Sunday, January 1, 2012

জীবনটা একটা হাওয়াই মিঠাই

জীবন একটা হাওয়াই মিঠাই, হ্যাঁ, স্রেফ একটা হাওয়াই মিঠাই, ব্যাস| এর আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই| বলা যায়, এই উদ্ভট চিন্তাটা মাথায় হঠাৎ করেই এলো, এটাকে দীর্ঘদিনের চিন্তাপ্রসূত উপসংহার বলা যায়না মোটেই| তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, জীবনকে আমি বায়োস্কোপ থেকে শুরু করে একদম ছিবড়ে যাওয়া চুইংগামের মতো এরকম অনেক কিছুর সাথে তুলনা করেছি, শুধু তাই নয়, সেই কবিগুরু থেকে শুরু করে হালের গুরুকবিদের অনেকের ছন্দের মাঝেই জীবনের অনর্থক মানে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছি, কিন্তু শেষমেষ গিয়ে ঠেকলো কিনা এই হাওয়াই মিঠাইতে!!

ব্যাপারটা সেরকম কিছুনা, এইতো সেদিন এটা খেতে গিয়েই মাথায় এলো কথাটা, আর কি সুন্দর খাপে-খাপে মিলে গেলো সব| প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-আশাভঙ্গের সব হিসাব-নিকাশ এই আর কি| যেমনটা, হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার সময় হয়| মিঠাই তো কত রঙ-বেরঙ এর হয়, লাল-নীল-সাদা, জীবনটাও কি কম রঙের?? প্রতিটি মুহুর্তের পরতে পরতে এক এক রকম রঙ| কবিদের ভাষায়, বেদনার রঙ নীল, ভালোবাসার যেমন লাল, কিছুটা সেই রকম আর কি|

আবার যখন হাওয়াই মিঠাই হাতে নিই, তখন মনে হয় অনেক কিছু, জিনিসটা তার অস্তিত্ব প্রমান করে রঙে-গন্ধে-ওজনে, কিন্তু যেই খাওয়া শুরু তখনই কমতে থাকে ওজন, যেনো স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে| জীবনটাও কি সেরকম নয়? যত গভীরে যাওয়া যায়, ততই কি এক বিশাল শুন্যতাই উপলব্ধি হয়না? মনে হয়, এই আছে, এই নেই| প্রথমে কত প্ল্যান, কোনো নিয়ম, সামাজিক দায়বদ্ধতার বেড়াজাল, কিন্তু শেষমেষ তো ঐ এক শুন্যতা| এক অতল শূন্যতায় স্রেফ মিলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি|

আবার যখন হাওয়াই মিঠাইটা মুখে দেই, তখন মুখের ভিতর প্রাপ্তির অনুভূতি, কিছুটা মিষ্টি-মিষ্টি স্বাদ| কিন্তু অনুভূতিটা একটু গাড় হবার আগেই হুট করে মুখে মিলিয়ে যায়| কতইবা সময় নেয়, দশ সেকেন্ড বা হয়তো আরও কম| জীবনটাও তো সেরকমই, সবসময় মনে হয় এইতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি, ব্যাস এইতো আর একটু| কিন্তু গুছিয়ে নিচ্ছি-নিবো করে একটু থিতু হবার আগেই সব মিলিয়ে যায়| জীবনে কোনো কিছুর স্বাদই কি অতটা গাড়?? আমার তো মনে হয়, ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা বছর| কেন মনে হয়না- এইতো সেদিন মায়ের হাতে ভাত খেতাম, বাবার কোলে ঘুরতাম??

হাওয়াই মিঠাইটা আসলেই দারুন একটা জিনিস, খেলাম-খেলাম করেও যেমন আসলে কিছুই খাওয়া হয়না, শুধু চোখের আর মনের দেখাই সব, জীবনটাও তেমনি| চোখের দেখা স্মৃতিগুলো মনের ভেতর জমে থাকে, বছর শেষে ধুলো ঝেড়ে মলাট পরিষ্কার করার মতো একবার করে শুধু মনেই তো করি| তারপর আবার হয়তো অনেক দিন পরে সেই একই ধুলো ঝাড়ার পুনরাবৃত্তি| জীবনের কোনো কিছুই যেমন স্থায়ী না, তেমনি সেটা জেনেও কত তোরজোর করে নিজেকে অমর করার বৃথা চেষ্টা করি|

একসময় যখন হেরে যাচ্ছিলাম জীবনের প্রতিটি ধাপে, তখন এক সাধু বলেছিলো- "ধরো তুমি একটা পাহাড়ে উঠছো, পাহাড়টা যত বড় উঠতে তত কষ্ট| আবার বাধা-বিপত্তি অনেক, তবে চূড়ায় ওঠার তৃপ্তিটাও কিন্তু কম নয়| কিন্তু এরপর??" আমি বোকার মতো বলেছিলাম- "এরপর??" তিনি হেসে বলেছিলেন- " এরপর আবার নিচে নামতে হবে যে,আবার অন্য একটা পাহাড়ে ওঠার জন্য| তবে নামার সময়ও বাধা-বিপত্তি মোটেই কম নয়, তা সে সময় কম লাগুক কিংবা বেশি|" আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম| এখন বুঝি, হাওয়াই মিঠাই এর মতো এই জীবনটার চরম সত্যটি কতোটা সরল ভাষায় বলেছিলো সাধু| কতোটা ভয়ংকর কঠিন সত্যকে কি অবলীলায় প্রকাশ করেছিলো সে|

সত্যিই তো, জীবনে একটু স্থায়ী হবার আশায় আমরা কত সংগ্রামই না করে চলি, কিন্তু সেই স্থায়িত্বটা কি কখনই খুব বেশি সময়ের?? আবার তো একই সংগ্রামের পুনরাবৃত্তি| তবে অধঃপতনের রাস্তাটাও তো কম দূর্ভোগের নয়| কত গঞ্জনা সইতে হয়| গাদা-গাদা হতাশার বোঝাটাও তো কম নয়| কতজন সামলাতে না পেরে হারিয়ে যায়, যারা বেঁচে থাকে তারা হয়ে যায় পাথুরে মানব|

তবে যত যাই বলি না কেনো, হাওয়াই মিঠাই মুখে মিলিয়ে গেলেও, একটা জিনিস কিন্তু হাতে থেকেই যায়, আর তা হলো কাঠিটা| জীবনটাও ঠিক তাই, সব হারিয়ে যায়, সবাই হারিয়ে যায়, কালের ঘূর্ণনে মিশে যায় অতীতে, কিন্তু আমরা বেঁচে থাকি মানুষ না স্রেফ স্মৃতির ফসিল হয়ে, ঠিক ঐ কাঠিটার মতো| নতুন বছরে আর যাই হোক না কেনো, এই উপলব্ধিটা নিয়ে বাঁচতে চাওয়াটাই বা কম কিসের?? জানিই তো, সব শেষে ঐ একটাই- "হাওয়াই মিঠাই|"

2 comments:

  1. এত সুন্দর লেখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ...

    ReplyDelete