নিয়েও যাওয়া যায়। গ্রামে বসেছে গরুর হাট, তারই মাঝ দিয়ে চললাম। শেষমেষ বড় একটা ধবংসাবশেষ এর কাছে গাড়ি থামলো। এটাই "হলুদ বিহার"।

43
[উঠার সিড়ি]

রাস্তার মোড়ে প্রায় ৫/৬ কি.মি আগে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম তাও গাছের শাখাপ্রশাখায় ঢেকে আছে, এছাড়া আর কোন দিকনির্দেশনা নেই।জায়গাটা দেখে হতাশ হলাম পুরোপুরি। স্থানীয় লোকেদের তাস খেলা আর বৈকালিক বিড়ি খাওয়ার জায়গা সেটা। উঁচু ইটের ঢিবি, মাটিতে ঢেকে আছে। একটা সিড়ি মোটামুটি টিকে গেছে।নেই কোন সাইনবোর্ড কিংবা কর্মী। চারপাশে গ্রাম বিস্তার লাভ করেছে, বসেছে দোকানপাট। এদিকে শহরের লোক খুব একটা আসেনা। স্থানীয়রা খুব উৎসাহ নিয়েই আমাদের নানা অভিজ্ঞতা বলে গেল। এখানে নাকি "হলুদ রাজা" নামে কোন এক রাজা ছিলেন, তারই নামে এই অঞ্চলের নাম। তাই এই বিহারটির নামও লোকমুখে চলে এসেছে "হলুদ বিহার"। পাশেই এক দোকানে চা খেতে খেতে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। দোকানি জানালো জন্মের পর থেকেই জায়গাটি দেখছেন। তাদের বাপ-দাদারাও দেখেছে তাদের জন্মের আগে থেকেই। তিনি যখন তরুণ ছিলেন তখন এর ঢিবির উচ্চতা ছিলো অনেক। একবারে হেঁটে উপরে উঠা যেত না। কালক্রমে এটি মাটিতে বসে যাচ্ছে। আশেপাশে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা ছিলো, লোকে সাহস করতো না খুব একটা এখানে আসার। পরে লোকজন বসতি স্থাপন শুরু করলে আস্তে আস্তে জঙ্গল সাফ করা হয়। বিহারের জায়গাতেই বসতি নির্মান শুরু হয়।

40
[হলুদ বিহার]

41
[খননকার্যের জায়গাটি]

42
[উপরের অংশ]


কিছু বিদেশী মানুষ নাকি এসেছিলেন এখানে। খোড়াখুড়ি চলেছিলো বেশ কিছুদিন। কয়েকটা মাটির তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছিলো। এর পরে আর কিছু কাজ হয়নি। মাটি খুড়ে বিহারের ভিত্তি পর্যন্ত কোন হদিস পাওয়া যায়নি তাই কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে বছরের পর বছর ধরে ধুলো ময়লা জমে গর্ত বন্ধ হয়ে যায়। পাশেই একটা পুকুর দেখলাম। ধারণা হলো নিচের মাটি বেশ নরম তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে জায়গাটি। একসময় হয়তো আর যা আছে তাও অবশিষ্ট থাকবেনা। একটি প্রাচীন জায়গায় অন্তত সরকারী একটা দেখভালের ব্যবস্থা করা যেত। অতীতকে এতোটা অবহেলা করার কোন মানে আছে বলে মনে হয়না।

ফেরার পথে অন্য রাস্তা ধরলো গাড়ি। অন্ধকার রাস্তা তার উপরে কুয়াশা। গাড়ির হেডলাইট কাজ করেনা। অন্ধকারেই কোনমতে চলছে। একবার দুর্ঘটনা হতে হতে বাঁচলো। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ একটা স্পিডব্রেকার। মাথায় ব্যথা পেল পার্থ। পরে নোকিয়া ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পথ দেখে দেখে চললো ঘন্টাখানেক! ভয় হচ্ছিল কখন গাড়ি রাস্তা ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে ক্ষেত কিংবা জলাশয়ে গিয়ে নামে! কোনমতে ফিরে এলাম পাহাড়পুর বাজারে। সেখান থেকে রাতের শেষ বাসে জয়পুরহাট শহরে। সেদিন রাতের ট্রেন ছিলো ১২টায়।

ট্রেন ধরার সময় আরেক ঘটনা। আমাদের জায়গা ছিলো "ঠ" বগিতে। খুঁজতে গিয়ে দেখি গাড়ির শেষে "ঠ" বগিই নেই! আমাদের টিকেট চেকার বললো ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই ওখানে বসা যাবেনা। ভালো কথা কিন্তু তার ঘোষণা তো দেয়া উচিত আমরা এখন কোথায় বসি? প্রশ্ন করতেই বললেন, যেখানে খুশি! তো আমাদের টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য কে ফেরৎ দিবে এই প্রশ্নে সে নিরব। শেষে যখন অন্য বগিতে উঠতে যাচ্ছি তখন ট্রেন ছেড়ে দিলো। কোন মতে দৌড়ে গিয়ে ঝুলে ঝুলে ট্রেনে উঠে পড়লাম।

কয়েকদিনের কিছু অপার্থিব মুহূর্ত আর ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে ফিরে এলাম যান্ত্রিক শহর ঢাকাতে। পুরো সফরে স্থানীয় মানুষদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। তাদের সরল ব্যবহারের কাছে নিজেদের অন্যরকম লেগেছে। নিজের দেশে এতোটা অমায়িক আচরণের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। এই মুহুর্তগুলো মনে দাগ কেটে রইলো।

map
[সম্পূর্ণ সফরের যাত্রাপথ]

কিছু উপলব্ধি হলো একই সাথে। আমরা অধিকাংশ সময় নিজেদের সমাজ,সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ধবংসের জন্য নানা রকম আগ্রাসনকে দায়ী করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা। নিজের চোখে দেখলাম কিভাবে অনাদরে-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে শত শত বছরের পুরনো সব স্থাপত্য। কিভাবে আমরা নিজেরা নষ্ট করছি আমাদের অতীত স্মৃতিকে। আমরা যদি আমাদের অতীতকে মর্যাদা দিতে না পারি, যদি তাদের আগলে রেখে রক্ষা করতে না পারি তাহলে এরজন্য দায়ী কে? অপরের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজেদের দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা সেই প্রশ্নটার আগে সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করি।


[লেখাটি প্রিয় বন্ধু, সহব্লগার তারেক অনুর ( আমাদের ঘনুদা) জন্য। এই মানুষটি আমার কাছে একটি রহস্য, মনে হয় অন্যগ্রহের প্রাণীর সাথে নির্ঘাত যোগাযোগ আছে!]