আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্র নিয়ে সব থেকে জন প্রিয় বাক্য হচ্ছে- “Democracy is the government of the people, by the people, for the people”| গণতন্ত্র নিয়ে ধারণা থাকুক আর নাই থাকুক কিন্তু লিঙ্কনের এই বাক্য তার জীবদ্দশায় শোনেনি এমন মানুষ কম আছে,মোদ্দা কোথায় এখন পর্যন্ত গনতন্ত্র পৃথিবীতে সব থেকে সার্থক ও জনপ্রিয় শাসন ব্যাবস্থা| সাদা বাংলায় জনগনের সরকার| জনগণ তার গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাকে ক্ষমতায় পাঠায় দেশ ও দশের দেখা শোনা করার জন্য, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই, জনপ্রতিনিধিদের তখন জন কম ক্ষমতা বেশি প্রিয় হয়ে যায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে আইন দিয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করতেই ব্যাস্ত হয়ে পরেন তারা|জনগনের দুর্ভোগ শুরু হয় সেখান থেকেই|
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, বর্তমান বিশ্বে সংবাদ মাধ্যম সাধারম জনগনের চোখ ও কানের কাজ করে, তারা যা দেখায় আমরা দেখি, তারা যা শোনায় আমরা শুনি, কিন্তু এখানেও সমস্যা থেকে যায়, আজকাল তারা তাই দেখায় যা দেখিয়ে তাদের লাভ, তারা তাই শোনায় যা শুনিয়ে তাদের মন ভরে, তাদের কাছে লাভ নেই তাই অনেক কিছুই গুরুত্ব পায়না, তাই আমাদেরও চোখ ও কান এড়িয়ে যায়| রাজনৈতিক নেতাদের আন্দোলন এর গরম গরম খবর তো প্রতিদিন আসে, তা নিয়ে আমরা চায়ের কাপে ঝড় তুলে গণতন্ত্রের চর্চা করি, কিন্তু আসেনা অনেক কিছুই| পৃথিবীতে অনেক বিপ্লবী বছরের পর বছর সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন, কিন্তু অনেকের কথাই আমরা জানিনা| এই ব্যাস্ত নাগরিক জীবনে সবার কথা জানার সময় কোথায়? এই বলে এড়িয়ে যাই আমরা, কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা কিন্তু থেমে থাকেনা|
ইরম চানু শর্মিলা- মনিপুরের লৌহমানবী, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের একটি আইনের প্রতিবাদে, এই ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে তার অনশনের ১১ বছর পূর্ণ হবে| আপোষহীন এই নারী তার প্রতিবাদী অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ ১১ বছর ধরে, আমরা অনেকেই জানিনা তার ব্যাপারে, তারপরও তিনি থেমে নেই| কি নিয়ে এই দীর্ঘ অনশন? ভারত সরকারের Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অধীনে জারিকৃত ক্ষমতাবলে সামরিক বাহিনী কোনো প্রমান ছাড়াই শুধু মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গুলি চালাতে পারে যে কারো উপর| আদিবাসীদের উপর অত্যাচারে এক চরম রাস্তা সংযোজন করে এই আইন| এরই হাত ধরে ২ নভেম্বর,২০০০ সালের এক সকালে ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্ফল ভ্যালি এর আদিবাসী শহর মালম এ বাসের জন্য অপেক্ষাকৃত সাধারণ জনগনের উপর গুলি চালায় আসাম রাইফেলস বাহিনীর কিছু সদস্য| এই ঘটনায় প্রাণ হারায় ১০ জন নিরীহ আদিবাসী, যাদের মধ্যে ৬২ বছরের বৃদ্ধা Leisangbam Ibetomi এবং ১৯৮৮ সালে ভারতের National Child Bravery Award বিজয়ী ১৮ বছরের Sinam Chandramani অন্যতম| এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অপসারণের দাবিতে অহিংস অনশনে বসেন শর্মিলা| দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১০ টি বছর কিন্তু আপোষ করেননি তিনি কোনো অবস্থাতেই|
জনগনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর অহিংস উপায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার গণতন্ত্র দেয়, কিন্তু সরকার দেয় কি?? তাই তথাকথিত জনগনের বন্ধু পুলিশ অনশনে বসার ৩ দিনের মাথায় ভারতীয় পেনাল কোড, ৩০৯ ধারার অধীনে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়, পড়ে তাকে কোর্টে হাজির করা হয়, ৩০৯ ধারার অধীনে গ্রেফতারকৃতদের সর্বচ্চো শাস্তি ১ বছর কারাদন্ডের বেশি নয়, তাই শর্মিলাকে অনবরত নিয়মিত ভাবে এই ধারার অধীনে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, নেওয়া হয়েছে থানায়, কিন্তু তাই বলে থেমে যায়নি তার আন্দোলন, চরম শারীরিক অসুস্থতার শিকার হয়েও তিনি দৃঢ় অটল|
এই আইনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা জাগানোর লক্ষে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন অনেক জায়গা, ২০০৬ সালে আসেন দিল্লিতে, প্রতিবাদ কার্যক্রম ও অনশন জারি রাখেন, দিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ৬ অক্টোবর, ২০০০৬ এ| এই আন্দোলনের সময়ে দিল্লিতে তার সাথে সাক্ষাত করেন নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী, তিনি আশ্বাস দেন তার এই অনশনের কথা তিনি United Nations Human Right Council এর কাছে তুলে ধরবেন|আন্তর্জাতিক ভাবে তার এই অনশন আন্দোলকে তখন সীকৃতি দিয়েছে অনেকেই|
ইরম চানু শর্মিলা ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়, ২০০৫ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয় গোহাটির একটি নারীবাদী সংস্থা, ২০০৭ সালে তাকে ভূষিত করা হয় Gwangju Prize For Human Right-এ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি পুরস্কার পান ২০১০ সালে, ১২ তম Signature Woman of Substance Award (Assam) দেওয়া হয় ২০১০ সালে, আজীবন সম্মাননা পুরস্কার সহ নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই নারী, কোনো পুরস্কার তিনি নিজে গ্রহণ করতে যাননি, এসব নিয়ে মাথা ব্যাথাও নেই তার| তার প্রতিবাদ যে সাধারণ মানুষের খুব সাধারণ একটি অধিকার নিয়ে, তা হলো বেঁচে থাকার অধিকার|
২৮ নভেম্বর ২০১০ সালে, ইউরোপিয়ান সংসদ সদস্য ও গ্রিন পার্টি এর নেত্রী কেইথ টেলর তার আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করে ভারতীয় সরকারের তত্কালীন ক্ষমতাসীনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, আরও অনেকেই তখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এই আন্দোলনকে, ভারতীয় সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে জবাবদিহি করতে হয়, কিন্তু প্রতিবারই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে এবং আইন অপসারণে কাজ চলছে বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অনশনের আন্দোলনের আওয়াজ জনপ্রতিনিধিদের কানে পৌছায়না|
ইরম চানু শর্মিলার এই অসমসাহসী আন্দোলনের সাথে তখন জাগ্রত হয়েছেন অনেক আদিবাসী, আদিবাসী সংগঠন গুলো তখন জন সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাই বলে অত্যাচার থেমে যায়নি| ১০ জুলাই, ২০০৪-এ মনোরমা দেবী নামের একজন আদিবাসী নারী অপহৃত হন আসাম রাইফেলস এর বাহিনীর হাতে, পরে তাকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করে হত্যার পর লাশ ফেলে দেওয়া হয়| এই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ জুলাই,২০০৪ একদল অসমসাহসী প্রতিবাদী আদিবাসী নারী "কান্গ্লা ফোর্ট" এর সামনে বস্ত্র ত্যাগ করে নগ্ন হয়ে "Indian Army Rape Us"! লেখা প্লেকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন| এই ঘটনা ও চিত্র আন্তর্জাতিক ভাবে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরী হয়| Ima Momonleima নামের সাহসী বৃদ্ধা নেতৃত্ব দেন এই প্রতিবাদের|
সবসময় নানাভাবে উপেক্ষা করা আর অত্যাচারিত এই আদিবাসীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো সাহায্য পৌছে না বললেই চলে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই দরিদ্র সাধারণ মানুষগুলোর প্রতিবাদ সরকারের কানে পৌছে কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ থকেই যায়| তাই প্রায় ১১ বছর ধরে চলা ইরম চানু শর্মিলার অনশন আন্দোলনের কোনো প্রভাব সরকারে উপর দেখা যায়না| একজন সাধারণ কয়েদির সাথে দেখা করতে গেলে কিছু সরকারী কাগজ পূরণ করলেই চলে, কিন্তু শর্মিলার সাথে দেখা করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হয়, এই অনুমতিপত্র সরকারী ভেলকি বাজিতে অধিকাংশ সময় গুম হয়ে যায়| একজন সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করাটাও কতটা কঠিন কাজ হয়তো এটাতেই প্রমান পাওয়া যায়|
প্রতিবাদের ভাষা সারা পৃথিবীতে এক, প্রতিবাদের কোনো আলাদা জাত নেই, নেই কোনো একক রাজনৈতিক পন্থা, মতাদর্শের ভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ সবসময় এক সুর তলে| তাই গণতন্ত্রের সংগা নতুন করে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় আমাদের মতো দুর্ভাগা দেশগুলোতে আমরা কাদের হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দেই? আমদের দেশেও অনশন প্রতিবাদ হয়, আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা বাতানুকুল জায়গায় বসে কয়েক ঘন্টার ছোট্ট অনশন করেন, তাদের জন্য আনা হয় ভালো খাবার, সুস্বাদু ফলের রস, অনশন ভাঙ্গলেই উদর পূর্তির ব্যাবস্থা, তাই অনেকেই প্রতিবাদীর মুখোশটা টুক করে পরে ফেলেন, আর আমাদের নেতাদের সামনে থাকে টিভি ক্যামেরা- মাইক্রোফোন, আমাদের বাগ্মী নেতারা হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের মুন্ডুপাত করেন, মুখে বক্তৃতার ফেনা তুলে গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়ান, তারপর সময় শেষে গণতন্ত্রের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে বাড়ি যান আর আরামের ঢেকুর তুলে বলেন, যা বাব্বা জনগনের জন্য শালা যা একটা ঝক্কি গেলনা!!! আমাদের চোখ তাদের দিকেই আটকে থাকে, আমরা তাদের কথাতেই মিছিল করি, আমরা গণতন্ত্রের বুলি আউড়াই, আমরা ছাত্র রাজনীতি করি দেশের জন্য আর সুযোগ পেলেই নেতার আদেশে বিপথগামীদের আচ্ছা করে ধোলাই দেই| এই না হলে প্রতিবাদ, এই না হলে গণতন্ত্র| আর ইরম চানু শর্মিলার মতো নিরবে নিভৃতে অনেকেই জীবন উত্সর্গ করেন সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য, একটি সত্যিকারের মহান আদর্শের জন্য, ভালো ভাবে মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস যোগানোর জন্য|
ইরম চানু শর্মিলার মতো মানুষ গুলোর প্রতিবাদের ভাষা যতই সরল হোক না কেন তা একদিন প্রচন্ড শক্ত আঘাত হানবেই শোষকের প্রাসাদের দেয়ালে, যারা গণতন্ত্রের নামে সাজানো তাসের ঘরে বসে সাধারণ মানুষকে জব্দ করে শোষণ করার নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজেন, তাদের হিসেব সেদিন দিতে হবেই| সত্যিকারের গণতন্ত্র সে দিনই আসবে, ইতিহাস বিপ্লবীদের ভোলে না|
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, বর্তমান বিশ্বে সংবাদ মাধ্যম সাধারম জনগনের চোখ ও কানের কাজ করে, তারা যা দেখায় আমরা দেখি, তারা যা শোনায় আমরা শুনি, কিন্তু এখানেও সমস্যা থেকে যায়, আজকাল তারা তাই দেখায় যা দেখিয়ে তাদের লাভ, তারা তাই শোনায় যা শুনিয়ে তাদের মন ভরে, তাদের কাছে লাভ নেই তাই অনেক কিছুই গুরুত্ব পায়না, তাই আমাদেরও চোখ ও কান এড়িয়ে যায়| রাজনৈতিক নেতাদের আন্দোলন এর গরম গরম খবর তো প্রতিদিন আসে, তা নিয়ে আমরা চায়ের কাপে ঝড় তুলে গণতন্ত্রের চর্চা করি, কিন্তু আসেনা অনেক কিছুই| পৃথিবীতে অনেক বিপ্লবী বছরের পর বছর সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন, কিন্তু অনেকের কথাই আমরা জানিনা| এই ব্যাস্ত নাগরিক জীবনে সবার কথা জানার সময় কোথায়? এই বলে এড়িয়ে যাই আমরা, কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা কিন্তু থেমে থাকেনা|
ইরম চানু শর্মিলা- মনিপুরের লৌহমানবী, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের একটি আইনের প্রতিবাদে, এই ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে তার অনশনের ১১ বছর পূর্ণ হবে| আপোষহীন এই নারী তার প্রতিবাদী অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ ১১ বছর ধরে, আমরা অনেকেই জানিনা তার ব্যাপারে, তারপরও তিনি থেমে নেই| কি নিয়ে এই দীর্ঘ অনশন? ভারত সরকারের Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অধীনে জারিকৃত ক্ষমতাবলে সামরিক বাহিনী কোনো প্রমান ছাড়াই শুধু মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গুলি চালাতে পারে যে কারো উপর| আদিবাসীদের উপর অত্যাচারে এক চরম রাস্তা সংযোজন করে এই আইন| এরই হাত ধরে ২ নভেম্বর,২০০০ সালের এক সকালে ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্ফল ভ্যালি এর আদিবাসী শহর মালম এ বাসের জন্য অপেক্ষাকৃত সাধারণ জনগনের উপর গুলি চালায় আসাম রাইফেলস বাহিনীর কিছু সদস্য| এই ঘটনায় প্রাণ হারায় ১০ জন নিরীহ আদিবাসী, যাদের মধ্যে ৬২ বছরের বৃদ্ধা Leisangbam Ibetomi এবং ১৯৮৮ সালে ভারতের National Child Bravery Award বিজয়ী ১৮ বছরের Sinam Chandramani অন্যতম| এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA) এর অপসারণের দাবিতে অহিংস অনশনে বসেন শর্মিলা| দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১০ টি বছর কিন্তু আপোষ করেননি তিনি কোনো অবস্থাতেই|
জনগনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর অহিংস উপায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার গণতন্ত্র দেয়, কিন্তু সরকার দেয় কি?? তাই তথাকথিত জনগনের বন্ধু পুলিশ অনশনে বসার ৩ দিনের মাথায় ভারতীয় পেনাল কোড, ৩০৯ ধারার অধীনে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়, পড়ে তাকে কোর্টে হাজির করা হয়, ৩০৯ ধারার অধীনে গ্রেফতারকৃতদের সর্বচ্চো শাস্তি ১ বছর কারাদন্ডের বেশি নয়, তাই শর্মিলাকে অনবরত নিয়মিত ভাবে এই ধারার অধীনে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, নেওয়া হয়েছে থানায়, কিন্তু তাই বলে থেমে যায়নি তার আন্দোলন, চরম শারীরিক অসুস্থতার শিকার হয়েও তিনি দৃঢ় অটল|
এই আইনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা জাগানোর লক্ষে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন অনেক জায়গা, ২০০৬ সালে আসেন দিল্লিতে, প্রতিবাদ কার্যক্রম ও অনশন জারি রাখেন, দিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ৬ অক্টোবর, ২০০০৬ এ| এই আন্দোলনের সময়ে দিল্লিতে তার সাথে সাক্ষাত করেন নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী, তিনি আশ্বাস দেন তার এই অনশনের কথা তিনি United Nations Human Right Council এর কাছে তুলে ধরবেন|আন্তর্জাতিক ভাবে তার এই অনশন আন্দোলকে তখন সীকৃতি দিয়েছে অনেকেই|
ইরম চানু শর্মিলা ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়, ২০০৫ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয় গোহাটির একটি নারীবাদী সংস্থা, ২০০৭ সালে তাকে ভূষিত করা হয় Gwangju Prize For Human Right-এ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি পুরস্কার পান ২০১০ সালে, ১২ তম Signature Woman of Substance Award (Assam) দেওয়া হয় ২০১০ সালে, আজীবন সম্মাননা পুরস্কার সহ নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই নারী, কোনো পুরস্কার তিনি নিজে গ্রহণ করতে যাননি, এসব নিয়ে মাথা ব্যাথাও নেই তার| তার প্রতিবাদ যে সাধারণ মানুষের খুব সাধারণ একটি অধিকার নিয়ে, তা হলো বেঁচে থাকার অধিকার|
২৮ নভেম্বর ২০১০ সালে, ইউরোপিয়ান সংসদ সদস্য ও গ্রিন পার্টি এর নেত্রী কেইথ টেলর তার আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করে ভারতীয় সরকারের তত্কালীন ক্ষমতাসীনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, আরও অনেকেই তখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এই আন্দোলনকে, ভারতীয় সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে জবাবদিহি করতে হয়, কিন্তু প্রতিবারই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে এবং আইন অপসারণে কাজ চলছে বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অনশনের আন্দোলনের আওয়াজ জনপ্রতিনিধিদের কানে পৌছায়না|
ইরম চানু শর্মিলার এই অসমসাহসী আন্দোলনের সাথে তখন জাগ্রত হয়েছেন অনেক আদিবাসী, আদিবাসী সংগঠন গুলো তখন জন সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাই বলে অত্যাচার থেমে যায়নি| ১০ জুলাই, ২০০৪-এ মনোরমা দেবী নামের একজন আদিবাসী নারী অপহৃত হন আসাম রাইফেলস এর বাহিনীর হাতে, পরে তাকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করে হত্যার পর লাশ ফেলে দেওয়া হয়| এই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ জুলাই,২০০৪ একদল অসমসাহসী প্রতিবাদী আদিবাসী নারী "কান্গ্লা ফোর্ট" এর সামনে বস্ত্র ত্যাগ করে নগ্ন হয়ে "Indian Army Rape Us"! লেখা প্লেকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন| এই ঘটনা ও চিত্র আন্তর্জাতিক ভাবে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরী হয়| Ima Momonleima নামের সাহসী বৃদ্ধা নেতৃত্ব দেন এই প্রতিবাদের|
সবসময় নানাভাবে উপেক্ষা করা আর অত্যাচারিত এই আদিবাসীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো সাহায্য পৌছে না বললেই চলে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই দরিদ্র সাধারণ মানুষগুলোর প্রতিবাদ সরকারের কানে পৌছে কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ থকেই যায়| তাই প্রায় ১১ বছর ধরে চলা ইরম চানু শর্মিলার অনশন আন্দোলনের কোনো প্রভাব সরকারে উপর দেখা যায়না| একজন সাধারণ কয়েদির সাথে দেখা করতে গেলে কিছু সরকারী কাগজ পূরণ করলেই চলে, কিন্তু শর্মিলার সাথে দেখা করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হয়, এই অনুমতিপত্র সরকারী ভেলকি বাজিতে অধিকাংশ সময় গুম হয়ে যায়| একজন সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করাটাও কতটা কঠিন কাজ হয়তো এটাতেই প্রমান পাওয়া যায়|
প্রতিবাদের ভাষা সারা পৃথিবীতে এক, প্রতিবাদের কোনো আলাদা জাত নেই, নেই কোনো একক রাজনৈতিক পন্থা, মতাদর্শের ভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ সবসময় এক সুর তলে| তাই গণতন্ত্রের সংগা নতুন করে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় আমাদের মতো দুর্ভাগা দেশগুলোতে আমরা কাদের হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দেই? আমদের দেশেও অনশন প্রতিবাদ হয়, আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা বাতানুকুল জায়গায় বসে কয়েক ঘন্টার ছোট্ট অনশন করেন, তাদের জন্য আনা হয় ভালো খাবার, সুস্বাদু ফলের রস, অনশন ভাঙ্গলেই উদর পূর্তির ব্যাবস্থা, তাই অনেকেই প্রতিবাদীর মুখোশটা টুক করে পরে ফেলেন, আর আমাদের নেতাদের সামনে থাকে টিভি ক্যামেরা- মাইক্রোফোন, আমাদের বাগ্মী নেতারা হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের মুন্ডুপাত করেন, মুখে বক্তৃতার ফেনা তুলে গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়ান, তারপর সময় শেষে গণতন্ত্রের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে বাড়ি যান আর আরামের ঢেকুর তুলে বলেন, যা বাব্বা জনগনের জন্য শালা যা একটা ঝক্কি গেলনা!!! আমাদের চোখ তাদের দিকেই আটকে থাকে, আমরা তাদের কথাতেই মিছিল করি, আমরা গণতন্ত্রের বুলি আউড়াই, আমরা ছাত্র রাজনীতি করি দেশের জন্য আর সুযোগ পেলেই নেতার আদেশে বিপথগামীদের আচ্ছা করে ধোলাই দেই| এই না হলে প্রতিবাদ, এই না হলে গণতন্ত্র| আর ইরম চানু শর্মিলার মতো নিরবে নিভৃতে অনেকেই জীবন উত্সর্গ করেন সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য, একটি সত্যিকারের মহান আদর্শের জন্য, ভালো ভাবে মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস যোগানোর জন্য|
ইরম চানু শর্মিলার মতো মানুষ গুলোর প্রতিবাদের ভাষা যতই সরল হোক না কেন তা একদিন প্রচন্ড শক্ত আঘাত হানবেই শোষকের প্রাসাদের দেয়ালে, যারা গণতন্ত্রের নামে সাজানো তাসের ঘরে বসে সাধারণ মানুষকে জব্দ করে শোষণ করার নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজেন, তাদের হিসেব সেদিন দিতে হবেই| সত্যিকারের গণতন্ত্র সে দিনই আসবে, ইতিহাস বিপ্লবীদের ভোলে না|
No comments:
Post a Comment