২০০১
২০০১ সালের এক সকালে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ আর ভারী পাথর গড়িয়ে পড়ার প্রচন্ড শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল আফগানিস্থানের বামিয়ান প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চল।
ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন তালিবান সরকারের উগ্রপন্থীরা সেদিন সকালে বিস্ফোরক দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল যথাক্রমে ১৮০ ফুট ও ১২১ ফুট উচ্চতার, পাথর কুঁদে তৈরী করা
হাজার বছরের পুরনো দুটো বৌদ্ধমূর্তি। এই দুটো সুউচ্চ প্রস্থরমূর্তি ছিলো আফগানিস্থানে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। তালিবানরা ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা
এদুটো মূর্তিকে তাদের ধর্মবিরোধী স্থাপনা হিসেবে উল্লেখ করে ধ্বংস করতে তৎপর ছিলো। অবশেষে ২০০১ সালের মার্চের ২ তারিখ থেকে, শুরু হয় এই ধ্বংসযজ্ঞ।
এন্টিএয়ারক্রাফট গান, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক সবধরনের শক্তি প্রয়োগ করে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উন্মত্ত কিছু মানুষ (!!) ধ্বসিয়ে দিতে থাকে পাথরের মূর্তিগুলো।
শেষে ডিনামাইটের শক্তিতে স্থাপত্যগুলো পুরো ধ্বংস করে ক্ষান্ত দেয় তারা। এভাবেই ধর্মীয় উগ্রপন্থার শিকার হয়ে হারিয়ে যায় মানব সভ্যতার অত্যন্ত মূল্যবান দুটো
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
[ছবিসুত্র উইকিপিডিয়া]
সেদিন কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অবমাননা হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে এটা সত্যি, অবমাননা হয়েছিল মানব সভ্যতার। যেই উন্নত সংস্কৃতি আর
কৃষ্টির জোরে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, সেদিন আর কিছুর না হোক, দুটো পাথরের নির্বাক-নিষ্প্রাণ মূর্তি ভেঙ্গে অপমান করা হয়েছিল তার। অপমান হয়েছিল
মানবিকতার।
২০১২
৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১২। কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে একদল ধর্মান্ধ উন্মাদ হামলা চালায় সে অঞ্চলের বৌদ্ধ বসতিগুলোতে।
গভীর রাতে এই হামলায় আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয় ৭টি বৌদ্ধ মন্দির এবং ৩০টি বাড়ি। ভাংচুর করা হয় আরও শতাধিক বসতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
ফেইসবুকে কোরআন শরিফ অবমাননা করে ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগ এনে শনিবার রাতে করা এই তান্ডবে কমপক্ষে ১০টি বৌদ্ধ গ্রামে হামলা চালিয়ে বসতভিটায় আগুন
জ্বালিয়ে দেয়া হয়, লুটপাট করা হয়।
ছবিসূত্র
ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। রামুর পর পটিয়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালায় ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। রোববার বেলা ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে এই হামলায় দুটি হিন্দু
মন্দির ও দুটি বৌদ্ধ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত করে হামলাকারীরা। তবে এই অঞ্চলে ঠিক কে, কাকে, কিভাবে, অবমাননা করলো সে বিষয়ে কোন খবর নেই কারো কাছে! তবে
হামলা যখন হয়েছে, ধরে নিতেই হচ্ছে কারো অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। এভাবেই আজকাল বড় নাজুক মানুষের এই ধর্মীয় অনুভূতি।
তবে এতোগুলো ধর্মীয় স্থাপনা ভেঙ্গে, এতো মানুষের ঘর পুড়িয়ে দেয়ায়, আক্রান্ত মানুষগুলোর কারো কোন অনুভূতিতে আঘাত নিঃশ্চয় হয়নি, একথা আমি হলপ করে বলতে
পারি। সংখ্যালঘুদের অনুভূতি আঘাতপ্রুফ। এতো সহজে তাতে আঘাত লাগেনা। তবে অন্য কারো মানবিক অনুভূতিতে আঘাত লাগলো কিনা সেটা একটা প্রশ্ন বটে। নাও
লাগতে পারে, সংখ্যালঘুরা কি মানুষ?
২০০১
এবার আবার ২০০১। তবে এবার বাংলাদেশ। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই দলবেধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্ত উগ্রপন্থীরা। গ্রামের পর গ্রাম চলে
অগ্নি-সংযোগ, হত্যা, লুন্ঠন, গণধর্ষণ, নির্যাতন।১১ বছর আগের হলেও এরকম কয়েকটি ঘটনা মনে গেঁথে আছে।
গভীর রাতে প্রায় ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল এমনি একটি গ্রামের ঘরে প্রবেশ করে। তিন সদস্যের ঐ ঘরে বাবা-মাকে বাইরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের অল্পবয়সী
মেয়ে সন্তানটিকে ধর্ষণ শুরু করে। সেসময় মেয়েটির মা সন্ত্রাসীদের কাছে হাতজোড় করে যেই কথাটি বলেছিল, "বাবা তোমরা একজন একজন করে যাও, আমার মেয়েটা
এখনও ছোট......।" ঠিক কতোটা অসহায় হলে সন্তানের জন্মদাত্রী মা এই অনুরোধ করতে পারেন সেটা আমার জানা নেই।
আরেকটি ঘটনায় গান-পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল একটি ঘরে। বের হতে দেয়া হয়নি ঘরের একজন সদস্যকেও।
একগ্রামে পালাক্রমে নির্যাতনের শিকার হয় শাশুড়ি-পুত্রবধু। অপমান সইতে না পেরে পরের দিন সকালে আত্মহত্যা করে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।
পূর্ণিমা নামের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মেয়েটিকে এভাবেই দলবেধে নির্যাতন করেছিল কিছু পশু। বহুল আলোচিত এই ঘটনাটি সেসময়ের অসংখ্য ঘটনাগুলোর মাত্র একটি।
এরপরে দেশ ছেড়ে, নিজের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকে। সাথে করে নিয়ে গেছেন কিছু দুঃসহ-অবর্ণনীয় স্মৃতি। পার হয়ে গেছে ১১টি বছর। সময় খুব দ্রুত হারিয়ে
যায়। মুছে যায়না শুধু ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো।
২০১২
সরকার বদল হয়েছে। বদল হয়েছে অনেক কিছুই।
বদল হয়নি সংখ্যালঘুদের জীবনচিত্র। তাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সাতক্ষীরা আর দিনাজপুরে পুড়েছে তাদের ঘর, ভেঙ্গেছে তাদের উপাসনালয়, লুট হয়েছে তাদের সম্পদ।
শিক্ষিকার একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তানকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছে উগ্রপন্থীরা। একজন প্রতিবন্ধী শিশুকে!!
সংখ্যালঘুরা তাই আবারও ঘর ছেড়েছে। পালিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। যেভাবে তাদের আশেপাশের অনেকেই পালিয়েছিলো অতীতে। পেছনে পড়ে রয়েছে ঘরের ভাঙ্গা টিনের
চাল, কিছু হাড়ি-পাতিল আর দীর্ঘশ্বাস।
_________________________________________________________________________________________
____________
পত্রিকায় সংবাদ, এদেশে ১০ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমেছে ৯ লাখ। আসলে বাস্তবতায় সংখ্যাটা আরও বেশি। এটা আমরা জানি। জেনেও চুপ থাকি। কারণ
চুপ থাকাটাই স্বাভাবিক, এসব বিষয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়না। সংখ্যালঘুদের দেশান্তরের হার বেশি। এরা কোথায় যায় আর কেনই বা যায়? কারনটা সবাই জানি, কিন্তু
বলা বারণ। সব কথা বলতে হয়না।
এদেশে মানুষ "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা" কথাটা অহরহ ব্যবহার করে। এদেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়না, হবেও না। দাঙ্গায় মারে দুইদলই, মরেও দুইদলই। কিন্তু এদেশে মারে
একদল, মার খায় আর মরে আরেকদল। তাই এদেশে হয় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। আর এই নির্যাতন সবসময় হয়েছে। গনিমতের মাল হিসেবে নির্যাতন করেছে পাকিস্তানিরা,
এরপরে করেছে স্বদেশীরা। শুধু হাত বদল। নির্যাতনের কথা উঠলেই নানা ষড়যন্ত্রের কথা এসেছে, এসেছে রাজনৈতিক পালা বদলের কথা। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা অহেতুক,
কিছু সংখ্যায়-শক্তিতে দুর্বল মানুষকে নির্যাতন করতে কোন কারণ লাগেনা। তাদের দুর্বলতাটাই যথেষ্ট বড় কারণ। লাগে শুধু একটু উস্কানি। আর এই দেশে উস্কানির অভাব
হয়না। নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোতে ওস্তাদ এদেশের মানুষ। তাই কোন মহাদেশের কোন চিপায় কোন অবমাননা হলেই হলো, হাতের ঝাল মেটাতে দলবেধে নেমে
পড়ে। আর এরজন্য সব থেকে ভালো টার্গেট আর কি হতে পারে?
এই নির্যাতনের শেষ হবে না, তাই সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে পালাবে। এটা স্বাভাবিক। তবে আমার চিন্তা অন্যখানে, একদিন দেশে সংখ্যালঘু নামক সম্প্রদায় থাকবেনা। সবাই
সংখ্যাগুরু। তখন কাদের বাড়ি পোড়ানো হবে, কাদের খুন করা হবে, কাদের স্ত্রী-সন্তানকে গণধর্ষণ করা হবে?
লেখার শুরুতে আফগানিস্থানের ঘটনাটা কেন লিখলাম? কেউ যদি দুই দেশের ঘটনাচক্রের মাঝে কোন মিল খুঁজে পেয়ে থাকেন তাহলে সেটা হয়তো কাকতাল মাত্র। আমার
শুধু মনে হয়, ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্য কোন নির্দিষ্ট দেশের প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন হয় মানুষরুপী কিছু ধর্মান্ধ পশু আর কিছু নিঃশ্চুপ মেরুদন্ডহীন মানুষের।
একটা প্রিয় উক্তি আছে আইনস্টাইন বুড়োর-
“The world is a dangerous place to live, not because of the people who are evil, but
because of the people who don't do anything about it.”
No comments:
Post a Comment