Monday, April 16, 2012

বিশ্বে নারী নির্যাতন [১]

[ধারাবাহিক ভাবে সমগ্র বিশ্বে সহিংস নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান ও চিত্র তুলে ধরার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস]

সমগ্র বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রটি ভয়ংকর। বিশ্বে বর্তমানে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছর এর পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। একই সাথে সামাজিক ভাবে নারীকে বিভিন্ন জায়গায় হেনস্তা হতে দেখা যাচ্ছে আগের থেকে অনেক বেশি, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্তে সরকারের উচ্চ পদস্থ অনেক কর্মকর্তা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানসিকতা বিবেচনায় আনলে এই আশংকা আরও বৃদ্ধি পায়। এই মাসে, ভারতের "তেহলেকা" পত্রিকার করা একটি গোপন তদন্ত প্রতিবেদন অভিযানে বের হয়ে এসেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩০ জনেরও বেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার, ধর্ষিতা-নির্যাতিতা নারীর প্রতি হীন মানসিকতা, ভিডিও ফুটেজ সহ, যা আবারও সমাজে নারীর প্রতি বিরূপ ও অশ্লীল ধারণা পোষণকারীদের একটি নগ্ন চিত্র প্রকাশ করলো। তাই আবারও এই বিতর্কটি সামনে উঠে এসেছে যে, সমাজে নারীকে আসলে কি দৃষ্টিতে দেখা হয়? একজন নির্যাতিতা নারীকে সমাজ কিভাবে গ্রহণ করে? আইন নারীকে কতটুকু সাহায্য করছে? নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারগুলো কতোটা সফল?

২০১১ সালের কিছু মানবাধিকার রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলে পাওয়া যায়, নারীর জন্য সবথেকে বিপদজনক দেশগুলোর মধ্যে প্রথম পাঁচটি হচ্ছে (ক্রমানুসারে) -

১. আফগানিস্থান
২. কঙ্গো
৩. পাকিস্থান
৪. ভারত
৫. সোমালিয়া

এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে- নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নারীশিশুর মৃত্যু, নারীর জন্য অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা এবং অনার কিলিংস। বিশেষ করে পাকিস্থান, আফগানিস্থান এবং ভারতে ধর্ষণ ও অনার কিলিংস এর হার আশংকাজনক অবস্থায়। বিশেষজ্ঞরা এই পাঁচটি দেশেরই কিছু প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মাত্রা বিবেচনা করলে যা পাওয়া যায় তার চিত্র ও পরিসংখ্যান কিছুটা এরকম-

আফগানিস্থান :

যুদ্ধবিদ্ধস্থ এই দেশটিতে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও দুর্নীতির পাশাপাশি নারী নির্যাতন এর হারও সবথেকে বেশি। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা সবার উপরে।
ঝুঁকিপূর্ণ সন্তান জন্মদানের হার প্রতি ১১ জনে ১ জন।
প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী অশিক্ষিত।
৭০-৮০ শতাংশ নারী ও কিশোরীকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়।

কঙ্গো :

এই দেশটিতে যৌন নির্যাতন এর হার সব থেকে বেশি।

প্রতিদিন প্রায় ১,১৫০ জন নারী ধর্ষিত হন, যা বছরে প্রায় ৪,২০,০০০ জন নারী। এই সংখ্যা ২০১১ এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ এর প্রতিবেদনে প্রকাশিত।
গর্ভবতী নারীদের মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ রক্তস্বল্পতায় ভোগে।

পাকিস্থান :

এই দেশটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে নারীদের নির্যাতনে সব থেকে এগিয়ে। অনার কিলিংস, পাথর ছুঁড়ে হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, শিশু ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, জোরপূর্বক বিয়ে ইত্যাদি নারী নির্যাতনের কয়েকটি দিক।

পাকিস্থান মানবাধিকার কমিশনের তালিকা অনুযায়ী প্রতি বছর ১,০০০ এরও বেশি নারী অনার কিলিং এর শিকার।
৯০ শতাংশ নারী গৃহে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার

ভারত :

নারী পাচার, যৌন নির্যাতন, শিশুবিবাহ, অনার কিলিংস এর হার পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতান্ত্রিক (!!) দেশটিকে এই স্থানে এনে দিয়েছে।

প্রাক্তন হোম সেক্রেটারি মধুকর গুপ্তা এর তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১০০ মিলিয়ন এরও বেশি নারী, পাচারকারীদের হাতে নির্যাতিত।
নারী ভ্রুণ হত্যা এবং নারী সন্তান হত্যার জন্য, বিগত শতকে ৫০ মিলিয়ন নিঁখোজ।
৪৪.৫ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই।

সোমালিয়া :

পৃথিবীর অন্যতম কুখ্যাত দেশ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী খৎনা, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি কারণে নারীদের জন্য চরম দুঃস্বপ্ন।

প্রায় ৯৫ শতাংশ নারী ৪ থেকে ১১ বছরের মধ্যে নারী খৎনা এর মতো একটি অমানুষিক প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়।
মাত্র ৯ শতাংশ নারী সন্তান জন্মদানের সময় স্বাস্থ্যসেবা পায়।
সংসদে মাত্র ৭.৫ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত।

[আফগানিস্তানে নারী- ১]


[আফগানিস্তানে নারী- ২]


[আফগানিস্তানে নারী-৩]

এগুলো অসংখ্য পরিসংখ্যান থেকে তুলে ধরা কিছু অংশমাত্র। এবার বিস্তারিতভাবে দেখা যাক।

ভারত :

বর্তমানে ভারতে নারী নির্যাতনের মাত্রা যেকোনো সময়ের পরিসংখ্যানকে আশংকাজনকভাবে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু নির্যাতনই নয় সামাজিক বৈষম্যের মাত্রাও বেড়ে চলেছে দিনকে দিন। বিশেষ করে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী বর্তমানে নারীদের জন্য সব থেকে বিপদজনক জায়গা। দিল্লীতে নারী ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা, সাধারনত বলা হয়ে থাকে যে, দিনের বেলাতেও কোনো নারী যদি ১০ মিনিট নিরাপদে দিল্লীতে ঘুরতে পারেন সেটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। নয়ডা, গুরগাঁও এর মত জায়গাগুলোতে অহরহ নারীদের অপহরণ এর পর নির্যাতন ও ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে চলেছে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) এর ভাষ্যমতে, ধর্ষণ ভারতের সব থেকে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়া একটি অপরাধ যা ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সব থেকে ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ২০০৯ সালে ২১,৩৯৭ টি ধর্ষণের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। ২৫,০০০ নারী অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, সম্ভ্রমহানির ঘটনা ৩৮,০০০।

১৯৯০ সালে লিপিবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১০,০৬৮ টি, সেখানে ২০০০ সালে সেটি দাড়ায় ১৬,৪৯৬ টি। ২০০৯ সালে মধ্য প্রদেশে সব থেকে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যা কিনা ৩,০০০ এরও বেশি। ২০০৯ সালে লিপিবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাগুলোর মধ্যে এক চতুর্থাংশ শুধু দিল্লীতেই সংঘটিত হয়েছে। ৩৫টি বড় শহরের মাঝে দিল্লীতে ৪০৪ টি ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে, অপহরণ এর ঘটনা ১,৩৭৯ এবং সম্ভ্রমহানির ঘটনা প্রায় ৫০০।

২০১০ এর জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী দিল্লীর ৮৫ শতাংশ নারী নির্যাতন আতংকে ভোগেন। শুধু তাই নয়, পারিবারিক ধর্ষণ এর ঘটনা ২০০৮ সালের ৩০৯ টি থেকে ২০০৯ সালে এসে দাড়ায় ৪০৯ এ। পারিবারিক ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়, এতে নির্যাতিতা এবং নির্যাতনকারী কেউই মুখ খুলতে রাজি হননা। একারণে আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে এই ঘটনা।

এছাড়াও পারিবারিকভাবে নির্যাতন, কন্যা ভ্রুণ হত্যা, কন্যা সন্তান জন্মের পরে কাচের গুড়ো খাইয়ে হত্যাসহ নানা ধরনের অত্যাচার সারা দেশ জুড়ে অব্যাহত আছে। ইভ টিজিং বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। দিল্লী ও মুম্বাইএ বেশ কিছু এধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রতিবাদকারী বেশ কয়েকজন। কিছুদিন আগে কলকাতায় একজন নারী রাতের বেলা ধর্ষণের শিকার হলে পুলিশ এই তদন্তে প্রচুর গড়িমসি করে, সংবাদ মাধ্যমে ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে, ব্যাবস্থা নেয়ার পরিবর্তে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কোলকাতার নাইটক্লাবগুলো রাত ১১ টার পরেই বন্ধের নির্দেশ জারি করেন। যেনো নাইটক্লাব ধর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেখানে ধর্ষণ এর অনেক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে পুলিশের হাতের সামনে।

তেহলেকা এর গোপন সচিত্র প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, অধিকাংশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মনে করেন যে, ধর্ষণের ঘটনার জন্য নারীরা নিজেরা দায়ী। নারীদের পোশাক আশাক, চালচলন, অনেক রাতে ঘরের বাইরে থাকা ইত্যাদি কর্মকান্ড নাকি একজন পুরুষকে ধর্ষণের জন্য উত্তেজিত করে। অনেকেই সরাসরি বলেছেন, নারীরা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে ব্যাবসা করে, নাম কামানোর ধান্দা। ধর্ষণের ঘটনা তদন্তকারী কর্মকর্তা পর্যন্ত নারীকেই দোষারোপ করলেন এই ঘটনার জন্য| [পুরো প্রতিবেদনটি নিচে সংযুক্ত করে দিলাম, অমানুষদের নিয়ে কথা বলার রুচি নেই]

ভারতের সামাজিক অবস্থা বিবেচনায়, প্রায়-

প্রতি ৫৪ মিনিটে একজন ধর্ষণের শিকার।
প্রতি ২৬ মিনিটে একজনের সম্ভ্রমহানি।
প্রতি ৪৩ মিনিটে একজন নারী অপহরণ।
প্রতি ৫১ মিনিটে একজন ইভ-টিজিং এর শিকার।
প্রতি ১ ঘন্টা ৪২ মিনিটে যৌতুকের জন্য নির্যাতনে একজন নারীর মৃত্যু|
প্রতি ৭ মিনিটে একজন নারীর প্রতি অন্যায়।

পাকিস্তান :

ইসলামাবাদের সরকারী প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ৮,৫৪৮ টি নারী নির্যাতনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫,৭২২ টি ঘটনা পাঞ্জাব, ১,৭৬২ টি সিন্ধ, ২৩৭ টি বালুচিস্তান এবং ১৭২ টি ইসলামাবাদে। ১,৯৮৭ জন অপহরণ, ১,৩৮৪ জন হত্যা, ৯২৮ জন ধর্ষণ/গণধর্ষণ, ৬৮৩ জন আত্মহত্যা, ৬০৪ জন অনার কিলিং, ২৭৪ জন যৌন নিপীড়ন, ৫৩ জন এসিড নিক্ষেপ, ১,৯৭৭ নানাবিধ নির্যাতনের এর শিকার।

এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর বার্ষিক প্রতিবেদনের তখ্য অনুযায়ী ২০১১ এর নভেম্বর পর্যন্ত ১,১৯৫ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৯৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৩২১ জন নারী ধর্ষণের শিকার এবং ১৯৪ জন গণধর্ষণের শিকার।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুন এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ জনে একজন নারী পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার। পাকিস্তানের প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ভাবে নিজ গৃহে নির্যাতনের শিকার, যার মধ্যে প্রতি তিন জনে একজন ধর্ষণ, এসিড, অনার কিলিং, শারীরিক নির্যাতনের শিকার। মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ দলগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তান এ লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট, এখানে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুন। জীবনযাত্রার মান অতি নিম্ন, নিরাপত্তা অপ্রতুল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৪,০০০ এরও বেশি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া অধিকাংশ নারীর বয়স ৪ থেকে ১১ বছরের মধ্যে, আশংকাজনক হারে বেড়েছে নারীশিশু নির্যাতনের সূচক। শহর মুলতানে প্রতি মাসে ১৮ টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, পুলিশ এর হেফাজতে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ভয়ংকর ভাবে, বিভিন্ন কারণে হেফাজতে রাখা নারীদের উপর চরম অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে, ১,০০০ এরও বেশি এধরনের ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কারণে শরণার্থী হয়ে আসা নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি, বিভিন্ন উপজাতীয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহ। প্রতি দিন প্রায় পাঁচ জন নারী যৌতুকের বলি হন।

[চলবে]

Tuesday, April 3, 2012

স্বপ্ন কিংবা অলীক বাস্তব

রাত-১

বিভৎস একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম থেকে উঠে বসলাম, গলা শুকিয়ে গেছে, পাশেই রাখা জলের বোতলটা থেকে জল নেয়ার মতো অবস্থাটাও নেই, যেনো শেকড় গজিয়ে গেছে শরীরে| কোনমতে কাঁপা কাঁপা হাতে জলের বোতলটা নিলাম, চোখ বন্ধ করে মুখে দিয়ে ঢোক গিলতেই তীব্র যন্ত্রনায় সারা শরীর ফেটে পড়তে চাইলো, জল নয়, যেনো তপ্ত সীসা গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে| চিত্কার করে উঠতে চাইলাম, গলা দিয়ে গোঙানির মতো অস্ফুট কিছু শব্দ বের হয়ে এলো, ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম এবার, বুঝতে পারলাম স্বপ্ন দেখছিলাম|

রাত-২

প্রচন্ড গরম পড়েছে, ঘরের জানালাটা দিয়ে বাতাসটাও যেনো রেশনের চালের মতো মেপে মেপে ঢুকছে, হলদেটে চাঁদটার দিকে চোখ কুঁচকে তাকালাম, সামনের হালকা জঙ্গলে ঢাকা বাগানটায় গাছগুলোর সব অদ্ভুত ছায়া, নিজেকে অলীক পরাবাস্তবতার মাঝে আটকে পড়া এক জন্তু বলে মনে হচ্ছে| হঠাৎ মৃদু বাতাসে পাতাগুলো কেঁপে উঠতে মনে হলো কোনো প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাস, আজকের রাতটাও নির্ঘুম কাটবে বোঝা যাচ্ছে|


রাত-৩

কালো, রোগা-পটকা, কিম্ভূত চেহারার যে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে পরম তৃপ্তিতে দাঁত খোঁচাচ্ছে এর নাম "চুন্নু", হ্যাঁ, স্রেফ চুন্নু, এর আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই| একে দেখে মনে হচ্ছে দাঁত খোঁচানোর অলিম্পিকে যোগ দিতে যাচ্ছে| প্রচন্ড রাগে মাথার ডান পাশের শিরাটা দপ দপ করছে আমার| এবার চুন্নু মুখ খুললো|

"১০,০০০ লাগবো"
এতো ??
হ এতই, মেশিনের দাম বাড়ছে, ভাড়াও বাড়ছে|
নিবো তো একরাতের জন্য !!
একরাত আর দুইরাত, সব একই রেট|
ঠিক আছে|
সাথে কিন্তু খালি দুই দানা|
চলবে|

এবার কুতকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে চুন্নু, আমার মোটা কালো চশমার ফ্রেমটা হয়তো পছন্দ হয়নি এর, কে জানে| এবার ধীরে ধীরে বলে, "কাহিনী কি? এইসব জিনিস কিন্তু খুবই রিস্কি, আপনের কি কামে লাগবো কন তো?" "সেটা আপনার জানার দরকার আছে কি?"- আমি বিকৃত মুখে বললাম| অনেক কষ্টে জিভের ডগায় এসে যাওয়া অশ্রাব্য গালিটা আটকালাম| "না, তবে সিনেমাতে যেমন দেহেন কাহিনী কিন্তু সেরম না, গুল্লি একবার বাইর হইলে কিন্তু কাহিনী উল্টায় যাইবো কইলাম|" আমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখলাম, "জানি, মাথায় গুলি করলে কপালের ঠিক মাঝখানে যে সুন্দর একটা গোল ছিদ্র দেখায় তা পুরো কাহিনী না, গুলি বের হওয়ার সময় খুলির ঠিক পেছনে একটা বড়সড় গর্ত করে দেয়, মগজ আর রক্ত চারিদিকে ছিটকে বের হয়| জিনিসটা মোটেও সুন্দর না|" চুন্নু পুরো কথাটা মুখ হা করে শোনে, আমি একটা বড় প্যাকেট হাতে নিয়ে ওর সামনে থেকে উঠে আসি|


রাত-৪

রাস্তার এইদিকের বাড়িগুলোর চেহারা অন্যরকম, ঝা-চকচকে, আভিজাত্যের ছোঁয়া| ১০ নাম্বার বাড়িটায় কি করে ঢুকবো এটা বের করতে আমার পাক্কা ১ মাস লেগেছে| আজকে অপেক্ষার শেষ| দোতলার ঘরটায় ঢুকলাম| অন্ধকারে দরজার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে এখন আসল খেলার অপেক্ষা| প্রায় ঘন্টাখানেক পরে পায়ের আওয়াজ| খুলে গেলো সামনের দরজাটা| ঘরে ঢুকে লাইটের সুইচটা অন করতেই আমাকে দেখে চমকে উঠে পিছিয়ে গেলো সে| আমি ইশারায় আমার হাতে ধরা কালো যন্ত্রটার দিকে দেখালাম, চুপচাপ দরজা বন্ধ করে আমার উল্টো দিকে পেতে রাখা চেয়ারটায় এসে বসলো মানুষটা| ঠিক এই মুহূর্তটা অসংখ্যবার চিন্তায় নেড়েচেড়ে দেখতে চেয়েছি, কিন্তু না, এর সাথে কোনো মিল নেই| বাকরুদ্ধ মানুষটা জানে কি জন্য এসেছি আমি, জানে তার সময় শেষ| আস্তে করে উঠে গিয়ে ঠিক কপালের মাঝখানটায় নলটা ছোঁয়ালাম| দেখতে পাচ্ছি কপালের দুপাশ বেয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে তার| মুখে পৈশাচিক একটা হাসি এনে রিভলবার এর হ্যামারটা পিছন দিকে টানলাম, ক্লিক করে একটা শব্দ হলো, পিনপতন নিস্তব্দতায় সেটাই অনেক জোরালোভাবে শোনা গেলো| মানুষটার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে, আলতো করে ট্রিগারটা টেনে দিলাম|


দরজা খুলে বের হওয়ার আগে পিছন ফিরে একবার দেখলাম, চেয়ারে ঠিক আগের অবস্থাতেই বসে আছে সে, বের হওয়ার আগে বললাম, "ভেজা প্যান্টটা বদলে নেবেন, নয়তো গন্ধ ছড়াবে !!!" কয়েক মুহুর্তের বিভীষিকায় থরথর করে কাঁপতে থাকা লোকটাকে দেখে হাসি পেলো|


রাস্তায় কেউ নেই, প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়লাম আমি, কোনার সঙ্গীহীন কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো দুবার| আজকেও আকাশে জন্ডিসে আক্রান্ত সেই হলদেটে চাঁদটা, বাস্তবতার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে হঠাৎ খুব সুখী মনে হলো|


রাত-৫

বিভৎস একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম থেকে উঠে বসলাম, গলা শুকিয়ে গেছে, পাশেই রাখা জলের বোতলটা থেকে জল নেয়ার মতো অবস্থাটাও নেই, যেনো শেকড় গজিয়ে গেছে শরীরে| কোনমতে কাঁপা কাঁপা হাতে জলের বোতলটা নিলাম, চোখ বন্ধ করে মুখে দিয়ে ঢোক গিলতেই তীব্র যন্ত্রনায় সারা শরীর ফেটে পড়তে চাইলো....... !!