Wednesday, January 18, 2012

স্মৃতির পাতায় নটরডেম

বিশালদেহী মিজান স্যার ক্লাসে ঢুকতেই গ্রুপ-৪ এর সব ছাত্র একসাথে বলে উঠেছিলো "কাইফা হালুকা", স্যারও প্রতিউত্তর করেছিলেন সরস ভাবেই, প্রায় ৬ ফুটের উপরে লম্বা, বিশাল আলখাল্লা টাইপের পাঞ্জাবী, আর মুখভর্তি লম্বা দাড়ির মিজান স্যারকে কাইফা হালুকা বলে অভ্যর্থনা না জানানোটাই আসলে হয়তো রীতিবিরুদ্ধ হতো, স্যার পরিচিত ছিলেন তার বিখ্যাত "ছিলা-বাঁশ" এর জন্য, প্রথম দিনই বলেছিলেন, "আমরা তো আবার ছিলা-বাঁশ (সিলেবাস) আগে জানতে চাই"|


স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগা দিতে গিয়ে প্রথম বেঞ্চে বসা আমি উঠে দাড়িয়েছিলাম, সংগা ঠিকঠাক শেষও হয়েছিল, কিন্তু তার পরেই স্যার এর প্রশ্ন "তোমার কি স্তন আছে??" ক্লাস ভর্তি ছেলে, আর এই প্রশ্নে ভেবাচেকা খেয়ে আমি হাসবো না কি করবো বুঝতে পারছিলামনা, আমি আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই স্যার বললেন, "এত চিন্তা করো কে?? নারী-পুরুষ সবারই স্তন আছে, কিন্তু পুরুষের স্তনগ্রন্থি কাজ করেনা, এইটা কইতে লজ্জা লাগেনি??" এই ছিলেন মিজান স্যার, বেমক্কা সব প্রশ্ন করতেন, কিন্তু তাতে কি, বায়োলজি মজার বিষয় এটা হয়তো মিজান স্যার না থাকলে বুঝতামনা|


নটরডেম কলেজে ভর্তির ভাইবা দেওয়ার পরে আমি নিশ্চিত ছিলাম এত জ্ঞানী মানুষের ভিড়ে আমার স্থান নাই, কিন্তু কিভাবে কি আমি চান্সও পেলাম গ্রুপ-৪ এ, মিরাকল জাতীয় কিছু যে দুনিয়াতে হয় তা টের পেলাম| আর প্রথম দিন তো দেখতে দেখতে এমনিতেই চলে গেলো, এখনো মনে পরে ২৫শে আগস্টের বোমা হামলার ঠিক পরের দিন ছিলো আমাদের প্রথম ক্লাস|


অঙ্কের ক্লাসে বরাবরই আমি অন্ধ এবং বধিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই, সেই অঙ্কের ক্লাসে প্রথম দিন এলেন জহরলাল স্যার, সেই বিখ্যাত উক্তি স্যারের, "কি লিখি, কেনো লিখি, জানতে চাই স্যারররর"| আসলেই, স্যার পরবর্তী ২ বছরে আমাদের মধ্যে সেই জানার প্রবল আগ্রহ তৈরী করে দিয়েছিলেন অসাধারণ ভাবে, "কোণের সংগা" দিয়ে যার শুরু হয়েছিল তার শেষ হয়েছিল অশ্রুসিক্ত এক বিদায়ের মধ্য দিয়ে| এই আমি শুধুমাত্র স্যারের ভয়ে অঙ্ক করতাম, তখনো আসলে জানিনা, এই ভয়টা কতোটা দরকার ছিলো জীবনে| বন্ধু ময়ূখের দিকে তাকিয়ে স্যার এর সেই " এই যে লাল গঞ্জি, আপনি দাড়ান, কি নাম স্যাররর??" থেকে শুরু করে আরও অজস্র বাক্য এখনো যেনো শুনতে পাই একটু কান পাতলেই|


ফাস্ট ইয়ারে বায়োলজি পড়াতেন আজমল স্যার|"বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথমবার যখন উড়ানো হয়েছিলো, জানো আমি তখন কই ছিলাম??" আমরা ভাবলাম স্যার বলবেন পতাকা হয়তো তার হাতেই ছিলো, ছাত্র-জনতার মাঝে আমরা বিপ্লবী স্যারকে দেখা শুরু করেছি মাত্র, উনি বললেন, "পতাকাটা যেই লাঠির মাথায় উড়ানো হয়েছিলো সেটা ধরেছিলাম আমি", হঠাৎ যেনো অনেক মানুষের ভিড়ে স্যার হারিয়ে গেলেন, আমরা বাস্তবে ফিরে এলাম, আর বুঝলাম কি অসাধারণ ভাবে গল্প শোনাতে হয়| একটা অদ্ভুত ঘটনা ছিলো তখন, স্যার নটরডেম এর বায়োলজি ক্লাস নিলেও, স্যার এর কাছে বেশি পড়তে যেত ভিকারুন্নেসার ছাত্রীরা| আর সেই গল্প স্যার করতেন ক্লাসে, আরও শোনাতেন কি ভীষণ সব কাহিনী, আর আমরা বুঝতাম "চাপা-মারা" নামে অলিম্পিকে কোনো ইভেন্ট থাকলে আর কেউ কিছু না জিতুক একটা স্বর্ণপদক তো নিশ্চিত ছিলো আমাদের|


আরও মজা হতো বোটানি ক্লাসে, রাহেলা ম্যাডাম আমরা কোনো প্রকার শয়তানি করলেই, উদ্ভিদবিদ্যার নিরস জগত ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদী জগতের ঘোর অনটনে| আর আমরাও অবাক হতাম নির্বোধ গাছ-পালাকেও পুঁজিবাদী দুনিয়া ছাড় দিচ্ছেনা দেখে..


বাংলা নিতেন আমাদের বিখ্যাত "সোহেল স্যার", ক্লাসে এসে প্রধান কাজ ছিলো চুল আচড়ানো, তবে চুলের ঘনত্বের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন একেবারেই অমূলক| প্রায়ই পিছে থেকে ফিচেল ছাত্ররা কয়েন ফেলে যন্ত্রণা করতো, আর স্যার বলতেন, "এইইই পয়সা ফেলে কে?? পয়সা ফেলে কে?? কার বাপের এত পয়সা হয়েছে এইদিকে আয়"| দুহাত আদনান সামির "লিফট করা দে" স্টাইলে ধরে পেটের কাছ থেকে আস্তে আস্তে উপরে এনে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাক্য শুরু করার সেই রীতি এখনো মনে পড়ে| তবে কিছু বলেই, একহাত কপাল থেকে শুরু করে চকচকে টাকের পিছন পর্যন্ত টেনে নেওয়ার অভ্যাসটাই স্যার এর চুলের ঘনত্ব কম করার পেছনে দায়ী কিনা, কে জানে?


শুধু একদিন বাংলা ক্লাস নিতে এসেছিলেন মোখতার স্যার, তার আদিরসাত্মক পড়ানোর স্টাইলে পড়িয়েছিলেন কুবের-কপিলার প্রেম কাহিনী| আমরা অন্য ক্লাসের ছেলেদের কাছে শুনতাম স্যারের ইয়েতে আর্মির বন্দুকের বাঁটের গুঁতোর কথা, সুবর্ণা মোস্তফাকে করা প্রেমের প্রস্তাবের কথা আরও কত কি| আসলেই যে ছাত্র কলেজ জীবনে মোখতার স্যার এর কাছে "পদ্মা নদীর মাঝি" একদিনের জন্যও না পড়েছে, তার কলেজ জীবনে আফসোস থেকে যাবে| একজন বয়স্ক মানুষকে চেয়ারে বসে নাচতে সেই প্রথম দেখেছিলাম|


গুহ স্যারের কেমিস্ট্রি ক্লাস করেছিলাম টানা ২ বছর, স্যার নিজে তার টেবিলের উপর বসে পড়াতেন, তাকে কখনো চেয়ারে বসতে দেখিনি, আর প্রায়ই মনুষ্য-বর্জ নিয়ে রসিকতা করতেন, মাঝখানে স্যার এর বদলে এসেছিলেন ২ জন, নাদিয়া ম্যাডাম খুব অল্প সময়ের জন্য, তাকে ছাত্ররা যখন বলেছিলো "শোনা যায়না ম্যাডাম" তিনি বোর্ডে লিখে বলেছিলেন, "কি আশ্চর্য, আমি তোমাদের দু দু বার করে দেখালাম, তাও বুঝছনা কেনো??" আসলেই প্রশ্নটা আমাদেরও ছিলো| তারপরে ছিলেন এলেন স্যার, কলেজের কেমিস্ট্রি বুঝতে হলে যে সব ছাত্রের মাস্টার্স করে আশা উচিত, সেটা স্যার এর পড়ানো দেখলেই বুঝতে পারতাম| তাই ছাত্রদের ইচ্ছায় আবার গুহ স্যার এর প্রত্যাবর্তন|


সেই শুরু থেকে আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো, যারা ক্লাসের একদম বাম-দিকের দুটো সারিতে বসতাম, আমি, অনুপ, সজল, শুভ্র, মেহেদী (শুভ্র), ময়ূখ, আনন্দ, সৌরভ, ফয়সাল, তানজীল আরও কয়েকজন| এখনো মনে আছে সজলের ছোটবেলার প্রেয়সী যেদিন মারা যায়, আমাদের জরিয়ে ধরে কি কান্নাই না কেঁদেছিলো, মনে পড়ে আনন্দ প্রথম প্রথম নাক উঁচু ভাব নিয়ে চললেও, সেই ছেলেটিই আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিলো আমাদের গ্রুপ এর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ| ময়ূখ প্রথম থেকেই ছিলো রকস্টার, হাতে মোটা মোটা রিস্টব্যান্ড আর সানগ্লাসে প্রথম থেকেই কুউউউল| বিতার্কিক সজলের লিঙ্কিন পার্ক এর গানে গলা ফাটিয়ে চিত্কার| মেধাবী অনুপের সদা-হাস্য মুখ, শুভ্রের হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, মোটা-সোটা সৌরভের জ্ঞানী জ্ঞানী উক্তি, এ সবই তো স্মৃতি| আর মনে পড়ে সুদর্শন রাকিব কে, কদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে, সব সময় হাসি লেগে থাকতো মুখে|


একটা ঘটনা এখনো মনে পড়ে, সোহেল স্যার ক্লাসে ঢুকেছেন আমরা সবাই দাড়ালাম, বসার একটু পড়ে স্যার দেখি আমাদের পেছনে কি দেখাতে চাচ্ছেন, আমরা না বুঝে এদিক ওদিক দেখছি, তারপর সবার চোখ গেলো ক্লাসের পেছনের খালি বেঞ্চগুলোতে, দেখলাম আমাদের সারির পেছনের এক খালি বেঞ্চে কেও একজন পায়ের উপরে পা তুলে শুয়ে আছে, বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরে লাফিয়ে উঠে বসলো আমাদের ময়ূখ| এখনো মনে পড়ে, সবার দম ফাটানো হাসির মধ্য দিয়ে চোখ ডলতে-ডলতে ময়ূখ নিজের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে|


মনে পড়ে আরও অনেক কিছুই, প্র্যাকটিকাল ক্লাসের প্র্যাকটিকাল জোকস, ফিজিক্স এর প্র্যাকটিকেল এ রিপিট খাওয়া, বায়োলজির প্র্যাকটিকাল ক্লাসে আরশোলা হাতে নিতে গিয়ে কারো কারো অজ্ঞান হবার দশা, ডিবেটিং ক্লাবের অনর্থক রাজনীতি, সাইন্স ফেয়ারে ঘুরাঘুরি, ভর দুপুরে ফুটবল-ক্রিকেট, ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা, ক্লাসের শেষে মোড়ের দোকানের সিগারেট-পুরি, আরামবাগ কলোনিতে কাটানো অসস্র সময়... আরো অনেক কিছু| মনে পড়ে এইতো সেদিন যেনো ছিলো সব, কিন্তু পার হয়ে গেছে ৬টা বছর, ২০০৬ এ যেদিন রেজাল্ট নিয়ে বেড়িয়েছিলাম তার পড়ে আর কোনদিন কলেজের ভেতরে ঢুকিনি, হয়তো পালিয়ে থাকতে চেয়েছি স্মৃতিগুলো থেকে, হয়তো দূর থেকেই ভালবাসতে চেয়েছি জীবনের সব থেকে সেরা মুহূর্তগুলোকে|


আজ আনন্দ জাপানে, ময়ূখ চীনে, সজল সিলেটে, মেহেদী লন্ডনে, অনুপ চট্টগ্রামে, বাকিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায়, কেউ কেউ দেশের বাইরে, অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই, হয়তো আর দেখাও হবেনা কোনদিন, কিন্তু এখনো সময় পেলেই পুরনো ডায়রিটা খুলে দেখি, তাতে পুরনো হয়ে যাওয়া লেখাগুলো, বিদায়বেলাতে লিখে যাওয়া সেই কথাগুলোই রয়ে গেছে, আর রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো| খুব মনে পড়ে, অনেক প্ল্যান করি একবার আবার একবার কলেজের চত্বরে একসাথে আড্ডা দিতে, কখনই হয়ে উঠেনা, জানিনা হবে কিনা, তবে আর যাই হোক, এখনো আমার জীবনের সব থেকে প্রিয় স্মৃতি হিসেবে নটরডেম কলেজের দুই বছর চিরসবুজ হয়ে থাকবে| যেখানেই থাকিস সবাই, ভালো থাকিস|


[ব্যাচ ২০০৬, গ্রুপ-৪, নটরডেম কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ]


Sunday, January 1, 2012

জীবনটা একটা হাওয়াই মিঠাই

জীবন একটা হাওয়াই মিঠাই, হ্যাঁ, স্রেফ একটা হাওয়াই মিঠাই, ব্যাস| এর আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই| বলা যায়, এই উদ্ভট চিন্তাটা মাথায় হঠাৎ করেই এলো, এটাকে দীর্ঘদিনের চিন্তাপ্রসূত উপসংহার বলা যায়না মোটেই| তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, জীবনকে আমি বায়োস্কোপ থেকে শুরু করে একদম ছিবড়ে যাওয়া চুইংগামের মতো এরকম অনেক কিছুর সাথে তুলনা করেছি, শুধু তাই নয়, সেই কবিগুরু থেকে শুরু করে হালের গুরুকবিদের অনেকের ছন্দের মাঝেই জীবনের অনর্থক মানে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছি, কিন্তু শেষমেষ গিয়ে ঠেকলো কিনা এই হাওয়াই মিঠাইতে!!

ব্যাপারটা সেরকম কিছুনা, এইতো সেদিন এটা খেতে গিয়েই মাথায় এলো কথাটা, আর কি সুন্দর খাপে-খাপে মিলে গেলো সব| প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-আশাভঙ্গের সব হিসাব-নিকাশ এই আর কি| যেমনটা, হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার সময় হয়| মিঠাই তো কত রঙ-বেরঙ এর হয়, লাল-নীল-সাদা, জীবনটাও কি কম রঙের?? প্রতিটি মুহুর্তের পরতে পরতে এক এক রকম রঙ| কবিদের ভাষায়, বেদনার রঙ নীল, ভালোবাসার যেমন লাল, কিছুটা সেই রকম আর কি|

আবার যখন হাওয়াই মিঠাই হাতে নিই, তখন মনে হয় অনেক কিছু, জিনিসটা তার অস্তিত্ব প্রমান করে রঙে-গন্ধে-ওজনে, কিন্তু যেই খাওয়া শুরু তখনই কমতে থাকে ওজন, যেনো স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে| জীবনটাও কি সেরকম নয়? যত গভীরে যাওয়া যায়, ততই কি এক বিশাল শুন্যতাই উপলব্ধি হয়না? মনে হয়, এই আছে, এই নেই| প্রথমে কত প্ল্যান, কোনো নিয়ম, সামাজিক দায়বদ্ধতার বেড়াজাল, কিন্তু শেষমেষ তো ঐ এক শুন্যতা| এক অতল শূন্যতায় স্রেফ মিলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি|

আবার যখন হাওয়াই মিঠাইটা মুখে দেই, তখন মুখের ভিতর প্রাপ্তির অনুভূতি, কিছুটা মিষ্টি-মিষ্টি স্বাদ| কিন্তু অনুভূতিটা একটু গাড় হবার আগেই হুট করে মুখে মিলিয়ে যায়| কতইবা সময় নেয়, দশ সেকেন্ড বা হয়তো আরও কম| জীবনটাও তো সেরকমই, সবসময় মনে হয় এইতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি, ব্যাস এইতো আর একটু| কিন্তু গুছিয়ে নিচ্ছি-নিবো করে একটু থিতু হবার আগেই সব মিলিয়ে যায়| জীবনে কোনো কিছুর স্বাদই কি অতটা গাড়?? আমার তো মনে হয়, ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা বছর| কেন মনে হয়না- এইতো সেদিন মায়ের হাতে ভাত খেতাম, বাবার কোলে ঘুরতাম??

হাওয়াই মিঠাইটা আসলেই দারুন একটা জিনিস, খেলাম-খেলাম করেও যেমন আসলে কিছুই খাওয়া হয়না, শুধু চোখের আর মনের দেখাই সব, জীবনটাও তেমনি| চোখের দেখা স্মৃতিগুলো মনের ভেতর জমে থাকে, বছর শেষে ধুলো ঝেড়ে মলাট পরিষ্কার করার মতো একবার করে শুধু মনেই তো করি| তারপর আবার হয়তো অনেক দিন পরে সেই একই ধুলো ঝাড়ার পুনরাবৃত্তি| জীবনের কোনো কিছুই যেমন স্থায়ী না, তেমনি সেটা জেনেও কত তোরজোর করে নিজেকে অমর করার বৃথা চেষ্টা করি|

একসময় যখন হেরে যাচ্ছিলাম জীবনের প্রতিটি ধাপে, তখন এক সাধু বলেছিলো- "ধরো তুমি একটা পাহাড়ে উঠছো, পাহাড়টা যত বড় উঠতে তত কষ্ট| আবার বাধা-বিপত্তি অনেক, তবে চূড়ায় ওঠার তৃপ্তিটাও কিন্তু কম নয়| কিন্তু এরপর??" আমি বোকার মতো বলেছিলাম- "এরপর??" তিনি হেসে বলেছিলেন- " এরপর আবার নিচে নামতে হবে যে,আবার অন্য একটা পাহাড়ে ওঠার জন্য| তবে নামার সময়ও বাধা-বিপত্তি মোটেই কম নয়, তা সে সময় কম লাগুক কিংবা বেশি|" আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম| এখন বুঝি, হাওয়াই মিঠাই এর মতো এই জীবনটার চরম সত্যটি কতোটা সরল ভাষায় বলেছিলো সাধু| কতোটা ভয়ংকর কঠিন সত্যকে কি অবলীলায় প্রকাশ করেছিলো সে|

সত্যিই তো, জীবনে একটু স্থায়ী হবার আশায় আমরা কত সংগ্রামই না করে চলি, কিন্তু সেই স্থায়িত্বটা কি কখনই খুব বেশি সময়ের?? আবার তো একই সংগ্রামের পুনরাবৃত্তি| তবে অধঃপতনের রাস্তাটাও তো কম দূর্ভোগের নয়| কত গঞ্জনা সইতে হয়| গাদা-গাদা হতাশার বোঝাটাও তো কম নয়| কতজন সামলাতে না পেরে হারিয়ে যায়, যারা বেঁচে থাকে তারা হয়ে যায় পাথুরে মানব|

তবে যত যাই বলি না কেনো, হাওয়াই মিঠাই মুখে মিলিয়ে গেলেও, একটা জিনিস কিন্তু হাতে থেকেই যায়, আর তা হলো কাঠিটা| জীবনটাও ঠিক তাই, সব হারিয়ে যায়, সবাই হারিয়ে যায়, কালের ঘূর্ণনে মিশে যায় অতীতে, কিন্তু আমরা বেঁচে থাকি মানুষ না স্রেফ স্মৃতির ফসিল হয়ে, ঠিক ঐ কাঠিটার মতো| নতুন বছরে আর যাই হোক না কেনো, এই উপলব্ধিটা নিয়ে বাঁচতে চাওয়াটাই বা কম কিসের?? জানিই তো, সব শেষে ঐ একটাই- "হাওয়াই মিঠাই|"

দরিদ্র মানুষের সেবায়ঃ এডরিক এস. বেকর

মানবতার সেবায় নিরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব বেশি হয়তো নয়, সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া আদর্শের- এই বর্তমানে তবুও কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেদের জীবন অপরের জন্য বিলিয়ে দেয়| অনেক মানুষের ভিড়ে তাদের কথা হয়তো আমাদের সামনে আসেনা| এরকমই একজন মানুষ চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর, দুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ৩২ বছর এর বেশি সময় ধরে নিরলস কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ১১০ কি.মি দূরের টাঙ্গাইল জেলার কায়লাকুড়ি গ্রামে| ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ড এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এডরিক এস. বেকর, চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন ১৯৬৫ সালে অতেগো মেডিকেল কলেজ, ডুনেদিন থেকে, তারপরেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আর্ত-মানবতার চিকিৎসাসেবা প্রদানের সাথে জড়িত হন| তিনি কাজ করেছেন ভিয়েতনাম সহ আরও কয়েকটি দরিদ্র দেশে| ভিয়েতনামে কাজ করার সময়ই জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা| তখন থেকেই ইচ্ছা ছিলো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কাজ করার| ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্থ ভিয়েতনামে, তারপরে তিনি চলে আসেন ইংল্যান্ড এ, চিকিৎসাশাস্ত্রে আরো পড়াশোনা করার জন্য| তারপর ১৯৭৯ সালে তিনি আসেন বাংলাদেশে| প্রথমে তিনি কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রে কাজ করেন, কিন্তু দুস্থ মানুষের সেবায় সরাসরি জড়িত হবার উদ্দেশ্যে তিনি পরে থানারবাইদ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে যোগদান করেন| কিন্তু কোনো ভাবেই সন্তুষ্ঠ হতে পারছিলেননা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রাম্য-দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য-সেবা দিতে হলে, সর্বপ্রথম তাদেরকে স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, চিকিৎসাসেবা এসব বিষয়ে ধারণা দিতে হবে| দুস্থ মানুষকে সেবা করার এই তাগিদ থেকেই তিনি পরে কায়লাকুড়ি গ্রামে প্রায় ৩ একর জায়গা নিয়ে তৈরী করেন তার স্বপ্নের স্বাস্থ্য-সেবাকেন্দ্র| দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন তার সেবাকেন্দ্রটি| নামমাত্র মূল্যে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ মানুষের জন্য সেবা প্রদান করছেন| নতুন রোগীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র ১০ টাকা এবং পুরনোদের জন্য মাত্র ৫ টাকা| রেজিস্ট্রেশনের পর সবাইকে ধারণা দেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে| সেবাকেন্দ্রে ৪০ জন পর্যন্ত রোগীকে ভর্তি করারও ব্যাবস্থা রয়েছে, এরজন্য এককালীন রোগীপ্রতি ১০০ টাকা এবং তার সাথের আত্মীয় এর থাকার জন্য ২০০ টাকা নেওয়া হয়| যদি কোনো দুস্থ রোগী এই পরিমান টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে তাদের জন্য চিকিৎসা করা হয় বিনামূল্যে| রোগীদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার প্রদানের লক্ষ্যে তিনি তৈরী করেছেন সবজি বাগান, দুধ এর জন্য পালন করা হয় গাভী| খাবার খরচ হতে আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করে তার সেবাকেন্দ্র| বর্তমানে প্রায় ১০ টি গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে চলেছে তার সেবাকেন্দ্রটি| ১৯৮৩ সালে স্থাপন করা এই সেবাকেন্দ্রটি দুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে চলেছে অবিরত| সাধারণ মানুষের কাছে "ডাক্তার ভাই" হিসেবে পরিচিত এডরিক এস. বেকর বাংলা বলতে পারেন আর দশজন সাধারণ বাংলাদেশীদের মতই| জীবনের ৩২টি বছর তিনি পার করে দিয়েছেন নিজের জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশে, দুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে| তার চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে ডায়বেটিক রোগীদের জন্য আছে আলাদা একটি পরিচর্যাকেন্দ্র| এর আওতায় ৪টি উপজেলার প্রায় ১১০০ মানুষ চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন| মা ও শিশুর জন্যও আছে আলাদা ব্যাবস্থা| মা ও শিশু সেবার আওতায় চিকিৎসা পাচ্ছে প্রায় ১৭টি গ্রামের মানুষ| তার সহায়তায় আছে গ্রামের প্রায় ১০০ জন তরুণ-তরুণী, যাদের সবাই স্বল্পশিক্ষিত, এডরিক বেকর যাদের তৈরী করেছেন নিজের হাতে, নিজে শিখিয়েছেন চিকিৎসাসেবার খুঁটিনাটি| সেবাকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য সব অর্থ সাহায্যই আসে এডরিক বেকর এর পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে| তিনি প্রতি বছর একবার নিজ দেশ নিউজিল্যান্ড যান, সেখানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে তিনি তার সেবাকেন্দ্রের জন্য অর্থ-সাহায্য জোগাড় করেন| সম্পূর্ণভাবে বেসরকারী অর্থ-সাহায্যে পরিচালিত তার এই সেবাকেন্দ্রটি নিরলস ভাবে বিনাস্বার্থে কাজ করে চলেছে গ্রামের দুস্থ মানুষদের জন্য, যেকোনো সরকারী সেবাকেন্দ্র থেকে ভালোভাবে| নিজের দেশের সম্ভ্রান্ত আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে, বহু দূরের বাংলাদেশে কাজ করে চলেছেন এই মানুষটি| তার থাকার ঘরটি মাটির তৈরী, মাটিতেই ঘুমানোর ব্যাবস্থা| নূন্যতম সুযোগে তিনি নিজের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন শুধুমাত্র আর্ত-মানবতার সেবার মহান উদ্দেশ্যে| ৭০ বছর বয়স্ক চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর এর জীবনের আকাংখা খুব বেশি কিছু নয়, তিনি শুধু চান দুস্থ মানুষের সেবার জন্য তার গড়ে তোলা এই সেবাকেন্দ্রটি যেনো তার মৃত্যুর পরে যোগ্য লোকের হাতে পরিচালিত হয়| যেনো মানুষের সেবার মহান উদ্দেশ্যেই চালিত হয় তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি, যেনো তার মতই কেও এগিয়ে আসে এই ব্রত নিয়ে| সাধারণ পোশাক গায়ে অতি সাধারণ একটি সাইকেলে করে ঘুরে বেরোনো এই মানুষটির চোখে যে অসাধারণ স্বপ্নটি আছে, তার ভার বহন করার ক্ষমতা কতজনের আছে জানিনা| দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজের জীবন উত্সর্গ করা, চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর এর এই স্বপ্নকে সফল করতে হয়তো এগিয়ে আসবে অন্য আর একজন তারই মতো, আর এভাবেই বেঁচে থাকবে মানবতার গল্প, ত্যাগের গল্প, সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের নির্মোহ ভালোবাসার গল্প| আর কিছু না পারি, অন্তত এইটুকু আশা করতে তো দোষ নেই|