Wednesday, January 18, 2012

স্মৃতির পাতায় নটরডেম

বিশালদেহী মিজান স্যার ক্লাসে ঢুকতেই গ্রুপ-৪ এর সব ছাত্র একসাথে বলে উঠেছিলো "কাইফা হালুকা", স্যারও প্রতিউত্তর করেছিলেন সরস ভাবেই, প্রায় ৬ ফুটের উপরে লম্বা, বিশাল আলখাল্লা টাইপের পাঞ্জাবী, আর মুখভর্তি লম্বা দাড়ির মিজান স্যারকে কাইফা হালুকা বলে অভ্যর্থনা না জানানোটাই আসলে হয়তো রীতিবিরুদ্ধ হতো, স্যার পরিচিত ছিলেন তার বিখ্যাত "ছিলা-বাঁশ" এর জন্য, প্রথম দিনই বলেছিলেন, "আমরা তো আবার ছিলা-বাঁশ (সিলেবাস) আগে জানতে চাই"|


স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগা দিতে গিয়ে প্রথম বেঞ্চে বসা আমি উঠে দাড়িয়েছিলাম, সংগা ঠিকঠাক শেষও হয়েছিল, কিন্তু তার পরেই স্যার এর প্রশ্ন "তোমার কি স্তন আছে??" ক্লাস ভর্তি ছেলে, আর এই প্রশ্নে ভেবাচেকা খেয়ে আমি হাসবো না কি করবো বুঝতে পারছিলামনা, আমি আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই স্যার বললেন, "এত চিন্তা করো কে?? নারী-পুরুষ সবারই স্তন আছে, কিন্তু পুরুষের স্তনগ্রন্থি কাজ করেনা, এইটা কইতে লজ্জা লাগেনি??" এই ছিলেন মিজান স্যার, বেমক্কা সব প্রশ্ন করতেন, কিন্তু তাতে কি, বায়োলজি মজার বিষয় এটা হয়তো মিজান স্যার না থাকলে বুঝতামনা|


নটরডেম কলেজে ভর্তির ভাইবা দেওয়ার পরে আমি নিশ্চিত ছিলাম এত জ্ঞানী মানুষের ভিড়ে আমার স্থান নাই, কিন্তু কিভাবে কি আমি চান্সও পেলাম গ্রুপ-৪ এ, মিরাকল জাতীয় কিছু যে দুনিয়াতে হয় তা টের পেলাম| আর প্রথম দিন তো দেখতে দেখতে এমনিতেই চলে গেলো, এখনো মনে পরে ২৫শে আগস্টের বোমা হামলার ঠিক পরের দিন ছিলো আমাদের প্রথম ক্লাস|


অঙ্কের ক্লাসে বরাবরই আমি অন্ধ এবং বধিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই, সেই অঙ্কের ক্লাসে প্রথম দিন এলেন জহরলাল স্যার, সেই বিখ্যাত উক্তি স্যারের, "কি লিখি, কেনো লিখি, জানতে চাই স্যারররর"| আসলেই, স্যার পরবর্তী ২ বছরে আমাদের মধ্যে সেই জানার প্রবল আগ্রহ তৈরী করে দিয়েছিলেন অসাধারণ ভাবে, "কোণের সংগা" দিয়ে যার শুরু হয়েছিল তার শেষ হয়েছিল অশ্রুসিক্ত এক বিদায়ের মধ্য দিয়ে| এই আমি শুধুমাত্র স্যারের ভয়ে অঙ্ক করতাম, তখনো আসলে জানিনা, এই ভয়টা কতোটা দরকার ছিলো জীবনে| বন্ধু ময়ূখের দিকে তাকিয়ে স্যার এর সেই " এই যে লাল গঞ্জি, আপনি দাড়ান, কি নাম স্যাররর??" থেকে শুরু করে আরও অজস্র বাক্য এখনো যেনো শুনতে পাই একটু কান পাতলেই|


ফাস্ট ইয়ারে বায়োলজি পড়াতেন আজমল স্যার|"বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথমবার যখন উড়ানো হয়েছিলো, জানো আমি তখন কই ছিলাম??" আমরা ভাবলাম স্যার বলবেন পতাকা হয়তো তার হাতেই ছিলো, ছাত্র-জনতার মাঝে আমরা বিপ্লবী স্যারকে দেখা শুরু করেছি মাত্র, উনি বললেন, "পতাকাটা যেই লাঠির মাথায় উড়ানো হয়েছিলো সেটা ধরেছিলাম আমি", হঠাৎ যেনো অনেক মানুষের ভিড়ে স্যার হারিয়ে গেলেন, আমরা বাস্তবে ফিরে এলাম, আর বুঝলাম কি অসাধারণ ভাবে গল্প শোনাতে হয়| একটা অদ্ভুত ঘটনা ছিলো তখন, স্যার নটরডেম এর বায়োলজি ক্লাস নিলেও, স্যার এর কাছে বেশি পড়তে যেত ভিকারুন্নেসার ছাত্রীরা| আর সেই গল্প স্যার করতেন ক্লাসে, আরও শোনাতেন কি ভীষণ সব কাহিনী, আর আমরা বুঝতাম "চাপা-মারা" নামে অলিম্পিকে কোনো ইভেন্ট থাকলে আর কেউ কিছু না জিতুক একটা স্বর্ণপদক তো নিশ্চিত ছিলো আমাদের|


আরও মজা হতো বোটানি ক্লাসে, রাহেলা ম্যাডাম আমরা কোনো প্রকার শয়তানি করলেই, উদ্ভিদবিদ্যার নিরস জগত ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদী জগতের ঘোর অনটনে| আর আমরাও অবাক হতাম নির্বোধ গাছ-পালাকেও পুঁজিবাদী দুনিয়া ছাড় দিচ্ছেনা দেখে..


বাংলা নিতেন আমাদের বিখ্যাত "সোহেল স্যার", ক্লাসে এসে প্রধান কাজ ছিলো চুল আচড়ানো, তবে চুলের ঘনত্বের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন একেবারেই অমূলক| প্রায়ই পিছে থেকে ফিচেল ছাত্ররা কয়েন ফেলে যন্ত্রণা করতো, আর স্যার বলতেন, "এইইই পয়সা ফেলে কে?? পয়সা ফেলে কে?? কার বাপের এত পয়সা হয়েছে এইদিকে আয়"| দুহাত আদনান সামির "লিফট করা দে" স্টাইলে ধরে পেটের কাছ থেকে আস্তে আস্তে উপরে এনে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাক্য শুরু করার সেই রীতি এখনো মনে পড়ে| তবে কিছু বলেই, একহাত কপাল থেকে শুরু করে চকচকে টাকের পিছন পর্যন্ত টেনে নেওয়ার অভ্যাসটাই স্যার এর চুলের ঘনত্ব কম করার পেছনে দায়ী কিনা, কে জানে?


শুধু একদিন বাংলা ক্লাস নিতে এসেছিলেন মোখতার স্যার, তার আদিরসাত্মক পড়ানোর স্টাইলে পড়িয়েছিলেন কুবের-কপিলার প্রেম কাহিনী| আমরা অন্য ক্লাসের ছেলেদের কাছে শুনতাম স্যারের ইয়েতে আর্মির বন্দুকের বাঁটের গুঁতোর কথা, সুবর্ণা মোস্তফাকে করা প্রেমের প্রস্তাবের কথা আরও কত কি| আসলেই যে ছাত্র কলেজ জীবনে মোখতার স্যার এর কাছে "পদ্মা নদীর মাঝি" একদিনের জন্যও না পড়েছে, তার কলেজ জীবনে আফসোস থেকে যাবে| একজন বয়স্ক মানুষকে চেয়ারে বসে নাচতে সেই প্রথম দেখেছিলাম|


গুহ স্যারের কেমিস্ট্রি ক্লাস করেছিলাম টানা ২ বছর, স্যার নিজে তার টেবিলের উপর বসে পড়াতেন, তাকে কখনো চেয়ারে বসতে দেখিনি, আর প্রায়ই মনুষ্য-বর্জ নিয়ে রসিকতা করতেন, মাঝখানে স্যার এর বদলে এসেছিলেন ২ জন, নাদিয়া ম্যাডাম খুব অল্প সময়ের জন্য, তাকে ছাত্ররা যখন বলেছিলো "শোনা যায়না ম্যাডাম" তিনি বোর্ডে লিখে বলেছিলেন, "কি আশ্চর্য, আমি তোমাদের দু দু বার করে দেখালাম, তাও বুঝছনা কেনো??" আসলেই প্রশ্নটা আমাদেরও ছিলো| তারপরে ছিলেন এলেন স্যার, কলেজের কেমিস্ট্রি বুঝতে হলে যে সব ছাত্রের মাস্টার্স করে আশা উচিত, সেটা স্যার এর পড়ানো দেখলেই বুঝতে পারতাম| তাই ছাত্রদের ইচ্ছায় আবার গুহ স্যার এর প্রত্যাবর্তন|


সেই শুরু থেকে আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো, যারা ক্লাসের একদম বাম-দিকের দুটো সারিতে বসতাম, আমি, অনুপ, সজল, শুভ্র, মেহেদী (শুভ্র), ময়ূখ, আনন্দ, সৌরভ, ফয়সাল, তানজীল আরও কয়েকজন| এখনো মনে আছে সজলের ছোটবেলার প্রেয়সী যেদিন মারা যায়, আমাদের জরিয়ে ধরে কি কান্নাই না কেঁদেছিলো, মনে পড়ে আনন্দ প্রথম প্রথম নাক উঁচু ভাব নিয়ে চললেও, সেই ছেলেটিই আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিলো আমাদের গ্রুপ এর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ| ময়ূখ প্রথম থেকেই ছিলো রকস্টার, হাতে মোটা মোটা রিস্টব্যান্ড আর সানগ্লাসে প্রথম থেকেই কুউউউল| বিতার্কিক সজলের লিঙ্কিন পার্ক এর গানে গলা ফাটিয়ে চিত্কার| মেধাবী অনুপের সদা-হাস্য মুখ, শুভ্রের হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, মোটা-সোটা সৌরভের জ্ঞানী জ্ঞানী উক্তি, এ সবই তো স্মৃতি| আর মনে পড়ে সুদর্শন রাকিব কে, কদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে, সব সময় হাসি লেগে থাকতো মুখে|


একটা ঘটনা এখনো মনে পড়ে, সোহেল স্যার ক্লাসে ঢুকেছেন আমরা সবাই দাড়ালাম, বসার একটু পড়ে স্যার দেখি আমাদের পেছনে কি দেখাতে চাচ্ছেন, আমরা না বুঝে এদিক ওদিক দেখছি, তারপর সবার চোখ গেলো ক্লাসের পেছনের খালি বেঞ্চগুলোতে, দেখলাম আমাদের সারির পেছনের এক খালি বেঞ্চে কেও একজন পায়ের উপরে পা তুলে শুয়ে আছে, বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরে লাফিয়ে উঠে বসলো আমাদের ময়ূখ| এখনো মনে পড়ে, সবার দম ফাটানো হাসির মধ্য দিয়ে চোখ ডলতে-ডলতে ময়ূখ নিজের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে|


মনে পড়ে আরও অনেক কিছুই, প্র্যাকটিকাল ক্লাসের প্র্যাকটিকাল জোকস, ফিজিক্স এর প্র্যাকটিকেল এ রিপিট খাওয়া, বায়োলজির প্র্যাকটিকাল ক্লাসে আরশোলা হাতে নিতে গিয়ে কারো কারো অজ্ঞান হবার দশা, ডিবেটিং ক্লাবের অনর্থক রাজনীতি, সাইন্স ফেয়ারে ঘুরাঘুরি, ভর দুপুরে ফুটবল-ক্রিকেট, ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা, ক্লাসের শেষে মোড়ের দোকানের সিগারেট-পুরি, আরামবাগ কলোনিতে কাটানো অসস্র সময়... আরো অনেক কিছু| মনে পড়ে এইতো সেদিন যেনো ছিলো সব, কিন্তু পার হয়ে গেছে ৬টা বছর, ২০০৬ এ যেদিন রেজাল্ট নিয়ে বেড়িয়েছিলাম তার পড়ে আর কোনদিন কলেজের ভেতরে ঢুকিনি, হয়তো পালিয়ে থাকতে চেয়েছি স্মৃতিগুলো থেকে, হয়তো দূর থেকেই ভালবাসতে চেয়েছি জীবনের সব থেকে সেরা মুহূর্তগুলোকে|


আজ আনন্দ জাপানে, ময়ূখ চীনে, সজল সিলেটে, মেহেদী লন্ডনে, অনুপ চট্টগ্রামে, বাকিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায়, কেউ কেউ দেশের বাইরে, অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই, হয়তো আর দেখাও হবেনা কোনদিন, কিন্তু এখনো সময় পেলেই পুরনো ডায়রিটা খুলে দেখি, তাতে পুরনো হয়ে যাওয়া লেখাগুলো, বিদায়বেলাতে লিখে যাওয়া সেই কথাগুলোই রয়ে গেছে, আর রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো| খুব মনে পড়ে, অনেক প্ল্যান করি একবার আবার একবার কলেজের চত্বরে একসাথে আড্ডা দিতে, কখনই হয়ে উঠেনা, জানিনা হবে কিনা, তবে আর যাই হোক, এখনো আমার জীবনের সব থেকে প্রিয় স্মৃতি হিসেবে নটরডেম কলেজের দুই বছর চিরসবুজ হয়ে থাকবে| যেখানেই থাকিস সবাই, ভালো থাকিস|


[ব্যাচ ২০০৬, গ্রুপ-৪, নটরডেম কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ]


No comments:

Post a Comment