Monday, September 12, 2011

বার্মা সোলজার : একজন আপোষহীন যোদ্ধার কথা


"HBO Documentary Films " এর কাজগুলো আমার সবসময় পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে, এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্যচিত্রটি দেখার পর লেখার ইচ্ছে হলো| সামরিক জান্তার শোষণ ও ভয়াবহ অত্যাচার এবং জাতিগত বিদ্বেষে জর্জরিত দেশ বার্মা বর্তমানে মায়ানমার, ৪০ বছররেও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে অগুনিত মানুষ, বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ও চরম মানবিক বিপর্যয়ে আক্রান্ত এই দেশটির কথা অনেক আগে থেকে শুনে আসলেও এতটা ভালো ভাবে জানার উপায় হয়নি কখনই, সামরিক সরকারের অধীনে থাকা এই দেশটি থেকে কোনো ধরনের তথ্য কিংবা তথ্যচিত্র দেশের বাইরে যাওয়াটা খুবই কঠিন এবং ধরা পড়লে শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ, তাই চরম সাহসিকতার সাথে এই কাজটি করেছেন কিছু মানুষ|


Myo Myint নামের একজন যুদ্ধাহত সৈনিকের দৃষ্টিতে এবং সাহায্যে তৈরী করা তথ্যচিত্রটি বার্মার মানবিক বিপর্যয়ের চরম নিদর্শন হয়ে থাকবে, একজন প্রকৌশলী হিসেবে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময় স্থল মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানোর পর অব্যাহতি নেন তিনি, তারপর ধীরে ধীরে দেশের চরম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কাজে জড়িয়ে পরেন, তার মুখেই শোনা যায় তার সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন সময়ের লোমহর্ষক বর্ণনাগুলো|


পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশটিতে সামরিক অত্যাচারে দিনের পর দিন চরম মানবিক বিপর্যয়ে জীবন যাপন করে চলেছে মানুষ, প্রাকৃতিক সম্পদশালী এই দেশটিতে শুধুমাত্র সামরিক শাসনের প্রভাবে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে এটি পরিণত হয়েছে পৃথিবীর সবথকে দরিদ্র দেশগুলোর একটি, আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোর মতো এখানেও নুন্যতম মানবিক সাহায্য অপ্রতুল, বাইরের বিশ্ব থেকে কোনো ধরনের জরুরি সাহায্য নিষিদ্ধ, দেশটি বর্তমানে সাস্থ্য সুবিধের দিক থেকে তলার দিকে অবস্থান করছে, যদিও এটি বৃহৎ দেশগুলোর তালিকায় ৪০ তম এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়াতে এর অবস্থান ২য় স্থানে, জনসংখ্যার দিক থেকে এটি জনবহুল দেশের তালিকায় ২৪তম, দেশটিতে নানাবিধ সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের নুন্যতম জীবনযাত্রার মান না থাকা সত্তেও দেশের সরকারের অধীনে আছে পৃথিবীর ১২তম বৃহৎ সক্রিয় সামরিক বাহিনী, সামরিক বাহিনী দেশটির সব, উচ্চপদে থাকা সামরিক কর্মকর্তাদের অধীনে দেশটির অধিকাংশ ক্ষমতা, শুধুমাত্র তাদের পরিবার উচ্চশিক্ষা হতে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে পারে, দেশটিতে ব্যাবসা বানিজ্য হতে শুরু করে সব কিছুই সামরিক বাহিনীর অধীনে|


জেনারেল নে উইন ১৯৬২ সালের পর থেকে দেশকে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে গড়ে তুলতে যেয়ে তৈরী করেন এক অভাবনীয় ক্ষমতাশালী ও নিষ্ঠুর সামরিক শাসনতন্ত্র, যার অধীনে ২৬ বছর চলা শাসনে দেশটিতে তার বিরুদ্ধে ওঠা যেকোনো আওয়াজ কে দমন করা হয়েছে নিষ্ঠুর ভাবে চিরতরে, মানুষ এর সভ্যতার ইতিহাসে চরম অবমাননা আর অত্যাচারের ইতিহাস লিখা হলে আমার মনে হয় বার্মা প্রথম সারিতে থাকবে, দেশের ইতিহাসকে সামরিক বাহিনীর উপযুক্ত করে তৈরী করা হয়েছে যাতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন মানিশিকতা নিয়ে বড় হয়, বার্মা সামরিক বাহিনী এখনো পৃথিবীতে শিশুসৈন্য ব্যাবহারে অন্যতম এবং এদের বাহিনীতে নিযুক্ত ১৬ বছরেরও কম বয়সী শিশুর সংখ্যা অনেক, সর্বপরি শিশুদের সামরিক বাহিনীতে ব্যাবহার করাতে পৃথিবীতে প্রথমদিকের দেশ গুলোর একটি, দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা গুলোর মধ্যে শিশুশ্রম ও মানুষ পাচার অন্যতম|


Myo Myint এর জবানিতে উঠে এসেছে তার অবলোকন করা সামরিক বাহিনীর চরম অত্যাচার এর দৃশ্যাবলী, নির্বিচারে হত্যা ও সাধারণ মানুষকে মাইন ক্ষেত্রর এর উপর দিয়ে হেটে যেতে বাধ্য করাটা খুবই সাধারণ কাজ গুলোর মধ্যে পরে, আর এখানেও সামরিক বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে নারী ধর্ষণ তো আছেই, দেশটিতে শুধুমাত্র সামরিক সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ বই পরার অপরাধে যেতে হয় জেলে, তাই বই পাওয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার, তার স্মৃতি থেকে আরও উঠে আসে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে তার সক্রিয় আন্দোলনে যোগদানের তথ্যগুলো. ১৯৮৮ সালের আন্দোলনে সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করার সময় পুলিশের আক্রমনে একদিনেই মারা যায় ছাত্র সংগঠনের ২০০রও বেশি ছাত্র, সেই আন্দোলনের দিনগুলোতে ৩০০০ লোকের মৃত্যু ও ১০০০ লোকের গ্রেফতার এর হদিস মেলে|


Myo Myint পরবর্তিতে সক্রিয় ভাবে যোগদান করেন Aung San Suu Kyi এর রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহবন্ধী করে রাখা এই আপসহীন লৌহমানবীর সঙ্গে থেকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনে, সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য নজরে পরে যান তিনি এবং সামরিক গোয়েন্দাদের হাতে বন্ধী হয়ে প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হন, পরবর্তিতে ১৫ বছরের জন্য জেলে যান, যার মধ্যে সাড়ে ৪ বছর ছিলেন সলিটারিতে, আবার ৪ মাসের বেশি সময় ধরে একটানা ছিলেন সলিটারি কনফাইনমেন্ট এ, চরম মানসিক চাপে তখন কার দিন গুলোর কথা যখন বর্ণনা করেছেন, যেকোনো মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট| সাজাকালীন সময়ের ১৯৮৯-১৯৯৯ এই ১০ বছর সব ধরনের যোগাযোগ তার জন্য নিষিদ্ধ ছিলো, যুদ্ধাহত হবার পরও বিন্দুমাত্র মানবিক বিবেচনা পাননি তিনি|


তার বর্ণনাতেই উঠে আসে সামরিক জান্তার প্রাচুর্যের কথা, জেনারেলের মেয়ের বিয়েতে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সমমানের উপহার সামগ্রীর কথা, বিয়ের খরচ যা কিনা দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য সেবার খরচের থেকে ৩ গুন বেশি|  


অসাধারণ মনোবলের অধিকারী এই বিপ্লবী তার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন শরণার্থী শিবিরে, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভাই-বোন এমনকি পুরো পরিবার থেকে আলাদা ছিলেন, তারপরও নিজের দেশ ছেড়ে বাইরে যাননি বরং বিভিন্ন ভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সহযোগিতা করে গেছেন, সাইক্লোন নার্গিস এর ধংসাত্মক ছোবলের পর দেশের সরকার বাইরের বিশ্বের মানবিক সাহায্য অগ্রাহ্য করলে চরম মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয় বার্মার উপকূলবর্তী মানুষ, তারপরও দেশে জনগনের কথা চিন্তা না করে সরকার নতুন সংবিধান তৈরী করে সামরিক ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করে|


সর্বোপরি একজন অসাধারণ দৃঢ় মনোবলের মানুষের জীবন যুদ্ধ নিয়ে তৈরী করা এই তথ্যচিত্রটি যেকোনো বিবেকবান মানুষের মনে নাড়া দিবে, আর সবার দৃষ্টির অগোচরে থাকা একটি দেশ বার্মা আর তার ভিতরে অসম যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিকামী মানুষের এই অভূতপূর্ব আন্দোলন সত্তি কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা, তথ্যচিত্রটির শেষ দিকে এসে জীবনের কিছু চরম অভিজ্ঞতার কথা যখন বর্ণনা করেছেন তখন সত্তি চিন্তা শক্তি লোপ পায়, বর্তমানে অনেক সংগ্রামের পর নিজের ভাই এর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্টে অবস্থানরত এই বিপ্লবী সত্তি নমস্য|


পৃথিবীতে শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবেই, মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগে প্রতিদিন নতুন করে তৈরী হবে মানব সভ্যতার ইতিহাস, আর এভাবেই মানুষ মুক্তির স্বপ্ন বুনে চলে, শোষণহীন সমাজ ব্যাবস্থার জন্য অজস্র বিপ্লবী লড়ে চলেছেন তাদের আপন আপন ক্ষেত্রে, Myo Myint তাদের জন্য এমনকি সমগ্র সভ্য মানব সমাজের জন্য জলন্ত উধাহরণ হয়ে থাকবেন, তার এই দৃঢ় মনোবল অনেকের জীবনে চলার পথে সঙ্গী হয়ে থাকবে বলে আসা রাখি|

No comments:

Post a Comment