Thursday, February 2, 2012

সীমান্ত সংঘাত : একটি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী ২,৫৪৫ মাইলের সীমান্ত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে সংঘাতপূর্ণ, নিয়মিত বিরতিতে হত্যা-নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আইন বহির্ভূত কর্মকান্ডে সীমান্ত পরিস্থিতি সব সময়ই উত্তপ্ত থেকেছে| শুধুমাত্র তাই নয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী "বিএসএফ" (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) এবং বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী "বিডিআর" (বাংলাদেশ রাইফেলস) বর্তমানের "বিজিবি" (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এর ভূমিকাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ| এই সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা অনেক দিনের হলেও বর্তমানে কয়েক বছর যাবৎ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকর্তৃক হত্যা-নির্যাতন এর মাত্রা পূর্ববর্তী যেকোনো সমীক্ষাকে ছাড়িয়ে গেছে, এই নির্যাতন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকদের উপরেই সীমাবদ্ধ নেই, কিছু কিছু ঘটনায় ভারতীয় নাগরিকরাও এর ভুক্তভুগী| বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী সীমান্ত কাঁটা-তার দিয়ে ঘিরে ভারতীয় সরকার সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন বন্ধ তো হয়ই নি, বরং বেড়ে গেছে বহুগুনে| আইন বহির্ভূত হত্যাকান্ডের রেশ ধরে বর্তমানে এই সীমান্ত পৃথিবীর অন্যতম সংঘাতপূর্ণ ও রক্তাক্ত সীমান্তের পরিচিতি পেয়েছে| দুঃখজনক হলেও সত্যি এই হত্যা নির্যাতন কোনভাবেই দুটি দেশের মধ্যবর্তী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিফলন হতে পারেনা, বরং সীমান্তে ত্রাস সৃষ্টিকারী এই ধরনের কর্মকান্ড ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারকারী মনোভাবেরই পরিচয় দেয়|

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তার তিন দিক থেকেই ভারত এর সাথে যুক্ত| ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে বৃহৎ সীমান্ত| বাংলাদেশের খুলনা,রাজশাহী,চট্টগ্রাম,রংপুর,ময়মনসিংহ এবং সিলেট যুক্ত আছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,আসাম,মেঘালয়,ত্রিপুরা এবং মিজোরামের সাথে| এই দুই দেশ লাগোয়া এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বৃহৎ সীমান্তে চোরাচালানী এবং অন্যান্য আইন বহির্ভূত কাজ বন্ধ করতে ভারত সরকার ৪,০০০ কি.মি দীর্ঘ এবং কংক্রিটের ৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট দেয়াল নির্মানের কাজ শুরু করেছে, যা সম্পন্ন হলে পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘ সীমান্ত-সুরক্ষাদেয়াল হবে| এই কাজে ৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছিলো এবং ২০০৯ এর মধ্যে সম্পন্ন হবার কথা ছিলো, কিন্তু ১.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ এবং ২০১১ শেষ হবার পরেও এখনো এই কাজ সম্পন্ন হয়নি| এই প্রক্রিয়ায় দেয়ালের বেশ কিছু অংশে বৈদ্যুতিক তারের প্রয়োগ করা হয়েছে এবং আসামের সাথে বাংলাদেশের ২৬৩ কি.মি সীমান্তের প্রায় ১৯৭ কি.মি কাঁটা-তারের বেড়া দেবার কাজ সম্পন্ন হয়েছে| ২০০৭ পর্যন্ত ২৫২৯ কি.মি দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে এই দেয়াল তৈরির কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা যায়| তাহলে পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়, অন্তত অর্ধেকেরও বেশি সীমান্ত জুড়ে ভারত সরকার তাদের কাঙ্খিত নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এটা অনুমান করা যায় যে, ৩ মিটারের উঁচু কংক্রিটের দেয়াল এবং কাঁটা-তারের বেড়া ডিঙিয়ে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে ভারতের ভূখন্ডে অন্তত ২৫২৯ কি.মি দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ করা সক্ষম নয়, শুধু তাই নয়, শক্তিশালী ফ্লাড লাইট, নিরাপত্তা চৌকি, বৈদ্যুতিক তার এবং সর্বোপরি সশস্র সীমান্তরক্ষী বাহিনী এহেন নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করা সহজসাধ্য নয় বরং বলা যায় নিশ্চিত মৃত্যু ফাঁদ|

কিন্তু তারপরেও হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, এর পেছনের কারণ গুলোর দিকে একটু আলোকপাত করা যায় ধাপে-ধাপে| তবে পৃথিবীর যে কোনো দুটি দেশ লাগোয়া সীমান্তে যেরকম আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড ঘটে থাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তও এর ব্যাতিক্রম নয়| যেমন কাঁটা-তারের বেড়া দেওয়ার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকো সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান নিত্যদিনের ঘটনা ঠিক সেরকমই এই দুই দেশের সীমান্তেও ঘটে চলেছে| কিন্তু তার জন্য রয়েছে সীমান্ত-নিয়ন্ত্রণ আইন, এছাড়াও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের উপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা| যতটা সম্ভব বিনা রক্তপাতে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগীতা সবসময়ই কাম্য| কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে বিনা বিচারে হত্যা-নির্যাতন আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন থেকে শুরু করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত| তাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়| এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয় ছিটমহলগুলো| বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের প্রায় ১০০টি এবং ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি ছিটমহল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে, যা কিনা কোচ-বিহারের মহারাজা এবং রংপুরের নবাবের মধ্যবর্তী চুক্তির ফল| তবে ২০১১ এর সেপ্টেম্বরে চুক্তির ফলে হয়তো এই সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হবে বলে আশা করা যায়|

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ ও ভারতের ২টি মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে সীমান্ত সংঘাত সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করে একটি ৮৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে| বাংলাদেশের সংস্থা "অধিকার" এবং ভারতের "বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ" এই দুটি সংস্থার সাহায্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন সীমন্ত সমস্যার উপরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে| বাংলাদেশের সাথে ভারতের অর্ধেকেরও বেশি সীমান্ত এই পশ্চিমবঙ্গের সাথেই| পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিএসএফ শুধুমাত্র বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার কারণেই অভিযুক্ত নয় একই সাথে নিজ দেশের নাগরিকদেরও বিনা বিচারে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত| ২০০৭ পর্যন্ত বিএসএফ এর হাতে ৩১৫ জন বাংলাদেশী এবং ৬১ জন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক| বিএসএফ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সংখ্যাটা, ২০০৬ পর্যন্ত ৩৪৭ জন বাংলাদেশী এবং ১৬৪ জন ভারতীয়|

সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সম্বল কৃষি নয়তো গবাদি পশু পালন| অর্থনৈতিক কারণেই হোক বা সামাজিক কারণেই হোক তারা সীমান্তে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছে| এছাড়াও অত্যাধিক জনসংখ্যা, সেচের অভাব, ফসলের অপ্রতুলতা, খাদ্যের ঘাটতি, জীবনযাত্রার নিম্নমান ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ| এরা রাজনীতি বোঝেনা, বোঝে কোনমতে বেঁচে থাকা| আর একারণেই অভাবকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বিশাল চোরাচালানি চক্র, যেখানে নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে হর-হামেশা|

তাই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে কিছু সমস্যা যদি চিহ্নিত করা যায় তা হলো-

১. অত্যাধিক জনসংখ্যা
২. ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়
৩. দারিদ্র
৪. সরকারী পর্যবেক্ষণ, অনুদান, সাহায্য-সহযোগিতার অভাব
৫. চোরাচালান (বিশেষত ফেনসিডিল চোরাচালান, নারী পাচার, গবাদিপশু চালান)
৬. ভৌগলিক অবস্থান

ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা যায় তা হলো-

১. অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি
২. চোরাচালান
৩. সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ/নিরাপত্তা হুমকি
৪. মুদ্রা পাচার
৫. অস্ত্র চালান

এই সমস্যাগুলোর সব কয়টি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত| ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সীমান্ত সংলগ্ন লোকালয়গুলো একে অপরের লাগোয়া এবং ঘন-জনবসতিপূর্ণ| তাই সঠিক ভাবে সীমানা পিলার চিহ্নিতকরণ এবং সবসময় তা অনুসরণ করা ভৌগলিক কারণেই অসম্ভবপ্রায়| একই সাথে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সীমান্ত সংলগ্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনের তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের জন্য যাওয়াটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা| যেহেতু দারিদ্র এই অঞ্চলগুলোর একটি অভিশাপ এবং তারা সরকারী সাহায্য থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত তাই এদের পরিস্থিতিকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে চোরাচালানী চক্র| যারা সাধারণ মানুষকে ব্যাবহার করে সামগ্রী দুইদেশেই পাচার করছে, এমনকি মানুষ পাচার নিত্য-দিনের ঘটনা, যার অধিকাংশ থেকে যাচ্ছে লোক-চক্ষুর আড়ালে|

ভারতীয় সরকার ও বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্যমতে, ভারতে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্খাজনক ভাবে, একই সাথে ভারত সরকার তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পেছনে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছে| একই সাথে অস্ত্র চালান একটি বড় হুমকি বলেও উঠে এসেছে| ভারতের আসামে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা আশঙ্খাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তিতে সেটি জাতিগত সহিংসতার রূপ নেয়| এখনো আসামে এই সহিংসতা চলছে, সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি লড়াই এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন এই অনুপ্রবেশকারীদের আধিক্য| এছাড়াও বিভিন্ন সূত্র মতে, ভারতে ১২ মিলিয়ন অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে শুধু আসামেই আছে ৫ মিলিয়ন| এছাড়াও, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে| এর ভিত্তিতেই ভারত সরকার বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু সময় ধরে "পুশ-ব্যাক" এর চেষ্টা চালায়| যা কিনা এখনো চলছে|


কিন্তু সীমান্তে এই সকল সমস্যা মোকাবেলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পদক্ষেপ প্রশ্নে জর্জরিত| যেখানে সীমান্ত আইন অনুযায়ী সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীকে আদালতের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করার কথা, সেখানে অধিকাংশ সময় গুলি করে হত্যা হচ্ছে বিএসএফ এর পথ| এছাড়াও যেকোনো হত্যা কান্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো বিচার-বিভাগীয় তদন্ত ভারত সরকার করেনি| কোনো হত্যা কান্ডের ঘটনাতেই অভিযুক্ত কোনো সদস্যের কোনো বিচার হয়নি| অধিকাংশ সময় বিএসএফ কর্তৃক গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়সাড়া গোছের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে অধিকাংশ সময় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, "সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাজে বাঁধা এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ|" কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক কারো নিহত হবার ঘটনায় যে পুলিশ রিপোর্ট এবং তদন্ত হবার কথা সেখানে কিছুই হয়নি| যেখানে নিরাপত্তাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়ে এই নিপীড়ন সেখানে মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে মৃত ব্যাক্তির কাছ থেকে কখনই কোনো অস্র-গোলাবারুদ কিংবা বিধ্বংসী কোনো কিছু জব্দ করে প্রমান হিসেবে দেখাতে পারেনি বিএসএফ| বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যাক্তির পিঠের দিকে গুলি লাগার কারণে এটাই অনুমেয় যে ওই ব্যাক্তি পালাতে গিয়েছিলো, তাই পলায়নপর ব্যাক্তিকে সতর্ক না করে কিংবা আটক করার চেষ্টা না করে গুলি করে হত্যা করা কোনভাবেই আইনসম্মত নয় এবং সীমান্ত আইনের পরিপন্থী| কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বহু বছর যাবৎ "শুট এট সাইট" বা দেখামাত্র গুলির পন্থা অনুসরণ করে চলেছে| তাই সাধারণ কৃষক, খামারের কর্মী এধরনের অশিক্ষিত মানুষ ভুলের কারণে সীমান্ত এর কাছাকাছি এলেই কিংবা ভুলবশত সীমান্ত অতিক্রম করলেই অনেককেই বিএসএফ এর গুলির শিকার হতে হচ্ছে| অনেকবার বিএসএফ বাংলাদেশের ভূখন্ডের ভেতরে এসে নিরীহ মানুষের উপরে গুলিবর্ষণ হতে শুরু করে কাওকে কাওকে জোর করে নিজেদের ক্যাম্প এ নিয়ে নির্যাতন-হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে| এই ধরনের ঘটনার স্মৃতি এখনো পুরনো হয়নি, যখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অনেক গ্রামের মানুষকেই ভিটে-মাটি ছেড়ে পালাতে হতো দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিবিনিময়ের ফলে|

বর্তমানে প্রায় ৪.৯ কি.মি পরপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে যা কিনা বেড়া দেওয়া শেষ হলে ২.৯ কি.মি এর দুরত্বে এসে দাড়াবে| এছাড়াও রাতে সীমান্তে চলে কারফিউ এবং টহল, দিনভর টহল এবং সার্চপার্টি তো রয়েছেই| তারপরও নিরাপত্তার অজুহাতে বারংবার নিরীহ গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়| এছাড়াও যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনাতেই কোনো অস্র কিংবা বিস্ফোরক উদ্ধার হয়নি, তাই নিরাপত্তার অজুহাত এখানে ধোপে টেকেনা| বরং অনেক সময়ই ওপেন ফায়ার এর কারণে গুলি ছিটকে এসে ঘরের মধ্যে থাকা মানুষ নিহত হচ্ছে| আর ভৌগলিক কারণে যেহেতু চাষের জমিগুলো একদমই সীমান্ত সংলগ্ন তাই ভুলবশত কৃষিকাজের সময় কোনো কৃষকের পক্ষে সমান্তি পিলার না দেখে অতিক্রম করে ফেলাটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, তাই এই জায়গাগুলোতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং অস্রের প্রয়োগ শুধুমাত্র একটি দেশের আধা সামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক তাদের আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ|

এরকম কয়েকটি সাধারণ গ্রামবাসী (বাংলাদেশী) নিহত হবার ঘটনা-

১. ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১০, রিক্সাচালক ফরিদ হাসান (২৩), শারিয়ালজট গ্রাম, পঞ্চগড়
২. ২৯ জানুয়ারি, ২০১০, শ্যামল সরকার (১৭), বিশ্রশিয়া গ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ
৩. ২২ জানুয়ারি, ২০১০, নজরুল ইসলাম (৪০), বারিবাকা গ্রাম, মেহেরপুর
৪. ১৫ জানুয়ারি, ২০১০, সহিদুল ইসলাম (৩৭), কাজিপুর গ্রাম, মেহেরপুর
৫. ৯ জানুয়ারি, ২০১০, মনিরুল ইসলাম (২৩), চাপাইনবাবগঞ্জ
৬. ১ জানুয়ারি,২০১০, শফিকুল ইসলাম (২৭), শীতলপুর গ্রাম, সাতক্ষীরা
৭. ১৩ মার্চ, ২০০৯, আব্দুর রাকিব (১৩), দোহালকারী লেক
৮. ৭ জানুয়ারি, ২০১১, ফেলানী (১৫), অনন্তপুর

কয়েকটি সাধারণ গ্রামবাসী (ভারতীয়) নিহত হবার ঘটনা-

১. ৪ মে, ২০১০, বাসিরুন বিবি এবং আশিক (৬), কোচবিহার
২. ২১ মার্চ, ২০১০, আতিউর রহমান, পুঠিয়া, জামতলা
৩. ১০ নভেম্বর, ২০০৯, শাহজাহান গাজী (১৮), উত্তর ২৪ পরগনা
৪. ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯, নূর হোসেন (১৭)
৫. ২২ আগস্ট, ২০০৯, শ্যামসুন্দর মন্ডল, মুর্শিদাবাদ
৬.১৩ জুলাই, ২০০৯, সুশান্ত মন্ডল (১৩), মুর্শিদাবাদ
৭. ৫ মে, ২০০৯, আব্দুস সামাদ (৩৫), মুর্শিদাবাদ
৮. ২৪ মার্চ, ২০০৯, সঞ্জিত মন্ডল (১৭)

এই ঘটনাগুলোতে চোরাচালান সম্পৃক্ততার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রমান করা যায়নি, শুধু তাই নয়, চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হলেও বিনা বিচারে, অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে এদের অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে| শুধু তাই নয়, এদের বয়স লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা অল্প বয়সী অথবা শিশু| তাই নিরাপত্তার খাতিরে গুলিবর্ষণের অজুহাত এখানে একদমই গ্রহণযোগ্য নয়|

এছাড়াও গ্রামবাসীদের সাথে বিএসএফ এর খারাপ ব্যাবহার, নারী নির্যাতন, অকথ্য গালিগালাজ থেকে শুরু করে অযথাই মারধর করা থেকে শুরু করে আরও অনেক ধরনের অভিযোগ আছে| যেই নিরাপত্তা আর চোরাচালান বন্ধের জন্য বিএসএফ এর আস্ফালন তা কিন্তু বন্ধ হয়নি কোনো অংশেই, বরং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিদিন চলছে হাত বদলের কাজ| আর এর সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে দুদেশেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর|

তাই সীমান্ত সংঘাত ও মৃত্যুর মিছিল বন্ধে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে দ্রুত এবং শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে, তার মধ্যে-

১. ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন মান্য ও জাতিসংঘের বিধান অনুসরণ করে সীমান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার আদেশ এবং ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বিচার বিভাগীয় সুস্থ তদন্ত এবং তার প্রতিবেদন আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ ও অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যাবস্থা নিশ্চিত|

২. বার বার ঘটে যাওয়া আইন অমান্য এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রমান হয় যে, বিএসএফ এর অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যাবস্থার দুর্বলতা ও অসাধুতা, তাই বিএসএফ এর এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ|

৩. বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন ও সকল বিচার বহির্ভূত হত্যা-নির্যাতনের সুষ্ট-স্বচ্ছ তদন্ত ও প্রতিবেদন প্রকাশ|

৪. প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের জন্য জাতিসংঘের সাহায্য কামনা ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ দল|

৫. দুই দেশের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজন হলে যৌথ টহলগ্রুপ গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনা|

৬. রাতের বেলা সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে অতিরিক্ত লোকবল প্রয়োগ ও যথাযথভাবে টহলদানের ব্যাবস্থা|

৭. পূর্বে ঘটে যাওয়া সকল বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ডের তদন্তের পড়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিএসএফ এবং ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমার আবেদন|

৮. বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন ও সময় উপযোগী পরিবর্তনের মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার প্রতি জোরালো দৃষ্টি|

৯. সীমান্তে চোরাচালান রোধে গ্রামবাসীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের সরকারী সাহায্য বৃদ্ধি|

১০. বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও কঠোর ও শক্তিশালী করা, প্রয়োজনে নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রকল্প শুরু|


সীমান্ত সংঘাত, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর আগ্রাসন ও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যার্থতা নিয়ে লিখতে গেলে কখনই ছোট পরিসর যথেষ্ট নয়, তাই আমাদের সকলকে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা নিরসনে সকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করার জন্য| নয়তো এই সংঘাত ভবিষ্যতে আরও রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে বলে মনে হয়|

[ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে "ট্রিগার হ্যাপি" হিসেবে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর পুরো প্রতিবেদন এবং ২০০৭ থেকে শুরু করে বিএসএফ এর গুলি এবং নির্যাতনে বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যুর সংযুক্ত করা হলো পোস্টের সাথে, এছাড়াও সীমান্তে নারী পাচার নিয়ে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পুরনো একটি লেখার লিঙ্ক সাথে দিলাম, এছাড়াও অনান্য লিঙ্কগুলোও সংযোজন করে দেওয়া হল]

http://www.hrw.org/sites/default/files/reports/bangladesh1210Web.pdf

http://en.wikipedia.org/wiki/Bangladesh%E2%80%93India_border

http://www.guardian.co.uk/commentisfree/libertycentral/2011/jan/23/india-bangladesh-border-shoot-to-kill-policy

http://www.globalpost.com/dispatch/news/regions/asia-pacific/india/111225/india-bangladesh-border

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.southasiaanalysis.org/%5Cpapers14%5Cpaper1391.html

http://www.sachalayatan.com/node/40946











No comments:

Post a Comment