Friday, December 7, 2012

অক্ষয় কিছু মুহূর্ত

একটি ছবি হাজারো বাক্যের থেকে বেশি শক্তিশালী। ছবি স্থির-মৌন হতে পারে, কিন্তু তার প্রকাশ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং তীব্র। একটিও শব্দ ব্যয় না করে অজস্র শব্দের তৈরী গভীর অনুভূতি তৈরী করতে সক্ষম। কোন কোন ছবি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হই, কখনও আবেগে আপ্লুত হই আবার কখনওবা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আমাদের সত্ত্বা। আমি তাই চিত্রগ্রাহকদের শ্রদ্ধা করি। আবার ঈর্ষা করি কারণ তাদের মতো নিরব থেকে অসংখ্য কথা বলে যাওয়ার নিপুন ক্ষমতা আমার নেই।


পেশার জন্যে হোক কিংবা ভালো লাগার কারণেই হোক, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে যন্ত্রের সহজলভ্যতায় চিত্রগ্রাহক এর সংখ্যা বেড়েছে। অজস্র রঙ্গিন ঝকঝকে ছবির ভিড়ে দুর্দান্ত কিছু মুহূর্ত প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে। মুগ্ধতা সেসব মানুষের জন্য, তাদের অনবদ্য-অন্তর্ভেদী দৃষ্টির জন্য, খুব সাধারণ মুহুর্তের মাঝে থেকেও অসাধারণত্ব খুঁজে বের করার ক্ষমতার জন্য।


পৃথিবীর ইতিহাসে এমনই কিছু মুহুর্তের স্থিরচিত্র অমর-অক্ষয় হয়ে স্থান করে নিয়েছে, এরকমই অসাধারণ কিছু মানুষের জন্য। মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে-বিশ্বকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। এরকম শক্তিশালী কিছু ছবির মাঝে থেকে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কয়েকটি রয়েছে, যেই ছবিগুলো এখনও যতবার দেখি আমাকে বাকরুদ্ধ করে রাখে। এই ছবিগুলোর পেছনের ইতিহাসও ঠিক ততোটাই শক্তিশালী।


১.
kevin-carter-vulture

ছবিসূত্র- কেভিন কার্টার, নিউইয়র্ক টাইমস

১৯৯৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত সুদানে জাতিসংঘের খাদ্যবিতরন কেন্দ্র থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরত্বে এই মুহুর্তটি ধারণ করেন চিত্রগ্রাহক কেভিন কার্টার। এই ছবিটি নিউইয়র্ক টাইমস এ ছাপা হলে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় শিউরে উঠে তৎকালীন সমাজ। ছবির মৃতপ্রায় শিশুটি কোনমতে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল খাদ্যবিতরন কেন্দ্রের দিকে আর পেছনে তার মৃত্যুপ্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলো শকুনটি। পরবর্তিতে শিশুটির ভাগ্যে কি হয়েছিল তা জানা যায়নি। মর্মস্পর্শী এই ছবির কারণে ১৯৯৪ সালে কেভিন পুলিতজার পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই শিশুটির জন্য কিছু না করার কারণে কেভিন প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুখীন হন এবং আত্মগ্লানিতে ভুগে তার তিন মাস পরে আত্মহত্যা করেন।


২.
0,,15751521_303,00

ছবিসূত্র- নিক উত্, এসোসিয়েটেড প্রেস

ভিয়েতনাম যুদ্ধের নৃশংসতার এই মুহুর্তটি মুঠোবন্ধী করেন চিত্রগ্রাহক নিক উত্। ৮ই জুন, ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর নাপ্লাম বোমা হামলায় আক্রান্ত ও দগ্ধ হয়ে ভিয়েতনামের তরাং বাং গ্রামের নিকটবর্তী রাস্তায় দৌড়ে পালাচ্ছিল আহত-আতংকিত এই শিশুরা। ছবির মধ্যবর্তী কিম ফুক নামের শিশুটি নাপ্লাম বোমার কারণে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে তার জ্বলন্ত বস্ত্র খুলে ফেলে। এসোসিয়েটেড প্রেসে ছাপা হওয়া এই ছবিটি নিককে পুলিতজার পুরস্কার এনে দেয়। চিত্রগ্রাহক নিক আহত শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং পরবর্তী জীবনে তার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।


৩.
child-1561

ছবিসূত্র- রশিদ তালুকদার

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সেই বিক্ষুব্ধ সময়ের দুর্দান্ত এই মুহুর্তটি উঠে আসে চিত্রগ্রাহক রশিদ তালুকদার এর ক্যামেরায়। ঢাকার রাজপথ কাঁপানো জনতার মিছিলের ঠিক সামনে এই ছোট্ট শিশুটির তীব্র স্লোগানে সেদিন অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং চিত্রগ্রাহক নিজেই। জনতার দাবি ও মুক্তির আন্দোলন ঠিক কতোটা গভীর ও শক্তিশালী ছিলো যে তা স্পর্শ করেছিল নির্ভয় এই শিশুটিকেও। ছবিটি রশিদ তালুকদারের অন্যতম সেরা একটি কাজ।


৪.
6a00d8341c2c7653ef01156efbe86d970c-800wi

ছবিসূত্র- এডওয়ার্ড থমাস এডামস, এসোসিয়েটেড প্রেস

দক্ষিন ভিয়েতনামের জাতীয় পুলিশপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নগুয়েন ন্গক পিস্তলের গুলিতে ভিয়েতকং অফিসার নগুয়েন ভ্যান লম্ কহত্যা করেন সায়গনের রাজপথে। দিনটি ছিলো ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮। মুহুর্তটি ধারণ করেন চিত্রগ্রাহক এডি এডামস। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম শক্তিশালী একটি ছবি। এই ছবিটি ছাপা হলে সারা বিশ্বে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ছবিটি ছাপা হয় এসোসিয়েটেড প্রেসের পক্ষ থেকে এবং ১৯৬৯ সালে এডামসকে পুলিতজার পুরস্কার প্রদান করা হয়।


৫.
enhanced-buzz-wide-4701-1338497429-4

ছবিসূত্র- জেফ ওয়াইডেনার, এসোসিয়েটেড প্রেস

৪ঠা জুন, ১৯৮৯ এর রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরে, এদিন চীনের তিয়ানানমেন স্কয়ারের প্রতিবাদকারীদের সম্পূর্ণ স্তব্ধ করতে প্রধান স্কয়ারের দিকে এগোতে থাকে প্রায় ২৫টি ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের পথ রুদ্ধ করতে সবার আতঙ্কিত দৃষ্টির সামনে, পূর্ব-পশ্চিম কোণের রাস্তা দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকা সাজোয়া গাড়িগুলোর সামনে হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন একজন সাধারণ মানুষ। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়া মানুষটির দুই হাতে
বাজারের ব্যাগ।
এই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্ধী করেন চিত্রগ্রাহক জেফ ওয়াইডেনার। তাঁর এই ছবিটি "ট্যাঙ্ক ম্যান" নামে পরিচিত। অন্যায়ের প্রতি একজন সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ছবিটি বিশেষভাবে পরিচিত।


৬.
enhanced-buzz-wide-20872-1338324598-18

ছবিসূত্র- এসোসিয়েটেড প্রেস

১৯৬৮, মেক্সিকো অলিম্পিকের পুরস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে "ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট" এর মাধ্যমে সেসময়ের বর্ণবাদী অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতিবাদ-আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছেন ১৬ অক্টোবর সকালে ২০০ মিটার দৌড়ে ১৯.৮৩ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড তৈরী করে প্রথম স্থান অধিকার করা টমি স্মিথ এবং একইসাথে ২০.১০ সেকেন্ড সময়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করা তারই বন্ধু জন কার্লোস। সাথে ব্যাজ বুকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়াবিদ পিটার নর্মান, তার সময় ছিলো ২০.০৬ সেকেন্ড। পরে এই প্রতিবাদের জন্য ক্রীড়াবিদ দুজনকেই বহিঃস্কার করা হয় এবং পরবর্তিতে নানা ধরনের অপমান সইতে হয়। অনবদ্য এই ছবিটি বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি জ্বলন্ত প্রতীক।


৭.
966942-vancouver-riots


ছবিসূত্র- রিচার্ড ল্যাম

ভ্যাঙ্কুবার এ স্ট্যানলি কাপের ফাইনালের পরে হঠাৎ শুরু হওয়া দাঙ্গায়, দাঙ্গা পুলিশের শিল্ড এর ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান এলেক্স থমাস। মারামারি, টিয়ার গ্যাস, দাঙ্গা পুলিশ, জ্বলন্ত গাড়ি এসব কিছুর মাঝে আতংকিত প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিচ্ছেন স্কট জনস। ২০১১ সালে চিত্রগ্রাহক রিচার্ড ল্যাম এর এই ছবিটি সহিংসতার বিরুদ্ধে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে সারা পৃথিবীতে আলোচিত হয় এবং খ্যাতি অর্জন করে।

_______________________________________________________________________________

অজস্র অসাধারণ ছবি থেকে এই সাতটি ছবি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে। ছবিগুলো যতবার দেখেছি ততবার আবেগআপ্লুত হয়েছি। প্রত্যেকটি ছবির আলাদা আলাদা তাৎপর্য এবং বিশেষ আবেগ রয়েছে, যা হৃদয় স্পর্শ করে করে। এধরনের অসংখ্য চিত্রগ্রাহক যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে দুঃসাহসিকতার সাথে কাজ করে চলেছেন তাদের শ্রদ্ধা। মৌন থেকেও অনুভূতির ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম এরকম আরও ছবি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করুক।

No comments:

Post a Comment