Sunday, February 26, 2012

বগালেক রহস্য : পর্ব তিন



১৫০০ শতাব্দীর দিকে যখন বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বানিজ্য রমরমা তখন বিভিন্ন দেশের নাবিকদের সাথে সাথে ১৫২০ এর দিকে এখানে এসে হাজির হয় পর্তুগিজ নাবিকরা, তবে অন্যান্যদের মতো সৈন্য সামন্ত নিয়ে যুদ্ধ লাগানোর বদলে তারা "কাসাদোস"দের দিয়ে কলোনি তৈরী করে, রিজার্ভ আর্মির বিবাহিত সদস্যদের বলা হতো "কাসাদোস", তবে বাংলায় তারা আসে ১৫১৭ এর দিকে, প্রথম এসে ভিড়ে চট্টগ্রাম এর বন্দরে, তখন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে সেটি| তবে পর্তুগিজদের মন তখন ব্যবসা-বানিজ্যের দিকেই ছিলো, গদির লড়াইয়ে তারা তখনো অতোটা তত্পর নয়| ১৫৩৬-১৫৩৭ বাংলার তত্কালীন রাজার ছত্রছায়ায় একচেটিয়া ব্যবসা করে এই অঞ্চলে| তবে এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে যা হয়, সেরকমই এবার তাদের নজর গেলো আধিপত্যের দিকে, ১৫৯০ এর দিকে তারা চট্টগ্রাম আর আশেপাশের অঞ্চলগুলো একপ্রকার দখল করে কলোনি তৈরী করে, ব্যবসার রুট হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে জলপথ একই সাথে স্থলপথ, আরাকান অঞ্চলের সাথে ভালোই ব্যবসা চলছিলো তখন| সন্দ্বীপ এও কলোনি তৈরী করে, ১৫৯৮ এর মধ্যে প্রায় বিনা বাধায় এই অঞ্চলে বেশ ভালো ভাবে জাকিয়ে বসে তারা| এরই পরিণতিতে ১৬০২ এ সন্দ্বীপ পুরো দখল করে দোমিঙ্গো কার্ভালহো এবং মানুয়েল দ্য মেত্তোস তাদের দলবল নিয়ে| তাদের বানিজ্যিক আধিপত্য ছড়িয়ে পড়ে তত্কালীন দিয়ান্গা বা বর্তমানের ফিরিঙ্গি বন্দর এলাকা পর্যন্ত| এই অঞ্চলের ফুলে-ফেঁপে ওঠা বানিজ্যিক অবস্থার কথা তখন গোপন কিছু নয়, তাই অনেকেই গন্ধ শুকে শুকে চলে আসছে ভাগ বসাতে, এভাবেই ১৬০৩ এ এখানে এসে হাজির হয় লিয়ান্দ্র কার্ভালহো, দোমিঙ্গো কার্ভালহোর বংশধর| আর এখান থেকেই আসল কাহিনী শুরু| এইটুকু বলে থামলো শুভ্র| ওরা বসে আছে একটা টিলার উপরে, সকাল থেকে ৪ ঘন্টা হাঁটা পথে চলেছে, সবার অবস্থাই করুণ| রাস্তা যতটা না দুর্গম তার থেকেও বৃষ্টির কারণে খারাপ অবস্থা| এই উঁচু টিলার মাথায় পৌঁছে তাই বিশ্রাম নেওয়ার সিধান্ত নিয়েছিলো সবাই| বাকিরা যখন এদিক ওদিকে বসে পড়েছে তখন রাদ কে একপাশে ডেকে কথাগুলো বলা শুরু করলো শুভ্র|


রাদ এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো ভোর ৫ টার, ওর মনে হলো চোখ বোজার সাথে সাথে এলার্ম বেজে উঠলো, কিন্তু না, উঠে দেখলো ঠিকই সকাল হতে চলেছে| বাইরে আবছা আলো| উঠে ধাক্কা দিয়ে অঙ্কুরকে ওঠানোর চেষ্টা করলো, কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পড়ে উঠে বসলো অঙ্কুরও| সবাই তৈরী হতে হতেই চলে এলো জাহিদ| খুব বেশি দেরি করলোনা ওরা, সব গুছিয়ে ৭ টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়লো সবাই| প্রথম টিলাটা পাড় হতেই জিভ বেড়িয়ে গেলো সবার| হাফাচ্ছে জোরে জোরে, ওদের দেখে হেসে ফেললো জাহিদ| জাহিদের সাথে গল্প করতে করতে চলেছে ওরা, তরুণ, হাসি-খুশি গাইড, ওর কাছ থেকেই জানলো, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা নদীটাকে ওদের রাস্তায় ৫৪ বার অতিক্রম করতে হবে, আর পার হতে হবে হাজার দুয়েক ফুট উঁচু পাহাড়ও| এসব শুনেই সবার চোখ কপালে উঠতে চললো| তবে শুভ্র বেশ আগ্রহ নিয়েই এটা ওটা প্রশ্ন করে চললো জাহিদকে, কয়েকবার জানার চেষ্টা করলো আদিবাসীদের পুরনো গ্রামগুলোকে নিয়ে|


রাস্তা যতই দুর্গম হোকনা কেনো, চারিদিক এর দৃশ্য অসাধারণ, এধরনের প্রকৃতি তো আর সবদিন দেখা হয়না, তাই ঝর্নার জলে ভিজে, পাহাড়ি নদী পার হয়ে, কখনো ঘন জঙ্গল আবার কখনো নিচু মাঠ পার হয়ে ওরা বেশ মনের আনন্দেই চললো, সাথে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা তো আছেই, দেখা গেলো, অঙ্কুরও আস্তে আস্তে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, ভালোই আনন্দে আছে সেও| জামিল অবশ্য বেশ কয়েকবার বললো, আগে জানলে ওজন কমিয়ে আসত ও যেভাবেই হোক, তবে রাদ আর শুভ্র ওকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলোনা এতো তাড়াতাড়ি ওর এই সুবিশাল ভুড়ি ও কি করে কমাতো যা কিনা এতদিনেও ও পারেনি| এসব করতে করতেই, ওদের ঘন্টা চারেক পার হয়ে গেলো, এর মধ্যে রাদ গুনে দেখলো প্রায় ছোট বড় মিলিয়ে ৩৫ বার পার করেছে নদীর স্রোত, বেশ কয়েকটা জায়গা খরস্রোতা ছিলো, একবার না বুঝে পা দিয়ে স্রোতের টানে শুয়ে পড়েছিল নিজেই| তবে আপাতত বৃষ্টি সেরকম হয়নি, বড় বড় পাথুড়ে পথ, কখনো পাহাড়ের গা বেয়ে, কখনো ঝর্নার জলের নিচ দিয়ে ওরা এগোতে এগোতে এসে পৌঁছলো এক পাথুড়ে দেয়ালের সামনে, কালো দেয়াল উঠে গেছে অনেক উঁচু পর্যন্ত| উপর থেকে অঝোর ধারায় জল পড়ছে| জাহিদ বললো, "বৃষ্টির জল, উপর থেকে নেমে আসছে|" কিন্তু ওদের এই দেয়াল বেয়েই উপরে যেতে হবে, আবার উপর থেকেই রাস্তা শুরু| কোনো মতে ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে উঠে এলো বিপদ ছাড়াই, তারপর ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকক্ষণ চলার পড়ে এই টিলা| উঠতে অনেকটা সময় লাগলো, যাত্রার ধকলে ক্লান্ত সবাই, খুব একটা বিশ্রাম নেওয়া হয়নি কোথাও, তাই এখানেই বসার সিদ্বান্ত নিলো ওরা| জাহিদ এদিক ওদিক থেকে ফল কুড়াতে গেলো, আর শুভ্র একপাশে বসে ব্যাগ থেকে বের করে একটা ডায়রি ঘাটতে লাগলো| সেটা দেখে রাদ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতেই শুরু করেছিলো শুভ্র বর্ণনা করা|


লিয়ান্দ্র কার্ভালহো, পেশায় ব্যবসায়ী হলেও, যোদ্ধার জাত| বানিজ্যের রমরমা অবস্থা দেখে সে নিজের উচ্চাভিলাষী প্ল্যানের বাস্তবায়ন শুরু করলো| সাথে নিয়ে আসা লোকজন আর যোদ্ধাদের নিয়ে বানিজ্য কুঠি বানালো সন্দ্বীপ এ| রকমারি জিনিস আর তার সাথে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র আর দামি পাথড়ের বড় ব্যাবসা , বেশ ভালোই চলছিলো, আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সম্পদ, তারই সাহায্যে দিয়ান্গাতেও আরেকটা কুঠি বানায় সে| তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর কঠোর হাতে বানিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করে প্রচুর সম্পদ জমা করে সে| কিন্তু ১৬০৭ এ, এই অঞ্চলে হামলা করে আরাকান এর রাজা, হামলায় নিহত হয় প্রায় ৬০০ পর্তুগিজ, অল্প কয়েকজন পালিয়ে বাঁচে| যারা পালিয়ে বাঁচে তাদের মধ্যে লিয়ান্দ্র আর তার কিছু সঙ্গী সাথী ছিলো| তারা অন্যদের মতো জলপথে না পালিয়ে, পেছনের পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে যায়| জানা যায় তারা সাথে নিয়ে গিয়েছিলো, প্রচুর সম্পদ| কিন্তু এর পরে আর কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের| বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলো যেনো| একনাগাড়ে সবটুকু বলে থামলো শুভ্র, রাদ বোঝেনি শুনতে শুনতে কখন তার মুখ হা হয়ে গিয়েছে| ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো শুভ্র|


রাদ প্রশ্ন করলো,- "তাহলে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো আর তার সঙ্গী সাথীদের কি হলো?? আর তাদের সেই ধন-রত্নই বা কথায় গেলো??" শুভ্র বললো,- "সেটা কোনো নথিতে সেরকম ভাবে পাওয়া যায়নি|" রাদ অবাক হয়ে বললো- "তাহলে তুই এতো কিছু কি করে জানলি??" শুভ্র বললো,- "আমি কয়েক মাস আগে আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে বাড়ির পুরনো লাইব্রেরীতে খোঁজা খুঁজি করছিলাম কিছু পুরনো আকর্ষনীয় বই পাওয়া যায় কিনা, হঠাৎ হাতের ধাক্কায় পাশের একটা আলগা ড্রয়ার খুলে নিচে পড়ে যায়, তাতে ছিলো একটা বাঁধানো বই| পরে হাতে নিয়ে দেখলাম, বই নয়, পুরনো দিনের ডায়রি, আর তার ভেতরে ভাঁজ করা একটা হাতে আঁকা ম্যাপ| ঐ দিন ডায়রিটা পড়ে যা বুঝলাম তাহলো, আমাদের বংশেরই কোনো পূর্বপুরুষ, এই অঞ্চলে ব্যাবসা করতেন, উনি ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এই গল্পের খোঁজ পান| প্রথমে গল্প বলে উড়িয়ে দিলেও নেহাৎ কৌতূহলের বশেই তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন এদিক ওদিক থেকে, সেগুলো তিনি টুকে রাখেন এই ডায়রিটাতে| একসময় তিনি তার তথ্য আর পুরনো ইতিহাস ঘেটে এতটুকু বুঝতে পারেন যে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো আর তার সম্পদের কাহিনী একদম ভিত্তিহীন নয়, আর তার অনেক পড়ে তিনি খুঁজে বের করেন যে, বান্দরবনের পাহাড়ি এলাকার এদিকে যেসব আদিবাসী গ্রাম আছে তার মধ্যে অনেকগুলো বেশ পুরনো, আর এখানেই কোথাও থেকে তিনি জানতে পারেন পুরনো কোনো এক স্থাপত্যের কথা যাকে এখানের লোকজন মন্দির বলে মনে করে| আরও জানতে পারেন যে, কোনো বিদেশী লোকের হাতে তৈরী হয়েছিল এই মন্দির আর তাতে নাকি সংরক্ষিত আছে পুরনো কোনো দেবতা, তবে মজার বিষয় হলো সেই বিদেশীর বর্ণনার সাথে লিয়ান্দ্র কার্ভালহোর মিল আছে, আর এটাও সত্যি যে লিয়ান্দ্র তার দলবল নিয়ে এদিকের পাহাড়েই লুকিয়েছিলো, তাই সেসময় আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক করে তাদের গ্রামে লুকিয়ে থাকাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা, আর তার সাথের ধন-রত্ন এই মন্দিরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে সব থেকে সহজ উপায়, তবে কোথা থেকে যিনি ডায়রি লিখেছেন তিনি এই খবর পান সেটা পরিষ্কার করে লিখে যাননি| কিন্তু হাতে আঁকা একটা ম্যাপ রেখে গেছেন, যাতে একটা অঞ্চলের রাস্তা আর মন্দিরের হদিস আছে|"


রাদ বললো,"তাহলে তুই কি করে নিঃশ্চিত হচ্ছিস এটা সেই মন্দির যেটার কথা ডায়রিতে লেখা আছে??" "আমি নিজে এটা হাতে আসার পরে কয়েক মাস ধরে খোঁজ নেই, বই ঘেঁটে আর এদিকের পুরনো কিছু ম্যাপ আর্কাইভ থেকে বের করি, পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে বের করি আরও তথ্য| পরে ম্যাপগুলো মিলিয়ে দেখি এটা এখনকার বগা লেক এর এদিকটা নির্দেশ করছে, আর তখন অতো ভালো ভাবে ম্যাপ করা না হলেও, মিল খুঁজে বের করতে অসুবিধে হয়নি আমার|"-বললো শুভ্র| রাদ উত্তেজনার বশে বলে উঠলো- "তাহলে এটা শুধু মন্দির কিংবা জঙ্গল দেখার প্ল্যান নয়, এটা আসলে একটা ট্রেজার হান্ট???" ট্রেজার হান্ট কথাটা প্রায় চিত্কার করে বললো রাদ, শুভ্র প্রায় ওকে মুখ চেপে ধরে থামালো, বললো বগা লেক না পৌঁছনো পর্যন্ত কাউকে বলা যাবেনা| এদিকে জাহিদ এসে তাড়া দিতে লাগলো আবার চলা শুরু করার জন্য, রাদ আর শুভ্র একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে উঠে চলা শুরু করলো, জামিল পেছন থেকে এসে বললো, "কিরে তোরা এতক্ষণ ধরে কি ফিসফিস করছিলি রে??" শুভ্র হেসে কথাটা পাশ কাটিয়ে গেলো, রাদ বললো, "আররে কিছুনা|" কিন্তু রাদ নিজেও জানে কিছুনা বললেও অনেক কিছুই এখনো ওদের সবার জানা বাকি আছে|

[ক্রমশঃ]

No comments:

Post a Comment