Sunday, May 13, 2012

রুদ্ধশ্বাস কয়েক ঘন্টা- একজন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা

আজকে গ্র্যাজুয়েশন এর শেষ পরীক্ষা ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই আজকের দিনটা অন্যরকম। আমার নরক থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দবার্তা। বিকেলে একটা পার্টিতে যাওয়া হলো, রাতে ফিরলাম হোস্টেলে প্রায় ১২টা বাজে তখন। সবকিছু ঠিক ছিলো, রাত ১টার দিকে জল ভরতে এক তলায় গিয়েছি, হঠাৎ দেখি দৌড়ে আসছে এক ব্যাচমেট। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললো, একজন জুনিয়র আত্মহত্যা করার জন্য ছাদে দাড়িয়ে আছে। শোনার সাথে সাথে আমার প্রথম বছরের প্রথম দিনের স্মৃতি চোখের সামনে যেনো ঝলসে উঠলো। আমি যেই রাতে প্রথম বর্ষের ছাত্রাবাসে উঠি, তার পরের দিন সকালে ছিলো আমাদের প্রথম ক্লাস। প্রচন্ড রেগিং (যাদের ভারতের উত্তর প্রদেশের রেগিং সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের বোঝার উপায় নেই) এর মাঝ দিয়ে অপরাধীদের মতো দল বেঁধে যখন ক্লাসে যাচ্ছিলাম তখনো জানিনা সামনে কি অপেক্ষা করছে, সেই দুঃসহ কয়েকটা ঘন্টা পার হবার পরে যখন হোস্টেলে ফিরলাম, শুনি, আমাদের এক ব্যাচমেট নিজের রুমে আত্মহত্যা করেছে। সাথে সাথে দৌড়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ। এখনও মনে আছে, ব্যাস, কয়েক ঘন্টার মাঝে মিডিয়া, পুলিশ, কলেজের প্রশাসন, আতংকিত অভিভাবক সব মিলিয়ে ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা। নিজের দেশের বাইরে এসে কলেজের প্রথম দিন এধরনের ঘটনায় হতবাক আমি।পরবর্তী কয়েক ঘন্টার মাঝেই সেদিন ৭০০ ছাত্রের হোস্টেল ফাঁকা হয়ে গেলো, রইলো হাতেগোনা আমার মতো ২০-৩০ জন। এই স্মৃতি এখনও খুব একটা পুরনো হয়নি।

তাই আজকে এই কথা শুনেই দৌড়ে ছাদে গেলাম, তখনো সবাই ব্যাপারটা জানেনা। আর এভাবেই পরীক্ষা শেষ, সবার বাড়ি ফেরার তোড়জোড়, অনেকে ইতিমধ্যেই চলে গেছে। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আতংকিত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে, খুবই সংকীর্ণ ছাদের কার্নিশে এক ছেলে মাতাল অবস্থায় বসে আছে। ফোনে কথা বলছে নিজের মা-এর সাথে। জায়গা পরিবর্তন এতই অসংলগ্ন ভাবে করছে যেকোনো মুহুর্তে নিচে পড়তে পারে। আমাদের ছাদ ৫ তলায়, এরই মাঝে নিচে ছাত্ররা যে যা পেড়েছে নিয়ে এসেছে। বিছানার তোষক হতে শুরু করে লেপ-কম্বল সব স্তুপাকৃতি করে রাখা হয়েছে, নিচের কার্নিশগুলোতেও বিছিয়ে দেয়া হয়েছে এসব। কোনভাবেই তাকে মানাতে না পেড়ে, শেষপর্যন্ত বেশ কয়েকজন কার্নিশে নেমে গেলো তাকে ধরার জন্য। সমস্যা হচ্ছে কার্নিশ এতই সংকীর্ণ যে, যারা নিচে নেমেছে তাদের জন্য এখন আলাদা ভয়।

এরই মাঝে, চিফ ওয়ার্ডেন, প্রক্টর, ডিরেক্টর, পুলিশ সব এসে হাজির। কিন্তু কেউ সাহস পাচ্ছেনা কিছু বলার, অনেকবার চেষ্টা করা হলো তাকে মানানোর। এরই মাঝে প্রক্টর বললেন মোটা রশির ব্যবস্থা করতে, আমার কাছে একটা বেশ মোটা বড় রশি ছিলো রুমে, দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসলাম। কিন্তু এখন ভয় হচ্ছে সেই ছেলেকে না জানিয়ে কিভাবে তাকে রশি বাঁধা হবে? যারা মানব শিকল তৈরী করতে নিচে নেমেছিলো উপর থেকে তাদেরকে ধরে রাখা হচ্ছে, কিন্তু জায়গা সংকুলান হচ্ছেনা।

কোনভাবে চেষ্টা করে ধীরে-সুস্থে রশির একটা অংশ সেই ছেলেটিকে জড়িয়ে দেয়া হলো, আমরা কয়েকজন মিলে ধরে রাখলাম পিছন থেকে। কিন্তু ছেলেটির যথেষ্ট ওজন হওয়ায় এই সুরক্ষা কোনভাবেই যথেষ্ট নয়, আর এছাড়াও যারা নিচে দাড়িয়ে আছে কার্নিশের ধারে, তাদের অনেকেই এখন তাদের ভারসাম্য রাখতে পারছেনা ধাক্কা-ধাক্কিতে। এদিকে ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দেয়া হলো, কিন্তু আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। এদিকে সেই ছেলেকে তার মা-বাবার সাথে কথা বলিয়ে মানানোর চেষ্টা চলছে ফোনে। অনেকবার নিচে পড়ার উপক্রম হলো, কিন্তু ছাত্ররা নিজেদের হাত দিয়ে কোনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।

ফায়ার-ব্রিগেড আসতে এতই দেরি হচ্ছিলো যে, শেষ পর্যন্ত হোস্টেল থেকে জলের পাইপ নিয়ে আসা হলো। যেটা পেঁচিয়ে পুরো একটা ব্যারিয়ার তৈরী করা হলো কার্নিশের সবার চারপাশে। এবার আসল পদক্ষেপ, যেভাবেই হোক আমরা বুঝলাম আমাদের নিজেদেরই ওকে উপরে তুলে আনতে হবে। কিন্তু একবার যদি সে মাঝখানে ভর ছেড়ে দেয় তাহলে শুধু সেই ছেলেই না সাথে আরও কয়েকজনের নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এদিকে বাতাস এর বেগ বাড়ছে, ঝড়ের সম্ভাবনা। তাই ধীরে ধীরে রশি টেনে শক্ত করা হলো, পাইপ পুরো পেঁচিয়ে শক্ত করে রাখা হলো। এরপর একসময় প্রায় ১৫-২০ জনের সাহায্যে সেই ছেলেকে উপরে কোনমতে ধরে তুলে আনা হলো অর্ধেক সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। সেই সাথে সমাপ্ত হলো রুদ্ধশ্বাস কয়েক ঘন্টার।

এই কলেজে আসার পর থেকে অনেক ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা আমরা দেখেছি, প্রচন্ড মানসিক চাপ, বিরূপ পরিবেশ, শিক্ষকদের অসহনীয় অত্যাচার, জঘন্য পরিস্থিতি, তাতে অনেক পরিচিত মুখ হারিয়ে গেছে অসময়ে। প্রথম বর্ষ এর রেজাল্টের পড়ে হোস্টেলে ফিরে শুনেছিলাম, আমাদেরই এক ব্যাচমেট মেয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছে। একইভাবে দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে দুইজন জুনিয়র আত্মহত্যা করেছিলো নানা কারণে। অসংখ্য মানুষের এভাবে চলে যাওয়া দেখে সবসময় একটাই প্রশ্ন মাথায় এসেছে, কিছু তো একটা ভুল হচ্ছে!! কিছু তো একটা সমস্যা এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আছে!!

যারা থ্রি ইডিয়টস চলচ্চিত্রটি দেখে থাকবে শুধু বলতে পারি তারা আমাদের পরিস্থিতির ৫ শতাংশ হয়তো বুঝতে পারবে। বাস্তব এর থেকেও জঘন্য। যদি শিক্ষা নিতে এসে শিক্ষক ও সিলেবাসের চাপে একজন ছাত্রর আত্মঘাতী হতেই হয় তাহলে সেই ছাত্রটির যদি দোষ থাকে তাহলে একই দোষ থাকে সেই শিক্ষা ব্যবস্থারও।

অসংখ্য অভিভাবক তাদের সন্তানকে শিক্ষা গ্রহণ করতে দেশের বাইরে পাঠান, কিন্তু আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি, শেষ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আর একবার ভাবুন। ভাবুন যে, এই পদক্ষেপে সেই মানুষটির জীবন কিভাবে বদলে যাবে, সে কি তার নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানসিক ও শারীরিক ভাবে যথেষ্ঠ পরিপক্ক কিনা। নয়তো এই অজস্র অসময়ের মৃত্যু মিছিলে হয়তো পরবর্তী নামটা তারও হতে পারে।

আমি শুধু সেই বাবা-মা এর কথা চিন্তা করি যাদের সন্তান আজকে রাতে এই অবস্থায় ছিলো, আর চিন্তা করি দূরদেশ থেকে শুধু ফোনে কথা বলার মুহূর্তগুলোতে তাদের দুর্বিষহ অনুভূতি। একবার ভাবুন, আপনার সন্তান ফোনের অন্যপ্রান্তে আর আপনি জানেন যেকোনো মুহুর্তেই এটা তার শেষ কথা হতে চলেছে !!!!

No comments:

Post a Comment