Thursday, September 13, 2012

ভাত চাই না মা, কুত্তা সামলা


[ছবি কৃতজ্ঞতা: দ্যা ডেইলি স্টার। চিত্রগ্রাহক: প্রবীর দাস।]

সরকার এবছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা পুরনো খবর। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও এসেছে অসংখ্য। বর্তমানে এই সিদ্ধান্তটি কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে, সরকারকে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আহব্বান জানিয়েছে এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখাও করেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে জনগনের মতামত আসবে, তর্ক-বিতর্ক চলবে, প্রতিবাদ হবে এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। জনগনের মত প্রকাশের অধিকার গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলোর একটি। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কর্মসূচির পেছনেই রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য থাকে, কখনো কখনো সেটা রূপ নেয় সহিংসতায়। কিন্তু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এতে অংশ নিয়েছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। আর এখন পর্যন্ত এই প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে সহিংসতার কোনো খবরও আসেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতেই পারে। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি। শুধু তাই নয়, এটি তাদের জীবন এর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর সাথেও জড়িত। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির অধিকার সকল সাধারণ নাগরিকেরই আছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি জানমালের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এতে সরাসরি হস্তক্ষেপের কোনো কারণ দেখিনা। নিরাপত্তা প্রদান অবশ্যই তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু শান্তিপূর্ণ একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বিনা উস্কানিতে হামলা করা কোনো সভ্য সমাজেই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। এটি সাধারণ জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি চরম আঘাত।

আজকে দৈনিক ডেইলি স্টার এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হওয়া এই চিত্রটি এরকমই একটি ঘটনা। "COPS OR CRIMINALS?" শিরোনামে ছাপা হওয়া এই ছবিটি দেখে আমি স্তম্ভিত, লজ্জিত, ক্ষুদ্ধ এবং ভীষনভাবে অপমানিত। আমি নিজেও একজন ছাত্র। একজন নিরপরাধ ছাত্রের উপরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এরকম আক্রমন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। এই যুবকটিকে আমি চিনিনা। কোনদিন দেখিওনি। কিন্তু এই মানুষটির বিরুদ্ধে কতিপয় মানুষের নির্দয় আচরণ আমাকে বাকরুদ্ধ করেছে। এভাবে একজন মানুষকে দলবদ্ধভাবে বুটজুতা পায়ে কেউ লাথি মারতে পারে এটা ভেবে আমি শিউরে উঠেছি, আর তাদের হাতেই কিনা আমরা নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছি??!! এহেন পাশবিক নির্যাতন যারা আইনের রক্ষক হয়ে করতে পারে তাদের আমি লাইসেন্সপ্রাপ্ত গুন্ডা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনা। খাকি পোশাক পড়ে মানুষকে নির্যাতনের লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো নিজেরাও একসময় ছাত্র ছিলো ভাবতে অবাক লাগে!! এদের মধ্যে মানবিকতার ছিটেফোঁটাও বাকি আছে কিনা এই নিয়ে আমার সন্দেহ হয়।

চট্টগ্রামের নন্দন কাননে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে জমায়েত হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে এভাবেই হামলা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাধারণ জামা-কাপড় আর স্যান্ডেল পড়া এই যুবকটিকে একদল পুলিশ এভাবেই নির্বিচারে মারধর করে। পরে তার সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ৮ জনকে। যুবকটির হাতে নেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র, নেই কোনো লাঠি, এমনকি নেই কোনো ইটের টুকরো। কোনভাবেই এই যুবকটি কি জানমালের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ? যদি তা নয়, তাহলে শান্তিপূর্ণ জমায়েতে অংশগ্রহণকারী এই যুবকটিকে এভাবে অত্যাচার করার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? যদি যুবকটি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তার বিচার প্রচলিত আইনের মাধ্যমে হবে, কিন্তু তাকে গ্রেফতারের সময় এভাবে অত্যাচার করার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে? খাকি পোশাক গায়ে থাকলেই সাধারণ মানুষকে এভাবে অত্যাচার করার অধিকার পুলিশবাহিনীকে কোন আইনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে? সরকারের কাছে এর জবাবদিহিতা আশা করি আমরা।

দেশের মেধাবীরা সুযোগ পেলেই দেশের বাইরে চলে যায়। আর কখনো দেশে ফেরৎ আসতেও চায়না। এরকম অভিযোগ অনেকদিন ধরেই। কিন্তু দেশে থাকবে কোন আশায়? কোনো একদিন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হতে কিংবা এভাবেই সরকারী গুন্ডাদের নির্দয় লাঠিপেটা আর লাথি সহ্য করতে?

মেডিকেলে ভর্তির ব্যাপারে যারা সরকারের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা আমার থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী মানুষ এ আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এহেন অত্যাচারের শিকার কেন হতে হবে? একজন সাধারণ নাগরিক যদি নিজের মত প্রকাশ না করতে পারে,সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ নাই করতে পারে তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র আর গণতান্ত্রিক থাকে কি করে? যদি যেকোনো প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এভাবে খাকি পড়া সরকারী গুন্ডা লেলিয়ে দেয়া হয় তাহলে সে দেশের নাগরিকদের অধিকার বলতে কি আর কিছু বাকি থাকে?

আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক আগেই নিজেদের কর্মগুণে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও তাদের সুনাম অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়ে। কিন্তু এভাবে আর কতো? আজকে এই যুবকটির শরীরে যে লাথিগুলো পড়ল তার একটা লাথি যে এরপরে আমার কিংবা আপনার গায়েও পড়বেনা এর কি কোন নিঃশ্চয়তা সরকার দিতে পারে? সরকারের অধীনে থাকা পুলিশবাহিনীকে যদি সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই দেশের জনগনের নিরাপত্তার দায়িত্ব কার?

খালেদ মোহাম্মদ সাইদ, নামটি হয়তো হঠাৎ করে কারো পরিচিত মনে হবেনা। কিন্তু ২৮ বছরের এই যুবকের মৃত্যু সারা পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। ২০১০ এর ৬ই জুন, এই যুবককে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের একটি সাইবার ক্যাফে থেকে গ্রেফতার করে মারতে মারতে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর নির্দয় ভাবে মারধর করে হত্যা করে তাকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের এহেন অত্যাচারে চুপ করে থাকেনি অন্যরা। প্রতিবাদ শুরু হয়। "উই আর অল খালেদ সাইদ" নামে তৈরী হয় একটি ফেসবুক গ্রুপ আর ফেসবুক এবং টুইটারের কল্যানে তারুণ্যের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের অত্যাচারে বিকৃত হয়ে যাওয়া সাইদ এর মুখমন্ডলের ছবি। ব্যাস বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। সেই আগুন শুধু মিশরেই থেমে থাকেনি। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো আশেপাশের দেশগুলোতেও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বহুকাল ধরে চলে আসা একনায়কতন্ত্র আর রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার দমনের তীব্র প্রতিবাদে একে একে পতন ঘটে বেশ কয়েকটি দেশের স্বৈরাচারী সরকারের। বর্তমানে প্রতিবাদের এই ঘটনাটি "আরব বসন্ত" নামে পরিচিত।

যদি আরব বসন্তের মতো ঘটনা থেকেও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষা না নিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো কিছুই বলার থাকেনা। সাধারণ জনগনের প্রতি অযথাই নির্যাতনের এরকম ঘটনাগুলিই মিলিত হয়ে একসময় চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। জনগনের অসন্তোষ ধীরে ধীরে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ক্রমশই লাগামছাড়া হয়ে যাওয়া এই গুন্ডাবাহিনীকে যদি সরকার সামলাতে ব্যর্থ হয় তাহলে আর একটি আগুন বসন্তের জন্ম যে হবেনা তার নিঃশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে??

No comments:

Post a Comment