Sunday, February 5, 2012










নাম: দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস
দৈর্ঘ্য: ১৩৮ মিনিট
বিষয়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইতিহাস
পরিচালক: আলেক্সান্ডার কট
দেশ: রাশিয়া, বেলারুস
ভাষা: রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান, বেলারুসিয়ান


[যুদ্ধ এবং ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের উপর যথেষ্ট আগ্রহ থাকায় খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন জায়গা থেকে এগুলো সংগ্রহ করি, এরকমই খুঁজতে গিয়ে "দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস" চলচ্চিত্রটি নজরে পড়লো, খুব বেশি পুরনো নয়, ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত, রাশিয়া এবং বেলারুস এর যৌথ প্রযোজনায় এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে| দেখা শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রায় দুই ঘন্টার জন্য চলচ্চিত্রটির চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে গেলাম| শেষ হবার পরেও দেখলাম এর রেশ থেকে গেলো অনেকটাই| শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ভয়াবহতা নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, শেষ হবার পরেও বেশ অনেকক্ষণ মন ভার হয়ে থাকবে]

বেলারুস এ অবস্থিত ব্রেস্ত দুর্গটি ১৯ শতকের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় দুর্গ| ১৯৩৯ এর যুদ্ধে জার্মানি পোল্যান্ড এর কাছ থেকে দুর্গটি অধিকার করে নিলেও পরবর্তিতে রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে এটি রাশিয়ার কর্তৃত্বে দেওয়া হয়| মুখাভেত্স এবং বাগ নদীর তীরবর্তী এই দুর্গটি অবস্থানগত কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ| ১৯৪১ সালে জার্মানি পুনরায় এটি আক্রমন করে অধিকার করে নেয়| আক্রমন প্রতিহত করে দুর্গটি রক্ষা করার জন্য রেড আর্মির যে সৈনিকরা আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছিলো, তাদের সেই অসমসাহসী বীরত্বগাঁথার উপর ভিত্তি করেই নির্মান করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি|






[ব্রেস্ত দুর্গ- বর্তমান ছবি]

গল্পটি সাশা আকিমভ নামের এক কিশোরের স্মৃতিচারণে এগিয়ে চলেছে, সাশা এবং তার ভাই দুজনেই দুর্গের রেড আর্মির সদস্য| সাশা কম বয়সী হওয়ায় সেনাবাহিনীর বাদক দলের অন্তর্ভুক্ত| তার চোখেই দেখা যায় দুর্গের ভেতরের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো, ছোটবেলার প্রেয়সী আন্যা এর সাথে সাশার কথোপকথন এবং দুর্গের অনান্য সদস্যের কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে গল্প| অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এতে দর্শকের বাড়তি পাওনা| কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতায় কি করে মুহুর্তের মধ্যেই এই সাধারণ-চঞ্চল জীবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে তা পরিচালক যথেষ্ট ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন| খুবই ধীরে চলতে থাকা গল্পটিতে চরিত্রগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত হবার আগেই দর্শক নিজেকে হঠাৎই আবিষ্কার করবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি জায়গার মাঝখানে, আঘাতটা খুব অপ্রত্যাশিতভাবে এনে পরিচালক দর্শককে একটু হলেও সত্যিকার ভয়াবহতার আঁচ দিতে পেরেছেন| এখানে সাশার উক্তি "I imagined the war, but I never imagined the war to be like that..." মনে দাগ কেটে যাবে|

২২শে জুন, ১৯৪১ সালের এক ভোরে সাশা যখন নদীর তীরে আন্যা এর সাথে মাছ ধরছিলো, ঠিক তখনি শান্ত সকালে হঠাৎ আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে জার্মান বিমান, একই সাথে প্রচন্ড শেলিং| দুর্গের তিনটি প্রবেশদিকের সবগুলো একসাথে অতর্কিতে আক্রমন করে জার্মান সেনারা| একই সাথে তারা বিচ্ছিন্ন করে দেয় দুর্গের বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ| মাত্র মিনিট দশেকের বোমাবর্ষণ ও শেলিংয়ের কারণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় দুর্গের ভেতরের বাসস্থানগুলো, অসাধারন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে মাত্র কিছুক্ষনের ভেতরে এরকম ধ্বংসযজ্ঞের মাঝখানে এসে বিশ্বাস করাটা কষ্টকর হয়, এখানেই আসল ধাক্কা লাগে| প্রাণ বাঁচাতে শিশু ও নারীদের ছুটোছুটি, একই সাথে দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এগিয়ে যাওয়া সেনাদের দৃশ্যর মাধ্যমে শুরু হওয়া চলচ্চিত্রের প্রধান অংশ, শেষ পর্যন্ত ছিলো উত্তেজনাপূর্ণ|

চলচ্চিত্রটি মূলত চারটি প্রধান চরিত্রের ঘটনা প্রবাহের উপর করা হয়েছে, সাশা আকিমভ এর স্মৃতিচারণ, তার সাথে কমিসার ফোমিন, মেজর গারিলভ এবং ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর অসম সাহসিকতার বর্ণনা| জার্মান আক্রমনের প্রথম ধাক্কাতে বিপর্যস্থ সেনাদের সংগবদ্ধ করে কিছুক্ষনের মাঝেই পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে রেড আর্মি এই তিন জন কমান্ডারের নির্দেশে দুর্গের তিনটি দিক থেকে| ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আহত এবং কিছু সংখ্যক অস্ত্র সাথে নিয়ে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে মেজর গারিলভ এর বাহিনী| এগিয়ে আসা জার্মান সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে দৌড়ে যাওয়া সৈন্যদের অধিকাংশের হাতেই কোনো অস্ত্র ছিলোনা, অনেকেই শুধু ছুরি কিংবা ট্রেঞ্চ তৈরী করার শাবল নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়| ঘটনার দৃশ্যায়ন দর্শকের চোখ পর্দায় আটকে রাখবে প্রতিটি মুহূর্ত|

চলচ্চিত্রের পরের পুরোটা অংশ জুড়ে আছে এক অসম লড়াইয়ের দৃশ্যায়ন, দুর্গে পানি সরবরাহ বন্ধ এবং চারিদিকে অবরুদ্ধ হয়ে দুর্গের ভেতরে আটকা পড়ে সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা| আহতদের চিকিৎসার কোনো ব্যাবস্থা নেই, এমনকি শিশুদের জন্যও কোনো খাবার নেই| এই পরিস্থিতিতে অসম সাহসিকতায় জার্মান সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যায় জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত, যা জার্মান বাহিনীর কাছে ছিলো কল্পনাতীত| এর মধ্যে প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ এবং আর্টিলারি শেলিং তো ছিলই| তিন ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মেজর গারিলভ এর সাথে কমিসার ফোমিন এবং ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর বাহিনীর করো যোগাযোগ সম্ভবপর ছিলোনা, তারা আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে| এর মাঝেই যুদ্ধকালীন সম্পর্ক, ভালোবাসা, আবেগ সব কিছু খুব সাধারণ-সাবলীল ভাবে ফুটে ওঠায় গল্পের চরিত্রগুলো দর্শকের আরও আপন মনে হবে| চরিত্রগুলোকে খুবই সাধারণভাবে দৃশ্যায়িত করে তাদের দর্শকের খুব কাছে এনে দিয়েছেন পরিচালক, তাদের চোখের জল, আপনজনের মৃতদেহের সামনে দিয়ে এগিয়ে যুদ্ধ করা, কখনো কোনঠাসা হয়ে পড়া, এসবই চরিত্রগুলোকে পুরো গল্পতেই অতিমানব হতে দেয়নি, আর এর কারণেই এক একটি চরিত্র দর্শকের কাছে স্থায়িত্ব পাবে অনেক দিনের জন্য|




[দুর্গের বীর যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত মনুমেন্ট]

পরবর্তিতে জার্মান বাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে বের হয়ে জল সংগ্রহ করার বারংবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত পরিণতির দিকে এগোতে থাকে গল্পটি, প্রায় ধংসস্তুপে পরিণত হওয়া দুর্গের কিছু কিছু জায়গা নিয়ে মাটি কামড়ে লড়তে থাকা স্বল্প সংখ্যক সৈন্যের প্রতিরোধও আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে, জার্মান বাহিনীর আর্তসমর্পনের প্রস্তাব উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যায় অবশিষ্ট সৈন্যরা| জার্মান সেনারা সকল ধরনের পথে দুর্গ অধিকার করতে ব্যার্থ হয়ে শেষপর্যন্ত ২000 কেজি ওজনের বোমা ফেলে| প্রায় ৯ দিনের অসম যুদ্ধের পড়ে পতন ঘটে দুর্গের|

জুনের শেষে কোনো একদিনে, জার্মান বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াড এর সামনে হল্মস্কি গেটে মৃত্যুবরণ করেন কমিসার ফোমিন, পড়ে যুদ্ধ শেষে অসীম বীরত্বের সম্মানে তার নাম "অর্ডার অব লেনিন" এ ভূষিত করা হয়|

যুদ্ধের ৩২তম দিনে জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মেজর গারিলভ, তাকে কারাগারে পাঠানো হয়| যুদ্ধশেষে তিনি স্তালিনের রোষানলে পড়েন এবং তাকে কমুনিস্ট পার্টি থেকে বহিঃষ্কার করে পুনরায় রাশিয়াতে জেলবন্ধি করা হয়| পরবর্তিতে স্তালিনের পড়ে ১৯৫৭ সালে তাকে মুক্তি দান করা হয় এবং "হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন" সম্মানে ভূষিত করা হয়|

নবম ফ্রন্টিয়ার পোস্টের কমান্ডার ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন, তার নাম ১৯৬৫ সালে "হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন" সম্মানে ভূষিত করা হয়|

সাশার প্রেয়সী আন্যা (ল্যাফটেন্যান্ট কিজ্হেভাতভ এর মেয়ে) এবং বাকি নারী-শিশু-বৃদ্ধ যারা আর্তসমর্পন করেছিলো জার্মান বাহিনীর আশ্বাসে, তাদের সকলকে ১৯৪২ সালের বসন্তের কোনো একদিনে হত্যা করে জার্মান সেনারা|





[দুর্গের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত মনুমেন্ট]

যুদ্ধের ২০ বছর পড়ে সর্জেয় স্মিরনভ এর বর্ণনায় উঠে আসে ব্রেস্ত দুর্গের সকল অসীম সাহসী বীর সেনানীদের কথা| ৮ই মে, ১৯৬৫ সালে ব্রেস্ত দুর্গকে "হিরো ফোরট্রেস" সম্মান দেওয়া হয়|

কিছু সাধারণ মানুষের মাতৃভূমির প্রতি অসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন, চলচ্চিত্রটিতে মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাদের বীরত্ব, ত্যাগ নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডি ছাড়িয়ে গেছে| কোনো অতিরিক্ত আবেগ অথবা কোনো চরিত্রকেই অতিমানব হিসেবে উপস্থাপন না করে পরিচালক চলচ্চিত্রটিকে আলাদা আবেগ দিয়েছেন| চরিত্রগুলো তাদের মানবীয় সামর্থ্য ছাড়িয়ে না যেয়েই বরং দর্শকের মনে বেশি দাগ কাটবে| যুদ্ধ ও ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র যাদের ভালো লাগে তাদের জন্য অবশ্যই দেখার "দ্যা ব্রেস্ত ফোরট্রেস"|




[ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

No comments:

Post a Comment