Friday, November 30, 2012

জীবনযুদ্ধ

শ্বেতশুভ্র চুল-দাড়ির বর্ষীয়ান মানুষটি তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে। হালকা শীতের সকালে সামনের গাছটায় ছোট্ট দুটো চড়ুই পাখির ঝগড়া। ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু করে কাঁপে গাছের শুকনো পাতা। রাস্তা দিয়ে রোজকার মতো আজকেও ব্যতিব্যস্ত মানুষের দল ছুটে চলে অনির্দিষ্ট পথে। এসব কিছুই তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে পারেনা আজকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু ভাবেন, ভেবে চলেন, মাথার ভেতরে অজস্র স্মৃতিরা যুদ্ধ করে, ফিরে ফিরে আসে। নিজের অজান্তেই একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় যান্ত্রিক জীবনের কোলাহলমুখরতায়।


ছোট্ট নাতনীটি পাশ ঘেঁষে বসে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দাদুর পায়ে লাগানো সাদা ব্যান্ডেজ এর দিকে। গোড়ালির কাছটায় লাল ছোপ। তিনি মুখ তুলে তাকান, নাতনীর অবাক বিস্ময় তাকে একটু হলেও স্পর্শ করে। ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকিয়ে নিজেও মাথা নাড়েন একটু একটু।

"এখানে কি হয়েছে দাদু?"

এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা থাকলেও, সত্যি উত্তরটা তার দেয়ার ইচ্ছে নেই। তিনি চুপ করে থাকেন, নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।



তার চোখে ভাসে, ৭১ এর আগস্টের ২ তারিখ।

নোয়াবাদী রেললাইনের পূর্বপাশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সেদিন যে ১১ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি আক্রমন করেছিল, তিনি ছিলেন তাদেরই একজন। তখন তিনি টগবগে যুবক। সেদিন যুদ্ধের শুরু থেকে ঘন্টা তিনেক তিনি আর হাবিলদার নবী মিলে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। এরইমাঝে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া একটি মর্টার শেল তাদের সামনে এসে পড়ে। প্রচন্ড শব্দে মুহূর্তেই বড় একটা গর্ত করে দেয় মাটিতে। বিস্ফোরণের সাথে সাথে স্প্লিন্টার ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে। তার পায়েও এসে বেঁধে কয়েকটা। কিন্তু মর্টার চালানোর ফাঁকে আর খেয়াল ছিলোনা ওতো। যখন খেয়াল হলো তখন দেখেন রক্তে ভিজে গেছে মাটি, আর গোড়ালিটা ভেঙ্গে বিচূর্ণ হয়ে গেছে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান।

সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে নিয়ে যায় আগরতলা হাসপাতালে। জ্ঞান ছিলোনা কয়েকদিন। সেসময় হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। গোড়ালির এরকম অবস্থায় চিকিৎসা সহজ ছিলোনা মোটেও। পরে একে একে বেশ কয়েকটা জায়গায় চিকিৎসা হয়েছিল। সর্বশেষে ছিলেন রামগড়ে। হাসপাতালে থাকতেই শোনেন দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা। ভারতীয় সৈনিকেরা এসেছিল শুভেচ্ছা জানাতে। অশ্রুসজল হয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের কথা শুনে।

...............ঠিক মনে হয় সেদিনের কথা।

কথাগুলো মনে পড়তেই অজান্তে দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তার দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকে।



যুদ্ধ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। সেই স্বাধীন দেশে মলিন পোশাকে তিনি এখন পায়ের যন্ত্রনায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন। আশেপাশের লোক ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ভাবে কোন ভিক্ষুক হয়তো, এখনই হাত পাতবে এসে। স্বাধীন দেশে রাজাকার হয়েছে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী। তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছে বঙ্গভবনে। তিনি রাষ্ট্রপতির মুখের উপর বলে এসেছিলেন, রাজাকার রাষ্ট্রপতির সাথে হাত মেলাবেন না। কথাটা মনে পড়তেই এতো কষ্টের মাঝে হাসি পায় তার। রাজাকাররা গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা লাগিয়ে ঘোরে, সার্টিফিকেটের জোরে অনেকেই হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সবই দেখেন, সবই বোঝেন।

প্রচন্ড কষ্ট আর বুক ভরা অভিমান নিয়ে তার মনে হয়, নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন না হয়ে দেশটা ভিয়েতনামের মতো যদি ৬ বছরে স্বাধীন হতো, তা হলে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারতো, স্বাধীনতার মানে কী।


ডান পা টা আস্তে করে সরাতে গিয়ে ব্যথায় মুখ কুঁচকে যায় তার। সেই ৭১ এর স্প্লিন্টারগুলো আজও রয়ে গেছে গোড়ালির ভেতরে। একের পর এক সাতটা অপারেশন হয়েছে পায়ে, কিন্তু তাও কিছু হয়নি। সুচিকিৎসার অভাবে গোড়ালির ভেতরে এখন ইনফেকশন। তাই একদিন পর পর চলে ড্রেসিং। রক্তে ভিজে থাকে জায়গাটা। টাকার অভাবে কোনমতে ধার করে চলে চিকিৎসা। সুতীব্র যন্ত্রনা নিয়ে তবুও তো স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকা !!


৪১টা বছর ধরে এভাবেই যুদ্ধের ক্ষত বয়ে নিয়ে চলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান, যেভাবে ক্ষত বুকে নিয়ে বেঁচে আছে তাঁর মাতৃভূমি। তিনি জানেন স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ হলেও, জীবনযুদ্ধে এখনও বাকি আছে অনেকটা পথ।



মূল- রাজাকার কীভাবে প্রেসিডেন্ট হন?

কৃতজ্ঞতা- সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক[/fn]



No comments:

Post a Comment