Thursday, May 10, 2012

প্রফেসরের মৃত্যুরহস্য

ফোনটা দুবার বেজে উঠতেই বিরক্তি সহকারে কানে লাগালেন উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল আলম, ওপাশ থেকে সহকর্মী আহসান এর গলা ভেসে এলো।

"স্যার, একটা মৃত্যুসংবাদ আছে"
"হুমম, মৃত্যুসংবাদ!!... নাকি খুন ?"
"মানে এখনও ঠিক বলা যাচ্ছেনা..."
"অ... তা কে? কোথায়?"
"প্রফেসর রাশেদুল হক..."
"হ্যাঁ !! .."
"জ্বি, স্যার, এইমাত্র উনার বাসার কেয়ারটেকার ফোন করেছিলো, ভোর বেলায় ডাকতে গিয়ে মৃত অবস্থায় পায় উনাকে.."
"হুমমম; ঠিক আছে আসছি.."
"ঠিক আছে স্যার"

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন শহীদুল আলম, কালকে একটা কেসের কাজ থেকে অনেক রাতে ঘরে ফিরেছেন। এখন বাজে মাত্র সকাল ৬:৩০টা, "প্রফেসর রাশেদুল হক, বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ রাশেদুল হক নিজের ঘরে মৃত !! খুন ? নাকি সাধারণ মৃত্যু?"

বাড়িটা পুরনো, দেয়ালের ফিকে হয়ে আসা রং আবছা বোঝা যায়। আশেপাশের বহুতল ভবনগুলোর কাছে একদম শ্রীহীন দেখাচ্ছে দোতলা বাড়িটাকে। তবে একটাই পার্থক্য যে, একচিলতে বাগান ঘেরা বাড়িটা সাবেকি আমলের জৌলুসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখন বাজে সকাল ৮টা, সকালের রোদে চারপাশটা অন্যরকম লাগছে।আহসানকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগে শহীদুল আলম আশপাশটা একবার দেখে নিলেন। মেইন গেট থেকে রাস্তা চলে গেছে সরাসরি বাড়ির সামনের বারান্দা পর্যন্ত, সেখানে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। তিনি সামনে যেতেই এগিয়ে এলো একজন বয়স্ক মানুষ,

"স্যার, আমিই ফোন করেছিলাম.."
"তাহলে আপনিই কেয়ারটেকার দিনেশ বাবু?"
"হ্যাঁ, স্যার.." কিছুটা জড়তা মেশানো গলায় উত্তর আসে।
"কিন্তু, আপনারা কোনো আত্মীয়-স্বজনকে ফোন না করে, পুলিশ স্টেশনে ফোন করলেন যে, কোনো অস্বাভাবিক কিছু?"
"না স্যার, সেরকম... কিছু নয়, কিন্তু প্রফেসর সাহেবের কোনো আত্মীয় তো দেশে নেই, তার একমাত্র ছেলে থাকেন দেশের বাইরে, আর এরকম ঘটনা ঘটবে আমরা কেউ তো বুঝতে পারিনি, ঠিক কি করা উচিত। সকাল সকাল ডাক দিতে গিয়েছিলাম হাঁটতে যাওয়ার জন্য, গিয়ে দেখি ঘরে নেই উনি। রে বাথরুমের দরজা খোলা দেখে উঁকি দিতেই, মেঝেতে পড়ে রয়েছেন দেখতে পাই।" এইপর্যন্ত বলে গলা ধরে আসে কেয়ারটেকারের।

কিছুটা সময় নিয়ে শহীদুল আলম এবার প্রশ্ন করেন, "তারপরে?"
"তারপরে আমি চিত্কার করে নুরুলকে ডাকি, [বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় লোকটিকে দেখিয়ে বলে দিনেশ] ও তখন সকালের নাস্তা বানাবার জন্য নিচের রান্নাঘরে, তারপরে দুজনে মিলে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসি, কিন্তু ততক্ষণে...." এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় দিনেশ।
নুরুলের দিকে তাকিয়ে আহসান প্রশ্ন করে, "তুমি শুধু রান্নার কাজই করো?"
"না স্যার, বাড়ির অন্যান্য কাজও করি।"

শহীদুল আলম কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতরে ঢোকেন এইবার, পুরনো ধাঁচের বাড়ি। সামনের বসার ঘর থেকে উপরে যাওয়ার সিড়ি উঠে গেছে, দোতলায় উঠতে উঠতে প্রশ্ন করেন দিনেশকে, "উনার কোনো শারীরিক সমস্যা ছিলো, মানে হার্টের অসুখ বা এরকম কিছু?"
"জ্বি, স্যার, হার্টের সমস্যা ছিলো, এছাড়াও বয়স হয়েছিলো, কিন্তু নিয়ম করে ওষুধ খেতেন, আর হাঁটা চলাও করতেন।"
দোতলার ঘরে ঢুকে বিছানার নিথর দেহটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, আহসানকে ভালো করে দেখতে বলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাধারণ জিনিসপত্র রাখা ভেতরে, একপাশে বেসিন অন্যপাশে পানি রাখার জায়গা। বেসিনের পাশেই জানালা, সেদিকে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো নিচের দিকে,আগাছায় ঢাকা বাগানের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে, দেয়ালের শেষদিকে একটা ছোট গেট, তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খোলা হয়না অনেকদিন। চারপাশে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লোনা, ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলেন বেসিনের কোনায় লেগে থাকা রক্তের দাগ। ভালো করে লক্ষ করে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আহসান বললো, "স্যার, দেহে অস্বাভাবিক কোনো কিছু তো দেখছিনা, শুধু কপালের এইদিকে রক্ত জমে আছে, মনে হচ্ছে পড়ার সময় লেগেছে, এছাড়া যা মনে হচ্ছে, হার্ট এটাকে মৃত্যু।" তাকে বেসিনের কোনায় লেগে থাকা রক্তের দাগের কথা বলে, দিনেশ আর নুরুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, "বাগানের ঐদিকে একটা গেট দেখলাম, খোলা হয় কি?"
নুরুল উত্তর দিলো, "না স্যার, আগে ময়লা পরিষ্কারের জন্য কাজে লাগতো, এখন ওভাবে বাগান তো নেই, যা দেখার আমিই দেখি, ঐ গেট অনেক বছর ধরেই আর খোলা হয়না।"
"হুমম, ঠিক আছে, আমি আহসানকে রেখে যাচ্ছি, তোমাদের জবানবন্দী লিখুক, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, পোস্টমর্টেম রিপোর্টের আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা। তোমরা উনার ছেলেকে খবরটা জানিয়ে দাও, আপাতত বিস্তারিত বলার দরকার নেই, আমি থানার দিকে এগোচ্ছি।"

বারান্দা থেকে নিচে নামতেই মুখোমুখি হলেন এক কিশোরের, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকানোর সাথে সাথেই ছেলেটি বলে উঠলো, "আমি দীপ্র, রাশেদ আঙ্কেল ঠিক আছেন তো? সকাল সকাল বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দেখে মনে হলো কিছু হয়েছে.. "
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন শহীদুল আলম, "উনি আজকে সকালে মারা গেছেন..বাড়ির কেয়ারটেকার পুলিশ স্টেশনে ফোন করে জানায়।"
"কিভাবে..!?" চমকে উঠে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো দীপ্র।
"আপাতত মনে হচ্ছে হার্ট এটাক..কিন্তু, তুমি রাশেদুল হকের কে হও?"
"আমি পাশেই থাকি, সন্ধ্যার দিকে দাবা খেলতে আসি মাঝে মাঝে... কালকেও এসেছিলাম, কিন্তু, তখন তো কিছু মনে হয়নি.."
"হুমম, শোনো, ভেতরে আমার সহকর্মী আছেন, তার কাছে যাও, কালকে কি কি ঘটেছে একবার বলো, যদি প্রাসঙ্গিক কিছু জানা যায় আর কি.."
এই বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন তিনি।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এলো মৃত্যুর কারণ, "কার্ডিয়াক এরেস্ট", দেহে অস্বাভাবিক কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, রক্তে পাওয়া যায়নি কোনো বিষাক্ত কিছু। আর বেসিনের কোনায় লেগে থাকা রক্তের গ্রুপের সাথে প্রফেসর রাশেদুল হকের রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো। বোঝা যাচ্ছে পড়ে যাওয়ার সময় কপালে আঘাত লেগে থাকবে। শহীদুল আলম কথা বলতে গিয়েছিলেন রাশেদুল হকের ছেলের সাথে। পুরো ব্যাপারটা আর রিপোর্টের কথা জানিয়ে বললেন যে অস্বাভাবিক কিছু যেহেতু তদন্তে এলোনা, তাহলে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই হার্টের সমস্যা থেকে হঠাৎ মারা যান প্রফেসর। শোকার্ত মানুষগুলোকে রেখে বাইরে বেড়িয়ে আসতেই চোখে পড়লো সেই ছেলেটিকে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামান্য মাথা নেড়ে বেড়িয়ে এলেন তিনি।


ঘটনার দিন সাতেক পরে, একদিন সকালে, একটা ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিলেন শহীদুল আলম, হঠাৎ সামনের চেয়ারটা নাড়ার শব্দে তাকালেন। দেখলেন সামনে দাঁড়ানো দীপ্র। প্রশ্ন করার জন্য মুখ খোলার আগেই বলতে শুরু করলো দীপ্র,
"রাশেদ আঙ্কেলের মৃত্যুটা আমার কাছে কখনই স্বাভাবিক মনে হয়নি, আর সন্দেহ আরও বাড়ে যখন ঐদিন সকালে উনার বাড়িতে যাই আমি।"
কিছুটা অবাক হয়ে কথাটা হজম করে বলতে শুরু করলেন তিনি,
"কিন্তু দেখো, তদন্তে বা পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোনো কিছুতো ধরা পড়েনি, তাহলে কি করে বলা যায় এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়?"
একটা স্বচ্ছ ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট এগিয়ে দিলো দীপ্র তার দিকে, ভেতরের জিনিসটি ভালো করে দেখার আগেই বললো, "এটাই সেই মার্ডার উইপন.."
হাতের জিনিসটি দেখে হাসবেন না গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তিনি, ছোট্ট এক টুকরো তামার তার, একটা আংটার থেকে সাইজে বড় হবেনা, এটা কি করে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে হত্যা করার জন্য ব্যবহার হতে পারে? তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, "ঠিক বুঝলামনা, কিভাবে সম্ভব?" মনে মনে ভাবছেন অল্পবয়স্ক কিশোর হয়তো গোয়েন্দাগিরির শখ জেগেছে।
"তাহলে চলুন ঘটনাস্থলে, সেখানে গিয়েই বাকিটুকু খোলসা করা যাক", বলেই উঠে দাঁড়ালো দীপ্র।


রাশেদুল হকের বাসার দিকে চলতে চলতে শহীদুল আলম ভাবছিলেন, কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম!! এই অল্পবয়স্ক ছেলেটার কথায় এভাবে সাড়া দেবার কোনো মানে হলো কি? বাড়িতে পৌঁছে বসার ঘরে ঢুকতেই তাদের দেখে এগিয়ে এলো রাশেদুল হকের ছেলে এবং বাড়ির কেয়াটেকার। দীপ্র তাদেরকে বসতে বলে নুরুলকেও ডাক দিতে বললো, আহসান দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে, উল্টোদিকে শহীদুল আলম বসতেই শুরু করলো দীপ্র।

"যেদিন সকালে রাশেদুল হক মারা যান, সেদিন সকালেই আমি এখানে এসেছিলাম। সবার সাথে কথাও হয়, পুলিশ বেরিয়ে যাবার পরে, আমি দোতলার ঘরে যাই। সেখানে কোনো অস্বাভাবিক জিনিস চোখে পড়েনি, কিন্তু বাথরুমে ঢুকে সবকিছু দেখে ফেরত আসার আগে চোখ যায় জানালার শিকে, পুরনো আমলের জানালার নকশা, লোহার শিক লাগানো। আর তারই কোনার একটি শিকে দেখি আংটার মতো পেঁচানো একটি সরু তামার তার, জিনিসটি বলতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক। স্বাভাবিকভাবেই চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো। আমারও এড়িয়ে যেতো যদিনা একটি সম্ভাবনা মাথায় না আসতো। বাথরুমের জানালা দিয়েই বাগানের পেছনের দিকের একটা দরজা দেখা যায়, আমার সন্দেহ হয় সেখানেই।" এটুকু বলে নড়ে চড়ে বসে দীপ্র। বাকিরা চুপ।

"বাগানের ঐদিকটা ব্যবহার হয়না আমি জানি, কিন্তু সেদিন যখন আমি দরজাটা ভালো করে দেখতে যাই, তখন খেয়াল করে দেখি, দরজার জং-ধরা হাতলে সদ্য হওয়া একটি দাগ!, জং-এ ধরা হাতলটি বেশিদিন হয়নি কেউ দরজাটি খুলতে ব্যবহার করেছে, আর তাই একটি সরু দাগ পড়ে গেছে হাতলটির গায়ে, যা ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝা যায়না। তার মানে এই দরজা দিয়ে কেউ ভেতরে এসেছে, অথবা কেউ বাইরে গেছে। কিন্তু বাড়ির লোকের জবানবন্দী অনুযায়ী ঐ দরজা অনেক বছর ধরে খোলা হয়না, তার মানে হতে পারে দুটি, কেউ মিথ্যা বলছে, অথবা বাইরের কেউ দরজা খুলেছে যা বাড়ির কেউ জানেনা।"

এই পর্যন্ত শুনে মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো শহীদুল আলমের, কিছুটা ঝুঁকে সামনে এগিয়ে বসলেন। দীপ্র বলে চললো, "দাবা খেলতে এসে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতো রাশেদ আঙ্কেলের সাথে, তার কথা থেকেই জানি তিনি তার এই বাড়ি আর সংগৃহীত সব জিনিসপত্র একটি ট্রাস্টি করে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়ে যেতে চান, তার সংগ্রহের জিনিস কম ছিলোনা, বিশেষ করে তিনি যখন মিশরে খননকার্যে গিয়েছিলেন সেখানে স্মারক হিসেবে বেশ কয়েকটি জিনিস তিনি উপহার পান যার এখনকার মূল্য অনেক। আমার সন্দেহ হয় কোনো ভাবে তাকে হত্যা করে এই জিনিসগুলো হাতিয়ে নেয়ার চক্রান্ত হতেই পারে।"

এবার শহীদুল আলম বলেন, "কিন্তু সেরকম কিছু তো হারানো যায়নি।" তার কথায় মাথা নাড়ে বাকিরা।
"না কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়, কিন্তু তাতে পরে আসছি। বাগানের দরজা খোলার চিহ্ন দেখে এবার আমি খুঁজতে খুঁজতে আসি দোতলার বাথরুমের জানালার ঠিক নিচে, দেখি সেখানে মাটিতে স্পষ্ট জুতোর দাগ। বোঝা যায় যে, প্রায় অনেকক্ষণ ধরে কেউ একজন এখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলো।"
"কিন্তু এই দাগ তো বাড়ির যে কারো হতে পারে"- প্রশ্ন করে আহসান।
"হ্যাঁ, হতে পারতো, যদিনা জুতোর নিচের অংশটা অদ্ভুত না হতো!"
"তার মানে?"
"যখন জুতোর দাগটা দেখি সেটার একটা অস্বাভাবিক জিনিস চোখে পড়ে আমার। সাধারনত জুতোর দাগে দুপায়ের সোলের ছাপ বোঝা যায়, অন্তত জুতোর নিচের হিলের দিকটার ছাপ দেখা যায়। কিন্তু এই জোড়া ছাপে বাম পায়ের হিলের দাগ বোঝা গেলেও ডান পায়ের হিলের জায়গা ছিলো সমান।"
"ঠিক বুঝলামনা" বলে উঠেন শহীদুল আলম।
"হ্যাঁ, এরকম ছাপ শুধু একভাবেই সম্ভব যদি ঐ পায়ের জুতোর সোল আলাদা করে উঁচু করা হয় তবে, আর এধরনের জুতো তারাই পড়ে যাদের এক পায়ের হাড় অন্য পা থেকে একটু ছোট।"
মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে সবাই দীপ্রর কথা শুনে।
"কিন্তু এই ঘটনাগুলোর সাথে খুনের কি সম্পর্ক? আর তামার তার-ই বা কি করে মার্ডার উইপন হলো?"-প্রশ্ন করলেন এবার আহসান।

"এই ঘটনাগুলো একটার সাথে আরেকটা জোড়া দিলে খুনের একটা মোটিভ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে খুন করা হলো কি দিয়ে,সেই অস্রটাই বা গেলো কোথায়? আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও কোনো কিছু ধরা পড়লোনা কেনো? এথেকে একটা জিনিস সহজেই অনুমেয় যেই অস্র দিয়েই খুন করা হোক না কেনো, তার কোনো ছাপ মৃতের শরীর নেই! তাহলে এমন কি উপায় হতে পারে? এই প্রশ্ন চিন্তা করতেই আমার মাথায় আসে রাশেদ আঙ্কেলের হার্টের সমস্যার কথা। কোনভাবে যদি তার এই সমস্যাটাকেই অস্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্বাভাবিক ভাবেই কোনো চিহ্ন থাকবেনা যা থেকে অন্যকিছু বোঝা সম্ভব। তখন আমার মাথায় আসে সেই তামার তারের টুকরোটার কথা, জানালার শিকে তামার তারটা কেনো লেগে আছে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় খেলে, যা হলে খাপে খাপে বসে যায় সবগুলো টুকরো ঘটনা, আর সেটা হলো বৈদ্যুতিক শক!!"

"কি!!?? কিকরে সম্ভব?? শরীরে কোনো চিহ্ন থাকবেনা? অসম্ভব"- বলে উঠলেন শহীদুল আলম।
"না অসম্ভব নয়, খুব অল্পমাত্রার বৈদুত্যিক শক (মাইক্রোশক) ব্যবহার করলে দেহে সেরকম কোনো চিহ্ন থাকবেনা। আর এক্ষেত্রে তামার তারটা সেকারণেই ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনাগুলো খাপে খাপে বসালে দাঁড়ায় এরকম-

রাতের অন্ধকারে কেউ একজন বাগানের দরজা দিয়ে ঢুকে দোতলার বাথরুমের জানালার নিচে অবস্থান নেয়, নিচ থেকে বেসিনের আয়না একাংশ দেখা যায়, রাতের বেলা ঘরে ঢুকে যখন বাথরুমে ঢোকেন রাশেদুল হক কেবিনেট থেকে ওষুধ নেয়ার জন্য, তখনি নিচে থেকে কোনভাবে, হয়তো শক্তিশালী টর্চের আলো ফেলা হয় আয়নায়, স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে ঘটনাটা কি হচ্ছে ভালো করে নিচে দেখার জন্য জানালার সামনে আসেন রাশেদুল হক। তখনি তার চোখে আলো ফেলা হয়, তীব্র আলোতে হঠাৎ দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ভারসাম্য সামলাতে জানালার শিক ধরতে যান উনি, আর তখনি আগে থেকে লাগানো তামার তার দিয়ে জানালার শিকে পাঠানো বিদ্যুৎপ্রবাহে শক পান, খুব বেশি মাত্রার না হলেও হার্টের অসুবিধের জন্য ঐ অল্প কয়েক সেকেন্ডের শক-ই তার হার্টে "ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেসন" এর জন্য যথেষ্ট ছিলো। আর তারপরে পড়ে যাওয়ার সময় বেসিনের কোনায় আঘাত লেগে তার মৃত্যু আরও তরান্বিত হয়| আর এই ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেসন রাশেদুল হকের কার্ডিয়াক এরেস্ট ঘটায়। খুব সাধারণ যন্ত্রাংশে এরকম বহনযোগ্য ব্যাটারি আর সংযোগ তৈরী করা কঠিন কিছু নয়।

তাই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট এর কথা লেখা থাকায় আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়|"

"তারপর?"-যেনো স্বপ্নের ঘোরে প্রশ্ন করলেন রাশেদুল হকের ছেলে।
"তবে এই ঘটনাতে বাড়ির ভেতরের কারো সহযোগিতা না হলে তামার তার দোতলার বাথরুমের জানালায় লাগানো কঠিন হয়ে যেতো, তাই আমার সন্দেহ গিয়ে পড়ে বাড়ির কেয়ারটেকার দিনেশবাবু এবং রাঁধুনি নুরুলের উপর। যদিও কেয়ারটেকার হওয়ার কারণে দিনেশবাবুর সম্ভাবনা বেশি ছিলো যেহেতু বাড়ির সব গেটের চাবি তার কাছেই থাকে, তাই বাগানের দরজার পুরনো তলার চাবি বের করা খুব একটা অসুবিধা হবার কথা না, আবার সকাল বেলা সবার আগে মৃতদেহ দেখতে পান তিনিই এবং মৃতদেহ জায়গা থেকে সরিয়ে আলামত নষ্ট করার ইচ্ছাও তার থাকতে পারে। কিন্তু একই ভাবে সন্দেহের বাইরে যায়না নুরুলও। তাই আমি নজর রাখা শুরু করি এই দুজনের উপরে। ফল পাই হাতেনাতে, ৫ দিন পরে এক দুপুরবেলায় রাস্তার শেষ মাথায় গলির ভেতর দিকে আড়ালে দেখি এ বাড়ির একজনকে একটি প্যাকেট অচেনা একজনের হাতে তুলে দিতে। আর যার হাতে তুলে দেয়া হলো সে ডান পা একটু খুঁড়িয়ে হাটে।"

এইকথা বলা শেষ করতেই শহীদুল আলম চোখের কোনা দিয়ে কারো নড়াচড়ার আভাস পান, মুখ ঘুরাতেই দেখেন দরজার পাশ দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে যাচ্ছে রাঁধুনি নুরুল, কিন্তু তার আগেই দরজার এইদিকে দাঁড়িয়ে থাকা আহসান চট করে এক পা এগিয়ে দেয়াতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নুরুল।

"হ্যাঁ, সেদিন নুরুলকেই আমি দেখি ঐ লোকের সাথে দেখা করতে"- দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে দীপ্র।

আহসান আর শহীদুল আলম মিলে নুরুলকে জোর করে বসানোর চেষ্টা করতে থাকেন আর এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় হা করে তাকিয়ে থাকে বাকি দুজন। গাড়িতে বসা আর দুজন পুলিশকে ডেকে তাদের হাতে নুরুলকে তুলে দিয়ে এবার শহীদুল আলম প্রশ্ন করেন, "ঐ প্যাকেটে কি ছিলো?"

"মিশরের প্রাচীন দেবতা "আনুবিসের" ছোট একটা কালো পাথড়ের মূর্তি, আকারে ছোট হলেও এখনকার বাজারে এর দাম কয়েক কোটির কম হবেনা!"
"কিন্তু তুমি কি করে জানলে এই মূর্তির কথা?"
"জানতে পারি পরে, যখন আবার একবার বাড়িতে খোঁজ করতে ঢুকি, তখন সংগ্রহশালার ভেতরের দিকের একটা জায়গায় একটা গোল দাগ দেখি যার চারপাশে ধুলো জমে আছে, বুঝতে পারি ঐখানে কিছু একটা রাখা ছিলো যা কিছুদিনের ভেতরেই সরানো হয়েছে। তখনি ঘুরে ঘুরে পুরো সংগ্রহটা আবার দেখি। আমাকে এর আগেই দেখিয়েছিলেন রাশেদ আঙ্কেল, তাই একটু চিন্তা করেই দেখি আনুবিসের ছোট্ট মূর্তিটা সেই আগের জায়গায় নেই।"
"কিন্তু খুনের মোটিভ কি তাহলে এই প্রাচীন মূর্তি?"-প্রশ্ন করেন শহীদুল আলম।
"না, প্রথমে ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু পরে দেখি তা নয়। আসলে অনেকদিন ধরেই রাশেদুল হককে এই বাড়িটা বেঁচে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রমোটার আসাদ চৌধুরী। কিন্তু উনি বেঁচতে রাজি ছিলেননা, আগেই বলেছিলেন তিনি এটি জাদুঘর হিসেবে দান করে যাবেন, তাই উনাকে যেভাবেই হোক রাজি করাতে আসাদ চৌধুরী নিয়োগ করেন রায়হানকে। সে এই লাইনের পুরনো, ঘাঘু লোক। সে জানে কি করে রাজি করাতে হয় মানুষকে, কিন্তু তার টাকার লোভ, মূর্তি বিক্রির লোভ, কোনো হুমকিতেই যখন সারা দিচ্ছিলেন না রাশেদুল হোক তখন অন্য রাস্তা দিয়ে কাজ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নেয় রায়হান। তবে এর আগেই তার চোখ যায় এই বাড়ির সংগ্রহশালার দিকে, অপরাধের লাইনের পুরনো বান্দা হওয়ায় তার বুঝতে অসুবিধা হয়না এখানে রাখা আছে বেশ কিছু দামি জিনিস। প্রাচীন মূর্তি পাচারের সাথে আগে থেকেই জড়িত ছিলো সে, তাই সে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সিদ্বান্ত নেয়। বাড়ির ভেতরে সে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে নুরুলকে হাত করে ফেলে, তাকে অবশ্যই সে খুনের পরিকল্পনা জানায়নি। তাহলে বেঁকে বসার সম্ভাবনা ছিলো নুরুলের। সে তাকে ঐ মূর্তি হাত করার আর এই তামার তারটা বাথরুমের জানলায় লাগানোর কাজ দেয়, অনেক টাকার লোভে মুখ বন্ধ থাকে নুরুলের। কিন্তু কখনই সে বুঝতে পারেনি কি ঘটতে যাচ্ছে। তাই খুনের পরেই ভয় পেয়ে যায় নুরুল। তাকে দেয়া টাকার অংশটা সে সুযোগ বুঝে সরানোর চেষ্টা করে, শুধু তাইনা, তার কাছে রাখা মূর্তিটাও সে রায়হানকে দিয়ে দেয়ার চাপ দেয়। আর ঐ মূর্তি নিতেই দেখা করে রায়হান, আর তখনি আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়। রায়হানের হয়তো ধীরে সুস্থে কাজ এগোনোর পরিকল্পনা ছিলো, কারণ এভাবেও রাশেদুল হকের মৃত্যুর পর তার ছেলে বাড়ি বিক্রি করে বিদেশে ফিরে যাবেন এটাই পরিকল্পনার অংশ ছিলো, কিন্তু নুরুলের জন্য সেটা আর হলোনা। মূর্তি আগেই সরাতে হলো "

"কিন্তু এই ঘটনায় যদি ঐ মূর্তিটা না থাকতো তাহলে?"-প্রশ্ন করে আহসান।
"হ্যাঁ, তাহলে একটু কঠিন হতো মূল অপরাধীকে বের করা, বেশি লোভ করতে গিয়েই নিজের পরিচয় প্রকাশ করে ফেললো রায়হান।"
"কিন্তু আসাদ চৌধুরী কি এই ঘটনার পেছনে জড়িত?"
"মনে হয় না, কারণ সেরকম হলে এতো প্ল্যান করে খুন করার পরে সেই বাড়ি থেকেই জিনিস চুরি করার মতো কাঁচা কাজ করার লোক নন তিনি, যতদুর মনে হচ্ছে রায়হান নিজের বসের কাছে লুকিয়ে বড় দাও মারার মতলবে ছিলো। তবে এখনই রায়হানের বাড়ি সার্চ করলে হয়তো জিনিসপত্র সমেতই ধরা পড়বে সে, আর আসাদ চৌধুরী নিজের দিক থেকে সন্দেহের তীর সরাতে ওর পেছনে থাকবেননা এটা অনুমান করা যায় সহজেই।"

শহীদুল আলম দ্রুত উঠে পড়লেন, আহসানকে বললেন থানায় ফোন করে সার্চ ওয়ারেন্ট বের করতে। "তোমাকে ধন্যবাদ পরে দিবো আগে আসল অপরাধীকে ধরে নেই", এই বলেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

পরের দিন সংবাদপত্রের পাতায় বেশ বড় করে এলো-

"চাঞ্চল্যকর হত্যা রহস্যের সমাধান: বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ রাশেদুল হক এর খুনিকে গ্রেফতার করলো পুলিশ"



No comments:

Post a Comment