Sunday, September 23, 2012

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, জঙ্গি তৎপরতা এবং বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক একটি পরিস্থিতি

বাংলাদেশে আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে জঙ্গি তৎপরতা। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন অংশকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বানিয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা নিজেদের প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বেশ জোরেসোরে। কিছুদিন আগে গোপন বৈঠকের সময় একইসাথে ১৬ জন জঙ্গি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় গুরুত্বপূর্ণ এবং আঁতকে উঠার মতো কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে, আর তার ফলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। মায়ানমারের অস্থিতিশীলতার সুযোগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো আবারও নাশকতামূলক কর্মকান্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, "জামায়াত-এ-আরাকান" নামক একটি জঙ্গি সংগঠন কক্সবাজারে বেশ সক্রিয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিদের সাথে মিলিত হয়ে তারা পার্বত্য অঞ্চল এর কিছু অংশ এবং মায়ানমারের আরাকান এই নিয়ে একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে বলে জানা যায়। বান্দরবন এবং কক্সবাজারের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাব কম, এরই সুযোগে বিভিন্ন অংশে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুর্ধর্ষ জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা।


বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা আছে, এই অভিযোগ অনেক আন্তর্জাতিক মাধ্যমের। কিন্তু এই বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সেরকম পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমান না থাকায় প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে দেশের সরকার। কিন্তু বর্তমানে একইসাথে বেশ কিছু জঙ্গিসদস্য এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ, জিহাদী সরঞ্জাম পুলিশের হাতে আসায় এই অভিযোগের দিকে নতুন করে দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়েছে বলে মনে হয়। শুধু জঙ্গিসদস্যই নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠনগুলোর বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় সদস্যকেও। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুর্গম অঞ্চলগুলোর আড়ালে আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠনগুলো ঠিক কি ধরনের নাশকতামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে এই প্রশ্ন আবার সামনে চলে এলো।


মায়ানমারে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পায়। বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ এবং পুলিশের সহযোগিতায় সরকার অনেক শরণার্থীকে ফেরাতে সক্ষম হলেও অনেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশে গোপনে প্রবেশ করে। এছাড়াও জামাত সমর্থিত বেশ কিছু এনজিও এর প্রতক্ষ্য সহায়তায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের দেশের অভ্যন্তরে আসার সুযোগ করে দিতে দেখা যায়। বর্তমানে শরনার্থী আগমন হ্রাস পেলেও গোপনে অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছেনা। রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল দিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে অনেকেই। পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন সময়ে আগত রোহিঙ্গা শরনার্থীরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ী, এই অভিযোগ অনেক আগে থেকেই ছিলো। দেশের ভেতরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী চক্রের সাথে মিলিত হয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরা অনেকদিন ধরেই সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। এছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতের প্রতক্ষ্য সহযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী আইনের ফাঁক গলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেতে সক্ষম হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে চলে যায়। এদের অনেকেই সেসব দেশে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং পারতপক্ষে এই দোষ যায় বাংলাদেশী শ্রমিক জনগোষ্ঠির উপরে। একারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি হুমকির মুখে পড়ে। তারপরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদদে দেশে রোহিঙ্গা অবৈধ অনুপ্রবেশ জারি আছে এবং এসব অনুপ্রবেশকারীকে নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে ব্যবহার করারও যথেষ্ঠ প্রমান রয়েছে। তাই এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা তৈরী করে কিছু সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এই অনুপ্রবেশকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে এবং রাখাইন জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতায় মদদ দেয়ার আশ্বাস দিতে থাকে।


বর্তমানে বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ এবং রেব এর অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, দেশে আবারও সংঘটিত হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদ। তারা বান্দরবন জেলাতে "জামায়াত-এ-আরাকান" নামে সংগঠিত হচ্ছে এবং দল ভারী করছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে। এই দলের ৪ জন সদস্য সম্প্রতি গ্রেফতার হয় কক্সবাজার পুলিশের হাতে। তাদের তথ্যমতে দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলে তারা কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, একই সাথে তারা বান্দরবন ও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের কিছু রোহিঙ্গাদেরকে সশস্ত্র ট্রেনিং দিয়ে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত করছিল। তারা কক্সবাজারে রিক্সা ও টমটম গাড়ি চালিয়ে ছদ্দবেশে অবস্থান করছিল। এধরনের কার্যকলাপ নতুন কিছু নয়। এরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কক্সবাজারে এসে বিভিন্ন পরিচয়ে অবস্থান করার পর বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে। মৌলবাদী চক্রগুলো এবং মিয়ানমার বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও, আরএনও, নুপা সহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা এদেরকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়।


এরপরে কক্সবাজার থেকে জঙ্গি সন্দেহে আরও গ্রেফতার করা হয় ৯ জনকে। একইসাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী এই দলগুলোর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। দেশের অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহল প্রথম থেকেই ছিলো উদাসীন। কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতি একটি উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উদাসীনতার সুযোগে দেশে আশ্রয় নিচ্ছে নানা জঙ্গি সংগঠনের দুর্ধর্ষ সদস্যরা। পুলিশের কিছু অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। দেশে অনেকদিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় কর্মীরা অবস্থান করে এসেছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত মনিটরিং এর ব্যবস্থা কখনো নেয়া হয়নি। এরই সুযোগে এরা দেশের ভেতরে সংগঠিত হয়েছে।২০০৯ সালের ২৭ মে, ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্ট সর্বপ্রথম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যকলাপের ব্যাপারে তথ্য জানায়। তারপরে দেশে গ্রেফতার হয় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন "লস্কর-ই-তৈয়বার" শীর্ষ নেতা মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ। তার তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর ধরে ৫টি কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিবরণ জানা যায়। সে নিজেই প্রায় ৫ হাজার জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে স্বীকার করে। তার সঙ্গে দেশের শীর্ষ সকল জঙ্গির সম্পর্ক ছিলো এবং ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রধান আসামিদের সাথেও তার যোগাযোগ ছিলো বলে সে স্বীকার করে।


মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ এর তথ্য অনুযায়ী পরবর্তিতে ঐ বছর গ্রেফতার করা হয় "লস্কর-ই-তৈয়বার" অন্যতম সংঘটক, ২৫ বার আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া, সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ মাওলানা মো: মনসুর আলীকে। সে ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলো। ২০১০ সালে রেবের গোয়ান্দা শাখা রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানভিত্তিক আত্মঘাতী জঙ্গি সংগঠন "জইশ-ই মোহাম্মদের" উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুর্ধর্ষ জঙ্গি রেজওয়ান আহম্মদকে। পরে তার বাংলাদেশী সহযোগীদেরও আটক করা হয়। একইসাথে গ্রেফতার হয় তাদের আশ্রয়দাতা জামাত নেতা। তাদের তথ্যানুযায়ী ঢাকার নিউমার্কেট অঞ্চলে বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে জঙ্গিরা নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিচ্ছে। দেশে নানা সময়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা আটক হলেও দেশের অভ্যন্তরে এধরনের অবৈধ অভিবাসী সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে। তাই দেশের বিভিন্ন আন্দোলন ও সহিংসতায় এধরনের জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং অবদান সম্পর্কে সঠিকভাবে নিঃশ্চিত হতে পারছেনা সরকার।

গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর ফকিরারপুল এলাকাতে গ্রেফতার হয় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের বাংলাদেশ প্রধান মাওলানা ইউসুফ। তার থেকে জানা যায়, কক্সবাজার, বান্দরবন এলাকায় অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদেরকে টার্গেট করে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জয়েশ-ই মোহাম্মদ বাংলাদেশে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর আগেও দেশে নানা জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ছিলো আস্তানা। এমনকি বাংলাদেশে পড়াশোনা করে নিজ দেশে হামলার পরিকল্পনা করে ভারতের কাশ্মিরের নাগরিক ওয়াসিম আহম্মেদ। মুম্বাইয়ের হাইকোর্টে বোমা হামলার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে তাকে আটক করে মুম্বাই পুলিশ। সে সিলেটের রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল।


দেশের অভ্যন্তরে এভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যকলাপের ব্যাপক বিস্তার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। পার্বত্য অঞ্চল হতে আটককৃত জঙ্গিদের থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক তথ্য আঁতকে উঠার মতো একটি খবর। বান্দরবন এর দুর্গম জঙ্গলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে তাতে উন্নত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে অনেক জঙ্গি। এদের সংখ্যা অনির্দিষ্ট। এভাবে আবার দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কর্মকান্ডের জন্য সংগঠিত হচ্ছে সন্ত্রাসীরা। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদলগুলোর মদদে পার্বত্য অঞ্চলগুলোকে অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করে এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের দলে নিয়ে জঙ্গি তৎপরতার উত্থান বাংলাদেশের জন্য একটি হুমকি।


এই তৎপরতাকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যবহার করছে মৌলবাদী চক্রগুলো। দেশে নানা রকমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে এরা নিজেদের ফায়দা লোটার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর দেশের প্রথম সারির অনেক দৈনিক এবং সংবাদ মাধ্যম নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে তাদের খবরের পাতা গরম রাখলেও দেশের আইন-শৃঙ্খলার এহেন অবনতির খবরে নিরব ভূমিকা পালন করছে। তাই আমাদের সাধারণ নাগরিকদেরই দেশের স্বার্থে সচেতন ও সংঘবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। নয়তো আবার দেখতে হবে অজস্র বোমা হামলা, হামলায় নিহত স্বজনের মৃতদেহ এবং আবার হয়তো রমনার বটমূলের মতো আরেকটি হৃদয় বিদারক সন্ত্রাসী হামলার জন্ম হবে।

তথ্য কৃতজ্ঞতা-

দৈনিক জনকন্ঠ
প্রথম আলো
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-23/news/291927
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=b714c074410d494c9c3ebda30053e0b8&nttl=20120830025930135626
http://dnewsbd.com/single.php?id=376
http://thenews71.com/?p=22820

Thursday, September 13, 2012

এশিয়ার শেষ সিংহেরা

10TH_ASIATIC_LION_141713f
[বিশ্রামরত সিংহ। ছবিসূত্র

সিংহের প্রসঙ্গ এলেই আমাদের প্রথমে যেটা চিন্তায় আসে তাহলো তার রাজসিক ভঙ্গি। সিংহের সোনালী কেশর, তার দুলকি চালে রাজার ভঙ্গিতে হেঁটে চলা, শিকার ধরার সময় ক্ষিপ্র ভঙ্গি, এসবই একে শক্তি, ক্ষমতা ও অহংকারের প্রতীকে পরিণত করেছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। সিংহকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন প্রাচীন সভ্যতা থেকেই। নানা জাতির অলংকার থেকে শুরু করে মুদ্রাতেও স্থান পেয়েছে সিংহের মুখায়ব। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের মুদ্রা থেকে শুরু করে আমাদের এশিয়া মহাদেশের পারস্য, মোঘল, রাজপুত ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ের শাসকদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়েছে।বাংলা ভাষায়ও "সিংহপুরুষ", "সিংহাসন" এই শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয় শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার প্রসঙ্গে।

daciar
প্রাচীন রোমান মুদ্রায় সিংহের প্রতিকৃতি

dacia_etruscilla_r
প্রাচীন রোমান মুদ্রায় সিংহের প্রতিকৃতি


সিংহের প্রসঙ্গ এলেই আমাদের চিন্তায় চলে আসে আফ্রিকার বিস্তৃত বন অঞ্চলের ছবি, সাফারি আর বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সিংহের পরিবারের দৃশ্য। তবে সিংহের

প্রজাতির উত্পত্তির সাথে আফ্রিকার নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও আমাদের উপমহাদেশেই আছে একটি প্রজাতি যা প্রায় ১,০০,০০০ বছর আগে তার পূর্ব পুরুষদের থেকে আলাদা

হয়ে বসবাস শুরু করে এই অঞ্চলে। "এশিয়াটিক লায়ন" এর এই প্রজাতিটি বর্তমানে সিংহের সব থেকে দুর্লভ একটি প্রজাতি। এককালের প্রবল প্রতাপে বনের গহিনে রাজত্ব করে চলা এই প্রজাতিটির হাতে গোনা কিছু সংখ্যক সদস্য এখন জীবত আছে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রজাতিকে নিয়েই একটু জানার চেষ্টা এখানে। অনেকেই ভেবে থাকে সিংহ প্রজাতির একমাত্র বিচরনক্ষেত্র হচ্ছে আফ্রিকা, এর কারণ আর কিছুই নয়, শিকারের নেশায় মানুষ বিপুল সংখ্যক সিংহ হত্যা করেছে বহুকাল ধরে,যার ফলে আফ্রিকা ছাড়া আর প্রায় সব মহাদেশেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর যেখানেও অবশিষ্ট আছে তারাও বিলুপ্তির পথে। একারণে উপমহাদেশে সিংহের প্রজাতি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা কম। এশিয়ার সিংহের প্রজাতিটি আফ্রিকান সিংহের একটি উপ-প্রজাতি। আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের থেকে আলাদা হয়ে এটি ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া মাইনর, আরব অঞ্চল বিশেষ করে পারস্য, ইরান, ভারত এদিকের অঞ্চলগুলোতে। অতীতে এই প্রজাতির সদস্য সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও নানাবিধ কারণে অন্যান্য অঞ্চলগুলো থেকে বিলুপ্ত হতে হতে এখন শুধুমাত্র ভারতের গুজরাট প্রদেশে অবস্থিত "গির অভয়ারণ্য" অঞ্চলে টিকে আছে মাত্র ৪১১টি প্রাণী। ১,৪৫০ বর্গকিলোমিটার এর এই অভয়ারণ্যটিকে পৃথিবীর অন্যতম স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলো।

আফ্রিকান সিংহের সাথে এশিয়াটিক লায়নের পার্থক্য সীমিত। দৈহিক গড়নে এশিয়াটিক লায়ন কিছুটা ছোট, কেশরও কিছুটা কম। এছাড়াও এদের জীবন-যাপনের ধরনে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। এশিয়াটিক লায়ন উচ্চতায় ৯০ সে.মি, এবং দৈর্ঘ্যে ২০০-২৮০ সে.মি এর মতো হয়ে থাকে। এদের ওজনও আফ্রিকান প্রজাতির থেকে কম, ২০০-২৭৫ কে.জি এর মধ্যে। জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সিংহ সবসময়ই দলবদ্ধ ভাবে থাকতে পছন্দ করে, এদের এক একটি দলকে বলা হয় "প্রাইড"। আফ্রিকান সিংহের প্রজাতিতে এক একটি প্রাইডে ৪ থেকে ৬ জন স্ত্রী সদস্য এবং সাথে তাদের সন্তানরা থাকে। তবে এশিয়ার সিংহের প্রাইড কিছুটা কম সদস্য বিশিষ্ট হয়। এতে সর্বোচ্চ দুইজন নারী সদস্য থাকে আর সাথে তাদের সন্তানরা। পুরুষ সদস্যের সংখ্যা ২ থেকে ৩টি। আফ্রিকান প্রজাতির পুরুষ সিংহের মতো এদেরও কেশর আছে তবে পরিমানে কম। কিন্তু এশিয়াটিক লায়নের শরীরে লোমের পরিমান বেশি এবং ঘন। তবে ঘন রংয়ের কেশর খুব অল্পসংখ্যক পুরুষ সিংহের থাকে, ধারণা করা হয় এটি প্রজাতির মধ্যে আভিজাত্যের প্রতীক এবং নারী সিংহরাও প্রজননের সময় এধরনের সিংহকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এছাড়াও তাদের লেজের শেষে লোমের দৈর্ঘ্যও বেশি। এছাড়া খাদ্যাভাস এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য প্রায় একই।

Captive-Male-Lion-L
পুরুষ এশিয়াটিক লায়ন


asiatic-lion
নারী এশিয়াটিক লায়ন


lion mane chart_thumb[12]



ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় সিংহের বিচরণক্ষেত্র ছিলো উত্তর ভারত থেকে শুরু করে পূর্বে বিহার পর্যন্ত নর্মদা নদীর তীর ঘেঁষে। কালক্রমে এই অঞ্চলগুলো থেকে সিংহের প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতে হতে সব শেষে বর্তমানের গুজরাট প্রদেশে কিছুসংখ্যক টিকে থাকে। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, বিহারে ১৮৪০, দিল্লীতে ১৮৩৪, ভাওয়ালপুরে ১৮৪২, পূর্ব ভিন্দ্যাস এবং বুন্দেলখন্ডে ১৮৬৫, মধ্য ভারত এবং রাজস্থানে ১৮৭০ এবং পশ্চিম আরাভালিতে ১৮৮০ সালের মধ্যে সিংহ বিলুপ্ত হয়ে যায়। সৌরাষ্ট্রতে ১৮৮৪ সালে সর্বশেষ সিংহ দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

Map_Guj_Gir_NatPark_Sanctuary
গুজরাটের গির অভয়ারণ্য


১৯০১-১৯০৫ এর দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীতে অনেক সিংহ বিলুপ্ত হয়। খাদ্যের জন্য এরা লোকালয়ে হানা দেয়া শুরু করে এবং গবাদিপশুর উপর হামলা করতে থাকে। এর জবাবে গ্রামবাসী সিংহ নিধন শুরু করে। তবে সিংহের বিলুপ্তপ্রায় এই প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান ছিলো জুনাগড়ের নবাব এর। তিনি গ্রামবাসীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থার মাধ্যমে সিংহ নিধন বন্ধ করতে সক্ষম হন এবং ১৯০৪-১৯১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সিংহের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। নবাব ১৮ শতকের শেষের দিকে গির অঞ্চলে মাত্র এক ডজন সিংহের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।তিনি সিংহ হত্যার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং দর্শনার্থীদের জন্য নবারের দরবার থেকে অনুমতির পদ্ধতি শুরু করেন, যা ছিলো অত্যন্ত কঠোর। এছাড়াও গির অঞ্চলে তিনি সিংহের জন্য নিরাপদ একটি বিচরণক্ষেত্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আবার সিংহ শিকার শুরু হয়, প্রতি বছর প্রায় ১২-১৩টি সিংহ শিকারের খবর পাওয়া যেতে থাকে। ১৯১১ এর পরে ব্রিটিশ প্রশাসন সিংহ শিকারে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং সেসময় জুনাগড়ের বন কর্মকর্তার হিসাব অনুযায়ী সেখানে মাত্র ২০টি সিংহ অবশিষ্ট ছিলো।

এশিয়াটিক লায়নের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে লাগামছাড়া শিকার। বিপুল সংখ্যক সিংহ এভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও খাদ্যাভাব আরও বড় একটি কারণ। খাদ্যের অভাবে এবং বিচরণক্ষেত্রের অপ্রতুলতার জন্য খুব দ্রুত বংশহ্রাস ঘটে এই প্রজাতির। তবে ১৯৩৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৮৭টি সিংহের সংখ্যা নথিবদ্ধ করা হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে গির বনাঞ্চলকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সিংহের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয় প্রশাসন। ১৯৬৮ সালের ১৭৭টি সিংহের থেকে ২০০৫ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৯টি। বর্তমানে দুর্লভ এই প্রজাতিটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪১১।

এশিয়াটিক লায়ন এর এই প্রজাতিটিকে কৃত্রিমভাবে বংশবিস্তারের চেষ্টা সফল হয়নি এখনও। এছাড়াও খুবই অল্পসংখ্যক সদস্যের মধ্যেই প্রজননের প্রচলন থাকায় এবং প্রজননের বিশুদ্ধতা রক্ষা করায় এদের সাথে অন্য প্রজাতির প্রজননের ক্ষেত্রে কোন সফলতা এখনও আসেনি। তাই পৃথিবীর দুর্লভ প্রানীদের মধ্যে এশিয়াটিক লায়ন অন্যতম।

সিংহের জীবন যাপন বৈচিত্রময়। এরা নিজেদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে থাকে, এমনকি শিকারও করে এক সাথে। এক একটা দলে ৩ জন পর্যন্ত পুরুষ সদস্য থাকে। কিন্তু শিকার হতে শুরু করে পরিশ্রমের সব কাজ করতে হয় নারী সদস্যদের। তবে পুরো দলের মধ্যে একজন পুরুষ নেতা থাকে, যে সম্পূর্ণ দলটি নিয়ন্ত্রণ করে। শিকারের ক্ষেত্রেও সিংহ দারুন নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, দলের কিছু নারী সদস্য একটি শিকারকে তাড়া করে কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যায় যেখানে আগে থেকে দাঁড়িয়ে
থাকা বাকি সদস্যরা শিকারটিকে অতর্কিতে আক্রমন করতে পারে। শিকারের ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে কিংবা দাঁত দিয়ে মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে শিকারকে কাবু করে এরা। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও দলবদ্ধভাবে বিপদের মোকাবেলা করে সিংহরা, একদম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের মতো। পারিবারিক সম্পর্ক একটি দলের মধ্যে দারুন, পরিবারের নারী সদস্যরা মিলিতভাবে সন্তানদের পালন করে এবং দেখাশোনা করে।

images
[বিশ্রামরত অবস্থায় সিংহের একটি পরিবার]


বর্তমানে এশিয়াটিক লায়নের দুর্লভ এই প্রজাতিটির কৃত্রিমভাবে বংশবিস্তারের চেষ্টা চলছে। এছাড়াও গির অঞ্চলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অন্য আরেকটি অভয়ারন্যে কিছু সংখ্যক সিংহ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।এশিয়াটিক লায়ন প্রাচীন কাল থেকেই উপমহাদেশের নানা বৈচিত্র্যময় মাধ্যমে স্থান পেয়েছে। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এই প্রজাতির সিংহ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এমনকি সম্রাট অশোক এর আমলে নির্মিত অশোকস্তম্ভতেও এই প্রজাতির চারটি সিংহের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। এই অশোকস্তম্ভের প্রতীক ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসে সম্রাট অশোকই প্রথম ব্যক্তি যিনি সিংহ সংরক্ষণের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শ্রীলংকার জাতীয় পতাকাতেও শোভা পায় সিংহের প্রতীক যা এই প্রজাতির। সিংহলি কথাটাও এসেছে এই সিংহ থেকেই। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এশিয়াটিক লায়নের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন শাসকের রাজত্বকালে।

national-emblem-of-india
অশোকস্তম্ভ

Sri-Lanka-Flag
[শ্রীলংকার জাতীয় পতাকা]

বিলুপ্তপ্রায় সিংহের এই প্রজাতিটি মানুষের নৃশংসতা এবং নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছে কোনমতে। অতি প্রাচীন একটি দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষন করা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের এই অঞ্চলগুলো থেকে নানা প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাবে এবং গুপ্ত চোরাচালানি ও শিকারীদের দৌরাত্ম্যে। বিলুপ্তপ্রায় প্রানীদের সংরক্ষণের মাধ্যমে এদের বংশবিস্তার নিঃশ্চিত করে এদের টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন অভয়ারণ্য এবং উন্নত পদ্ধতির লালন-পালনের ব্যবস্থা। নয়তো এভাবেই একদিন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে এরা হয়তো সাথে সাথে একদিন আমরাও। বনের রাজা সিংহ শুধু শিশুদের গল্পের বইয়ের পাতাতেই নয়, রাজত্ব করুক অরন্যে গহিনে দাপটের সাথে।

[সম্রাট অশোকের রাজত্বকালের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সারনাথ ভ্রমণের সময়। সর্বশেষ অশোক স্তম্ভের ভগ্নাংশগুলো রক্ষিত আছে এখানে আর মূল অংশটি কাছের জাদুঘরে সেখানে ক্যামেরা নেয়া বারণ। এটিই ভারতের সংরক্ষিত একমাত্র অশোকস্তম্ভ। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে সারনাথের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানেই গৌতম বুদ্ধ তাঁর দর্শন শিক্ষা দান করেন অনুসারীদের মাঝে। একটা বাগানও ছিলো গৌতম বুদ্ধের, এখানে তিনি হরিণ পালন করতেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য মঠ।

DSCN0144
[অশোকস্তম্ভের বেদীর ভগ্নাংশ। সারনাথ ভ্রমণের সময় তোলা।]

DSCN0161
[সারনাথ এর একাংশ। মঠের ধ্বংসাবশেষ]]









http://www.asiaticlion.org/index.htm
http://www.wildlywise.com/asiatic_lions.htm
http://ngm.nationalgeographic.com/ngm/0106/feature3/index.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Asiatic_Lion
http://en.wikipedia.org/wiki/Gir_Forest_National_Park
http://en.wikipedia.org/wiki/Lion
http://www.thehindu.com/news/states/tamil-nadu/article507831.ece

ভাত চাই না মা, কুত্তা সামলা


[ছবি কৃতজ্ঞতা: দ্যা ডেইলি স্টার। চিত্রগ্রাহক: প্রবীর দাস।]

সরকার এবছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা পুরনো খবর। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও এসেছে অসংখ্য। বর্তমানে এই সিদ্ধান্তটি কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে, সরকারকে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আহব্বান জানিয়েছে এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখাও করেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে জনগনের মতামত আসবে, তর্ক-বিতর্ক চলবে, প্রতিবাদ হবে এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। জনগনের মত প্রকাশের অধিকার গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলোর একটি। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কর্মসূচির পেছনেই রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য থাকে, কখনো কখনো সেটা রূপ নেয় সহিংসতায়। কিন্তু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এতে অংশ নিয়েছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। আর এখন পর্যন্ত এই প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে সহিংসতার কোনো খবরও আসেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতেই পারে। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি। শুধু তাই নয়, এটি তাদের জীবন এর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর সাথেও জড়িত। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির অধিকার সকল সাধারণ নাগরিকেরই আছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি জানমালের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এতে সরাসরি হস্তক্ষেপের কোনো কারণ দেখিনা। নিরাপত্তা প্রদান অবশ্যই তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু শান্তিপূর্ণ একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বিনা উস্কানিতে হামলা করা কোনো সভ্য সমাজেই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। এটি সাধারণ জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি চরম আঘাত।

আজকে দৈনিক ডেইলি স্টার এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হওয়া এই চিত্রটি এরকমই একটি ঘটনা। "COPS OR CRIMINALS?" শিরোনামে ছাপা হওয়া এই ছবিটি দেখে আমি স্তম্ভিত, লজ্জিত, ক্ষুদ্ধ এবং ভীষনভাবে অপমানিত। আমি নিজেও একজন ছাত্র। একজন নিরপরাধ ছাত্রের উপরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এরকম আক্রমন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। এই যুবকটিকে আমি চিনিনা। কোনদিন দেখিওনি। কিন্তু এই মানুষটির বিরুদ্ধে কতিপয় মানুষের নির্দয় আচরণ আমাকে বাকরুদ্ধ করেছে। এভাবে একজন মানুষকে দলবদ্ধভাবে বুটজুতা পায়ে কেউ লাথি মারতে পারে এটা ভেবে আমি শিউরে উঠেছি, আর তাদের হাতেই কিনা আমরা নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছি??!! এহেন পাশবিক নির্যাতন যারা আইনের রক্ষক হয়ে করতে পারে তাদের আমি লাইসেন্সপ্রাপ্ত গুন্ডা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনা। খাকি পোশাক পড়ে মানুষকে নির্যাতনের লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো নিজেরাও একসময় ছাত্র ছিলো ভাবতে অবাক লাগে!! এদের মধ্যে মানবিকতার ছিটেফোঁটাও বাকি আছে কিনা এই নিয়ে আমার সন্দেহ হয়।

চট্টগ্রামের নন্দন কাননে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে জমায়েত হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে এভাবেই হামলা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাধারণ জামা-কাপড় আর স্যান্ডেল পড়া এই যুবকটিকে একদল পুলিশ এভাবেই নির্বিচারে মারধর করে। পরে তার সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ৮ জনকে। যুবকটির হাতে নেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র, নেই কোনো লাঠি, এমনকি নেই কোনো ইটের টুকরো। কোনভাবেই এই যুবকটি কি জানমালের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ? যদি তা নয়, তাহলে শান্তিপূর্ণ জমায়েতে অংশগ্রহণকারী এই যুবকটিকে এভাবে অত্যাচার করার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? যদি যুবকটি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তার বিচার প্রচলিত আইনের মাধ্যমে হবে, কিন্তু তাকে গ্রেফতারের সময় এভাবে অত্যাচার করার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে? খাকি পোশাক গায়ে থাকলেই সাধারণ মানুষকে এভাবে অত্যাচার করার অধিকার পুলিশবাহিনীকে কোন আইনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে? সরকারের কাছে এর জবাবদিহিতা আশা করি আমরা।

দেশের মেধাবীরা সুযোগ পেলেই দেশের বাইরে চলে যায়। আর কখনো দেশে ফেরৎ আসতেও চায়না। এরকম অভিযোগ অনেকদিন ধরেই। কিন্তু দেশে থাকবে কোন আশায়? কোনো একদিন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হতে কিংবা এভাবেই সরকারী গুন্ডাদের নির্দয় লাঠিপেটা আর লাথি সহ্য করতে?

মেডিকেলে ভর্তির ব্যাপারে যারা সরকারের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা আমার থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী মানুষ এ আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এহেন অত্যাচারের শিকার কেন হতে হবে? একজন সাধারণ নাগরিক যদি নিজের মত প্রকাশ না করতে পারে,সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ নাই করতে পারে তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র আর গণতান্ত্রিক থাকে কি করে? যদি যেকোনো প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এভাবে খাকি পড়া সরকারী গুন্ডা লেলিয়ে দেয়া হয় তাহলে সে দেশের নাগরিকদের অধিকার বলতে কি আর কিছু বাকি থাকে?

আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক আগেই নিজেদের কর্মগুণে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও তাদের সুনাম অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়ে। কিন্তু এভাবে আর কতো? আজকে এই যুবকটির শরীরে যে লাথিগুলো পড়ল তার একটা লাথি যে এরপরে আমার কিংবা আপনার গায়েও পড়বেনা এর কি কোন নিঃশ্চয়তা সরকার দিতে পারে? সরকারের অধীনে থাকা পুলিশবাহিনীকে যদি সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই দেশের জনগনের নিরাপত্তার দায়িত্ব কার?

খালেদ মোহাম্মদ সাইদ, নামটি হয়তো হঠাৎ করে কারো পরিচিত মনে হবেনা। কিন্তু ২৮ বছরের এই যুবকের মৃত্যু সারা পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। ২০১০ এর ৬ই জুন, এই যুবককে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের একটি সাইবার ক্যাফে থেকে গ্রেফতার করে মারতে মারতে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর নির্দয় ভাবে মারধর করে হত্যা করে তাকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের এহেন অত্যাচারে চুপ করে থাকেনি অন্যরা। প্রতিবাদ শুরু হয়। "উই আর অল খালেদ সাইদ" নামে তৈরী হয় একটি ফেসবুক গ্রুপ আর ফেসবুক এবং টুইটারের কল্যানে তারুণ্যের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের অত্যাচারে বিকৃত হয়ে যাওয়া সাইদ এর মুখমন্ডলের ছবি। ব্যাস বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। সেই আগুন শুধু মিশরেই থেমে থাকেনি। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো আশেপাশের দেশগুলোতেও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বহুকাল ধরে চলে আসা একনায়কতন্ত্র আর রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার দমনের তীব্র প্রতিবাদে একে একে পতন ঘটে বেশ কয়েকটি দেশের স্বৈরাচারী সরকারের। বর্তমানে প্রতিবাদের এই ঘটনাটি "আরব বসন্ত" নামে পরিচিত।

যদি আরব বসন্তের মতো ঘটনা থেকেও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষা না নিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো কিছুই বলার থাকেনা। সাধারণ জনগনের প্রতি অযথাই নির্যাতনের এরকম ঘটনাগুলিই মিলিত হয়ে একসময় চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। জনগনের অসন্তোষ ধীরে ধীরে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ক্রমশই লাগামছাড়া হয়ে যাওয়া এই গুন্ডাবাহিনীকে যদি সরকার সামলাতে ব্যর্থ হয় তাহলে আর একটি আগুন বসন্তের জন্ম যে হবেনা তার নিঃশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে??