Saturday, March 24, 2012

থাংজাম মনোরমা এবং পেবম চিত্তরঞ্জন এর কথা

[ ইরম চানু শর্মিলা কে নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে লেখার পরে একজন পাঠক অনুরোধ করেছিলেন মনিপুরের থাংজাম মনোরমা ও পেবম চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে লেখার জন্য। এই দুজনই ভারত সরকারের "Armed Forces (Special Powers) Act (AFSPA)"/ "আফসা" এর নির্যাতনের ভয়াবহতার সাক্ষী। সংঘাতপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলো- অরুনাচল, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরাতে এই আইন কার্যকর করা হলেও বর্তমানে এটি কার্যকর আছে জম্মু এবং কাশ্মীরেও। সামরিক বাহিনীকে বিনা বিচারে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গুলি করার অধিকার দেয়া এই আইন এর মাধ্যমে, অনেক বছর ধরেই নির্যাতনের খড়গ ঝুলে আছে এই অঞ্চলগুলোতে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু এবং অবিরাম প্রতিবাদের পরেও এই আইন কার্যত বলবৎ আছে এখনও, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচন্ড বিতর্ক সৃষ্টিকারী এই আইন এর বিরুদ্ধে এখনও পাহাড়ের অধিবাসীদের আন্দোলন অব্যাহত আছে।]

থাংজাম মনোরমা

থাংজাম মনোরমা, মনিপুর এর ইতিহাসে আর এক নির্যাতিত-নিহত নারীর নাম। ৩২ বছর বয়স্ক থাংজাম মনোরমাকে, ১৭ আসাম রাইফেলস এর কয়েকজন সদস্য আইন বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১ জুলাই, ২০০৪ গভীর রাতে, বামন কাম্ফু, ইম্ফল ভ্যালীর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সে দিনই সন্ধ্যার দিকে, বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত মনোরমার শরীর পাওয়া যায় তাদের বাড়ি থেকে ৪ কি.মি দুরের রাস্তার পাশে। তারপর কেটে গেছে ৮টি বছর, উপযুক্ত বিচার কিংবা তদন্ত কিছুই হয়নি।

কি হয়েছিল সেদিন?

১১ জুলাই, ২০০৪ মধ্যরাতে, ১৭ আসাম রাইফেলস এর কয়েকজন সদস্য দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে থাংজাম মনোরমাদের বাড়িতে। ঘুমন্ত মনোরমাকে টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করে সেখানেই নির্মমভাবে মারধর করে হাত-পা বেঁধে। পরিবারের সদস্যরা বাধা দিতে গেলে তাদেরও আঘাত করা হয়। এই নির্যাতন অনেকক্ষণ ধরে চলে, তারপর গভীর রাতে মনোরমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে কাগজ হস্তান্তর করে তারা। কিন্তু কোনো ধরনের তথ্য কিংবা কাগজপত্র মনোরমার কাছে সেদিন পাওয়া যায়নি, যা থেকে তার আইন বহির্ভূত কোনো কর্মকান্ডের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। পরবর্তিতে তাকে আসাম রাইফেলস এর সদস্যরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

সেদিন সন্ধ্যা ৫ টার দিকে, থাংজাম মনোরমার দেহ পাওয়া যায় কেইরাও বংখেম রাস্তার পাশে। তার দেহে কোনো কাপড় ছিলোনা, সারা দেহে ধর্ষণ-নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো স্পষ্ট এবং শরীরে ছিলো অসংখ্য বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর হত্যার অভিযোগ আনা হলেও তা অস্বীকার করা হয় আসাম রাইফেলস এর তরফ থেকে। পরবর্তিতে তদন্ত রিপোর্টেও সম্পূর্ণরূপে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। আসাম রাইফেলস এর তরফ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, থাংজাম মনোরমা নিষিদ্ধ ঘোষিত "পিপলস লিবারেশন আর্মি" এর সাথে সংযুক্ত এবং গ্রেফতারের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত হয় সে।

থাংজাম মনোরমার মৃত্যু মনিপুরে "আফসা" বিরোধী আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে পুরো পাহাড়। অসংখ্য নারী অধিকার সংস্থা একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। অসংখ্য আদিবাসী নারী আসাম রাইফেলস এর মনিপুরের প্রধান কার্যালয় অবরোধ করেন, সব থেকে সাহসী প্রতিবাদ করেন প্রায় ৪০ জন আদিবাসী নারী সম্পূর্ণ বিবস্র হয়ে, হাতে "Indian Army rape us" এবং "Indian Army takes our flesh" লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে।

প্রতিবাদে অশান্ত মনিপুরে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বহুল প্রচলিত দমন-নিপীড়নের পথ বেছে নেয়, আসাম রাইফেলস এর সাথে প্রায় সব ধরনের সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জড়ো করে এবং কার্ফ্যু জারি করে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে সংঘর্ষ চলতে থাকে সাধারণ মানুষের, ১৬ জুলাই এর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে ১০০ জনের বেশি নাগরিক আহত হয়। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে, মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হন বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দিতে।

২০১০ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পেশ হয়েছে, পাল্টাপাল্টি অনেক অভিযোগের ঝড় বয়ে গেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো উপযুক্ত রায় ঘোষণা করতে ব্যার্থ হয়েছে কমিশন। ৩১ আগস্ট, ২০১০ এ তদন্ত এর দায়িত্বভার প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং উপযুক্ত তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়।

তথাকথিত গণতন্ত্রে এভাবেই বারবার রুদ্ধ করা হয়েছে গণমানুষের কন্ঠ, এভাবেই অত্যাচার-নির্যাতনে হারিয়ে গেছে অসংখ্য থাংজাম মনোরমা।

পেবম চিত্তরঞ্জন

বিক্ষুব্ধ ইম্ফল ভ্যালীতে, সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ও বিতর্কিত "আফসা" প্রত্যাহারের দাবিতে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন পেবম চিত্তরঞ্জন, ১৫ আগস্ট, ২০০৪ এ। সরকারের সামরিক কালো আইনের বিরুদ্ধে নিজের শরীরকে জলন্ত মশালে পরিণত করে প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা করে গিয়েছিলেন তিনি। মনিপুর ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা পেবম চিত্তরঞ্জনের এই দুঃসাহসিক প্রতিবাদ এ তীব্র রোষে ফেটে পড়ে পুরো আদিবাসী সম্প্রদায়।

নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে কলেজ থেকে বিষ্ণুপুরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দৌড়ে যান তিনি, পরবর্তিতে পুলিশ আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও, শরীরের প্রায় ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ার ক্ষত নিয়ে ১৬ আগস্ট হাসপাতালে মারা যান পেবম চিত্তরঞ্জন।

পেবম চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো পাহাড়, অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের তরফ থেকে অনির্দিষ্টকালের কার্ফ্যু জারি করা হলেও, রাস্তায় সাধারণ মানুষের মিছিল-প্রতিবাদ চলতে থাকে।

আত্মাহুতির আগে পেবম একটি চিঠি লিখে যান, শুধু মনিপুরবাসীদের উদ্দেশ্যেই নয়, মানবতার উদ্দেশ্যে। চিঠিটির বাংলা অনুবাদ তুলে দিচ্ছি-

"প্রথমেই আমি মাথা নত করি ও শ্রদ্ধা জানাই সকলকে এবং মাতৃভূমি মনিপুরকে। আমার মা (মাতৃভূমি মনিপুর) যিনি জন্ম দিয়েছেন পাহাড় ও সমতল, শেকলে আবদ্ধ হয়ে নিজের সন্তানের থেকে দূরে থাকার নির্মম কষ্ট ভোগ করে চলেছেন। আমাকে শক্তি দাও যাতে আমি মাথা উঁচু করে আত্মত্যাগ করতে পারি আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

এই সেই ১৩ আগস্ট যেদিন আমাদের বীর বিপ্লবীদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, তারা লড়াই করেছিলো শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। তারা জানতো যে তাদের এই প্রতিবাদের পরিনাম কি, কিন্তু তারা একবারের জন্যও পিছুপা হয়নি। তারা মাতৃভূমির প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসার নিদর্শন পুরো পৃথিবীর সামনে রেখে গেছে, তাদের উত্তরাধিকার হতে পেরে আমি গর্ব বোধ করি। কিন্তু যখন আমরা তথাকথিত ভারতীয় গণতন্ত্রের অংশীদার হলাম, তখন থেকেই আমাদের উপর হত্যা-নির্যাতন চলেছে। প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে থেকেই মনিপুরের অধিবাসীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে সরকার তাদের সামরিক কালো আইনের প্রয়োগ করে। তারপরে "আফসা" প্রবর্তন করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়নের এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা করেছে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে অনেক মানবাধিকার সংস্থা। তারা তুলে ধরেছে মানুষের অসহায়ত্ব।প্রাদেশিক সরকারের হাতে স্থাপিত মানবাধিকার পরিষদ একটি কৌতুক মাত্র।

ইয়াওসাং উত্সবের সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৩ জন মানুষকে সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে হত্যা করে সামরিক কর্তৃপক্ষ একে এনকাউন্টার হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। এটা সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসের এক চরম উদাহরণ, এছাড়াও পাহাড়ে অসংখ্য মানুষকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে দিনের পর দিন। একসাথে ৬-৭ জন করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে পরিবার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে। কিছুদিন আগেই, জাম্খোলেত খন্গ্সাই এবং থাংজাম মনোরমা কে নির্যাতন ও ধর্ষণের পর হত্যা করেছে সামরিক বাহিনী।

সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারের এহেন কর্মকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে।

শেষে একটি কথাই বলতে চাই, সামরিক কালো আইনের হাতে মৃত্যুবরণ করার আগে আমি চাই পুরো পৃথিবী পরিস্থিতি সম্পর্কে জানুক। আমি মনে করি আত্মাহুতি দেয়া আমার জন্য সঠিক পথ এবং অনেক চিন্তাভাবনার পরে আমি ঠিক করেছি নিজেকে জলন্ত মশালে পরিণত করে আমি আমার প্রতিবাদ পুরো পৃথিবীর সামনে দেখিয়ে যাবো। আমার সহকর্মীবৃন্দ, আমার মা-বোন, বন্ধুরা, আমকে ভুল বুঝোনা।

আমার পিতা-মাতা যারা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি। এই জন্মে তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলামনা, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে কিছুটা হলেও তোমাদের ঋণশোধ করার চেষ্টা করবো। তোমরা আমার জন্য দুঃখ করোনা, কারণ আমার দেখানো প্রতিবাদের পথে হাজারো মানুষ এগিয়ে আসবে।

"সামরিক বাহিনী ফেরত যাও।
তোমাদের কালো আইন প্রত্যাহার করো।
ভারতীয় গণতন্ত্র শুধু মুখের কথা, কাজের নয়।
একতা আমাদের শক্তি।
একক নয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করো, শাস্তি নিঃশ্চিত করো যারা জাম্খোলেত খন্গ্সাই এবং থাংজাম মনোরমা কে হত্যা করেছে।"

আমার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য মনিপুর সরকার ও ভারত সরকার দায়ী।

-- পেবম চিত্তরঞ্জন মান্গাং"

পেবম চিত্তরঞ্জনের এই আত্মত্যাগ প্রদেশে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের সৃষ্টি করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে একসময় সরকার কিছুদিনের জন্য "আফসা" অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।

সারা পৃথিবীতে সরকার কর্তৃক নির্যাতনের চিত্রটা বহুলাংশে এক, সাধারণ জনগনের মতামতের তোয়াক্কা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন চলছে তথাকথিত গনতন্ত্রের নামে। আদতে গণতন্ত্রকে পুঁজি করে শাসকগোষ্ঠী নির্যাতনের একটি নতুন পথ তৈরী করে নিয়েছে মাত্র। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্যাতন-নিপীড়ন আর দুর্নীতির জোয়ার বইয়ে দেয়া এই সরকারগুলো সাধারণ মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিঃশ্চয়তা দিতে পর্যন্ত ব্যার্থ। এভাবেই অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদ করে গেছে, জীবন দিয়েছে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠির ক্ষমতার দম্ভ এখনও অটুট। হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন এই সব প্রতিবাদগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে চরম এক বিস্ফোরণের সূচনা করবে। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।

No comments:

Post a Comment