Monday, February 27, 2012

ভুলে গেছি যেই আঘাত অনায়াসে


আমরা জাতি হিসেবে অনেক কৃতিত্ব এর দাবীদার, আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, স্বাধীনতা যুদ্ধ করে অর্জন করেছি, স্বৈরশাসক এর পতন ঘটিয়েছি তরুণ রক্ত দিয়ে, জাতি হিসেবে আমরা বীরের জাতি, এই দাবি করতেই পারি। কিন্তু একটা দাবি আমরা করিনা, সেটা কি? আমরা ভুলোমনা একটি জাতি| আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই, আমরা খুব সহজে ভুলে যাই আমাদের অতীত, আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমরা চোখ ফেরালেই ভুলে যাই। তারপর একসময় আমরা সেই ঘটনা কখনো ঘটেছিল কিনা সে নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করি|

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪, আজ থেকে ৮ বছর আগের এই দিনে, বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ এর উপর ধারালো অস্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল কিছু মানুষরুপী নরপশু, হায়েনা| আঘাতে আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন করে পৃথিবী থেকে মানুষটির অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছিলো কি নৃশংস আক্রোশে| ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির চরম শক্তি প্রদর্শন ছিলো সেটি, মুক্ত কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে দেয়ার কি প্রচন্ড আস্ফালন ছিলো তাদের| আঘাতে জর্জরিত মানুষটি বেঁচে গিয়েছিলেন কোনমতে সেদিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারেননি, ১১ আগস্ট, ২০০৪, প্রবাসে মৃত্যুবরণ করেন তিনি|

হ্যাঁ, আমরা ভুলে গেছি তাকে, ভুলে গেছি তার অবদান, তার মুক্তচিন্তাকে, তার কণ্ঠস্বরকে, তার লেখনীকে, যেই চিন্তাশক্তি আর লেখনী দিয়ে তিনি লড়ে গেছেন সমাজে একা, এক প্রবল নৃশংস চক্রের বিরুদ্ধে। জীবদ্দশায় তাকে কম হুমকি দেওয়া হয়নি, দেশের ধর্মীয় মৌলবাদী চক্র তাকে হত্যার জন্য কম চেষ্টা করেনি, তার কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখার জন্য তার উপরে কম চাপ ছিলোনা, কিন্তু কি প্রবল বিক্রমে তিনি লড়ে গেছেন| আমরা ভুলে গেছি তার "পাক সার জামিন সাদ বাদ", তার সেই বীরত্ব| কি দুর্দান্ত স্পর্ধায় তিনি একাই মৌলবাদীদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন| কলমের শক্তি বুঝি একেই বলে|

তার লেখার চাছা-ছোলা ধরণ অনেকেরই ভালো লাগতোনা, সমালোচনায় তার ক্ষুরধার মন্তব্য অনেকেই অপছন্দ করতেন, ধর্মের বিরুদ্ধে সর্বোপরী ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান অনেকেরই চক্ষুশুল ছিলো, কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশে শুধু মাত্র সাহিত্য রচনার জন্য এভাবে একজন মানুষকে আক্রমনের শিকার হতে হবে, এ চরম ভাবনাটি মনে হয় কারো মাথায় আসবেনা| কিন্তু সেই আঘাত এসেছে, যদি কেউ বলে এই আঘাত তার অবস্থানের জন্য, তাহলে বলবো, ভুল, এই আঘাত শুধু তার একার নয়, এই আঘাত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, এই আঘাত মানবতার বিরুদ্ধে, এই আঘাত মুক্তকণ্ঠকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য| এই আঘাত আমাদের সকলের, প্রত্যেকটি আঘাত ক্ষত-বিক্ষত করেছে আমাদের, রক্ত ঝড়িয়েছে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এতগুলো বছর চলে গেলো, ঘটনার আসল নায়করা পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলো, বিচার হলোনা একজনেরও। দেশে এখনো সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন, এখনো মুক্তকণ্ঠকে থামিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা, কিন্তু আমরা ভুলে যাবো, আমরা ভুলে থাকবো| যেভাবে আমরা ভুলে গেছি রমনার বটমূল, যেভাবে ভুলে গেছি তসলিমা নাসরিন, যেভাবে ভুলে গেছি অজস্র বোমা হামলার ক্ষত, ঠিক সেভাবেই আমরা ভুলে যাবো, কারণ একদিন ঠিক এভাবেই সব কিছু নষ্টদের হাতে চলে যায়|

আমরা জাতি হিসেবে অনেক ভুলোমনা, তার উপরে ক্ষমাশালী, আমরা ভুলে থাকতে পছন্দ করি, আমরা অতীতকে ভুলে যেতে পছন্দ করি| আর এ কারণেই অস্তিত্বের টানাপড়েন লাগে যখন-তখন| আমরা ভুলে যাই আমাদের সংগ্রাম, আমরা ভুলে যাই নরপশুদের, আমরা ভুলে যাই আমাদের খুনিদের। ভুলে গিয়ে তাদের আমরা আপ্যায়ন করি, তাদের জন্য স্লোগান দেই, তাদের জন্য মমতা প্রকাশ করি, তাদের জন্য ভালোবাসা দেখাই, কারণ আমরা অতীত ভুলে যাওয়াতে বিশ্বাসী।


হুমায়ুন আজাদ অনেক আগে লিখেছিলেন-

"আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে।"

আমরা তার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, আলোচনা করেছি, দুঃখ করেছি, কিন্তু ভুলে গেছি। তাই আটটি বছর পরেও অমিমাংসিত থেকে গেছে এই ঘটনার রহস্য, কারণ আমরা দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছি, সরকার এর পর সরকার এসেছে কিন্তু কিছুই হয়নি| আর এভাবেই দম্ভ বেড়েছে মৌলবাদী শক্তির আর এভাবেই তারা পার পেয়ে গেছে সবখানে|


স্যারকে একসময় বলতে ইচ্ছে হতো, না, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যেতে পারেনা, যেতে দেয়া যায়না, নাহ তাকে ভুল প্রমান করতে পারিনি, এখন বলতে ইচ্ছে হয়, রাষ্ট্রযন্ত্র তো অনেক আগেই পচে গেছে এখন পচন ধরেছে পুরো সমাজের, আমাদের মস্তিষ্কের, আমাদের সত্ত্বার। আমরা হয়তো সত্যিই হেরে গেছি|

Sunday, February 26, 2012

বগালেক রহস্য : পর্ব তিন



১৫০০ শতাব্দীর দিকে যখন বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বানিজ্য রমরমা তখন বিভিন্ন দেশের নাবিকদের সাথে সাথে ১৫২০ এর দিকে এখানে এসে হাজির হয় পর্তুগিজ নাবিকরা, তবে অন্যান্যদের মতো সৈন্য সামন্ত নিয়ে যুদ্ধ লাগানোর বদলে তারা "কাসাদোস"দের দিয়ে কলোনি তৈরী করে, রিজার্ভ আর্মির বিবাহিত সদস্যদের বলা হতো "কাসাদোস", তবে বাংলায় তারা আসে ১৫১৭ এর দিকে, প্রথম এসে ভিড়ে চট্টগ্রাম এর বন্দরে, তখন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে সেটি| তবে পর্তুগিজদের মন তখন ব্যবসা-বানিজ্যের দিকেই ছিলো, গদির লড়াইয়ে তারা তখনো অতোটা তত্পর নয়| ১৫৩৬-১৫৩৭ বাংলার তত্কালীন রাজার ছত্রছায়ায় একচেটিয়া ব্যবসা করে এই অঞ্চলে| তবে এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে যা হয়, সেরকমই এবার তাদের নজর গেলো আধিপত্যের দিকে, ১৫৯০ এর দিকে তারা চট্টগ্রাম আর আশেপাশের অঞ্চলগুলো একপ্রকার দখল করে কলোনি তৈরী করে, ব্যবসার রুট হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে জলপথ একই সাথে স্থলপথ, আরাকান অঞ্চলের সাথে ভালোই ব্যবসা চলছিলো তখন| সন্দ্বীপ এও কলোনি তৈরী করে, ১৫৯৮ এর মধ্যে প্রায় বিনা বাধায় এই অঞ্চলে বেশ ভালো ভাবে জাকিয়ে বসে তারা| এরই পরিণতিতে ১৬০২ এ সন্দ্বীপ পুরো দখল করে দোমিঙ্গো কার্ভালহো এবং মানুয়েল দ্য মেত্তোস তাদের দলবল নিয়ে| তাদের বানিজ্যিক আধিপত্য ছড়িয়ে পড়ে তত্কালীন দিয়ান্গা বা বর্তমানের ফিরিঙ্গি বন্দর এলাকা পর্যন্ত| এই অঞ্চলের ফুলে-ফেঁপে ওঠা বানিজ্যিক অবস্থার কথা তখন গোপন কিছু নয়, তাই অনেকেই গন্ধ শুকে শুকে চলে আসছে ভাগ বসাতে, এভাবেই ১৬০৩ এ এখানে এসে হাজির হয় লিয়ান্দ্র কার্ভালহো, দোমিঙ্গো কার্ভালহোর বংশধর| আর এখান থেকেই আসল কাহিনী শুরু| এইটুকু বলে থামলো শুভ্র| ওরা বসে আছে একটা টিলার উপরে, সকাল থেকে ৪ ঘন্টা হাঁটা পথে চলেছে, সবার অবস্থাই করুণ| রাস্তা যতটা না দুর্গম তার থেকেও বৃষ্টির কারণে খারাপ অবস্থা| এই উঁচু টিলার মাথায় পৌঁছে তাই বিশ্রাম নেওয়ার সিধান্ত নিয়েছিলো সবাই| বাকিরা যখন এদিক ওদিকে বসে পড়েছে তখন রাদ কে একপাশে ডেকে কথাগুলো বলা শুরু করলো শুভ্র|


রাদ এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো ভোর ৫ টার, ওর মনে হলো চোখ বোজার সাথে সাথে এলার্ম বেজে উঠলো, কিন্তু না, উঠে দেখলো ঠিকই সকাল হতে চলেছে| বাইরে আবছা আলো| উঠে ধাক্কা দিয়ে অঙ্কুরকে ওঠানোর চেষ্টা করলো, কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পড়ে উঠে বসলো অঙ্কুরও| সবাই তৈরী হতে হতেই চলে এলো জাহিদ| খুব বেশি দেরি করলোনা ওরা, সব গুছিয়ে ৭ টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়লো সবাই| প্রথম টিলাটা পাড় হতেই জিভ বেড়িয়ে গেলো সবার| হাফাচ্ছে জোরে জোরে, ওদের দেখে হেসে ফেললো জাহিদ| জাহিদের সাথে গল্প করতে করতে চলেছে ওরা, তরুণ, হাসি-খুশি গাইড, ওর কাছ থেকেই জানলো, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা নদীটাকে ওদের রাস্তায় ৫৪ বার অতিক্রম করতে হবে, আর পার হতে হবে হাজার দুয়েক ফুট উঁচু পাহাড়ও| এসব শুনেই সবার চোখ কপালে উঠতে চললো| তবে শুভ্র বেশ আগ্রহ নিয়েই এটা ওটা প্রশ্ন করে চললো জাহিদকে, কয়েকবার জানার চেষ্টা করলো আদিবাসীদের পুরনো গ্রামগুলোকে নিয়ে|


রাস্তা যতই দুর্গম হোকনা কেনো, চারিদিক এর দৃশ্য অসাধারণ, এধরনের প্রকৃতি তো আর সবদিন দেখা হয়না, তাই ঝর্নার জলে ভিজে, পাহাড়ি নদী পার হয়ে, কখনো ঘন জঙ্গল আবার কখনো নিচু মাঠ পার হয়ে ওরা বেশ মনের আনন্দেই চললো, সাথে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা তো আছেই, দেখা গেলো, অঙ্কুরও আস্তে আস্তে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, ভালোই আনন্দে আছে সেও| জামিল অবশ্য বেশ কয়েকবার বললো, আগে জানলে ওজন কমিয়ে আসত ও যেভাবেই হোক, তবে রাদ আর শুভ্র ওকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলোনা এতো তাড়াতাড়ি ওর এই সুবিশাল ভুড়ি ও কি করে কমাতো যা কিনা এতদিনেও ও পারেনি| এসব করতে করতেই, ওদের ঘন্টা চারেক পার হয়ে গেলো, এর মধ্যে রাদ গুনে দেখলো প্রায় ছোট বড় মিলিয়ে ৩৫ বার পার করেছে নদীর স্রোত, বেশ কয়েকটা জায়গা খরস্রোতা ছিলো, একবার না বুঝে পা দিয়ে স্রোতের টানে শুয়ে পড়েছিল নিজেই| তবে আপাতত বৃষ্টি সেরকম হয়নি, বড় বড় পাথুড়ে পথ, কখনো পাহাড়ের গা বেয়ে, কখনো ঝর্নার জলের নিচ দিয়ে ওরা এগোতে এগোতে এসে পৌঁছলো এক পাথুড়ে দেয়ালের সামনে, কালো দেয়াল উঠে গেছে অনেক উঁচু পর্যন্ত| উপর থেকে অঝোর ধারায় জল পড়ছে| জাহিদ বললো, "বৃষ্টির জল, উপর থেকে নেমে আসছে|" কিন্তু ওদের এই দেয়াল বেয়েই উপরে যেতে হবে, আবার উপর থেকেই রাস্তা শুরু| কোনো মতে ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে উঠে এলো বিপদ ছাড়াই, তারপর ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকক্ষণ চলার পড়ে এই টিলা| উঠতে অনেকটা সময় লাগলো, যাত্রার ধকলে ক্লান্ত সবাই, খুব একটা বিশ্রাম নেওয়া হয়নি কোথাও, তাই এখানেই বসার সিদ্বান্ত নিলো ওরা| জাহিদ এদিক ওদিক থেকে ফল কুড়াতে গেলো, আর শুভ্র একপাশে বসে ব্যাগ থেকে বের করে একটা ডায়রি ঘাটতে লাগলো| সেটা দেখে রাদ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতেই শুরু করেছিলো শুভ্র বর্ণনা করা|


লিয়ান্দ্র কার্ভালহো, পেশায় ব্যবসায়ী হলেও, যোদ্ধার জাত| বানিজ্যের রমরমা অবস্থা দেখে সে নিজের উচ্চাভিলাষী প্ল্যানের বাস্তবায়ন শুরু করলো| সাথে নিয়ে আসা লোকজন আর যোদ্ধাদের নিয়ে বানিজ্য কুঠি বানালো সন্দ্বীপ এ| রকমারি জিনিস আর তার সাথে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র আর দামি পাথড়ের বড় ব্যাবসা , বেশ ভালোই চলছিলো, আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সম্পদ, তারই সাহায্যে দিয়ান্গাতেও আরেকটা কুঠি বানায় সে| তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর কঠোর হাতে বানিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করে প্রচুর সম্পদ জমা করে সে| কিন্তু ১৬০৭ এ, এই অঞ্চলে হামলা করে আরাকান এর রাজা, হামলায় নিহত হয় প্রায় ৬০০ পর্তুগিজ, অল্প কয়েকজন পালিয়ে বাঁচে| যারা পালিয়ে বাঁচে তাদের মধ্যে লিয়ান্দ্র আর তার কিছু সঙ্গী সাথী ছিলো| তারা অন্যদের মতো জলপথে না পালিয়ে, পেছনের পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে যায়| জানা যায় তারা সাথে নিয়ে গিয়েছিলো, প্রচুর সম্পদ| কিন্তু এর পরে আর কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের| বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলো যেনো| একনাগাড়ে সবটুকু বলে থামলো শুভ্র, রাদ বোঝেনি শুনতে শুনতে কখন তার মুখ হা হয়ে গিয়েছে| ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো শুভ্র|


রাদ প্রশ্ন করলো,- "তাহলে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো আর তার সঙ্গী সাথীদের কি হলো?? আর তাদের সেই ধন-রত্নই বা কথায় গেলো??" শুভ্র বললো,- "সেটা কোনো নথিতে সেরকম ভাবে পাওয়া যায়নি|" রাদ অবাক হয়ে বললো- "তাহলে তুই এতো কিছু কি করে জানলি??" শুভ্র বললো,- "আমি কয়েক মাস আগে আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে বাড়ির পুরনো লাইব্রেরীতে খোঁজা খুঁজি করছিলাম কিছু পুরনো আকর্ষনীয় বই পাওয়া যায় কিনা, হঠাৎ হাতের ধাক্কায় পাশের একটা আলগা ড্রয়ার খুলে নিচে পড়ে যায়, তাতে ছিলো একটা বাঁধানো বই| পরে হাতে নিয়ে দেখলাম, বই নয়, পুরনো দিনের ডায়রি, আর তার ভেতরে ভাঁজ করা একটা হাতে আঁকা ম্যাপ| ঐ দিন ডায়রিটা পড়ে যা বুঝলাম তাহলো, আমাদের বংশেরই কোনো পূর্বপুরুষ, এই অঞ্চলে ব্যাবসা করতেন, উনি ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এই গল্পের খোঁজ পান| প্রথমে গল্প বলে উড়িয়ে দিলেও নেহাৎ কৌতূহলের বশেই তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন এদিক ওদিক থেকে, সেগুলো তিনি টুকে রাখেন এই ডায়রিটাতে| একসময় তিনি তার তথ্য আর পুরনো ইতিহাস ঘেটে এতটুকু বুঝতে পারেন যে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো আর তার সম্পদের কাহিনী একদম ভিত্তিহীন নয়, আর তার অনেক পড়ে তিনি খুঁজে বের করেন যে, বান্দরবনের পাহাড়ি এলাকার এদিকে যেসব আদিবাসী গ্রাম আছে তার মধ্যে অনেকগুলো বেশ পুরনো, আর এখানেই কোথাও থেকে তিনি জানতে পারেন পুরনো কোনো এক স্থাপত্যের কথা যাকে এখানের লোকজন মন্দির বলে মনে করে| আরও জানতে পারেন যে, কোনো বিদেশী লোকের হাতে তৈরী হয়েছিল এই মন্দির আর তাতে নাকি সংরক্ষিত আছে পুরনো কোনো দেবতা, তবে মজার বিষয় হলো সেই বিদেশীর বর্ণনার সাথে লিয়ান্দ্র কার্ভালহোর মিল আছে, আর এটাও সত্যি যে লিয়ান্দ্র তার দলবল নিয়ে এদিকের পাহাড়েই লুকিয়েছিলো, তাই সেসময় আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক করে তাদের গ্রামে লুকিয়ে থাকাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা, আর তার সাথের ধন-রত্ন এই মন্দিরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে সব থেকে সহজ উপায়, তবে কোথা থেকে যিনি ডায়রি লিখেছেন তিনি এই খবর পান সেটা পরিষ্কার করে লিখে যাননি| কিন্তু হাতে আঁকা একটা ম্যাপ রেখে গেছেন, যাতে একটা অঞ্চলের রাস্তা আর মন্দিরের হদিস আছে|"


রাদ বললো,"তাহলে তুই কি করে নিঃশ্চিত হচ্ছিস এটা সেই মন্দির যেটার কথা ডায়রিতে লেখা আছে??" "আমি নিজে এটা হাতে আসার পরে কয়েক মাস ধরে খোঁজ নেই, বই ঘেঁটে আর এদিকের পুরনো কিছু ম্যাপ আর্কাইভ থেকে বের করি, পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে বের করি আরও তথ্য| পরে ম্যাপগুলো মিলিয়ে দেখি এটা এখনকার বগা লেক এর এদিকটা নির্দেশ করছে, আর তখন অতো ভালো ভাবে ম্যাপ করা না হলেও, মিল খুঁজে বের করতে অসুবিধে হয়নি আমার|"-বললো শুভ্র| রাদ উত্তেজনার বশে বলে উঠলো- "তাহলে এটা শুধু মন্দির কিংবা জঙ্গল দেখার প্ল্যান নয়, এটা আসলে একটা ট্রেজার হান্ট???" ট্রেজার হান্ট কথাটা প্রায় চিত্কার করে বললো রাদ, শুভ্র প্রায় ওকে মুখ চেপে ধরে থামালো, বললো বগা লেক না পৌঁছনো পর্যন্ত কাউকে বলা যাবেনা| এদিকে জাহিদ এসে তাড়া দিতে লাগলো আবার চলা শুরু করার জন্য, রাদ আর শুভ্র একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে উঠে চলা শুরু করলো, জামিল পেছন থেকে এসে বললো, "কিরে তোরা এতক্ষণ ধরে কি ফিসফিস করছিলি রে??" শুভ্র হেসে কথাটা পাশ কাটিয়ে গেলো, রাদ বললো, "আররে কিছুনা|" কিন্তু রাদ নিজেও জানে কিছুনা বললেও অনেক কিছুই এখনো ওদের সবার জানা বাকি আছে|

[ক্রমশঃ]

Friday, February 24, 2012

বগা লেক রহস্য : পর্ব দুই



খুব একটা বেশি সময় লাগলোনা, এই আধ ঘন্টা, ওরা পৌঁছে গেলো যেখান থেকে চান্দের গাড়ি ছাড়বে। নেমে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো ওরা ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই, বাকিরা এদিক ওদিকের গ্রামে চলে গেলো| শুভ্র একটু এগিয়ে গিয়ে কয়েকজন লোকের সাথে মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলতে শুরু করলো| এদিকে টিপ টিপ বৃষ্টি বন্ধ হলেও আকাশ আগের থেকে বেশি মেঘলা হয়েছে, চারিদিকে একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব। রাদ জামিলের দিকে তাকিয়ে বললো, "এখনই রওনা না হলে, মনে হচ্ছে ফেরত যেতে হবে শহরের দিকে|" অঙ্কুরও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। এসময় শুভ্র এসে বললো, "এখান থেকে যাওয়ার সকালের শেষ গাড়ি চলে গেছে আবার যাবে একদম বিকেলে, কিন্তু আমরা যদি এখনি না যাই, তাহলে আজকে রুমা বাজার যেয়ে পৌঁছতে পারবোনা, কারণ এরা আমাদের নিয়ে যাবে শঙ্খ নদীর পাড় পর্যন্ত, সেখান থেকে নৌকা করে ঘন্টাখানেকের নদী পার করে তবে রুমা বাজার।" জামিল বললো, "এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো মনে হচ্ছেনা, যেকোনো সময়ে পুরোদমে শুরু হবার জন্য মুখিয়ে আছে।" সবাই মিলে ঠিক করলো কোনো একজন চালককে ধরে একটা পুরো গাড়িই জোগাড় করা হবে| রাদ আর শুভ্র পাশে ঝুপড়ি দোকানে গিয়ে কথা বলতেই একজন এগিয়ে এলো, বললো সে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক তবে তার জন্য বেশি টাকা লাগবে, কত প্রশ্ন করতেই বললো ৩০০০।

নিজেদের অবস্থা দেখে আর আকাশের পরিস্থিতি দেখে খুব বেশি দরদাম করতে পারলোনা, ঠিক হলো ২০০০ এ। সবাই মিলে যখন সামনেই রাখা ক্যাটক্যাটে নীল রঙের গাড়িতে উঠে বসলো তখন আবিষ্কার হলো "চান্দের গাড়ি" নামকরণের সার্থকতা। গাড়ি বলতে যা বোঝানো হচ্ছে আসলে সেটা গাড়ির অবশিষ্ট বললে ভুল হবেনা। পিকআপ জীপ, পেছনে বসার জায়গা, কোনো হেডলাইট নেই, গাড়ির গীয়ার দড়ি দিয়ে কোনমতে লাগানো, হর্নের আওয়াজ ড্রাইভার নিজেও শুনবে কিনা সন্দেহ আর বসার জায়গায় দুটো কাঠের তক্তা রেখে দেওয়া। আর এই গাড়িতেই নাকি ৪০-৫০ জন অনায়াসে ভিতরে আর ছাদে বসে চলে যায়| অঙ্কুর বলে উঠলো, "এই গাড়ি যদি কোনভাবে ব্রেক ফেল করে, তাহলে তো চাঁদে যাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা দেখিনা।" একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো চারজন।

এদিকে গাড়ির এই অবস্থা দেখে শুভ্র নিজেও দমে গেলো কিছুটা| তবে রাস্তা শুরু হলো কিছুক্ষণ পড়ে, যেনো রোলার কোস্টার চড়ছে গাড়ি। একবার এই উঠে যাচ্ছে তো আরেকবার সাই করে নিচে নামছে, যখন গাড়ি মোড় নিচ্ছে তখন মনে হচ্ছে পিছনের চাকা এই খাদে চলে গেলো| বসার জায়গার ভিতরের দিকে অঙ্কুর আর জামিল গাড়ির দুইপাশের রড ধরে কোনমতে বসার চেষ্টা করছে, আর এদিকে শুভ্র আর রাদ পিছন দিকের খোলা জায়গা দিয়ে রাস্তার পাশের খাদ অনায়াসে বসে বসেই দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি অনেকটা উঁচুতে উঠে গেলো, নিচে দিয়ে মেঘ চলে যাচ্ছে, এবার ওরা ছবি তোলার জন্য গাড়ি দাড়া করলো রাস্তার পাশে, রাস্তায় নেমে বিচিত্র ভঙ্গিতে ছবি তোলা শুরু করলো, দেখলো রাস্তার উপর দিয়েই হালকা হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে| ছবি তুলতে তুলতেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো, গাড়ি চলতে শুরু করার পরে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়তে থাকলো, একসময় আশেপাশের কিছু আর দেখা গেলোনা। এরই মধ্যে নিঃশ্চিন্ত মনে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে ড্রাইভার, এবার অঙ্কুর প্রশ্ন না করে পারলোনা, ড্রাইভার কি আসলেই দেখে চালাচ্ছে?? জোর গলায় ড্রাইভারকে এই কথা জিগ্গেস করতেই ড্রাইভার বললো, "দেখা তো কিছু যাইতাছেনা, কিন্তু আন্দাজ কইরা চালাইতাছি আরকি।" অঙ্কুর প্রায় ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো,"তাহলে থামাচ্ছেন না কেনো??" ড্রাইভারের উত্তর এলো, "আপনারা বলেন নাই যে !!" এরপর সবাই মিলে বলে-কয়ে গাড়ি থামানো হলো একটা আদিবাসী দোকানের পাশে, রাস্তায় নামতে গিয়ে দেখলো পা রাখা যাচ্ছেনা এতটাই পিছলে যাচ্ছে। উপর থেকে বৃষ্টির জল মাটি ধুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কোনমতে বাঁশ ধরে ধরে দোকানের ভিতরে ঢুকলো সবাই| শীতকাল নয়, তবুও বৃষ্টি কাপুনি ধরিয়ে দিয়েছে শরীরে, ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কিছু বাচ্চা-কাচ্চা| দোকান বলতে যেটা মনে হয়েছিল, সেটা আসলে থাকার ঘর, কিন্তু সামনের অংশ দোকান হিসেবে চালানো হচ্ছে, সেখান থেকেই ধুমায়িত চা হাতে নিলো সবাই| এদিকে বেশি ওস্তাদি দেখাতে গিয়ে জামিল আছাড় খেলো গাড়ির সামনে, ওকে ধরে তুলতে গিয়ে শুভ্র আর অঙ্কুরের নিজেদের আছাড় খাওয়ার অবস্থা| কোনমতে হাচড়ে-পাচড়ে নিজেকে আর নিজের ভুড়ি সামলিয়ে উঠে এলো জামিল, এদিকে বৃষ্টি পুরো না কমলেও তেজ কমে গেছে, আবার শুরু হলো যাত্রা| তবে এবার প্রতিবার গাড়ি মোড় ঘোরার সময় রাদ দেখলো পেছনের চাকা রাস্তা থেকে অনেকটাই পিছলে যাচ্ছে, নিরবে তাকালো শুভ্রর দিকে, শুভ্র মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো সেও দেখেছে, কিন্তু ভেতরের দুজনকে বলার ঝুঁকি নিলো না কেউ|


অনেকটাই উপর দিয়ে চলছে গাড়ি, নিচে সদ্য বৃষ্টিস্নাত জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির এর মধ্যেই রোদ দেখা যাচ্ছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে চারদিকে, গল্প বন্ধ করে চারিদিকে দেখতে লাগলো সবাই, অদ্ভুত এক নিরবতা চারিদিকে, মাঝেমাঝে শুধু ওদের গাড়ির আওয়াজ এছাড়া প্রায় নিরব বলা চলে আশপাশ। রাস্তার একপাশে উঠে গেছে উঁচু পাথরের দেয়াল, উপরে জঙ্গল, অনেক জায়গায় দেখলো বৃষ্টির জন্য মাটি ধুয়ে উপর থেকে বড় পাথড়ের খন্ড খসে পড়েছে, এর একটা যদি গাড়ির উপরে পড়ত তাহলে আর বলতে হতোনা। একপাশে দেখলো একটা গাড়ি চাকা উপরে তুলে পড়ে আছে, ওদের মনে হলো এর ড্রাইভার নিঃশ্চিত আন্দাজে চালানোর ঝুকি নিয়েছিলো। এভাবে কখনো দুপাশে জঙ্গল, কখনো একপাশে উঁচু পাহাড়ের দেয়াল এরকম করে চলতে থাকলো, পিচ্ছিল রাস্তায় কোনমতে ক্যাঁচক্যাঁচ আর টায়ারের কর্কশ আওয়াজ তুলে চলছে ওদের গাড়ি| প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পড়ে, ওরা পৌঁছালো একটা ছোট বাজারের মতো জায়গায়| ড্রাইভার নেমে ঘোষণা দিলো এটাই সেই জায়গা, এখান থেকে নেমে নিচে গিয়ে নৌকা নিতে হবে| ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে চারজন এগিয়ে চললো ঘাটের দিকে| ঘাটে নেমে নৌকা করার কথা বলতেই মাঝিরা বললো, আগে উপর থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে নাম লিখিয়ে আসতে হবে। হতাশ ভঙ্গিতে উপরে তাকিয়ে দেখলো নদীর পাড় থেকে সেই ক্যাম্প ভালোই উঁচুতে| অগ্যতা চারজনকেই আবার উপরে উঠতে হলো, ক্যাম্পে গিয়ে দেখলো, বেশ কয়েকজন প্রায় ওদের বয়সী সেনাসদস্য আরাম করে গল্প করছে| ওদের দেখেই হেসে একজন এগিয়ে এলো, কথাবার্তা শেষে নিজেই ঘুরিয়ে দেখালো ক্যাম্প|উপর থেকে শঙ্খ নদীর কিছু ছবিও তুলে নিলো এই ফাঁকে রাদ| নৌকার জন্য অনেক দরদাম করার পরেও খুব একটা অল্প পয়সায় কেউ যেতে রাজি হলোনা, তখন শুভ্র কোথা থেকে ছোট একটা ছিপ নৌকা জোগাড় করলো, যার মাঝি আবার দুজন ১০-১২ বছরের ছেলে|

নৌকার আকার আর তার মাঝি দেখে বাকি তিনজনেরই অবস্থা খারাপ, একে তো কখনো পাহাড়ি নদীতে যায়নি, তার উপরে বৃষ্টির মৌসুম, কিরকম স্রোত থাকবে কেউই জানেনা, কিন্তু কিছু করারও নেই, বাকি মাঝিরা প্রায় ঐ নৌকার তিনগুন ভাড়া চেয়ে বসে আছে| বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত ঐ নৌকাতেই যাত্রা শুরু হলো রুমাবাজারের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলো স্রোতের উল্টো দিকে চলছে ওরা, আর স্রোতের ধাক্কায় নৌকা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মাঝিরা| রাদ আর জামিল দুজনে দুটো লগি নিয়ে নিজেরাই নৌকা এগোনোর কাজ শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরেই হাত প্রায় অকেজো হবার জোগাড়, বুঝতে পারলো স্রোতের বিপরীতে লগি ঠেলা কতোটা কঠিন| গল্প চলছে এরই মাঝে, অঙ্কুর মাঝিদের একজনকে জিগ্গেস করলো এই নদীতে কুমির আছে কিনা, শুনে সেই ছেলে দাঁত বের করে হেসে জবাব দিলো, ভরা মৌসুমে দুই-একটা থাকতে পারে| জবাব শুনে অঙ্কুর আঁতকে উঠলো, এদিকে হেসে উঠলো বাকিরা। এর পরে প্রায় বেশ কয়েকবার স্রোতে ভেসে আসা কাঠের গুড়িকে কুমির বলে চিত্কার করে উঠেছিলো অঙ্কুর। চারপাশের দৃশ্য অসাধারণ, বৃষ্টি ভেঁজা পাথুরে জায়গা, নদীর পাড় ঘেষে যাওয়া সবুজ জঙ্গল, কখনো হঠাৎ দেখা যাচ্ছে আদিবাসী লোকেদের, ওদের দিকে তাকিয়ে কখনো হাত নাড়ছে ছোট আদিবাসী শিশুরা। শহুরে কোলাহল থেকে অনেক দুরে প্রকৃতির একদম অদ্ভুত এক আয়োজন|


প্রায় ঘন্টা দুয়েক স্রোতের বিপরীতে লগি ঠেলে, ক্লান্ত হয়ে পৌঁছলো রুমা-বাজার| নেমে দেখলো কিছুটা উপরে উঠে বাজার এর শুরু, সেখানে গিয়ে প্রশ্ন করতেই জানা গেলো এখানের একটাই পাকা হোটেল, বাকিদের অধিকাংশ টিনের নয়তো বাঁশের বেড়া। সেই পাকা হোটেলে গিয়ে জানা গেলো, সব রুম ভর্তি, তবে দুটি সিঙ্গেল রুম খালি আছে, যদি চায় সেখানে নিজেদের ব্যাবস্থা করতে হবে| হোটেলের অবস্থা করুন, আর এতেই যদি এই অবস্থা, বাকি আর জায়গা খোঁজার পরিশ্রম করার কোনো ইচ্ছাই নেই চারজনের| তাই ঐ দুই রুমেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো| এদিকে আবার কালকে রুমা বাজার থেকে বগা লেক যাওয়ার জন্য আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি আর গাইড দুটোরই ব্যাবস্থা করতে হবে, রুমে ঢুকে একটু ধাতস্ত হয়েই আবার রওনা হলো আর্মি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে| লোকজনকে জিগ্গেস করে করে জানতে পারলো ক্যাম্প অবস্থিত একটা টিলার উপরে, বেশ অনেকটাই উপরে উঠতে হবে| যখন চারজন ক্যাম্পে পৌঁছলো, হাঁফাতে হাঁফাতে অবস্থা কাহিল সবার| কোনমতে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসলো, ওদের দেখে হাসছে টেবিলে বসা অফিসার| আলাপ হলো আস্তে আস্তে, জানা গেলো এখানে সব কিছু বিস্তারিত জানাতে হবে, এখান থেকেই গাইড ঠিক করে দেওয়া হবে নাম্বার দেখে, আর শুধু তাই নয়, কালকে যদি ওরা হাঁটা পথে যেতে চায় তাহলে ৮ ঘন্টার মধ্যে বগা-লেক পৌঁছে ওখানকার আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট না করলে,ওদের খুঁজতে বের হবে এখানকার টহলদল| আর অফিসার ভালোভাবেই জানিয়ে দিলো হাঁটা রাস্তা এমনিতেই দুর্গম, তার উপরে বর্ষা, যদি চায় ওরা চান্দের গাড়ি করে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে পারে| তবে সকালের চান্দের গাড়ির অভিজ্ঞতার পড়ে, ওরা হাঁটা রাস্তাতেই যাওয়াটাকে ভালো মনে করলো। গাইডের সাথে পরিচয় হলো একটু পড়ে, তরুণ গাইড, নাম জাহিদ| বেশ হাসি-খুশি| জানিয়ে দিলো কালকে সকাল সকাল বের হতে হবে, রাস্তায় খাবার কিছু ব্যাবস্থা নেই, তাই খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিস এখানকার বাজার থেকেই কিনে নিতে হবে। কালকে খুব ভোরে ওদের হোটেল থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়ে জাহিদ চলে গেলো|


বাকি সময়টা এদিক ওদিক ঘুরে কাটালো চারজনে| রাত নামতেই প্রায় অন্ধকার হয়ে গেলো চারিদিক, যেসব দোকানে আর ঘরে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যাবস্থা আছে ওখানেও টিমটিম করে ধরছে কম পাওয়ারের বাল্ব। আর বাকি সব জায়গাতেই দেখা গেলো কুপি ভরসা| শুভ্র কালকের প্ল্যান গুছিয়ে বললো| তবে সেখান থেকে অন্য আদিবাসী গ্রামে যাবার কথাটা এড়িয়ে গেলো, আর রাদ কেও বললো কথাটা কাওকে না বলতে| বেশি রাত করতে চাইলোনা, তাই আগে ভাগেই রাতের খাবার খেয়ে নিলো একটা দোকান থেকে, কিনে নিলো কিছু দরকারী জিনিস| অন্ধকারে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার বিড়বিড় করলো জামিল, অঙ্কুর পুরো সময়টাতেই বেশ চুপচাপ কাটালো, বোঝা যাচ্ছে বেশ ভালো ধকল যাচ্ছে বেচারার উপর দিয়ে| হোটেলে ফিরেই শুতে গেলো ওরা, কথা বলার মতো শক্তি কারোই অবশিষ্ট নেই| কোনমতে নিজেদের ব্যাবস্থা করে শুতে হলো, অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে বেশ অনেকক্ষণ চিন্তা করলো রাদ কালকে বগা-লেক পৌঁছানোর পড়ে শুভ্রর বাকি প্ল্যান শুনে কি করবে বাকি দুজন সেটা নিয়ে| ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেলো টের পেলোনা। সামনে অপেক্ষা করছে অনিঃশ্চিত কয়েকটা দিন|

[ক্রমশ:]

Wednesday, February 15, 2012

বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা

[এই পোস্টের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে বাংলাদেশে যেসব ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিংবা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, এসব পণ্য বা প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলে কিংবা ব্যবহার না করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় বানিজ্যিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করার পেছনে ভূমিকা রাখা যায়| কোনো ধরনের ধর্মীয় কিংবা ভারত বিদ্বেষ ছড়ানো এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়, তাই সুযোগসন্ধানীরা (ছাগু) দুরে থাকুন|]


বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বেশ কিছু ভারতীয় পন্যের কিংবা প্রতিষ্ঠানের অত্যাধিক ব্যবহার দেশের অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, শুধু তাই নয়, একই মানসম্মত বাংলাদেশী পণ্য এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। তাই বাংলাদেশী পন্যের চাহিদা খোদ বাংলাদেশেই কমে যাচ্ছে, কিন্তু এই ধরনের পণ্য পৃথিবীর অনেক দেশে রপ্তানী হচ্ছে দেদারসে| এর মাঝে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সুবিশাল অর্থনীতির চাপে পড়ে দেশীয় বাজার হুমকির সম্মুখীন, তাই স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করে আমাদের দেশ, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন| যেহেতু বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পন্যের চাপ বেশি তাই কিছু শীর্ষস্থানীয় পণ্য এবং প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হলো, তবে শুধু ভারত নয়, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে দেশের সবাইকে স্বদেশী পণ্য ব্যবহার ও বিদেশী পণ্য এড়িয়ে চলার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে| যেসব পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দেশীয় পণ্য ও প্রতিষ্ঠান সহজলভ্য সেসব ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই দেশীয় পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার এবং অপরকেও উত্সাহ দেওয়া প্রয়োজন|

[b][u]বাংলাদেশের বাজারে শক্তিশালী কিছু ভারতীয় পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা[/u][/b] -

[u]প্রতিষ্ঠান[/u] -

১. কিংফিশার
২. আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক
৩. এযারটেল
৪. স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
৫. এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক
৬. এয়ার ইন্ডিয়া
৭. জেট এয়ারওয়েজ


[u]প্রসাধনী[/u] -

১. লেকমে
২. হিমালয়া
৩. বোরোলীন

[u]অটোমোবাইল[/u] -

১. বাজাজ
২. টাটা
৩. মাহিন্দ্রা
৪. হিরো
৫. মারুতী

[u]জীবন-যাপন[/u] -

১. টাইটান
২. এপোলো গ্রুপ
৩. তাজ গ্রুপ
৪. গোদরেজ সামগ্রী
৫. সিনথল
৬. ভিআইপি
৭. প্যারাসুট (মারিকো গ্রুপ)


[u]খাবার[/u] -

১. কিসান
২. বারিস্তা
৩. কোয়ালিটি
৪. মাদার ডেইরি
৪. ব্রিটানিয়া
৫. ডাবর
৬. আমুল


[উপরোক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাধিক পণ্য জীবন-যাপনের নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে, তাই একাধিক পণ্য উত্পাদনকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি দেওয়া হলো, আলাদা আলাদা ভাবে পণ্যগুলোর নাম উল্লেখ না করে|]

এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষুদ্র কিংবা ব্যক্তিগত পণ্য ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্য বিক্রি করছে, বিশেষ করে পোশাক এবং কুটির-শিল্পসামগ্রী ইত্যাদি| এসব পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের নাম জানা থাকলে যোগ করতে পারেন এই তালিকার সাথে| এছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জন্য ভারতীয় পণ্য ব্যবহার হ্রাস করতে হবে ( পিঁয়াজ, মাংস ইত্যাদি)।


[u]এসব পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বাংলাদেশের কিছু আন্তর্জাতিক মানের সামগ্রী উত্পাদনকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান[/u] -

১. প্রাণ
২. কেয়া
৩. জিএমজি এয়ারলাইনস
৪. ইউনাইটেড এয়ারলাইনস
৫. রিজেন্ট এয়ারলাইনস
৬. বেক্সিমকো
৭. নাভানা
৮. স্কয়ার
৯. গ্রামীন
১০. রহিম-আফরোজ
১১. আড়ং
১২. একমে
১৩. ইনসেপটা
১৪. প্রাইড
১৫. ওয়ালটন

প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে পোশাক, খাবার, ওষুধ, কুটিরশিল্প ইত্যাদি সামগ্রী আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম|বিশেষ করে পোশাক ও ওষুধ রপ্তানিতে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বেশ ভালো অবস্থানে আছে| তাই দেশীয় এসব পণ্য নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং এর সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যান্য দ্রব্যাদিও মানসম্পন্ন এই আশা করা যায়| তাই ভারতীয় কিংবা অন্যান্য দেশের তৈরী সামগ্রীর পরিবর্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরী সামগ্রী ক্রয় করলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে নিঃসন্দেহে।

দেশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার দায়িত্ব সকল নাগরিকের, এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা| তাই বাজারে সামগ্রী ক্রয়ের সময় দয়া করে সামগ্রীর গায়ে উল্লেখিত লেখাগুলো পড়ে দেখে নিন সেটি কোন দেশের তৈরী, যদি সেই সামগ্রী বাইরের দেশের প্রতিষ্ঠানের তৈরী হয় এবং আপনার কাছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরী একই সামগ্রী কেনার সুযোগ থাকে তাহলে স্বদেশী সামগ্রী কিনে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখুন|

পরিবর্তন একদিনে আসেনা, পরিবর্তনের জন্য বিশাল আয়োজনেরও প্রয়োজন পড়ে না, নিজ নিজ জায়গায় থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপগুলিই পারবে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে|

Monday, February 13, 2012

বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে

ভালোবাসা- একটা অনুভূতি, ব্যাখ্যাতীত,অদ্ভুত,জটিল একটা অনুভূতি| ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলার একটা অদ্ভুত আবেগ, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার একটা অদ্ভুত সন্তুষ্টি| প্রতিটি মুহুর্তের কিছু অন্যরকম শিহরণ আর না বলা কিছু কথার স্রোতে ভাসতে ভাসতে শুধুই এগিয়ে যাওয়া| প্রতিদিনের পরিচিত রাস্তা হেঁটে পেরোনোর সময় হঠাৎ যেনো সব কিছু নতুন করে অন্যভাবে দেখা, সকালের ঝকমকে রোদটাকে একটু বেশিই আপন মনে হওয়া, ঝরা পাতার ভিড়ে গুনগুনিয়ে কিছু পুরনো গান, আপন মনে হেসে ওঠা| অনেক কথার ভিড়ে পূর্ণ নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যাওয়া, টেবিলকে তবলা করে বাজানো কিছু খাপছাড়া সুর কিংবা হঠাৎ রবীন্দ্রপ্রীতি| যাই হোকনা কেনো ভালোবাসার তুলনা শুধু ভালোবাসাই|


পৃথিবীজুড়ে এই ভালোবাসাকে নিয়ে কম চর্চা হয়নি, তাইতো সাধু ভ্যালেন্টাইন থেকে শুরু করে রোমিও-জুলিয়েট, কিংবা লায়লা-মজনু থেকে চন্ডিদাস-রজকিনী শুধু গল্প-উপন্যাসের একেকটা চরিত্রই হয়ে থাকেনি, হয়ে আছে আরও বেশি কিছু| মানুষ তাদের ভালোবেসেছে, তাদের কষ্টে চোখের জল ফেলেছে, আবার তাদের মতো করে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতেও চেয়েছে| উইলিয়াম শেক্সপিয়ার থেকে কবিগুরু সবাই ভালোবাসার সুধায় মশগুল প্রাণ| আর এই একটা জিনিস পৃথিবী যতদিন থাকবে মানুষের কাছে থাকবে ঠিক ততদিন|

ভালোবাসাটা আমার কাছে শুধু গল্প-কবিতা নয়, কিংবা নয় কোনো যুদ্ধজয়| আমি কবি নই, তাই ভালোবেসে কবিতা লিখতে পারিনি, বীর নই, তাই যুদ্ধজয় করে ছিনিয়েও আনতে পারিনি কাওকে| শুধু পেরেছি অবাক হয়ে মানুষকে ভালবাসতে দেখতে| শ্রদ্ধা করেছি নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে| কিন্তু এরকম করতে করতে একদিন আমিও ভালোবেসেছি, তোমাকে|

আমাদের ভালোবাসাটা অদ্ভুত, দুরত্ব দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু, আমরা কাছে থাকি কম, দুরে দুরে সময় কাটাই, কথা হয় কম, দেখা তার থেকেও কম| আমরা একসময় শুধু বন্ধু হতে চেয়েছি, অযথাই লড়াই করেছি, প্রতিযোগিতা করেছি, নিজেদের দুরে রাখতে চেয়েছি জাগতিক কোনো সম্পর্ক থেকেই, কিন্তু পেরে উঠিনি| তাইতো একদিন আমারও ভোর হয়েছিল একটু অন্যরকম, আপনমনে হেসেছিলাম, গুনগুনিয়ে গেয়েছিলাম গান| হয়তো খুব নাটকীয় ভাবে কিছুই করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, কিন্তু কাছে থাকতে চেয়েছি সব কিছুর পরেও, জানিনা খুব বেশি চেয়েছি কিনা|

আমাদের সম্পর্কেও ঝড় এসেছে, আমরা দুজন ভিন্ন রাস্তায় ছিটকে পড়েছি বারংবার, হেরে গিয়েছি নিজেদের কাছে, অঘোষিত নির্বাসনকে বেছে নিয়েছি আমরা দুজনই, কিন্তু আমরা থেমে থাকিনি, থেমে থাকেনি আমাদের সম্পর্ক| কোথাও পড়েছিলাম, "চলতে থাকার নামই জীবন", সেরকম করেই আমরা পথ চলেছি, আর এভাবেই চলতে চলতে পেছনে ফেলে এসেছি দুটি বছর সাথে কিছু ভালোলাগা-খারাপলাগার মুহূর্ত| কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হলো, এই দীর্ঘ সময় আমরা পথ চলেছি, কখনো একসাথে, কখনো একা| কোনকিছুতেই থেমে থাকেনি আমাদের পথ-চলা, আমরা কখনো একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে গেছি, কখনো একা অপেক্ষা করেছি কখন আবার হাত ধরবো বলে|

তাই যখন অনেক দুরে, গভীর রাতে একাকী-নিসঙ্গ, মনে পড়েছে তোমার কথা, আমার খারাপ লাগেনি, মনে হয়েছে সাথে আছো, যেখানেই থাকো| এই সাথে থাকার অনুভূতিটাই আমার কাছে ভালোবাসা| এইযে অনেক দিন পর পর কয়েক মুহুর্তের কাছে থাকার সময়গুলো, তোমাকে ছেড়ে আসার সময় আমাকে দুর্বল করেনি, বরং আরও দৃঢ় ভাবে হাঁটতে শিখিয়েছে, একা একা বাঁচতে শিখিয়েছে, তোমার জন্য| তাই বেঁচে থাকার মতো কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছি অনবরত| কখনো পথ থেকে সরে গিয়েছি, পিছলে পড়েছি, কিন্তু থেমে যাইনি, থেমে থাকিনি, হেরে যাইনি| এটাই আমার কাছে ভালোবাসা|

আমি খুব সাধারণ মানুষের থেকেও সাধারণ, আমার চাওয়া-পাওয়ার অনুপাত হাস্যকর, জীবনের লক্ষ্য ঘোলাটে, জীবনে সম্মান অপ্রতুল, কিন্তু তাই বলে আমার ভালোবাসার অনুভূতি কারো থেকে কম নয়| আমি বাগ্মী নই, তাই প্রকাশে দুর্বল, আমি ধনী নই, তাই আড়ম্বরে ব্যার্থ, কিন্তু আমি ভালবাসতে জানি, তাই সেটাই করে যেতে চেয়েছি প্রচন্ডভাবে, সাথে থেকে| এখনো করছি, ভবিষ্যতেও করে যাবো, জানিনা সেদিন সাথে থাকতে পারবো কিনা!!

আমি ভুলে ভরা একজন মানুষ, নিজেকে নিজে শুদ্ধ করার চেষ্টা করি, কিন্তু তাই বলে আবার ভুল করিনা সেরকম কিছুনা, কিন্তু আমি এভাবেই আমার জীবনকে ভালোবেসেছি, তোমার সাথেও থাকতে চেয়েছি এভাবেই| হয়তো এমন সময় আসবে যখন আমদের অনুভূতি শীতল হয়ে যাবে, ব্যাবধান বাড়বে, কিন্তু তাই বলে সব থেমে যাবেনা, থেমে যাবেনা আমাদের পথচলা| জীবনটা হিসেব করে চলেনা, তাই জানিনা এর পরে কি হতে চলেছে, কিন্তু জানি একটা জিনিস, সাথে থাকার কথা দিয়েছিলাম, সাথে আছি, সাথে থাকবো|

ভালবাসি|

Friday, February 10, 2012

শিরোনামহীন ??

"ভালোই, শেষ পর্যন্ত নিজেদের দেশে যাচ্ছিস", ঠিক এই কথাটাই শুনতে হয়েছিল ১১ বছরের পরিচিত, একই সাথে স্কুলে পড়া, এক বন্ধুর মুখ থেকে, যখন স্কলারশিপ নিয়ে ভারতে প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে এসেছিলাম| প্রতিউত্তর দিতে ইচ্ছা করছিলো খুব, কিন্তু শুধু একবারই বলেছিলাম, "কোনটা যে আমার দেশ সেটা যদি তোর বোঝার ক্ষমতা থাকতো !!" আমার সাথে পড়তে আসা ভিন্ন ধর্মালম্বী বন্ধুদের কিছু শুনতে হয়েছিল কিনা জানিনা| আমাকে শুনতে হয়েছিল কারণ জন্মের পর থেকেই একটা সীল আমার নামের সাথে লেগে গেছে "সংখ্যালঘু"|

সাম্প্রদায়িকতা খুব অদ্ভুত ভয়ংকর একটা জিনিস, গল্পের পরশ পাথরের মতো এরও অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, তবে সোনাতে রূপান্তরের নয়, একজন নিরীহ-পরিচিত মানুষকে অপরিচিত হিংস্র-জন্তুতে পরিণত করার| যখন ভারতে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মদদে সৃষ্ট রাজনৈতিক দাঙ্গায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল, তখন আমি যথেষ্ঠ ছোট| সাম্প্রদায়িকতা বোঝার বয়স তখন হয়নি, কিন্তু দেখেছি আমাদেরই এলাকায় চকচকে তরবারি নিয়ে মিছিল করেছিলো কিছু পরিচিত মানুষ| তাদের মুখে ছিলো ধর্মীয় স্লোগান, আর বিধর্মীদের নিঃশেষ করার প্রতিজ্ঞা| বাবা তখন শহরের বাইরে চাকরি করতেন, আমি আর মা, ঘরের আলো বন্ধ করে আমাদের জানালার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া মিছিলগুলো দেখতাম| এখনো মনে পড়ে আবছা আবছা, কতোটা নিঃশ্চুপ কাটত সেই সময়গুলো| আমাদের বাড়ির মালিক একদিন মাকে ডেকে বলেছিলেন, এই পরিস্থিতিতে উনি কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবেননা, শুধু কিছু হলে আমাদের লুকিয়ে থাকার ব্যাবস্থা করতে পারেন, জিনিসপত্র এর মায়া ছাড়তে হবে| মাকে তখন অসহায় হতে দেখেছি, চুপ থাকতে দেখেছি|

যখন আফগানিস্থানে হামলা চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তখন বাসার সামনে দিয়ে মিছিল হতো, ঠিক আগের মতো, এবার বোঝার বয়স হয়েছে যথেষ্ঠ| স্লোগানগুলো মনে আছে এখনো, "আমরা হবো তালেবান, দেশ বানাবো আফগান"| ঠিক কোন ধরনের জাতীয়তাবোধ থেকে এই মানসিকতার উদ্ভব হতে পারে আমার জানা নেই| যখন দেশে একের পর এক সংখ্যালঘু গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা, তখন মনে হতো ৭১ যেনো আবার ফিরে এলো| আমি দেখেছি অনেক পরিচিত পরিবারকে লুকিয়ে চলে যেতে, অনেক পরিবারের মেয়েকে ভারতে আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দিতে| যেরকম ভাবে আমি দেখেছি অনেক বছর আগে আমার মায়ের বোনকে তার পরিবার নিয়ে চলে যেতে|

আমাদের দেশটা বিচিত্র, সংখ্যালঘু তা যে ধর্মেরই হোকনা কেনো, সে বিষয়ে লোকজন খুব একটা কথা বলতে চায়না| তাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তিত হয়না| দেশের সব সরকারের মুখেই শোনা যায়, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ| কিন্তু বাস্তব ঘটনাও কি তাই??

আজকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে যা ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তা নিয়ে কোনো মিডিয়াতেই খুব একটা তোরজোর নেই, ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলাম,"হিন্দু হয়ে জন্মানো কি আমার অপরাধ?এই অপরাধে আজ আমার পরিবারকে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে।আগুন জলছে আমার বন্ধুর বাড়িতে। সব মন্দির জালিয়ে দেয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সব হিন্দু দোকান। কারণ হিন্দুরা তো মানুষ না। ২জন শিবির কর্মীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে হিন্দু মেরে।প্রশাসন বসে আছে চুপচাপ। তাদের সরকার এর ভাবমুর্তি যদি ক্ষুণ্ণ হয়......।" তারপর দেখলাম আরও কিছু খবর, শেষপর্যন্ত দেখলাম সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে| ঠিক কি ঘটলে একটি স্বাধীন দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হতে পারে? প্রশ্নটা হয়তো সেখানকার মানুষগুলোকে করলে আরও ভালো ভাবে উত্তর দিতে পারতো|


একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হওয়া সত্তেও যখন শুধুমাত্র জন্মসুত্রে প্রাপ্ত ধর্মের কারণে একজন মানুষকে নির্যাতিত হতে হয়, তখন সেই মানুষটির কি অনুভূতি হতে পারে?? যখন সেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, শরণার্থী হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, শহীদ হয়েছে এই মানুষগুলোই| ধর্মীয় কারণে বারংবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে, নিজের ভিটে-মাটি ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়া মানুষের কি অনুভূতি, কি কষ্ট, তা বোঝার ক্ষমতা কজন রাখে আমি জানিনা| যখন রাজনৈতিক দলগুলো দাঙ্গাকে রাজনীতির ঘুটি হিসেবে ব্যাবহার করতে চায়, যখন কিছু নিরীহ মানুষের লাশ কিংবা ভাঙ্গা হাড়ি-পাতিলের উপর দিয়ে ক্ষমতায় বসার উপলক্ষ খোঁজে, তখন গণতন্ত্রের কোন ঝান্ডাটা সমুন্নত থাকে?? কোন সম্প্রীতির সমাজে বাস করার স্বপ্ন দেখে সাধারণ মানুষ??

লেখার ইচ্ছে ছিলো অনেক কিছুই, লিখতে ইচ্ছে করছেনা, এই কথাগুলো নতুন কিছু নয়, ঘটনাগুলোও নতুন কিছু নয়| শুধু একই ঘটনার বৃত্তে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত| এক বন্ধুর লেখা কথাগুলো ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে গেলো, "সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারী, হিংস্র, তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন অসংখ্য মানুষের সামনে ভীরু, নিরস্ত্র কিছু আজাদের ন্যায় মানুষ দ্বারা গঠিত এক অসাম্প্রদায়িক দেশ মোদের এই বাংলাদেশ।"

ঠিক এই একটি জায়গায় হেরে যাই আমরা, হেরে যায় আমাদের জাতীয়তাবোধ|





Sunday, February 5, 2012

বগা লেক রহস্য : পর্ব ১

বান্দরবন থেকে বের হবার আগে থেকেই প্যানপ্যান করে যাচ্ছিলো অঙ্কুর, তার প্যানপ্যানানির ঠেলায় অতিষ্ট হয়ে একবার রাদ প্রায় বলেই বসেছিলো, “তুই থাক, তোর যাওয়ার দরকার নাই|” কিন্তু চিন্তা করে বললোনা| একা একা গেস্ট হাউসে থেকে করবেই বা কি? আর ওদের ফিরতেও প্রায় দিন দশেক| এদিকে মোটা জামিল একবার দাঁত কেলিয়ে বলেছিলো, “কিরে অঙ্কুইরা, একলা থাকবি নাকি? রাইতের বেলা, জোস্নায় বিড়ি খাইস আর জঙ্গল দেখিস, যদি কিছু হাত-ফাত নাইড়া তরে ডাক দেয় আর কি?? হে হে হে...” দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওকে প্রায় মারতেই গিয়েছিলো অঙ্কুর, সেই দৃশ্য মনে করলেই হাসি পায়|

তবে কালকে রাতে গেস্ট হাউসের ছাদে যে কীর্তি করেছে অঙ্কুর তারপর থেকেই ওকে খেপাচ্ছে পালাক্রমে ওরা| বেচারা এমনিতেই খিঁচে আছে| শুভ্রর বাবা পর্যটনের সিনিয়র অফিসার হওয়ার সুবাদে বান্দরবনের এই সরকারী গেস্ট হাউসটা বিনে পয়সায় পেয়ে গেছে ওরা, আর এভাবেও এখন অফ সীজন, ঘুরতে আসার লোকজন খুব একটা নেই| প্ল্যানটা হঠাৎ করেই একদিন হয়ে গেলো, হয়ে গেলো বলতে, শুভ্র ধুম করে বুধবার দিন রাদ এর ঘরে ঢুকেই বললো, “ওই চল ঘুইরা আসি|” রাদ অবাক হয়ে বললো, “এই বর্ষার সময় কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো?” শুভ্র প্রায় বিরক্ত হয়েই বলেছিলো, “সব কাজেই খালি প্রয়োজন খুঁজিস কেন রে তোরা??” রাদ আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই আবার শুরু করলো, “ঐ গানটা তো জানিস, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, এর মানে বুঝিস?” রাদ প্রায় জোর করেই ওকে থামিয়ে বলেছিলো মানে বুঝানোর কোনোও দরকার নাই, মনে মনে ভাবছিলো এই রে সাহিত্য শুরু হলেই খবর আছে| শুভ্রর কথা সংক্ষেপে মোটামুটি এরকম দাড়ায়, তার ইচ্ছে হয়েছে ভরা বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ে বৃষ্টি দেখবে, শুধু তাই নয় তার আরও ইচ্ছে এর মধ্যে বান্দরবনের জঙ্গল ঘুরে সে আমাজন জঙ্গলের স্বাদ মেটাতে চায়| তাই বাবাকে ম্যানেজ করে বান্দরবনের গেস্ট হাউসটা ঠিক করেছে, কিন্তু সাথে জামিল আর অঙ্কুর কেও নিতে চায়|

রাদ বললো, “অঙ্কুর এর বাবা এমনিতেই যে মানুষ, তার উপরে এই রকম সময়ে জঙ্গলে যেতে দিবে??” শুভ্র এবার প্রায় খেঁপেই গেলো, “আররে আমরা কি জঙ্গলে ঘোরার কথা বইলা যাবো ভাবছিস? আমরা বলবো বান্দরবন শহরে ঘোরার কথা| তুই খালি অঙ্কুর আর জামিল রে রাজি করা”, এতক্ষণে আসল মতলব এ আসলো অঙ্কুর| তারপরের দুইদিন কি করে গেলো জানেনা রাদ, শুক্রবার রাতের ট্রেনে যখন বসেছিলো, ভাবছিলো, মন্দ নয়, এমন হুট করে বেরিয়ে পড়াটা, তবে ফেরত আসার পড়ে কি পরিমান চাপ থাকবে ভার্সিটির সেটাও মনেমনে একবার হিসেব করে নিলো| জামিল মোটু ট্রেনে ওঠার পর থেকেই নাক ডাকাচ্ছে, সে নাকি এনার্জি সঞ্চয় করতে চায়, অঙ্কুর নাক কুঁচকে রেখেছে তখন থেকেই, বেচারার পাশে যে লোক বসেছে সে নাকি থেকে থেকেই বায়ু ত্যাগ করছে, আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছে অঙ্কুর, কিছু বলতেও পারছেনা| এদিকে তখন থেকেই একমনে কি একটা ম্যাপ দেখে চলেছে শুভ্র| কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলছে, গুগল ম্যাপ থেকে নাকি সে জঙ্গলে ট্রেকিংএর রুট প্রিন্ট করে এনেছে, তাই দেখছে| রাদ একবার বলেও বসেছিলো, “এতে দেখার কি আছে, যখন যাবি তখন তো দেখবই|” শুভ্র একবার অদ্ভুত ভাবে আরমোড়া ভেঙ্গে বলেছিলো, “বুঝবিনা রে, তোরা বুঝবিনা|” রাদ এর বলতে ইচ্ছে করছিলো, “বুঝবো কি করে ছাগল, বোঝালে তবে তো?” নাহ থাক কি দরকার তার থেকে বরং ঘুমানো যাক, এই ভেবে চোখ বুজলো সে| সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেনা পরের কিছু দিনে তার সাথে কি হতে চলেছে|

বান্দরবন পৌঁছানো নিয়ে কোনো হাঙ্গামা হলো না বললেই চলে, সকালে চট্টগ্রাম নামার পড়ে হোটেলে নাস্তা করেই বাস ধরেছিল, রাস্তা বেশ ভালোই, দুলুনি আর ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ বুঁজে গিয়েছিলো টের পায়নি রাদ| যখন চোখ খুললো ততক্ষণে পাহাড়ি রাস্তার মাঝ দিয়ে চলছে বাস, দুপাশে পাহাড় আর জঙ্গল দেখা যাচ্ছে| ও মুখ ঘুরাতেই পাশে বসা শুভ্র চোখ টিপলো হাসি হাসি মুখে| ওদিকে অবাক কান্ড, মোটু জামিল জেগে আর অঙ্কুর ঘুমে| নাহ তাহলে এনার্জি ভালোই সঞ্চয় করেছিলো জামিল বোঝা যায়| আর বেচারা অঙ্কুর, ভাবতেই হাসি পেলো| দুপুর থাকতে থাকতে গেস্ট হাউস পৌঁছে গিয়েছিলো ওরা, গেস্ট হাউসটা দারুন লাগলো পড়ন্ত আলোতে, টিলার উপরে, বেশ উঁচুতে, আশ-পাশটা বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় বোঝা যাচ্ছিলো গেট থেকেই| কেয়ারটেকার সন্তু চাকমার নাম বলার আগেই চেহারা দেখেই বোঝা যায় সে চাকমা, ওদের দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে এগিয়ে এলো| তারপর নিয়ে গেলো দুই তালার একটা ঘরে, পাশেই খোলা ছাদ, বেশ বড়-সড় ঘর, দারুন ব্যাবস্থা| কেয়ারটেকার জানিয়ে গেলো, খাবারের ম্যানু আগেই বলতে হবে, এমনকি কালকে কি খাবে তা আজকে বললেই ভালো হয়| এভাবেই বৃষ্টির সময়, বাজার বলতে গেলে যে টং দোকান গুলো আছে তা রাতের আগে ভাগেই বন্ধ হয়ে যায়, তাই যত আগে বলবে জিনিসপত্র আনাও ততো সহজ হবে|

সন্ধের পড়ে হালকা হালকা ঠান্ডা লাগা শুরু হলো, আর অন্ধকারটাও যেনো ঝুপ করে নেমে এলো মাথার উপর, এতদিন শুনে এসেছে পাহাড়ে অন্ধকার হয় হঠাৎ আজকে চোখের সামনে দেখেও বেশ অবাক লাগছে| ছাদে বসে আড্ডা মারছিলো চার জন, রাতের খাবারের অনেক দেরি আছে, চারপাশটা একদম নিরব-নিঝুম, শেষ বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি গেছে, অন্ধকারটা তাই যেনো আরও একটু ভারী হয়ে আছে| আকাশে মেঘের জন্য একটা তারাও দেখা যাচ্ছেনা| যতদুর চোখ যায়, শুধু অন্ধকারে আবছা পাহাড়ের ঢেউ বোঝা যাচ্ছে| মাঝে মাঝে অনেক দুরে কোথাও দু-একটা টিমটিমে আলো, সাথে কুকুরের হালকা ডাক| অদ্ভুত একটা পরিবেশ| শহরের কোলাহল থেকে দুরে, অন্যরকম| এর মাঝেই কথা গিয়ে দাড়ালো ভূত-প্রেত-প্যারানরমাল একটিভিটি নিয়ে| যা হয় আর কি এরকম পরিবেশে| রাদ মজা করে ওদের গ্রামের বাড়ির একটা ঘটনা বেশ রসিয়ে রসিয়ে মশলা মাখিয়ে মাখিয়ে বলছিলো, শেষ হবার আগেই, অঙ্কুরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার মাথার পেছন দিকে তাকিয়ে| ও ভাবছিলো ওকে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু কিছু বলার আগেই, অঙ্কুর প্রায় চিত্কার করে বললো, “ঐযে হাতের মতো কি জানি নড়ে|” ওরা বাকি তিন জন ঘুরে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো, আসলেই তো!! শুভ্রর সাহস মোটামুটি, রাদ এরও কম না, কিন্তু এই পরিবেশে যেনো, আড়ষ্ট হয়ে গেছে সবাই| একটু পরেই বুঝতে পারলো ভুলটা, আর সাথে সাথেই হেসে উঠলো রাদ জোড়ে, শুভ্র যোগ দিলো একটু পরেই, জামিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো, অঙ্কুরের তো প্রায় চোখ উল্টায়| শুভ্র হাসতে হাসতেই বললো, “ধুর, ছাদের কিনারায় বাঁশের সাথে বাধা একটা কাপড় ঝুলছে, আর ওটাই বাতাসে দুদিক থেকে দেখতে হাতের মতো মনে হচ্ছে, আর যতবার দুলছে মনে হচ্ছে হাত নাড়ছে কেউ|” আর এর পর থেকেই বাকি রাতটা অঙ্কুর বেশ জব্দ হয়ে কাটিয়েছে, ভয় ভালোই পেয়েছে, কিন্তু বুঝতে দিচ্ছেনা| এদিকে ওরা খেঁপিয়ে চলেছে একসাথে| তবে শোবার আগে শুভ্র একবার ফিসফিস করে রাদ এর কানের কাছে যা বললো তা মোটেও ভালো লাগলোনা ওর| কি একটা জানি জায়গা আছে বগা লেকের ওদিকে, অনেক পুরনো একদল আদিবাসী থাকে, তাদের ওখানে কি নাকি পুরনো মন্দির এর যাওয়ার রাস্তা আছে, খুব নাকি দুর্গম, সেখানে নাকি কি এক প্রাচীন মূর্তি-ফুর্তি দেখতে যেতে চাইছে| শেষ করার আগে একবার খালি বললো. কার কাছ থেকে জানি শুনে এসেছে, আদিবাসীদের পূর্বপুরুষরা নাকি আগে নর-খাদক ছিল| রাদ কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও প্ল্যানটা ভালো লাগলোনা| তবে শুভ্র যখন একবার বলেছে ওকে ঠেকানো যাবেনা, আর এটাও বুঝলো, আগে থেকেই এই প্ল্যান করে এসেছে ও, ম্যাপটাও ঐ জায়গার| এখন দেখার বিষয় বাকি দুজন রাজি হয় কিনা| অঙ্কুরকে দেখে লাগছেনা ও ঐ জায়গা কেন বগা লেকেও যেতে চাইবে, আর জামিলের যা আয়তন ও বগা লেকে নামলে হয়তো লেকের সব পানি পাড়ে উঠে যাবে| দেখা যাক, কালকে সকালের নাটকটা ভালোই জমবে| ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে|

পরের দিন সকালেই কেয়ারটেকারকে বলে বুঝিয়ে দিলো শুভ্র, কি কি করতে হবে, তাদের বগা লেক যাবার কথা গোপন থাকবে যতদিন তারা ফেরত না আসে, আর প্রয়োজনে তার বাবার ফোন নাম্বারটাও লিখে দিলো| তবে তার আসল প্ল্যান শুনে সন্তু চাকমা খালি একবার অদ্ভুত একটা চোখে তাকালো, তারপর শুধু একবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললো, “আপনারা শহরের লোক, কাজটা ঠিক করতেছেন না|” শুভ্র ওকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নিজের প্ল্যান ঘোষণা করলো বাকি দুজনের কাছে, জামিল শুনে মুখভর্তি খাবার নিয়ে কিছু একটা বলতে যেয়েও পারলোনা, অঙ্কুর একবার তিড়িং করে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে দাড়ালো, তারপর বাদরের মতো কিছুক্ষণ একজায়গাতেই দাপালো, তারপর ফোসফোস করতে করতে বললো, “বাবা জানলে আস্ত রাখবেনা| আমি যাবোনা|” শুভ্র মোলায়েম হেসে বললো, “ঠিক আছে দেখ তুই থেকে যা এখানেই, ভালো ব্যাবস্থা আছে, আরামে থাকবি, আমি, রাদ আর জামিল ঘুরে আসি, খুব বেশি তো দুরে না|” রাদ অবাক ভাবে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, “একবার তো জিজ্ঞেসও করলিনা ব্যাটা, নিজেই বলে দিলি??” কিছু বলার আগেই হাত তুলে শুভ্র বললো, বিকেলের মাঝে রুমাবাজার পৌঁছতে চাইলে এখুনি সব কিছু গুছিয়ে নে, তাড়াতাড়ি, চান্দের গাড়ি ধরতে হবে| জামিল এতক্ষণে বললো, “চান্দের গাড়ি কি একেবারে বগা লেকে নিয়ে যাবে নাকি??” শুভ্র হতাশ ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “কিচ্ছু হবেনা, কিচ্ছু হবেনা|” রাদ অনেক কষ্টে হাসি আটকালো জামিলের চেহারা দেখে, অঙ্কুর তখনো খেঁপে আছে|


পড়ে অবশ্য নিজেই সব কিছু গুছিয়ে সাথে এলো অঙ্কুর| কি আর করবে বেচারা, তখন থেকেই তাকে ইতিহাস শুনতে হচ্ছে, জামিল একটু পর পর কে কবে কখন এই ছাদে গায়েবি ডাক শুনেছিলো তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে, আর অঙ্কুর নিজের রাগ সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করছে| ওরা যখন বের হচ্ছিলো তখন হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে, পাহাড়ি বৃষ্টির এমনিতেই কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, তার উপরে বর্ষার সময় তো কথাই নেই, তবুও যেতে যখন হবেই দেরি করে লাভও নেই, তাই বেরিয়ে পড়লো বৃষ্টি মাথায় নিয়েই| চান্দের গাড়ি যেখান থেকে ছাড়ে সেটা বেশ খানিকটা দুরে, যাওয়ার জন্য ওদের স্থানীয় মুড়ির টিন ধরনের একটা গাড়ি ধরতে হবে, গাড়ি দেখেই অঙ্কুরের চেহারা আমসি হয়ে গেলো, রাদ ভাবছে আসল প্ল্যান শোনার পড়ে অঙ্কুর আর জামিলের চেহারা কেমন হবে?? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে চড়ে বসলো ওরা সবাই| শুরু হলো যাত্রা অজানার উদ্দেশ্যে| একটা জিনিস খটকা লাগছে রাদ এর মনে, ওরা যখন গেস্ট হাউস থেকে বের হচ্ছিলো, কেয়ারটেকার খুব অদ্ভুত ভাবে ওদের দিকে তাকাচ্ছিলো, আর মাথা নাড়ছিলো, সেটা কি ওদের পাগলামি দেখে, নাকি কোনো আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে?? কে জানে?!!









নাম: দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস
দৈর্ঘ্য: ১৩৮ মিনিট
বিষয়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইতিহাস
পরিচালক: আলেক্সান্ডার কট
দেশ: রাশিয়া, বেলারুস
ভাষা: রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান, বেলারুসিয়ান


[যুদ্ধ এবং ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের উপর যথেষ্ট আগ্রহ থাকায় খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন জায়গা থেকে এগুলো সংগ্রহ করি, এরকমই খুঁজতে গিয়ে "দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস" চলচ্চিত্রটি নজরে পড়লো, খুব বেশি পুরনো নয়, ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত, রাশিয়া এবং বেলারুস এর যৌথ প্রযোজনায় এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে| দেখা শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রায় দুই ঘন্টার জন্য চলচ্চিত্রটির চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে গেলাম| শেষ হবার পরেও দেখলাম এর রেশ থেকে গেলো অনেকটাই| শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ভয়াবহতা নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, শেষ হবার পরেও বেশ অনেকক্ষণ মন ভার হয়ে থাকবে]

বেলারুস এ অবস্থিত ব্রেস্ত দুর্গটি ১৯ শতকের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় দুর্গ| ১৯৩৯ এর যুদ্ধে জার্মানি পোল্যান্ড এর কাছ থেকে দুর্গটি অধিকার করে নিলেও পরবর্তিতে রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে এটি রাশিয়ার কর্তৃত্বে দেওয়া হয়| মুখাভেত্স এবং বাগ নদীর তীরবর্তী এই দুর্গটি অবস্থানগত কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ| ১৯৪১ সালে জার্মানি পুনরায় এটি আক্রমন করে অধিকার করে নেয়| আক্রমন প্রতিহত করে দুর্গটি রক্ষা করার জন্য রেড আর্মির যে সৈনিকরা আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছিলো, তাদের সেই অসমসাহসী বীরত্বগাঁথার উপর ভিত্তি করেই নির্মান করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি|






[ব্রেস্ত দুর্গ- বর্তমান ছবি]

গল্পটি সাশা আকিমভ নামের এক কিশোরের স্মৃতিচারণে এগিয়ে চলেছে, সাশা এবং তার ভাই দুজনেই দুর্গের রেড আর্মির সদস্য| সাশা কম বয়সী হওয়ায় সেনাবাহিনীর বাদক দলের অন্তর্ভুক্ত| তার চোখেই দেখা যায় দুর্গের ভেতরের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো, ছোটবেলার প্রেয়সী আন্যা এর সাথে সাশার কথোপকথন এবং দুর্গের অনান্য সদস্যের কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে গল্প| অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এতে দর্শকের বাড়তি পাওনা| কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতায় কি করে মুহুর্তের মধ্যেই এই সাধারণ-চঞ্চল জীবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে তা পরিচালক যথেষ্ট ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন| খুবই ধীরে চলতে থাকা গল্পটিতে চরিত্রগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত হবার আগেই দর্শক নিজেকে হঠাৎই আবিষ্কার করবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি জায়গার মাঝখানে, আঘাতটা খুব অপ্রত্যাশিতভাবে এনে পরিচালক দর্শককে একটু হলেও সত্যিকার ভয়াবহতার আঁচ দিতে পেরেছেন| এখানে সাশার উক্তি "I imagined the war, but I never imagined the war to be like that..." মনে দাগ কেটে যাবে|

২২শে জুন, ১৯৪১ সালের এক ভোরে সাশা যখন নদীর তীরে আন্যা এর সাথে মাছ ধরছিলো, ঠিক তখনি শান্ত সকালে হঠাৎ আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে জার্মান বিমান, একই সাথে প্রচন্ড শেলিং| দুর্গের তিনটি প্রবেশদিকের সবগুলো একসাথে অতর্কিতে আক্রমন করে জার্মান সেনারা| একই সাথে তারা বিচ্ছিন্ন করে দেয় দুর্গের বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ| মাত্র মিনিট দশেকের বোমাবর্ষণ ও শেলিংয়ের কারণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় দুর্গের ভেতরের বাসস্থানগুলো, অসাধারন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে মাত্র কিছুক্ষনের ভেতরে এরকম ধ্বংসযজ্ঞের মাঝখানে এসে বিশ্বাস করাটা কষ্টকর হয়, এখানেই আসল ধাক্কা লাগে| প্রাণ বাঁচাতে শিশু ও নারীদের ছুটোছুটি, একই সাথে দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এগিয়ে যাওয়া সেনাদের দৃশ্যর মাধ্যমে শুরু হওয়া চলচ্চিত্রের প্রধান অংশ, শেষ পর্যন্ত ছিলো উত্তেজনাপূর্ণ|

চলচ্চিত্রটি মূলত চারটি প্রধান চরিত্রের ঘটনা প্রবাহের উপর করা হয়েছে, সাশা আকিমভ এর স্মৃতিচারণ, তার সাথে কমিসার ফোমিন, মেজর গারিলভ এবং ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর অসম সাহসিকতার বর্ণনা| জার্মান আক্রমনের প্রথম ধাক্কাতে বিপর্যস্থ সেনাদের সংগবদ্ধ করে কিছুক্ষনের মাঝেই পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে রেড আর্মি এই তিন জন কমান্ডারের নির্দেশে দুর্গের তিনটি দিক থেকে| ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আহত এবং কিছু সংখ্যক অস্ত্র সাথে নিয়ে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে মেজর গারিলভ এর বাহিনী| এগিয়ে আসা জার্মান সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে দৌড়ে যাওয়া সৈন্যদের অধিকাংশের হাতেই কোনো অস্ত্র ছিলোনা, অনেকেই শুধু ছুরি কিংবা ট্রেঞ্চ তৈরী করার শাবল নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়| ঘটনার দৃশ্যায়ন দর্শকের চোখ পর্দায় আটকে রাখবে প্রতিটি মুহূর্ত|

চলচ্চিত্রের পরের পুরোটা অংশ জুড়ে আছে এক অসম লড়াইয়ের দৃশ্যায়ন, দুর্গে পানি সরবরাহ বন্ধ এবং চারিদিকে অবরুদ্ধ হয়ে দুর্গের ভেতরে আটকা পড়ে সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা| আহতদের চিকিৎসার কোনো ব্যাবস্থা নেই, এমনকি শিশুদের জন্যও কোনো খাবার নেই| এই পরিস্থিতিতে অসম সাহসিকতায় জার্মান সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যায় জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত, যা জার্মান বাহিনীর কাছে ছিলো কল্পনাতীত| এর মধ্যে প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ এবং আর্টিলারি শেলিং তো ছিলই| তিন ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মেজর গারিলভ এর সাথে কমিসার ফোমিন এবং ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর বাহিনীর করো যোগাযোগ সম্ভবপর ছিলোনা, তারা আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে| এর মাঝেই যুদ্ধকালীন সম্পর্ক, ভালোবাসা, আবেগ সব কিছু খুব সাধারণ-সাবলীল ভাবে ফুটে ওঠায় গল্পের চরিত্রগুলো দর্শকের আরও আপন মনে হবে| চরিত্রগুলোকে খুবই সাধারণভাবে দৃশ্যায়িত করে তাদের দর্শকের খুব কাছে এনে দিয়েছেন পরিচালক, তাদের চোখের জল, আপনজনের মৃতদেহের সামনে দিয়ে এগিয়ে যুদ্ধ করা, কখনো কোনঠাসা হয়ে পড়া, এসবই চরিত্রগুলোকে পুরো গল্পতেই অতিমানব হতে দেয়নি, আর এর কারণেই এক একটি চরিত্র দর্শকের কাছে স্থায়িত্ব পাবে অনেক দিনের জন্য|




[দুর্গের বীর যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত মনুমেন্ট]

পরবর্তিতে জার্মান বাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে বের হয়ে জল সংগ্রহ করার বারংবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত পরিণতির দিকে এগোতে থাকে গল্পটি, প্রায় ধংসস্তুপে পরিণত হওয়া দুর্গের কিছু কিছু জায়গা নিয়ে মাটি কামড়ে লড়তে থাকা স্বল্প সংখ্যক সৈন্যের প্রতিরোধও আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে, জার্মান বাহিনীর আর্তসমর্পনের প্রস্তাব উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যায় অবশিষ্ট সৈন্যরা| জার্মান সেনারা সকল ধরনের পথে দুর্গ অধিকার করতে ব্যার্থ হয়ে শেষপর্যন্ত ২000 কেজি ওজনের বোমা ফেলে| প্রায় ৯ দিনের অসম যুদ্ধের পড়ে পতন ঘটে দুর্গের|

জুনের শেষে কোনো একদিনে, জার্মান বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াড এর সামনে হল্মস্কি গেটে মৃত্যুবরণ করেন কমিসার ফোমিন, পড়ে যুদ্ধ শেষে অসীম বীরত্বের সম্মানে তার নাম "অর্ডার অব লেনিন" এ ভূষিত করা হয়|

যুদ্ধের ৩২তম দিনে জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মেজর গারিলভ, তাকে কারাগারে পাঠানো হয়| যুদ্ধশেষে তিনি স্তালিনের রোষানলে পড়েন এবং তাকে কমুনিস্ট পার্টি থেকে বহিঃষ্কার করে পুনরায় রাশিয়াতে জেলবন্ধি করা হয়| পরবর্তিতে স্তালিনের পড়ে ১৯৫৭ সালে তাকে মুক্তি দান করা হয় এবং "হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন" সম্মানে ভূষিত করা হয়|

নবম ফ্রন্টিয়ার পোস্টের কমান্ডার ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন, তার নাম ১৯৬৫ সালে "হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন" সম্মানে ভূষিত করা হয়|

সাশার প্রেয়সী আন্যা (ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর মেয়ে) এবং বাকি নারী-শিশু-বৃদ্ধ যারা আর্তসমর্পন করেছিলো জার্মান বাহিনীর আশ্বাসে, তাদের সকলকে ১৯৪২ সালের বসন্তের কোনো একদিনে হত্যা করে জার্মান সেনারা|





[দুর্গের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত মনুমেন্ট]

যুদ্ধের ২০ বছর পড়ে সর্জেয় স্মিরনভ এর বর্ণনায় উঠে আসে ব্রেস্ত দুর্গের সকল অসীম সাহসী বীর সেনানীদের কথা| ৮ই মে, ১৯৬৫ সালে ব্রেস্ত দুর্গকে "হিরো ফোরট্রেস" সম্মান দেওয়া হয়|

কিছু সাধারণ মানুষের মাতৃভূমির প্রতি অসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন, চলচ্চিত্রটিতে মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাদের বীরত্ব, ত্যাগ নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডি ছাড়িয়ে গেছে| কোনো অতিরিক্ত আবেগ অথবা কোনো চরিত্রকেই অতিমানব হিসেবে উপস্থাপন না করে পরিচালক চলচ্চিত্রটিকে আলাদা আবেগ দিয়েছেন| চরিত্রগুলো তাদের মানবীয় সামর্থ্য ছাড়িয়ে না যেয়েই বরং দর্শকের মনে বেশি দাগ কাটবে| যুদ্ধ ও ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র যাদের ভালো লাগে তাদের জন্য অবশ্যই দেখার "দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস"|




[ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

Thursday, February 2, 2012

সীমান্ত সংঘাত : একটি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী ২,৫৪৫ মাইলের সীমান্ত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে সংঘাতপূর্ণ, নিয়মিত বিরতিতে হত্যা-নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আইন বহির্ভূত কর্মকান্ডে সীমান্ত পরিস্থিতি সব সময়ই উত্তপ্ত থেকেছে| শুধুমাত্র তাই নয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী "বিএসএফ" (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) এবং বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী "বিডিআর" (বাংলাদেশ রাইফেলস) বর্তমানের "বিজিবি" (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এর ভূমিকাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ| এই সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা অনেক দিনের হলেও বর্তমানে কয়েক বছর যাবৎ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকর্তৃক হত্যা-নির্যাতন এর মাত্রা পূর্ববর্তী যেকোনো সমীক্ষাকে ছাড়িয়ে গেছে, এই নির্যাতন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকদের উপরেই সীমাবদ্ধ নেই, কিছু কিছু ঘটনায় ভারতীয় নাগরিকরাও এর ভুক্তভুগী| বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী সীমান্ত কাঁটা-তার দিয়ে ঘিরে ভারতীয় সরকার সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন বন্ধ তো হয়ই নি, বরং বেড়ে গেছে বহুগুনে| আইন বহির্ভূত হত্যাকান্ডের রেশ ধরে বর্তমানে এই সীমান্ত পৃথিবীর অন্যতম সংঘাতপূর্ণ ও রক্তাক্ত সীমান্তের পরিচিতি পেয়েছে| দুঃখজনক হলেও সত্যি এই হত্যা নির্যাতন কোনভাবেই দুটি দেশের মধ্যবর্তী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিফলন হতে পারেনা, বরং সীমান্তে ত্রাস সৃষ্টিকারী এই ধরনের কর্মকান্ড ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারকারী মনোভাবেরই পরিচয় দেয়|

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তার তিন দিক থেকেই ভারত এর সাথে যুক্ত| ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে বৃহৎ সীমান্ত| বাংলাদেশের খুলনা,রাজশাহী,চট্টগ্রাম,রংপুর,ময়মনসিংহ এবং সিলেট যুক্ত আছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,আসাম,মেঘালয়,ত্রিপুরা এবং মিজোরামের সাথে| এই দুই দেশ লাগোয়া এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বৃহৎ সীমান্তে চোরাচালানী এবং অন্যান্য আইন বহির্ভূত কাজ বন্ধ করতে ভারত সরকার ৪,০০০ কি.মি দীর্ঘ এবং কংক্রিটের ৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট দেয়াল নির্মানের কাজ শুরু করেছে, যা সম্পন্ন হলে পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘ সীমান্ত-সুরক্ষাদেয়াল হবে| এই কাজে ৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছিলো এবং ২০০৯ এর মধ্যে সম্পন্ন হবার কথা ছিলো, কিন্তু ১.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ এবং ২০১১ শেষ হবার পরেও এখনো এই কাজ সম্পন্ন হয়নি| এই প্রক্রিয়ায় দেয়ালের বেশ কিছু অংশে বৈদ্যুতিক তারের প্রয়োগ করা হয়েছে এবং আসামের সাথে বাংলাদেশের ২৬৩ কি.মি সীমান্তের প্রায় ১৯৭ কি.মি কাঁটা-তারের বেড়া দেবার কাজ সম্পন্ন হয়েছে| ২০০৭ পর্যন্ত ২৫২৯ কি.মি দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে এই দেয়াল তৈরির কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা যায়| তাহলে পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়, অন্তত অর্ধেকেরও বেশি সীমান্ত জুড়ে ভারত সরকার তাদের কাঙ্খিত নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এটা অনুমান করা যায় যে, ৩ মিটারের উঁচু কংক্রিটের দেয়াল এবং কাঁটা-তারের বেড়া ডিঙিয়ে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে ভারতের ভূখন্ডে অন্তত ২৫২৯ কি.মি দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ করা সক্ষম নয়, শুধু তাই নয়, শক্তিশালী ফ্লাড লাইট, নিরাপত্তা চৌকি, বৈদ্যুতিক তার এবং সর্বোপরি সশস্র সীমান্তরক্ষী বাহিনী এহেন নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করা সহজসাধ্য নয় বরং বলা যায় নিশ্চিত মৃত্যু ফাঁদ|

কিন্তু তারপরেও হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, এর পেছনের কারণ গুলোর দিকে একটু আলোকপাত করা যায় ধাপে-ধাপে| তবে পৃথিবীর যে কোনো দুটি দেশ লাগোয়া সীমান্তে যেরকম আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড ঘটে থাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তও এর ব্যাতিক্রম নয়| যেমন কাঁটা-তারের বেড়া দেওয়ার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকো সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান নিত্যদিনের ঘটনা ঠিক সেরকমই এই দুই দেশের সীমান্তেও ঘটে চলেছে| কিন্তু তার জন্য রয়েছে সীমান্ত-নিয়ন্ত্রণ আইন, এছাড়াও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের উপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা| যতটা সম্ভব বিনা রক্তপাতে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগীতা সবসময়ই কাম্য| কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে বিনা বিচারে হত্যা-নির্যাতন আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন থেকে শুরু করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত| তাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়| এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয় ছিটমহলগুলো| বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের প্রায় ১০০টি এবং ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি ছিটমহল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে, যা কিনা কোচ-বিহারের মহারাজা এবং রংপুরের নবাবের মধ্যবর্তী চুক্তির ফল| তবে ২০১১ এর সেপ্টেম্বরে চুক্তির ফলে হয়তো এই সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হবে বলে আশা করা যায়|

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ ও ভারতের ২টি মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে সীমান্ত সংঘাত সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করে একটি ৮৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে| বাংলাদেশের সংস্থা "অধিকার" এবং ভারতের "বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ" এই দুটি সংস্থার সাহায্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন সীমন্ত সমস্যার উপরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে| বাংলাদেশের সাথে ভারতের অর্ধেকেরও বেশি সীমান্ত এই পশ্চিমবঙ্গের সাথেই| পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিএসএফ শুধুমাত্র বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার কারণেই অভিযুক্ত নয় একই সাথে নিজ দেশের নাগরিকদেরও বিনা বিচারে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত| ২০০৭ পর্যন্ত বিএসএফ এর হাতে ৩১৫ জন বাংলাদেশী এবং ৬১ জন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক| বিএসএফ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সংখ্যাটা, ২০০৬ পর্যন্ত ৩৪৭ জন বাংলাদেশী এবং ১৬৪ জন ভারতীয়|

সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সম্বল কৃষি নয়তো গবাদি পশু পালন| অর্থনৈতিক কারণেই হোক বা সামাজিক কারণেই হোক তারা সীমান্তে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছে| এছাড়াও অত্যাধিক জনসংখ্যা, সেচের অভাব, ফসলের অপ্রতুলতা, খাদ্যের ঘাটতি, জীবনযাত্রার নিম্নমান ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ| এরা রাজনীতি বোঝেনা, বোঝে কোনমতে বেঁচে থাকা| আর একারণেই অভাবকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বিশাল চোরাচালানি চক্র, যেখানে নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে হর-হামেশা|

তাই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে কিছু সমস্যা যদি চিহ্নিত করা যায় তা হলো-

১. অত্যাধিক জনসংখ্যা
২. ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়
৩. দারিদ্র
৪. সরকারী পর্যবেক্ষণ, অনুদান, সাহায্য-সহযোগিতার অভাব
৫. চোরাচালান (বিশেষত ফেনসিডিল চোরাচালান, নারী পাচার, গবাদিপশু চালান)
৬. ভৌগলিক অবস্থান

ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা যায় তা হলো-

১. অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি
২. চোরাচালান
৩. সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ/নিরাপত্তা হুমকি
৪. মুদ্রা পাচার
৫. অস্ত্র চালান

এই সমস্যাগুলোর সব কয়টি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত| ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সীমান্ত সংলগ্ন লোকালয়গুলো একে অপরের লাগোয়া এবং ঘন-জনবসতিপূর্ণ| তাই সঠিক ভাবে সীমানা পিলার চিহ্নিতকরণ এবং সবসময় তা অনুসরণ করা ভৌগলিক কারণেই অসম্ভবপ্রায়| একই সাথে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সীমান্ত সংলগ্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনের তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের জন্য যাওয়াটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা| যেহেতু দারিদ্র এই অঞ্চলগুলোর একটি অভিশাপ এবং তারা সরকারী সাহায্য থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত তাই এদের পরিস্থিতিকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে চোরাচালানী চক্র| যারা সাধারণ মানুষকে ব্যাবহার করে সামগ্রী দুইদেশেই পাচার করছে, এমনকি মানুষ পাচার নিত্য-দিনের ঘটনা, যার অধিকাংশ থেকে যাচ্ছে লোক-চক্ষুর আড়ালে|

ভারতীয় সরকার ও বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্যমতে, ভারতে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্খাজনক ভাবে, একই সাথে ভারত সরকার তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পেছনে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছে| একই সাথে অস্ত্র চালান একটি বড় হুমকি বলেও উঠে এসেছে| ভারতের আসামে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা আশঙ্খাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তিতে সেটি জাতিগত সহিংসতার রূপ নেয়| এখনো আসামে এই সহিংসতা চলছে, সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি লড়াই এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন এই অনুপ্রবেশকারীদের আধিক্য| এছাড়াও বিভিন্ন সূত্র মতে, ভারতে ১২ মিলিয়ন অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে শুধু আসামেই আছে ৫ মিলিয়ন| এছাড়াও, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে| এর ভিত্তিতেই ভারত সরকার বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু সময় ধরে "পুশ-ব্যাক" এর চেষ্টা চালায়| যা কিনা এখনো চলছে|


কিন্তু সীমান্তে এই সকল সমস্যা মোকাবেলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পদক্ষেপ প্রশ্নে জর্জরিত| যেখানে সীমান্ত আইন অনুযায়ী সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীকে আদালতের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করার কথা, সেখানে অধিকাংশ সময় গুলি করে হত্যা হচ্ছে বিএসএফ এর পথ| এছাড়াও যেকোনো হত্যা কান্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো বিচার-বিভাগীয় তদন্ত ভারত সরকার করেনি| কোনো হত্যা কান্ডের ঘটনাতেই অভিযুক্ত কোনো সদস্যের কোনো বিচার হয়নি| অধিকাংশ সময় বিএসএফ কর্তৃক গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়সাড়া গোছের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে অধিকাংশ সময় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, "সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাজে বাঁধা এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ|" কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক কারো নিহত হবার ঘটনায় যে পুলিশ রিপোর্ট এবং তদন্ত হবার কথা সেখানে কিছুই হয়নি| যেখানে নিরাপত্তাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়ে এই নিপীড়ন সেখানে মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে মৃত ব্যাক্তির কাছ থেকে কখনই কোনো অস্র-গোলাবারুদ কিংবা বিধ্বংসী কোনো কিছু জব্দ করে প্রমান হিসেবে দেখাতে পারেনি বিএসএফ| বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যাক্তির পিঠের দিকে গুলি লাগার কারণে এটাই অনুমেয় যে ওই ব্যাক্তি পালাতে গিয়েছিলো, তাই পলায়নপর ব্যাক্তিকে সতর্ক না করে কিংবা আটক করার চেষ্টা না করে গুলি করে হত্যা করা কোনভাবেই আইনসম্মত নয় এবং সীমান্ত আইনের পরিপন্থী| কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বহু বছর যাবৎ "শুট এট সাইট" বা দেখামাত্র গুলির পন্থা অনুসরণ করে চলেছে| তাই সাধারণ কৃষক, খামারের কর্মী এধরনের অশিক্ষিত মানুষ ভুলের কারণে সীমান্ত এর কাছাকাছি এলেই কিংবা ভুলবশত সীমান্ত অতিক্রম করলেই অনেককেই বিএসএফ এর গুলির শিকার হতে হচ্ছে| অনেকবার বিএসএফ বাংলাদেশের ভূখন্ডের ভেতরে এসে নিরীহ মানুষের উপরে গুলিবর্ষণ হতে শুরু করে কাওকে কাওকে জোর করে নিজেদের ক্যাম্প এ নিয়ে নির্যাতন-হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে| এই ধরনের ঘটনার স্মৃতি এখনো পুরনো হয়নি, যখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অনেক গ্রামের মানুষকেই ভিটে-মাটি ছেড়ে পালাতে হতো দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিবিনিময়ের ফলে|

বর্তমানে প্রায় ৪.৯ কি.মি পরপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে যা কিনা বেড়া দেওয়া শেষ হলে ২.৯ কি.মি এর দুরত্বে এসে দাড়াবে| এছাড়াও রাতে সীমান্তে চলে কারফিউ এবং টহল, দিনভর টহল এবং সার্চপার্টি তো রয়েছেই| তারপরও নিরাপত্তার অজুহাতে বারংবার নিরীহ গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়| এছাড়াও যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনাতেই কোনো অস্র কিংবা বিস্ফোরক উদ্ধার হয়নি, তাই নিরাপত্তার অজুহাত এখানে ধোপে টেকেনা| বরং অনেক সময়ই ওপেন ফায়ার এর কারণে গুলি ছিটকে এসে ঘরের মধ্যে থাকা মানুষ নিহত হচ্ছে| আর ভৌগলিক কারণে যেহেতু চাষের জমিগুলো একদমই সীমান্ত সংলগ্ন তাই ভুলবশত কৃষিকাজের সময় কোনো কৃষকের পক্ষে সমান্তি পিলার না দেখে অতিক্রম করে ফেলাটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, তাই এই জায়গাগুলোতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং অস্রের প্রয়োগ শুধুমাত্র একটি দেশের আধা সামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক তাদের আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ|

এরকম কয়েকটি সাধারণ গ্রামবাসী (বাংলাদেশী) নিহত হবার ঘটনা-

১. ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১০, রিক্সাচালক ফরিদ হাসান (২৩), শারিয়ালজট গ্রাম, পঞ্চগড়
২. ২৯ জানুয়ারি, ২০১০, শ্যামল সরকার (১৭), বিশ্রশিয়া গ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ
৩. ২২ জানুয়ারি, ২০১০, নজরুল ইসলাম (৪০), বারিবাকা গ্রাম, মেহেরপুর
৪. ১৫ জানুয়ারি, ২০১০, সহিদুল ইসলাম (৩৭), কাজিপুর গ্রাম, মেহেরপুর
৫. ৯ জানুয়ারি, ২০১০, মনিরুল ইসলাম (২৩), চাপাইনবাবগঞ্জ
৬. ১ জানুয়ারি,২০১০, শফিকুল ইসলাম (২৭), শীতলপুর গ্রাম, সাতক্ষীরা
৭. ১৩ মার্চ, ২০০৯, আব্দুর রাকিব (১৩), দোহালকারী লেক
৮. ৭ জানুয়ারি, ২০১১, ফেলানী (১৫), অনন্তপুর

কয়েকটি সাধারণ গ্রামবাসী (ভারতীয়) নিহত হবার ঘটনা-

১. ৪ মে, ২০১০, বাসিরুন বিবি এবং আশিক (৬), কোচবিহার
২. ২১ মার্চ, ২০১০, আতিউর রহমান, পুঠিয়া, জামতলা
৩. ১০ নভেম্বর, ২০০৯, শাহজাহান গাজী (১৮), উত্তর ২৪ পরগনা
৪. ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯, নূর হোসেন (১৭)
৫. ২২ আগস্ট, ২০০৯, শ্যামসুন্দর মন্ডল, মুর্শিদাবাদ
৬.১৩ জুলাই, ২০০৯, সুশান্ত মন্ডল (১৩), মুর্শিদাবাদ
৭. ৫ মে, ২০০৯, আব্দুস সামাদ (৩৫), মুর্শিদাবাদ
৮. ২৪ মার্চ, ২০০৯, সঞ্জিত মন্ডল (১৭)

এই ঘটনাগুলোতে চোরাচালান সম্পৃক্ততার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রমান করা যায়নি, শুধু তাই নয়, চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হলেও বিনা বিচারে, অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে এদের অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে| শুধু তাই নয়, এদের বয়স লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা অল্প বয়সী অথবা শিশু| তাই নিরাপত্তার খাতিরে গুলিবর্ষণের অজুহাত এখানে একদমই গ্রহণযোগ্য নয়|

এছাড়াও গ্রামবাসীদের সাথে বিএসএফ এর খারাপ ব্যাবহার, নারী নির্যাতন, অকথ্য গালিগালাজ থেকে শুরু করে অযথাই মারধর করা থেকে শুরু করে আরও অনেক ধরনের অভিযোগ আছে| যেই নিরাপত্তা আর চোরাচালান বন্ধের জন্য বিএসএফ এর আস্ফালন তা কিন্তু বন্ধ হয়নি কোনো অংশেই, বরং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিদিন চলছে হাত বদলের কাজ| আর এর সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে দুদেশেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর|

তাই সীমান্ত সংঘাত ও মৃত্যুর মিছিল বন্ধে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে দ্রুত এবং শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে, তার মধ্যে-

১. ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন মান্য ও জাতিসংঘের বিধান অনুসরণ করে সীমান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার আদেশ এবং ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বিচার বিভাগীয় সুস্থ তদন্ত এবং তার প্রতিবেদন আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ ও অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যাবস্থা নিশ্চিত|

২. বার বার ঘটে যাওয়া আইন অমান্য এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রমান হয় যে, বিএসএফ এর অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যাবস্থার দুর্বলতা ও অসাধুতা, তাই বিএসএফ এর এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ|

৩. বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন ও সকল বিচার বহির্ভূত হত্যা-নির্যাতনের সুষ্ট-স্বচ্ছ তদন্ত ও প্রতিবেদন প্রকাশ|

৪. প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের জন্য জাতিসংঘের সাহায্য কামনা ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ দল|

৫. দুই দেশের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজন হলে যৌথ টহলগ্রুপ গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনা|

৬. রাতের বেলা সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে অতিরিক্ত লোকবল প্রয়োগ ও যথাযথভাবে টহলদানের ব্যাবস্থা|

৭. পূর্বে ঘটে যাওয়া সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ডের তদন্তের পড়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিএসএফ এবং ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমার আবেদন|

৮. বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন ও সময় উপযোগী পরিবর্তনের মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার প্রতি জোরালো দৃষ্টি|

৯. সীমান্তে চোরাচালান রোধে গ্রামবাসীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের সরকারী সাহায্য বৃদ্ধি|

১০. বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও কঠোর ও শক্তিশালী করা, প্রয়োজনে নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রকল্প শুরু|


সীমান্ত সংঘাত, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর আগ্রাসন ও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যার্থতা নিয়ে লিখতে গেলে কখনই ছোট পরিসর যথেষ্ট নয়, তাই আমাদের সকলকে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা নিরসনে সকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করার জন্য| নয়তো এই সংঘাত ভবিষ্যতে আরও রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে বলে মনে হয়|

[ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে "ট্রিগার হ্যাপি" হিসেবে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর পুরো প্রতিবেদন এবং ২০০৭ থেকে শুরু করে বিএসএফ এর গুলি এবং নির্যাতনে বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যুর সংযুক্ত করা হলো পোস্টের সাথে, এছাড়াও সীমান্তে নারী পাচার নিয়ে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পুরনো একটি লেখার লিঙ্ক সাথে দিলাম, এছাড়াও অনান্য লিঙ্কগুলোও সংযোজন করে দেওয়া হল]

http://www.hrw.org/sites/default/files/reports/bangladesh1210Web.pdf

http://en.wikipedia.org/wiki/Bangladesh%E2%80%93India_border

http://www.guardian.co.uk/commentisfree/libertycentral/2011/jan/23/india-bangladesh-border-shoot-to-kill-policy

http://www.globalpost.com/dispatch/news/regions/asia-pacific/india/111225/india-bangladesh-border

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.sachalayatan.com/node/40946