Saturday, March 24, 2012

থাংজাম মনোরমা এবং পেবম চিত্তরঞ্জন এর কথা

[ ইরম চানু শর্মিলা কে নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে লেখার পরে একজন পাঠক অনুরোধ করেছিলেন মনিপুরের থাংজাম মনোরমা ও পেবম চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে লেখার জন্য। এই দুজনই ভারত সরকারের "Armed Forces (Special Powers) Act (AFSPA)"/ "আফসা" এর নির্যাতনের ভয়াবহতার সাক্ষী। সংঘাতপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলো- অরুনাচল, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরাতে এই আইন কার্যকর করা হলেও বর্তমানে এটি কার্যকর আছে জম্মু এবং কাশ্মীরেও। সামরিক বাহিনীকে বিনা বিচারে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গুলি করার অধিকার দেয়া এই আইন এর মাধ্যমে, অনেক বছর ধরেই নির্যাতনের খড়গ ঝুলে আছে এই অঞ্চলগুলোতে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু এবং অবিরাম প্রতিবাদের পরেও এই আইন কার্যত বলবৎ আছে এখনও, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচন্ড বিতর্ক সৃষ্টিকারী এই আইন এর বিরুদ্ধে এখনও পাহাড়ের অধিবাসীদের আন্দোলন অব্যাহত আছে।]

থাংজাম মনোরমা

থাংজাম মনোরমা, মনিপুর এর ইতিহাসে আর এক নির্যাতিত-নিহত নারীর নাম। ৩২ বছর বয়স্ক থাংজাম মনোরমাকে, ১৭ আসাম রাইফেলস এর কয়েকজন সদস্য আইন বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১ জুলাই, ২০০৪ গভীর রাতে, বামন কাম্ফু, ইম্ফল ভ্যালীর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সে দিনই সন্ধ্যার দিকে, বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত মনোরমার শরীর পাওয়া যায় তাদের বাড়ি থেকে ৪ কি.মি দুরের রাস্তার পাশে। তারপর কেটে গেছে ৮টি বছর, উপযুক্ত বিচার কিংবা তদন্ত কিছুই হয়নি।

কি হয়েছিল সেদিন?

১১ জুলাই, ২০০৪ মধ্যরাতে, ১৭ আসাম রাইফেলস এর কয়েকজন সদস্য দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে থাংজাম মনোরমাদের বাড়িতে। ঘুমন্ত মনোরমাকে টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করে সেখানেই নির্মমভাবে মারধর করে হাত-পা বেঁধে। পরিবারের সদস্যরা বাধা দিতে গেলে তাদেরও আঘাত করা হয়। এই নির্যাতন অনেকক্ষণ ধরে চলে, তারপর গভীর রাতে মনোরমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে কাগজ হস্তান্তর করে তারা। কিন্তু কোনো ধরনের তথ্য কিংবা কাগজপত্র মনোরমার কাছে সেদিন পাওয়া যায়নি, যা থেকে তার আইন বহির্ভূত কোনো কর্মকান্ডের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। পরবর্তিতে তাকে আসাম রাইফেলস এর সদস্যরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

সেদিন সন্ধ্যা ৫ টার দিকে, থাংজাম মনোরমার দেহ পাওয়া যায় কেইরাও বংখেম রাস্তার পাশে। তার দেহে কোনো কাপড় ছিলোনা, সারা দেহে ধর্ষণ-নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো স্পষ্ট এবং শরীরে ছিলো অসংখ্য বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর হত্যার অভিযোগ আনা হলেও তা অস্বীকার করা হয় আসাম রাইফেলস এর তরফ থেকে। পরবর্তিতে তদন্ত রিপোর্টেও সম্পূর্ণরূপে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। আসাম রাইফেলস এর তরফ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, থাংজাম মনোরমা নিষিদ্ধ ঘোষিত "পিপলস লিবারেশন আর্মি" এর সাথে সংযুক্ত এবং গ্রেফতারের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত হয় সে।

থাংজাম মনোরমার মৃত্যু মনিপুরে "আফসা" বিরোধী আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে পুরো পাহাড়। অসংখ্য নারী অধিকার সংস্থা একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। অসংখ্য আদিবাসী নারী আসাম রাইফেলস এর মনিপুরের প্রধান কার্যালয় অবরোধ করেন, সব থেকে সাহসী প্রতিবাদ করেন প্রায় ৪০ জন আদিবাসী নারী সম্পূর্ণ বিবস্র হয়ে, হাতে "Indian Army rape us" এবং "Indian Army takes our flesh" লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে।

প্রতিবাদে অশান্ত মনিপুরে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বহুল প্রচলিত দমন-নিপীড়নের পথ বেছে নেয়, আসাম রাইফেলস এর সাথে প্রায় সব ধরনের সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জড়ো করে এবং কার্ফ্যু জারি করে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে সংঘর্ষ চলতে থাকে সাধারণ মানুষের, ১৬ জুলাই এর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে ১০০ জনের বেশি নাগরিক আহত হয়। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে, মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হন বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দিতে।

২০১০ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পেশ হয়েছে, পাল্টাপাল্টি অনেক অভিযোগের ঝড় বয়ে গেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো উপযুক্ত রায় ঘোষণা করতে ব্যার্থ হয়েছে কমিশন। ৩১ আগস্ট, ২০১০ এ তদন্ত এর দায়িত্বভার প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং উপযুক্ত তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়।

তথাকথিত গণতন্ত্রে এভাবেই বারবার রুদ্ধ করা হয়েছে গণমানুষের কন্ঠ, এভাবেই অত্যাচার-নির্যাতনে হারিয়ে গেছে অসংখ্য থাংজাম মনোরমা।

পেবম চিত্তরঞ্জন

বিক্ষুব্ধ ইম্ফল ভ্যালীতে, সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ও বিতর্কিত "আফসা" প্রত্যাহারের দাবিতে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন পেবম চিত্তরঞ্জন, ১৫ আগস্ট, ২০০৪ এ। সরকারের সামরিক কালো আইনের বিরুদ্ধে নিজের শরীরকে জলন্ত মশালে পরিণত করে প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা করে গিয়েছিলেন তিনি। মনিপুর ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা পেবম চিত্তরঞ্জনের এই দুঃসাহসিক প্রতিবাদ এ তীব্র রোষে ফেটে পড়ে পুরো আদিবাসী সম্প্রদায়।

নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে কলেজ থেকে বিষ্ণুপুরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দৌড়ে যান তিনি, পরবর্তিতে পুলিশ আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও, শরীরের প্রায় ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ার ক্ষত নিয়ে ১৬ আগস্ট হাসপাতালে মারা যান পেবম চিত্তরঞ্জন।

পেবম চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো পাহাড়, অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের তরফ থেকে অনির্দিষ্টকালের কার্ফ্যু জারি করা হলেও, রাস্তায় সাধারণ মানুষের মিছিল-প্রতিবাদ চলতে থাকে।

আত্মাহুতির আগে পেবম একটি চিঠি লিখে যান, শুধু মনিপুরবাসীদের উদ্দেশ্যেই নয়, মানবতার উদ্দেশ্যে। চিঠিটির বাংলা অনুবাদ তুলে দিচ্ছি-

"প্রথমেই আমি মাথা নত করি ও শ্রদ্ধা জানাই সকলকে এবং মাতৃভূমি মনিপুরকে। আমার মা (মাতৃভূমি মনিপুর) যিনি জন্ম দিয়েছেন পাহাড় ও সমতল, শেকলে আবদ্ধ হয়ে নিজের সন্তানের থেকে দূরে থাকার নির্মম কষ্ট ভোগ করে চলেছেন। আমাকে শক্তি দাও যাতে আমি মাথা উঁচু করে আত্মত্যাগ করতে পারি আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

এই সেই ১৩ আগস্ট যেদিন আমাদের বীর বিপ্লবীদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, তারা লড়াই করেছিলো শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। তারা জানতো যে তাদের এই প্রতিবাদের পরিনাম কি, কিন্তু তারা একবারের জন্যও পিছুপা হয়নি। তারা মাতৃভূমির প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসার নিদর্শন পুরো পৃথিবীর সামনে রেখে গেছে, তাদের উত্তরাধিকার হতে পেরে আমি গর্ব বোধ করি। কিন্তু যখন আমরা তথাকথিত ভারতীয় গণতন্ত্রের অংশীদার হলাম, তখন থেকেই আমাদের উপর হত্যা-নির্যাতন চলেছে। প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে থেকেই মনিপুরের অধিবাসীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে সরকার তাদের সামরিক কালো আইনের প্রয়োগ করে। তারপরে "আফসা" প্রবর্তন করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়নের এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা করেছে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে অনেক মানবাধিকার সংস্থা। তারা তুলে ধরেছে মানুষের অসহায়ত্ব।প্রাদেশিক সরকারের হাতে স্থাপিত মানবাধিকার পরিষদ একটি কৌতুক মাত্র।

ইয়াওসাং উত্সবের সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৩ জন মানুষকে সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে হত্যা করে সামরিক কর্তৃপক্ষ একে এনকাউন্টার হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। এটা সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসের এক চরম উদাহরণ, এছাড়াও পাহাড়ে অসংখ্য মানুষকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে দিনের পর দিন। একসাথে ৬-৭ জন করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে পরিবার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে। কিছুদিন আগেই, জাম্খোলেত খন্গ্সাই এবং থাংজাম মনোরমা কে নির্যাতন ও ধর্ষণের পর হত্যা করেছে সামরিক বাহিনী।

সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারের এহেন কর্মকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে।

শেষে একটি কথাই বলতে চাই, সামরিক কালো আইনের হাতে মৃত্যুবরণ করার আগে আমি চাই পুরো পৃথিবী পরিস্থিতি সম্পর্কে জানুক। আমি মনে করি আত্মাহুতি দেয়া আমার জন্য সঠিক পথ এবং অনেক চিন্তাভাবনার পরে আমি ঠিক করেছি নিজেকে জলন্ত মশালে পরিণত করে আমি আমার প্রতিবাদ পুরো পৃথিবীর সামনে দেখিয়ে যাবো। আমার সহকর্মীবৃন্দ, আমার মা-বোন, বন্ধুরা, আমকে ভুল বুঝোনা।

আমার পিতা-মাতা যারা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি। এই জন্মে তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলামনা, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে কিছুটা হলেও তোমাদের ঋণশোধ করার চেষ্টা করবো। তোমরা আমার জন্য দুঃখ করোনা, কারণ আমার দেখানো প্রতিবাদের পথে হাজারো মানুষ এগিয়ে আসবে।

"সামরিক বাহিনী ফেরত যাও।
তোমাদের কালো আইন প্রত্যাহার করো।
ভারতীয় গণতন্ত্র শুধু মুখের কথা, কাজের নয়।
একতা আমাদের শক্তি।
একক নয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করো, শাস্তি নিঃশ্চিত করো যারা জাম্খোলেত খন্গ্সাই এবং থাংজাম মনোরমা কে হত্যা করেছে।"

আমার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য মনিপুর সরকার ও ভারত সরকার দায়ী।

-- পেবম চিত্তরঞ্জন মান্গাং"

পেবম চিত্তরঞ্জনের এই আত্মত্যাগ প্রদেশে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের সৃষ্টি করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে একসময় সরকার কিছুদিনের জন্য "আফসা" অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।

সারা পৃথিবীতে সরকার কর্তৃক নির্যাতনের চিত্রটা বহুলাংশে এক, সাধারণ জনগনের মতামতের তোয়াক্কা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন চলছে তথাকথিত গনতন্ত্রের নামে। আদতে গণতন্ত্রকে পুঁজি করে শাসকগোষ্ঠী নির্যাতনের একটি নতুন পথ তৈরী করে নিয়েছে মাত্র। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্যাতন-নিপীড়ন আর দুর্নীতির জোয়ার বইয়ে দেয়া এই সরকারগুলো সাধারণ মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিঃশ্চয়তা দিতে পর্যন্ত ব্যার্থ। এভাবেই অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদ করে গেছে, জীবন দিয়েছে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠির ক্ষমতার দম্ভ এখনও অটুট। হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন এই সব প্রতিবাদগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে চরম এক বিস্ফোরণের সূচনা করবে। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।

Wednesday, March 21, 2012

রবি দাদুর শান্তিনিকেতন


[প্রকৃতি এভাবেই মিলে মিশে আছে শান্তিনিকেতনের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে]


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "শান্তিনিকেতন" এর কথা মনে পড়লেই আমার মনে একটা ছবি ভেসে উঠতো, শান্ত-সবুজ উদ্যান, তাতে গাছের নিচে পাঠশালা, সাধা ধবধবে কাপড়ে শিক্ষক-ছাত্র, আত্মার বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে সকলে প্রকৃতির কোলে আপন আপন ছন্দ সৃষ্টিতে ব্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুটা নাটকীয় ধারণা হলেও জানিনা কি করে এধরনের ছবি মনে গেঁথে গিয়েছিলো অনেক আগে থেকেই, আমার ঘুরে বেড়ানোর জায়গাগুলোর মাঝে "শান্তিনিকেতন" একটি অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান হয়ে থাকলেও যাওয়ার সুযোগ কখনই সেভাবে হয়ে উঠেনি, কিন্তু এবার যখন আর দেরি করতে পারলামনা, বসন্ত উত্সবের ঠিক দিন কতক আগে ঘুরেই এলাম বোলপুরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত জ্ঞানের আশ্রম "শান্তিনিকেতন"।

অনেক দিন ধরেই যাবো যাবো করছিলাম, তার মাঝে বসন্ত উত্সব এর দিনটা ছিলো লোভনীয় একটা সময়। কিন্তু কোনভাবেই সময় মেলাতে পারছিলামনা, বসন্ত উত্সব মার্চের ৮ তারিখ কিন্তু আমাকে এর আগেই যেতে হবে, তাই অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠিক হলো মার্চের ২ তারিখ। ট্রেনে করে বোলপুর সেখান থেকে শান্তিনিকেতন এবং এর আশেপাশের জায়গা ঘুরে দেখার প্ল্যান হলো।

বোলপুর যখন পৌঁছালাম তখন মাত্র সকাল ৯ টা, এরই মাঝে প্রখর রোদ। স্টেশন থেকে বের হতেই রিক্সা নেয়ার জন্য ঘিরে ধরলো অনেকেই। বারবার বলতে লাগলো, শান্তিনিকেতন নিজেরাই ঘুরিয়ে দেখাবে রিক্সা করে, কিন্তু আমাদের নিজেদের হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখার ইচ্ছা| শান্তিনিকেতন, বোলপুর শহর থেকে কিছুটা দূরে। হাঁটা পথে যাওয়া যায়, কিন্তু এই গরমে সেটা অসম্ভব। তাই রিক্সা ঠিক করা হলো শান্তিনিকেতন এর গেট পর্যন্ত| রিক্সা চালকই আমাদের জানালো যে শান্তিনিকেতন এ দুপুর ১টা পর্যন্ত দর্শনার্থী সব জায়গায় যেতে দেয়া হয়না, ক্লাসের সময়সূচির জন্য। দুপুর ১টার পর থেকে দর্শনার্থীদের জন্য মোটামুটি সব জায়গা খোলা থাকে। আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম, এখনো দুপুর হতে অনেক দেরি, তার উপরে আমাদের ফিরতি ট্রেনের টিকেট সন্ধ্যার। চারিদিক দেখাতে দেখাতে রিক্সাচালক আমাদের নিয়ে গেলো শান্তিনিকেতনের গেটে। সেখান থেকে একটু ঘুরিয়ে আমাদের নিয়ে থামালো এক গ্যালারীতে। গ্যালারীর নাম "নীহারিকা"।

শিল্পী প্রফেসর সেলিম মুন্সীর নিজস্ব বাড়ি এবং গ্যালারী। আমরা গ্যালারী ঘুরে দেখতে লাগলাম, শিল্পীর ভাস্কর্য এবং নানা ধরনের চিত্রকর্ম। অসাধারণ সব কাজ, শান্তিনিকেতন এর উপরে করা অনেকগুলো কাজের প্রদর্শনী হচ্ছে, একই সাথে বেশ কিছু নান্দনিক ভাস্কর্য দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম শিল্পী নিজেই আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন, বেশ অমায়িক মানুষ। নিজেই ঘুরে দেখালেন সব, দেখালেন তার কয়েকটি ভাস্কর্য এবং ছবি যা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় শোভা পাচ্ছে, দেখালেন দেশ পত্রিকায় করা তার প্রচ্ছদও। বেশ কিছু ছবিও তোলা হলো শিল্পীর সাথে।

DSC_0010
[শিল্পী সেলিম মুন্সী এবং তার চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যের একাংশ]


এবার মূল শান্তিনিকেতন এ ঢোকার পালা, গ্যালারীর সামনের রাস্তা সোজা চলে গেছে শান্তিনিকেতন এর ভেতরে, আশেপাশে বেশ কয়েকজন শিল্পীর বাসস্থান।
গেট দিয়ে ঢুকে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম, চোখে পড়লো একটা অডিটরিয়াম। রাস্তার দুপাশেই বাগান করা আছে, তবে প্রথম দর্শনেই যেটা হতাশ হলাম তা হলো সবকিছু কেমন যেনো অযত্নে বেড়ে ওঠা। বাগানে স্পষ্টত পরিচর্যার অভাব, আশেপাশের জায়গাতেও সেটাই। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেই সামনে বিশাল মাঠ, এখানেই হয় বসন্ত উত্সব। আগে ভেতরের মাঠে হতো, এখন অগুনিত দর্শনার্থীর ভিড়ের কারণে বড় মাঠে আয়োজন করা হয়ে থাকে।


বিভিন্ন জায়গায় লেখা দেখলাম "অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা নিষেধ", কিন্তু আমাদের ক্যামেরা চলছে। তবে লক্ষ্য করলাম, ছাত্র-ছাত্রীর ভিড় নেই, জায়গা খালি খালি। বুঝতে পারলাম কোনো কারণে ক্লাস বন্ধ আছে আজকে।

DSC_0013
[বিশাল বট, রাস্তার পাশে যেখানে খোলা জায়গায় ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থাও আছে]


এরই মাঝে অনির্দিষ্টভাবে ঘুরতে ঘুরে পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত "ছাতিম তলায়"।

DSC_0033
[ছাতিম তলা উদ্যান]

এখানে দেখলাম বেশ গোছানো বাগান, চারিদিকে বড় গাছের ছায়ায় দারুন জায়গা। ক্যামেরা হাতে এদিক ওদিক ছবি তুলছি, হঠাৎ কোথা থেকে এক নাক উঁচু দিদিমণি এসে হাজির| আমাকে দেখেই উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, "এই যে শুনুন, আপনারা কি অনুমতি নিয়ে এসেছেন, ছবি তোলার জন্য??" আমি অবাক, কি হ্যাঁপা রে বাবা, গাছের ছবি তুলছি তারও আবার অনুমতি, কিন্তু ধারে কাছে তো কাওকে দেখছিওনা। এটা বলতেই, উনি জানালেন, আমাদের নাকি শান্তিনিকেতন থেকে বাইরে বেড়িয়ে প্রধান রাস্তার বিপরীত পাশে গিয়ে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে, শুনে আমি অনেকক্ষণ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে গেলাম ঠিকই কিন্তু কোনই ইচ্ছা নেই এতদূর আবার হেঁটে ফেরত যাওয়ার। দিদিমণি বেড়িয়ে যেতেই আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আবার ক্যামেরা চালানোর জন্য, তখন সহযাত্রী অর্ণব বলে উঠলো, পেছন থেকে আবার কে জানি সন্দেহের চোখে দেখছে।

DSC_0036
[ছাতিম তলা উদ্যানের প্রধান ফটক]


এবার অগ্যতা যেতেই হলো, রাস্তার দিকে এগোচ্ছি, এক গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম এই বিষয়ে, উনি তো দেখি হেসেই উড়িয়ে দিলেন, বললেন, কোনো অনুমতি লাগেনা, আর আজকে এভাবেও খেলাধুলার জন্য বন্ধ। আমার সাথে চলুন যেকোনো জায়গায় ছবি তোলা যাবে, একই সাথে উনার দক্ষিনাও জানিয়ে দিলেন ২০০ রুপী। ঝামেলা এড়াতে তাতেই রাজি আমরা। তবে গাইড মহাশয় আর যাই করুকনা কেনো বেশ ভালোভাবে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো পুরো শান্তিনিকেতন।


আবার শুরু করেছিলাম সেই ছাতিম তলা থেকেই, ছাতিম তলা চত্বরটি বছরে শুধুমাত্র দুটো বিশেষ দিনে খোলা হয়ে থাকে। সমাবর্তনের দিন যেদিন রাষ্ট্রপতি পরিদর্শন করেন আর পৌষ উত্সবের দিন। ছাতিম তলার সাথে রবি ঠাকুরের অনেক স্মৃতি জড়িত। এখান থেকেই তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন জায়গাটিকে জ্ঞানের আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যা কিনা এতো বছর ধরে ভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার পথিকৃত হয়ে আছে। সেখানের ইতিহাস শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলাম বাগানের জায়গায় যেখানে ক্লাস নেয়া হয়। গাছের নিচেই ছাত্র-ছাত্রীদের বসার ব্যাবস্থা করা আছে, একটু এগিয়ে যেতেই সামনে পড়ে "শান্তিনিকেতন ভবন"।

DSC_0052
[শান্তিনিকেতন ভবন, যা তৈরী করার সময় পাঁচটি ধর্মের রূপক ব্যবহার করা হয়েছিল]

বর্তমানে এই ভবনটি মিউজিয়ামে রুপান্তরিত করা হয়েছে, ভেতরে রবি ঠাকুর থাকার সময়কার বেশ কিছু জিনিসের প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করা আছে। এখানে সুদুর চীন থেকে আগত রবি ঠাকুরের একজন ছাত্রের ইতিহাসও জড়িত, যে কিনা বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিকে আপন করে নিয়েছিলো এখানে, সংরক্ষিত আছে সেই ছাত্রের ছবি ও কিছু চিঠি। ভবনটির ঠিক সামনে প্রবেশদ্বারের সামনে একটি ভাস্কর্য। প্রজ্বলিত শিখা হিসেবে ভাস্কর্যটি বানানো হয়েছে কিন্তু যখন রোদ পড়ে এর উপরে তখন ছায়াতে "মা ও শিশু" এর আকৃতি ফুটে ওঠে। দারুন একটা কাজ।

DSC_0044
[ভাস্কর্য, ছায়াতে ফুটে ওঠা মা ও শিশু]


এই ভবনের পিছন দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের বাম পাশে পড়ে "মেডিটেশন হল", সপ্তাহের একদিন সবাইকে ধ্যান করতে বসতে হয় এখানে, দর্শনার্থীরাও ইচ্ছা করলে ধ্যানে অংশ নিতে পারে। পোশাক সাদা হতে হবে, কেউ যদি রঙ্গিন পোশাক পড়ে না জেনে অংশও নেয় তাকে বাধা দেয়া হয়না, কিন্তু পরে তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া হয়। অন্যান্য দিন হলটি বন্ধ থাকে। এছাড়া ক্রিসমাসে, উত্সবের সন্ধ্যায় এই হলটিই ব্যবহার করা হয় সবার জন্য।

DSC_0049
[ধ্যানগৃহ]


সেখান থেকে খোলা অডিটরিয়াম হয়ে প্রধান ভবনের সামনের চত্বরে। খোলা মাঠের এদিকে শান্তিনিকেতন ভবনে ঢোকার মূল ফটক এর রাস্তা আর মাধবীলতার ঝাড় অন্যদিকে স্কুল ভবন। ভবনের সামনে বানানো বিশাল আকৃতির ঘন্টা।

DSC_0062

[শান্তিনিকেতন ভবন এর সামনে মূল রাস্তা থেকে]

DSC_0066

[সেই ঘন্টা]

DSC_0063

[বিদ্যালয় ভবন]


এগিয়ে গেলে সামনের দিকে লাইব্রেরী এবং খোলা অডিটরিয়াম। অধিকাংশ সময় এখানে নাটক কিংবা বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয় এই অডিটরিয়ামটি।

DSC_0071

[অডিটরিয়াম এর দেয়ালে শিল্পীর তৈরী ম্যুরাল, এতে রং হিসেবে ব্যবহার হয়েছে প্রাকৃতিক উপাদান]


এখান থেকে আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে যেতে থাকলাম, ছাত্রী হোস্টেল এর রাস্তা হয়ে এগিয়ে গেলে সামনের দিকে বেশ কিছু ভাস্কর্য। এরপরে ছাত্রদের থাকার কিছু ঘর। গাইডের কাছ থেকে জানলাম, এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম চলে, কিন্তু মাসিক বেতন খুবই অল্প, এমনকি কোনো শিক্ষার্থী যদি পরবর্তিতে দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার্থে যেতে আগ্রহী হয় তাহলে তার পড়ার সম্পূর্ণ খরচ বহন করে শান্তিনিকেতন।

DSC_0075

[ছাত্র হোস্টেল লাগোয়া ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের বিশাল ভাস্কর্য]

DSC_0082

[ছাত্রদের থাকার কিছু ঘর]

DSC_0084

[ডানায় মুখ লুকানো হাঁস]

দেখলাম এদিকের অংশে প্রস্তুতি চলছে বসন্ত উত্সবের, গীতিনাট্যের জন্য প্রস্তুত হতে দেখলাম শিক্ষার্থীদের। দেয়ালে করা কাজের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক যুগ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুন্দরভাবে| সামনে তৈরী করা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মুখায়ব এবং পেছনে দেয়ালে ম্যুরাল|

DSC_0089

[দেয়ালে শিল্পের মাধ্যমে প্রাচীন ইতিহাস]

DSC_0094

[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মুখায়বের ভাস্কর্য, পেছনে ম্যুরাল]

বেশ কিছু বড় ভাস্কর্য চোখে পড়লো, এর মাঝে লক্ষনীয় বিষয় এদের বানানোর প্রক্রিয়া। সম্পূর্ণ ভেতরের কাঠামো তৈরী করে তার উপরে মূল উপাদান হাতে ছুড়ে ছুড়ে ভাস্কর্যটির বাইরের মূল কাঠামো তৈরী করা হয়েছে।

DSC_0101

এছাড়াও আদিবাসীদের উপর করা কিছু কাজ চোখে পড়লো।

DSC_0097

[সাঁওতাল রমনী ও শিশু]

শান্তিনিকেতনে বাইরের ঘোরার অংশ বলতে এতটুকুই। এর পরে রবি ঠাকুরের জন্য তৈরী করা বাসস্থানগুলো যেগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। পুঃনশ্চ, কোনার্ক, উদীচী, শ্যামলী এবং উদয়ন এই পাঁচটি বাড়ি তিনি ব্যবহার করেছেন তার জীবদ্দশায়। এর মাঝে শ্যামলী সম্পূর্ণ মাটির ঘরের আদলে তৈরী, ছোট ছোট থাকার জায়গা। কোনার্ক নিয়ে রবি ঠাকুর অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছেন, বাড়িটি বেশ কয়েকবার ভেঙ্গে আবার নতুন করে বানানো হয়েছিল তার নিজের করা ডিজাইনে। বাকি বাড়িগুলো মোটামুটি একই রকম। তবে উদয়ন সব থেকে বড়, এর আসবাবপত্রে আছে প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যের ছাপ।

DSC_0121

[বাগানে নির্মিত ভাস্কর্য]

DSC_0104

[শ্রমিক]

DSC_0117

[সংরক্ষিত গাড়ি]

DSC_0129

[কোনার্ক]

DSC_0127

[উদয়ন]

DSC_0130

[উদয়ন সামনে থেকে]

ঘোরা শেষ হলো, একই সাথে আনন্দিত ও হতাশ। আনন্দিত এই কারণে যে, এখানে আসার স্বপ্ন পূরণ হলো, হতাশ নিজের তৈরী কাল্পনিক ছবির সাথে চরম পার্থক্য দেখে। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অংশটুকু যেটা পুরোটাই সংরক্ষিত সেটা ছাড়া বাকি জায়গাগুলোতে পরিচর্যার দারুন অভাব মনে হলো, কিছুটা খারাপ লাগলো এরকম অযত্নের ছাপ দেখে। ভেবেছিলাম আর একটু গোছানো হবে। সব থেকে ভালো লাগলো বড় করে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি, "এখানে আমার কাজের হিসেব কেউ নিতে আসেনি, কেউ প্রশ্ন করতে আসেনি, সামাজিক নিয়মের বাইরে থেকে এখানে আমি নিজের মতো থেকেছি" কিছুটা এরকম ছিলো। ভালো লাগলো স্বাধীনচেতা মুক্তমনের একজন মানুষের এই কীর্তি দেখে যা আজও অমর-অক্ষয়।

আপসোস থাকলো শান্তিনিকেতনের বসন্ত উত্সবে যোগ দিতে পারলামনা বলে, এই একটা দিন হাজারো রঙে সেজে ওঠে পুরো শান্তিনিকেতন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তবে ভবিষ্যতে একদিন আবার আসবো এখানে নিজেকে এই সান্তনা দিতে দিতেই বের হয়ে এলাম। পিছে রইলো কয়েক ঘন্টার অসাধারণ কিছু স্মৃতি আর মুঠোবন্ধি কিছু মুহূর্ত।

[কৃতজ্ঞতা : অর্ণব মুখার্জী ( যার ডাক নাম বাবুনী !!) , যে না থাকলে শান্তিনিকেতন ঘোরা হতোনা।]









Thursday, March 15, 2012

বগা লেক রহস্য : শেষ পর্ব



অন্ধকারের মধ্যেই কোনমতে টর্চের আলোতে পাথুড়ে ভাঙাচোড়া অজানা রাস্তায় দৌড়ে চলেছে রাদ, তার ঠিক পেছনেই শুভ্র| পেছন থেকে ওর টর্চের আলোতেই যা দেখা যাচ্ছে, নিজের হাতের টর্চটা অনেক আগেই পড়ে গেছে। চোখা পাথড় এ হঠাৎ পা হড়কে পড়লেও থামার উপায় নেই, পিছনেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে| মশালের কাঁপা-কাঁপা আলোয় দেখা যাচ্ছে দৌড়ে আসা মানুষগুলোকে। কতক্ষণ ধরে অনির্দিষ্ট ছুটে চলেছে আতংকে তার কোনো হিসেব নেই, শুভ্রর মনে হলো সামনের দিক থেকে গুমগুম একটা আবছা শব্দ ভেসে আসছে, চিত্কার করে সামনে দৌড়োতে থাকা রাদকে কিছু বলার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলোনা, তার আগেই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে রাদ|

রুদ্ধশ্বাস দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ রাদ বুঝতে পারলো, পিছনের টর্চের আলোটা নেই, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে জলের শব্দ, তারপরেই মনে হলো হঠাৎই পায়ের নিচের মাটি নেই হয়ে গেলো, শুন্যে ভেসে আছে সে, পতন ঠেকানোর জন্য হাত-পা ব্যবহার করার আগেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা আর সাথে সাথে মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো| গুহার এইদিকের পথটা আচানক শেষ হয়ে গিয়েছে আর সোজা চলে গেছে নিচের খাদে, জল পড়ার শব্দে মনে হলো বয়ে চলেছে কোনো নদী| প্রচন্ড গতিতে নিচের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়টুকুতে রাদ কিছু একটা ধরার ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকলো, প্রায় কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝপাস করে জলে পড়লো রাদ, পতনের জোরে অনেকটাই গভীরে চলে গেলো, হুশ করে সব দম বেড়িয়ে গেলো, চোখে অন্ধকার দেখলো| মনে হলো এই শেষ| স্রোতের টানে আবার ভেসে উঠলো উপরে, বা হাতটা শক্ত কিছুতে লেগে প্রায় অকেজো, কোনমতে দম নেওয়ার চেষ্টা করলো রাদ, অন্ধকারে ভেসে চললো। এর মাঝে কোনো শক্ত চোখা পাথড় এ লাগলেই আর বলতে হবেনা| ভাসতে ভাসতেই বুঝতে পারলো সামনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জলের শব্দ, মানে পথ শেষ!!!! নিজেকে অজানা পরিণতির জন্য প্রস্তুত করার আগেই নিজের অজান্তেই ধাক্কা লাগা থেকে বাঁচতে ডুব দিলো, শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা| এগোতে এগোতে মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে, বাতাসের জন্য আকুতি করছে ফুসফুস, ইচ্ছার কাছে প্রায় হার মানছে মনের জোর, ভালো করেই জানে এখন মুখ খুললেই গলগল করে ঢুকে পড়বে সব জল, ফুসফুস ভর্তি হয়ে ডুবে মরবে| অকেজোপ্রায় এক হাত নিয়ে কোনমতে ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে উপরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করতে থাকলো, কিন্তু ওপরে খোলা জায়গা নেই !!! ফুসফুসের ক্ষমতা প্রায় শেষ, হার মানছে মস্তিস্ক, বুঝতে পারলো রাদ, আর বেশিক্ষণ বন্ধ রাখতে পারবেনা নাক-মুখ, মাথার ভেতরে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছে| চোখ বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। শেষ পর্যন্ত হার মানলো শরীর, একই সাথে খুলে গেলো নাক আর মুখ, খালি ফুসফুস একসাথে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো সব বাতাস, জল ঢোকা শুরু করলো আর সে সময়ই ভুস করে ভেসে উঠলো রাদ নিজের অজান্তেই| ঠান্ডা বাতাস আর জল একসাথে ঢুকে পড়ায় দম বন্ধ হয়ে আসলো ওর, অজ্ঞান হতে খুব বেশি বাকি নেই| অবচেতন মনেই সামনে এগোনোর চেষ্টা করলো, জানেনা কোথায়-কোনদিকে যাচ্ছে| হঠাৎ হাতে লাগলো শক্ত কিছু, সেটাকে ভালো করে আকড়ে ধরার আগেই জ্ঞান হারালো। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগেই নাকে এলো খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ, ভেজা মাটির স্যাতস্যাতে গন্ধ !!



বিকেলের দিকে যখন বগা লেক পৌঁছলো প্রায় ৯ ঘন্টার যাত্রা শেষে তখন কারো আর কথা বলার অবস্থা নেই| সাথে সাথেই মাটিতে বসে হাফাতে শুরু করলো ওরা, অঙ্কুর আর জামিল মাটিতেই শুয়ে পড়লো। একটু ধাতস্ত হয়ে যখন উঠে দাড়ালো বুঝতে পারলো ওদের সামনেই দাড়িয়ে আছে সেনাবাহিনীর পোশাক পড়া দুজন| হাসিমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে সম্ভাষণ জানালো অফিসার, পরিচিত হলো সবাই, নাম ক্যাপ্টেন মাকসুদ আর রাফি| ওদের পৌঁছতে দেরি হচ্ছে দেখে খোঁজ নিতে তারা নেমে এসেছিলো নিচের গ্রামে| ওদের অবস্থা দেখে আর বেশিক্ষণ কথা বললোনা, ওদের ক্যাম্প ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলো| ঘর ঠিকঠাক করেই লেকের জলে স্নান করতে নামলো সবাই, দারুন সুন্দর লেক, পদ্ম আর শাপলা ফুটে আছে চারদিকে, জল বেশ উষ্ণ উষ্ণ। অঙ্কুর যখন
জামা খুললো ঠিক তার পেছনেই ছিলো রাদ, অঙ্কুরের পিঠের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিত্কার দিলো ও| অঙ্কুরের পিঠে তিনটা জোক রক্ত খেয়ে প্রায় ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হয়ে গিয়েছে, ভৌতিক দৃশ্য একটা| কোনমতে হাত দিয়ে জোকগুলো ছুড়ে ফেলতেই রক্ত পড়তে থাকলো অঙ্কুরের পিঠ থেকে, এই নিয়েই স্নান করে এলো সবাই, প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়লো অঙ্কুরের পিঠ থেকে| ক্লান্তিতে অবশ শরীর, খাবার এর পড়ে শুয়ে পড়লো সবাই, সন্ধার দিকে ওদের সবাইকে নিয়ে বসলো শুভ্র তার আসল প্ল্যান জানাতে| স্বাভাবিকভাবেই প্ল্যান শোনার পড়ে জামিল আর অঙ্কুরের চেহারা দেখার মতো হলো, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রাদ আর শুভ্রের দিকে তাকাতে থাকলো দুজনেই| রাদ মাথা নাড়লো, শুভ্র বললো, "যেভাবেই হোক যেতে হবে ঐ আদিবাসীদের গ্রামে, আমি খোঁজ নিয়েছি এখানকার লোকেদের থেকে, খুব একটা দুরে নয় কিন্তু পথ দুর্গম, ঐদিকের লোকেরা জিনিসপত্র কিনতে মাঝে মাঝে এই গ্রামে আসে, তবে ওদিকের কেউই খুব একটা মিশুকে নয়, এখানকার লোকেরাও ওদিকে খুব একটা যায়না| তবে ঐ গ্রামে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর অনুমতি পাওয়া যাবেনা মনে হয়| আর গাইড নিজেও যেতে রাজি হবেনা, কোনো ভাবে এদিকের কোনো আদিবাসীকে টাকা দিয়ে রাজি করাতে হবে কালকে, যে করেই হোক অন্ধকারেই এই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে হবে যাতে কেউ না দেখে|" রাতের বেলা খাবার পরে শুভ্র ঘুরে আসার কথা বলে বেড়িয়ে গেলো, এদিকে বাকি তিনজন নিজেরা এই প্ল্যানের দুঃসাহসিকতা আলোচনা করতে শুরু করলো, ভালো করেই জানে, ওরা না গেলেও একাই হয়তো চলে যাবে শুভ্র| অঙ্কুর বললো, "এতটা দূর যখন পাগলামী করতে করতে চলেই এলাম, তখন না দেখেই বা যাই কেনো??" জামিল বললো,"হুমম, ঠিক, দেখাই যাক কি হয় শেষমেষ, হয়তো কিছুই হবেনা, বেকার পরিশ্রম হবে|" রাদ ভাবলো শেষমেষ কিছু না হলেই ভালো হয়| ঘন্টাখানেক পড়ে ফিরে এলো শুভ্র, এসে জানালো, এক মাতালকে রাজি করিয়েছে টাকার লোভ দেখিয়ে| তবে সেই লোক শুধু ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু ওদের সাথে ঐ গ্রামে থাকবেনা, তবে এটাও নাকি জানিয়েছে, ঐ আদিবাসীরা নরখাদক নয় এটা সে নিঃশ্চিত। নরখাদক এর ব্যাপারটা মূল আলোচনায় এড়িয়ে গিয়েছিলো তখন শুভ্র, এখন সেটা বলতেই জামিল আর অঙ্কুর বুঝতে পারলো, না জেনেশুনেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ওরা| আতংকিত হলো কিছুটা হলেও|



পরের দিনটা গ্রাম আর আর্মি ক্যাম্প ঘুরে কাটালো, বেশ গল্প হলো ক্যাম্পের সেনাদের সাথে, এরাও বাইরের মানুষ পেয়ে বেশ খুশিই হলো| দুর্গম জায়গাগুলোতে ডিউটি দিতে হয় রাতের অন্ধকারেও, টহলদল এই পথেও ঘুরে আসে রাতের বেলা, শুনেই অবাক হলো ওরা| দুপুরের মাঝেই ঠিক হলো, সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই বের হবে ওরা আর তাদের সাহায্যকারী| ব্যাগ থেকে দরকারী জিনিসপত্র আলাদা করে বাকিগুলো সরিয়ে রাখলো সবাই, শুভ্র বের করলো দুইটা বেশ শক্তিশালী টর্চ, সাথে আরও কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনিস| সব গুছিয়ে রেখে ওরা অপেক্ষা করতে থাকলো আসল সময়ের, অঙ্কুর এই পরিস্থিতিতেও বেশ ভালোই মাথা ঠান্ডা রেখেছে| সন্ধ্যা এগিয়ে আসতেই চারজনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো, ঐ লোক ঘরে আসতেই বের হলো চারজন| প্রথমদিকে পথ বেশ ভালোই, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো জঙ্গল| কাটা গাছের ঝোপ, বড় বড় লতা, কখনো লম্বা ঝুলে পড়া শাখা এর মধ্য দিয়েই টর্চের আলোতে কোনমতে এগিয়ে চললো ওরা| ওদের সাহায্যকারী হাতে বানানো মশালের আলোতে আগে আগে চলেছে, বোঝা গেলো সে এখনো মাতাল হয়েই আছে| ঘন্টা দুয়েক বিরামহীন চলার পরেই ওদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে আর সামনে যেতে রাজি হলোনা সে| এবার ওদের নিজেদের পালা, সোজাসুজি আরও আধ ঘন্টা প্রায় চলার পড়েই রাস্তা কিছুটা মসৃন হলো, বোঝা গেলো পায়ে চলা রাস্তা| ওরা যখন আদিবাসী গ্রামে ঢুকলো ওদের দেখে অবাক হয়ে গেলো সেখানের সবাই, ছোটখাটো ভিড় তৈরী হয়ে গেলো সহজেই| হঠাৎ পাওয়া এই জনপ্রিয়তায় বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলো চারজনেই|


ভিড়ের মাঝেই এগিয়ে এলো বেশ বয়স্ক একজন, সবাই জায়গা করে দিলো তাকে, বোঝা গেলো গ্রামের কোনো কর্তা| ওদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় স্বাগত জানিয়ে এদিকে আসার কারণ জানতে চাইলো, শুভ্র কোনমতে বোঝাতে পারলো, ওরা জঙ্গলে ঘুরতে এসেছে, এদিকটায় কখনো কেউ আসে কিনা জানেনা, তাই ওরা চাইছে ওদের এই গ্রামটাও ঘুরে যেতে| হাসি মুখেই ওদের নিয়ে এগিয়ে গেলো সেই ব্যাক্তি| পরিচয় দিলো নিজেকে গ্রামের পূজারী হিসেবে| ওদেরকে একটা ছোট থাকার ঘর দেখিয়ে রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করতে বেড়িয়ে গেলো সে| এবার ফুসরত মিললো চার জনের কথা বলার, রাদ বললো, "যদি উনিই পুজারী হয় তাহলে মন্দিরের কথা একে জিগ্গেস করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখিনা, আর আমাদের কাছে মন্দিরে যাওয়ার কোনো রাস্তা তো জানা নেই|" তার কথায় সায় দিলো বাকিরা| চিন্তিত মুখে কিছু একটা ভাবতে থাকলো শুভ্র| এদিকে রাতের খাবারের পর গ্রামের কয়েক জনের সাথে পরিচিত হলো ওরা, বাচ্চাদের দিলো নিয়ে আসা চকলেট| বেশ ভালো ভাবেই ওদের গ্রহণ করেছে আদিবাসীরা দেখে খুশি হলো রাদ একরকম| শুতে যাবার আগে পূজারীকে যখন মন্দিরের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে জিগ্গেস করলো তখন সে জানালো কালকেই কোনো একটা উত্সব আছে তাদের, বিকেলে মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে সবাইকে তখনি|


পরের দিন সকালটা গ্রামের এদিক ওদিক আর জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে সময় গেলো, তবে ওদের সাথে সবসময়ই কোননা কোনো ব্যাক্তি ছিল গ্রামের| বলতে গেলে, ওরা নিজেরাই বুঝতে পারলো নজর রেখেছে ওদের ওপরে আদিবাসীরা| দুপুরে খাবারের পরে পূজারী এসে ওদের মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার কথা বললো, খুশি হয়েই রাজি হলো ওরা| যখন কিছুটা হেঁটে জঙ্গলের ভেতরে একটা জায়গায় ওদের মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গেলো পূজারী, বুঝতে পারলো জায়গাটা বেশ পুরনো| কিন্তু শুভ্র ফিসফিস করে রাদের কানের কাছে বললো, "এটা এতটাও পুরনো লাগছেনা, মনে হচ্ছে কিছু একটা গন্ডগোল আছে|" মন্দিরের বিগ্রহ যখন দেখাতে নিয়ে গেলো ওদের, তখন ওরা সেটা দেখে বেশ অবাক হলো| অদ্ভুত একটা মূর্তি, আধা সিংহ-আধা মানুষ, বসে আছে একটা বেদীতে। এগিয়ে বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলো ওরা, ঘুরে ফিরে দেখে বুঝতে পারলো, কাঠ খোদাই করে বানানো মূর্তি, বেশ পুরনো দেখলেই বোঝা যায়| ভারী কাঠ কালো হয়ে আছে, তাতে নানা রকম রং লেগে আছে, তবে যেই জিনিসটা ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেটা হলো সিংহ-মানবের বুকে খোদাই করা একটা ঢালের প্রতীক, যাতে আরও কিছু প্রতীক চিহ্ন আছে| মন্দির দেখা শেষে ওদের ঘরে পৌঁছে দিলো পূজারী, সন্ধ্যায় উত্সবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলো|


এইবার মুখ খুললো অঙ্কুর, বললো, "জানতাম প্রাচীন মিশরে এধরনের আধা পশু আধা মানুষের মূর্তি বা প্রতীকের চল ছিলো কিন্তু এখানে সেটা কি করে এলো, আর আধা সিংহ-আধা মানুষ এরকম অদ্ভুত কোনো মূর্তি তো আমার চোখে পড়েনি কোনো ইতিহাস বইতেই|" জামিলও সম্মতি জানালো, রাদ প্রশ্ন করলো শুভ্রকে, " দেখ যে করেই হোক তোর কথা অনুযায়ী তো মনে হয়না এটা সেই মন্দির, নাহলে পূজারী এতো সহজে বিগ্রহ দেখানোর জন্য নিয়ে যেতোনা, আর যদি এটাই সেই মন্দির হয় তাহলে এতে কোনো দামি কিছুই নেই, তাই আসাটাই বৃথা, আর সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো এর বিগ্রহ| কি করে এরকম অদ্ভুত আকৃতির বিগ্রহ এলো?? এর পেছনে কারনটাই কি??" শুভ্র বললো, "দেখ, এতটুক বলা যাচ্ছে যে, এটা সেই মন্দির নয়, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিনা সিংহ-মানবের বিগ্রহ কি হিসেবে এলো, এই অঞ্চলে কখনো সিংহ ছিলো বলে তো জানা নেই, তাই এদের সংস্কৃতিতে সিংহ প্রতীকের প্রচলন থাকার কথা না, তাও একদম বিগ্রহ বানানোর মতো| যদি শক্তিশালী কোনো কিছুর প্রতীক বিবেচনায় আসে তাহলে অন্তত বাঘের মাথা হলেও মানতে পারতাম, এখানেই খটকা লাগছে, আর একটা জিনিস বুকে খোদাই করা ঐ ঢাল কোনভাবেই মেলানো যাচ্ছে না।" নানারকমের প্রশ্ন আর না পাওয়া জবাব নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলো সবাই, অদ্ভুত নিরবতা ঘরের মাঝে। অনেকক্ষণ পড়ে যখন সময়ের দিকে ধ্যান নেই কারো, শুভ্র বলে উঠলো, "হ্যাঁ, খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে সব এখন।" চমকে উঠে বাকি তিনজন ঘুরে তাকালো ওর দিকে|


শুভ্র ওর পুরনো সেই ডায়রির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, "লিয়ান্দ্র কার্ভালহো ছিলো ক্ষমতা প্রিয় মানুষ, প্রচন্ড ক্ষমতাধর ব্যাক্তি হতে চেয়েছিলেন, আর এখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের বিগ্রহের সমাধান।" কিছু না বুঝেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো বাকিরা, শুভ্র বলতে থাকলো, " যেহেতু ওর নাম লিয়ান্দ্র, এর অর্থ জানা দরকার ছিলো আমাদের, এই ডায়রিতেই এক জায়গায় উল্লেখ আছে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো এর দাপটের জন্য ওর সঙ্গীসাথীরা ওকে সিংহ-পুরুষ বলতো, আর এক জায়গায় লেখা আছে "লিয়ান্দ্র" এর মানে পর্তুগিজ ভাষায় "সিংহমানব", এখানেই মিলে যাচ্ছে সব, মন্দিরে যে বিগ্রহ আমরা দেখলাম তা অবশ্যই লিয়ান্দ্র কার্ভালহো এর রূপক, একারণেই আধা সিংহ-আধা মানুষের মূর্তি, সিংহ-মানব|" চোখ চকচক করছে শুভ্রর, প্রশ্ন করলো জামিল, "কিন্তু ঢাল??" শুভ্র বললো, "এটাও মিলছে, পর্তুগিজদের পতাকা বা জাহাজে ঢালের চিহ্ন ব্যবহার হয়, তাই লিয়ান্দ্র কার্ভালহো অবশ্যই তার পরিচয় এর স্মারক হিসেবে এই প্রতীকই খোদাই করতে চাইবে, শুধু তাই নয়, ঢালের ভেতরে যে চিহ্নগুলো খোদাই করা ছিলো সেটা আর কিছুই নয়, পর্তুগিজ ভাষায় ৬০০ !!" অঙ্কুর অবাক হয়ে বললো, "৬০০ !!" "হ্যাঁ, ৬০০, আর এটাই হচ্ছে আরাকান রাজার আক্রমনে সেসময়ে নিহত পর্তুগিজ বাসিন্দাদের সংখ্যা", বললো রাদ| ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে সম্মতি জানালো শুভ্র| "কিন্তু পর্তুগিজ সংখ্যা সম্পর্কে কি করে নিঃশ্চিত হওয়া যাচ্ছে??" বললো জামিল| ওর দিকে ডায়রি এগিয়ে দিলো শুভ্র, এগিয়ে গিয়ে বাকি দুজন দেখতে পেলো, এক পাতায় জ্বলজ্বল করছে পর্তুগিজ সংখ্যা গণনার দশটি চিহ্ন| বুঝতে পারলো ডায়রির লেখক প্রায় সব ধরনের ইতিহাসই ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করেছেন এমনকি প্রাচীন পর্তুগিজ সংখ্যা প্রতীক পর্যন্ত| "নিজের দেশের লোকেদের স্মরণ ঠিকই করে রেখে গেছে লিয়ান্দ্র কার্ভালহো, আর এতগুলো মিল কাকতালীয় হতে পারেনা, তার মানে আসল মন্দির লোকচক্ষুর আড়ালে যা আমাদের নিজেদের খুঁজে বের করতে হবে সুযোগ মতো|" -বললো শুভ্র|


সন্ধ্যায় আদিবাসীদের উত্সবে যোগ দিলো ওরা, ওদের ভাষার গান আর নাচে বেশ ভালোই সময় কাটলো, পূজারী দলবল নিয়ে মন্দিরে চলে গেলেন, ওরা রাতের খাবার খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলো ঘরে| কথা বলতে বলতে কখন চোখ লেগে গিয়েছিলো জানেনা রাদ, ধাক্কায় জেগে উঠলো, ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে সাথে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো শুভ্র, ঘর থেকে ধীরে ধীরে বের হতেই শুভ্র রাদ কে বললো, "আমি চোখ রেখেছিলাম পূজারীর উপর, তোরা ঘুমিয়ে পড়ার পড়ে আমি লুকিয়ে ওর ঘরের উপর নজর রাখি, গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পড়ে দেখি পূজারী আর সাথে কিছু লোক নিঃশব্দে কোথায় জানি চলেছে, বুঝতে পারলাম কোনো গোপন জায়গায়, ওদের পিছু নিতে হবে জলদি চল|" দুজনেই বেশ কিছুটা দূর থেকে আদিবাসীদের সেই দলটাকে অনুসরণ করে চললো, টর্চ ব্যবহার করার ঝুঁকি নিচ্ছেনা, কোনমতে সামনে এগিয়ে যাওয়া দলটার রাস্তা ধরেই চলার চেষ্টা করছে, অনেকটা চলার পরে সামনে থেকে ভেসে এলো জলের শব্দ| বুঝতে পারলো কোনো ঝর্নার সামনে আছে ওরা, কিন্তু সামনে যেতেই দেখলো যেনো জাদুবলে সামনের আদিবাসীদের দলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে| অবাক হয়ে বোকার মতো পথরোধ করে দাড়িয়ে থাকা ঝর্নার দিকে চেয়ে রইলো ওরা, সামনে রাস্তাও দেখা যাচ্ছেনা কোনো। এবার ওকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র এগিয়ে গেলো ঝর্নার দিকে, পিচ্ছিল পথে সাবধানে পিছে গেলো রাদ, কিছুক্ষণ ভেবে ঝর্নার জলের মধ্যেই ঢুকে গেলো শুভ্র ওকে অনুসরণ করে নিজেও ঢুকে পড়লো, ভাবছিলো এই পাথুড়ে দেয়ালে ধাক্কা লাগে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো, পৌঁছে গেছে ঝর্নার পেছনে, সামনে একটা গুহার রাস্তা দেখা যাচ্ছে যা ঝর্নার জলে আড়াল হয়ে ছিলো পুরোটাই, বাইরে থেকে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই !!


নিঃশব্দে এগিয়ে চললো ওরা দুজন সামনে থেকে কথার আওয়াজ আসছে, কিছুটা আন্দাজে এগিয়ে যেতেই পাথড়ের আড়াল থেকে দেখতে পেলো সামনে একটা প্রশস্ত জায়গা ঘিরে দাড়িয়ে আছে আদিবাসীরা, মাঝখানে পূজারী, ওদের দিকে পেছন ফিরে আছে| আর চোখে পড়লো সেই সিংহ-মানবের বিগ্রহ| কিন্তু আগেরটার চাইতে অনেক অনেক বড় আর আবছা অন্ধকারে জ্বলন্ত মশালের আলোতে এটাও বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে এই বিগ্রহ কাঠের নয়| এবার আর সন্দেহ রইলোনা ওদের দুজনের, বুঝতে পারলো এটাই সেই আসল মন্দির, রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগলো আদিবাসীদের বিচিত্র প্রথা, একই সাথে চোখ ঘুরতে লাগলো চারিদিকে, পুরো জায়গাটায় উপরে উঠে গেছে পাথড়ের দেয়াল, সামনে আরও কিছু গুহার রাস্তা দেখা যাচ্ছে, ওদের পাশেও একটা প্রশস্ত গুহামুখ দেখতে পেলো| শুভ্র ইশারায় রাদকে নির্দেশ করলো বিগ্রহের বেদীর দিকে, রাদ কিছুক্ষণ তাকিয়েই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা, সাধারণ বেদীর মতো নয় এটা, কিছুটা বর্গাকৃতির সিন্দুকের মতো, ঠিক সামনেই খোদাই করা একটা চিহ্ন, সেই ঢাল!! ভালো করে দেখতে যেতেই হঠাৎ পা হড়কে গেলো, পাথড় গড়ানোর শব্দটা মনে হলো ডিনামাইটের মতো, একসাথে সবগুলো আদিবাসী মানুষের চোখ ঘুরে গেলো ওদের দিকে, রাদ বুঝতে পারলো শরীরের ভর বদল করতে গিয়ে কি বোকামিটাই না করেছে আলগা পাথরে চাপ দিয়ে| সাথে সাথেই দৌড়ে আসতে শুরু করলো আদিবাসীরা ওদের দিকে, কিছু না চিন্তা করেই শুভ্র টান দিলো রাদকে, টাল সামলাতে না পেড়ে হাত থেকে টর্চটা খসে পড়লো রাদ এর, শুভ্রের সাথে সাথে দৌড় দিলো, বুঝতে পারলো ঢুকে পড়েছে পাশের গুহার ভেতরে|



শুভ্র টর্চ জ্বলিয়ে প্রানপনে দৌড়ে চললো, সাথে রাদ, পথ আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে, ঢালু পথে পা পিছলে পড়লো কয়েকবার, কিন্তু থামার উপায় নেই, পেছনে তেড়ে আসছে ক্রুদ্ধ আদিবাসীরা| ধরতে পারলে কি করবে কে জানে, অজানা পথেই দৌড়ে চললো দুজনে, রাদ অনেকটা এগিয়ে গেছে শুভ্রের থেকে| শুভ্র দেখতে পেলো, রাদকে এখন আর টর্চের আলোতে দেখা যাচ্ছেনা শুধু পায়ের আওয়াজ আসছে, এরই মাঝে গুমগুম শব্দ প্রতিধ্বনিত হতেই মাথায় এলো কথাটা, বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী !!! রাদকে সাবধান করতে যাওয়ার আগেই শুনলো চিত্কার আর তারপর সামনে থেকে আসা পায়ের আওয়াজটা হারিয়ে গেলো, টর্চের আবছা আলোতে যা দেখলো তাতে মাথা খারাপ হয়ে গেলো শুভ্রর, যা ভেবেছিলো তাই, সামনে শেষ হয়ে গেছে গুহা চলে গেছে সোজা নিচে বয়ে চলা নদীর দিকে, কিছু ভাবতে পারলোনা এইমুহুর্তে, সামনে রাদ পড়ে গেলো নদীতে আর পেছনে ধেয়ে আসছে আদিবাসীরা, চোখ বন্ধ করে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো নিচে, জানে শক্ত পাথড় এ পড়লে নিঃশ্চিত মৃত্যু|


হাতের টর্চটা কাছ ছাড়া করলোনা শুভ্র ধরে রাখলো শক্ত করে, পতন কোনো বিপদ ছাড়াই হয়েছে, স্রোতের টানে কোথায় ভেসে চলেছে জানেনা, উপরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো মশালের আলো ধার থেকে| সামনে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো রাদকে, দেখলো পাথুড়ে দেয়াল এগিয়ে আসছে, দম নিয়েই ডুব দিলো, ডুব সাঁতারে এগিয়ে চললো সামনে, শেষ পর্যন্ত যখন ওপরে ভেসে উঠলো তখন বুঝতে পারলোনা কোথায় এসে পৌঁছলো, সামনে শব্দ শুনে তাকালো। দেখলো একটা ছায়া এগিয়ে যাচ্ছে, বুঝলো রাদ, পিছু নিলো, সামনেই ঘোলাটে একটা রেখা দেখতে পেলো, বুঝলো পাথড়। এগিয়ে কোনমতে উঠে এলো পাড় এ, জ্ঞান না হারালে রাদ দেখতে পেত ওর প্রায় সাথে সাথেই তীরে উঠে এসেছে শুভ্রও। রাদকে টেনে তুলে এগিয়ে যেতে থাকলো শুভ্র, জানে যেভাবেই হোক পৌঁছতে হবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে, সাহায্য দরকার, কারণ ঐ গ্রামে এখনো রয়ে গেছে অঙ্কুর আর জামিল, ঘুমের মধ্যে ওরা জানেও না কি ঘটে গেছে|


এদিকে রাদ আর শুভ্রকে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হতে লক্ষ্য করেছিলো জামিল, সে নিজেও একটু পরে ওদের পিছু নিয়েছিলো, আদিবাসীদের দলটা যখন গুহার মধ্যে শুভ্র আর রাদ এর দিকে ধাওয়া করে এলো তখন অন্ধকার এর সুযোগে দেয়ালের সাথে সেঁটে গিয়েছিলো সে, যখন বুঝলো যে করেই হোক বের হতে হবে এখান থেকে ঘুরে দাড়াতেই চমকে উঠলো সে, সামনেই ওর দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে পূজারী|


ওরা তিনজন ঘর থেকে বের হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পড়ে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো অঙ্কুরের, দেখলো কেউ নেই আশেপাশে| ঘর থেকে বের হতে যাওয়ার আগেই কানে এলো হইচই এর শব্দ, সাবধানে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিতেই দেখলো জামিলকে ঘিরে ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছে আদিবাসীদের একটা দল, আর অসহায়ভাবে ঘরের দিকে তাকাচ্ছে জামিল| দরজা বন্ধ করে দুঃসাহসিক একটা সিদ্বান্ত নিলো অঙ্কুর, জানেনা কি ঘটেছে, তবে অনুমান করতে কষ্ট হলোনা| যে করেই হোক পালাতে হবে, ব্যাগ থেকে বের করলো ছোট্ট অল্প পাওয়ারের একটা টর্চ, পেছনের খোলা জানালা দিয়ে টপকে বাইরে এলো, নিঃশব্দে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো গ্রাম থেকে, এগিয়ে চললো বগা লেকের আদিবাসীদের গ্রামের দিকে| সাহায্য আনতে হলে এখন এটাই ভরসা| প্রায় অনুমানের উপর ভরসা করে এগিয়ে চললো অঙ্কুর, জানে ওর উপর নির্ভর করছে বাকিদের ভাগ্য|


কোনমতে রাদকে টানতে টানতে শুভ্র এগিয়ে চললো, দেখলো সামনেই টিমটিম করে জ্বলছে আলো, পৌঁছতেই মনে হলো জায়গাটা পূর্বপরিচিত| সময় নেই, তাই প্রায় চিত্কার করে উঠলো, কয়েকটা ঘরের দরজা খুলে গেলো সাথে সাথেই, ওকে দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে এলো গাইড জাহিদ| তার থেকেও বেশি অবাক হলো শুভ্র ওকে দেখে| সংক্ষেপে ঘটনা বলে শেষ করার আগেই দেখলো ক্যাম্প থেকে নেমে এসেছে ক্যাপ্টেন মাকসুদ আর রাফি সাথে আরও কিছু সাথী নিয়ে| ওদের কে ঘটনা জানাতেই ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলো বাকিদের তৈরী হতে, সার্চ পার্টি যাবে এখনি, ওয়ারলেস এ বার্তা চলে গেলো রুমা বাজারের ক্যাম্পে| রাদকে একটা ঘরে শুইয়ে দিলো ওরা, ওর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চললো, এদিকে প্রায় জনা বিশেক সৈন্য তৈরী, শুভ্র আর গাইড এগিয়ে চললো ওদের সাথে, দ্রুত পৌঁছতে হবে ওখানে| কিছুটা এগিয়ে যেতেই সরসর শব্দ কানে এলো, পজিশন নিলো সৈন্যরা, দেখলো টিমটিমে একটা আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে কেউ একজন, শক্তিশালী টর্চের আলো পড়তেই দেখা গেলো অঙ্কুরকে| ওর থেকে অবস্থা জেনেই প্রায় দৌড়ে চললো সবাই, গ্রামে পৌঁছতেই দেখলো, একটা খুঁটির সাথে বাঁধা রয়েছে জামিল আর তাকে ঘিরে উত্তেজিত আদিবাসীরা বিচিত্র ভাষায় তর্ক করে চলেছে| অস্র হাতে সুসজ্জিত সৈনিকদের দেখেই কিছুটা পিছিয়ে গেলো সবাই, এগিয়ে গেলো আদিবাসী গাইড আর ক্যাপ্টেন| শুরু হলো তর্ক ওদের সাথে|


শেষপর্যন্ত বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই ফিরে এসেছিলো ওরা চারজন, তবে ওদের খুঁজে পাওয়া প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বেশ ভালোই সাড়া জাগিয়েছে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনায়| জামিলকে উদ্ধার করেছিলো ওরা অক্ষত ভাবেই, তারপরে গ্রামে ফিরে দেখেছিলো রাদ এর জ্ঞান ফিরেছে, সেনাবাহিনীর ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী বা-হাতের ফ্র্যাকচার আর শক থেকে সেরে উঠতে ভালোই সময় লাগবে। ওদের তথ্য অনুযায়ী পরেরদিনই সংবাদ যায় ঢাকাতে উচ্চ পর্যায়ে, সেখান থেকে ছুটে আসেন গবেষকরা। শুভ্র ওদের সাহায্য করতে থেকে যায় আরও কিছু দিন বগা লেকে| ফেরত আসে বাকি তিনজন, ওদের পৌঁছে দেয় সেনাবাহিনীর মেডিকেল হেলিকপ্টার| পরে সপ্তাহখানেক পরে ঢাকায় পৌঁছে শুভ্র, ওর মুখ থেকেই বাকিটুকু শোনে ওরা| এদিকে ওদের সব বাসাতেই এই ঘটনার খবর বিশদ ভাবে পৌঁছে গেছে, পরিবারের সদস্যদের কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছেনা এতো কিছু| পত্রিকার পাতায়ও বেশ বড় করে খবর ছেপেছে ওদের সবার ছবি সহ।



শুভ্র জানায়, ঐ আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার পরে চুক্তি হয়যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কিংবা গবেষনায় তাদের কোনো ক্ষতি বা মন্দিরের কোনো ক্ষতি হবেনা, আর সে অনুযায়ী ওরা প্রাচীন সেই মন্দির ভালোভাবে খোঁজার সুযোগ পায়| অনুসন্ধানকারী দলের সাথে ছিলো শুভ্র, তার দেয়া ডায়রির তথ্য এর সাহায্যে আর খনন করে উদ্ধার করা হয় প্রাচীন পর্তুগিজ আমলের নানা জিনিসের ধ্বংসাবশেষ। এতটুক তথ্য জানিয়ে থামে শুভ্র, ওরা প্রায় হল্লা করে বলে উঠে তাহলে দামি ধাতু বা রত্নের কি হলো?? শুনে হাসে শুভ্র, তারপর শুরু করে, "যেই বিগ্রহটা ঐ গুহায় ছিলো সেটা ছিলো সম্পূর্ণ সোনার তৈরী, ধারণা করা হচ্ছে, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো তার নিয়ে আসা জিনিসপত্রর অল্প কিছু দিয়ে আদিবাসীদের হাত করার পরে লুকিয়ে রাখা সোনার পুরোটাই গলিয়ে এই মূর্তি বানায়, আর সিংহের চোখ এবং নখ গুলো ছিলো সব দামি পাথড়ের, এছাড়াও যে বেদীতে সেটি দাড়িয়ে ছিলো সেটা আসলে একটা চৌকো সিন্দুক, খননের সময় বেদীটা সরানো হয়, আর তার ভেতরে মেলে আরও দামি কিছু জিনিস, যেমন ধাতুর তৈরী কিছু সীলমোহর, স্মারক, ছুরি ইত্যাদি ইত্যাদি| আর সিংহের বুকের ঐ ঢালের প্রতীকেও খোদাই করা ছিলো পাথড় !!! এখনো খনন চলছে, আশা করা হচ্ছে আরও মূল্যবান জিনিস আর তথ্য আবিষ্কৃত হবে যা কিনা ইতিহাস বদলে দিবে এই অঞ্চলের|।" "তাহলে আদিবাসীরা বংশানুক্রমে সিংহ-মানব ওরফে লিয়ান্দ্র কার্ভালহোকেই সেবা করে এসেছে", বলেই হাসতে থাকে বাকিরা| "কিন্তু তোরা দুজনে সোজা বগালেকে কি করে পৌঁছে গেলি গুহা থেকে নদীতে পড়ে??"- প্রশ্ন করলো জামিল| "আসলে গভীরে কোনভাবে গুপ্তপথে, বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর সাথে যোগ আছে বগা লেকের, আর সেই পথেই আমরা ডুবে ডুবে চলে আসি লেকের অংশে, তারপরের ঘটনাতো জানিস সবাই|"- বললো রাদ।

"বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র থেকে আমাদের চারজনকেই বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে খননকার্য দেখে আসার জন্য, যাবি নাকি??", বলে উঠে শুভ্র| একে অন্যের দিকে চেয়ে একসাথে মাথা নেড়ে না করে দেয় বাকি তিনজন| "যখন সব জিনিস মিউজিয়াম এ প্রদর্শনীর জন্য আসবে তখন না হয় দেখে আসা যাবে, কিন্তু ঐ জঙ্গলে কোনভাবেই আর একবার নয়", বললো জামিল| হাসতে থাকে শুভ্র ওদের কথা শুনে|


পরিশিষ্ট :

কয়েকমাস পরে একটা ভারী পার্সেল পায় রাদ নিজের ঠিকানায়, সাথে একটা চিঠি, পার্সেলটা খোলার পরেই দেখে পুরনো কাঠের একটা বাক্স, তাতে কারুকাজ করা| খোলার পরেই মুখ হা হয়ে যায়, ভেতরে শুয়ে আছে, ধাতুর বাঁটের কারুকার্যময় একটা বিচিত্র দর্শনের ছুরি| ছুরির বাঁটে আধাসিংহ-আধামানুষের অলঙ্করণ খোদাই করা, সাথে সাথে চিঠিটা খোলে রাদ, তাতে বড় বড় করে লেখা-

"যে ডাইভখানা তুই মেরেছিলি, আর যে পরিমান নাকানিচুবানি খেয়েছিলি, সে হিসেবে এই স্মারকটা তোরই প্রাপ্য, বগালেকের গভীরে গুপ্তপথের প্রথম যাত্রী, হাজার হলেও সিংহমানব লিয়ান্দ্র কার্ভালহো এর ছুরি আরেক সিংহমানবকেই শোভা পায়, কি বলিস ??

পুনশ্চঃ আচ্ছা, কখনো ভেবে দেখেছিস, লিয়ান্দ্র কার্ভালহো যে জাহাজ করে এখানে এসেছিলো সেটার কি হলো?? আর ওর বিপুল সম্পদের বাকিটাই বা কোথায় গেলো?? বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া প্রাচীন জাহাজের ব্যাপারে আগ্রহ আছে তোর ???? !! -- শুভ্র"


রাদ ফোন করে শুভ্রকে প্রায় সাথে সাথেই, ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, "হ্যালো, হ্যাঁ বল"।

শুভ্রকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশ্ন করে রাদ, "এতো সো সো শব্দ কিসের, কোথায় তুই ?? "

ওপাশ থেকে উত্তর আসে- " সন্দ্বীপ !! "


সমাপ্ত !! ??