Saturday, May 26, 2012

চলচ্চিত্র: দ্যা ফ্লাওয়ার্স অফ ওয়ার


the-flowers-of-war-poster

নাম: দ্যা ফ্লাওয়ার্স অফ ওয়ার
দৈর্ঘ্য: ১৪৬ মিনিট
বিষয়: নানকিং ম্যাসাকার, ধর্ষণ, চীন-জাপান যুদ্ধ
পরিচালক: ইমও জহাং
দেশ: চীন
ভাষা: চাইনিজ (নানকিং প্রাদেশিক), ইংরেজি

যুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রে বরাবরই আগ্রহ বেশি, বেশিরভাগ সময় চেষ্টা করি এধরনের প্রেক্ষাপটে তৈরী ভালো চলচ্চিত্রগুলো সংগ্রহে রাখতে। এরকম অনেক ভাষার চলচ্চিত্র সংগ্রহে রাখার একটি সুবিধে হচ্ছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুদ্ধকালীন সময়কে যাচাই করা। মানুষের ক্রোধ-ভালোবাসা, জীবন-মৃত্যু এরকম অসংখ্য অনুভূতি ও পরিস্থিতিগুলোকে একই জায়গায় পরস্পরের বিপরীতে রেখে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। মিশ্র অনুভূতির এই জটিল রসায়ন বিশ্লেষণে, একটি ভালো চলচ্চিত্রের থেকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আর কি হতে পারে।

যেকোনো যুদ্ধে নারী এবং শিশু সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নারীদের সব থেকে বেশি নির্যাতনও ভোগ করতে হয়। ইতিহাসে এর অনেক দৃষ্টান্ত উপস্থিত। "মাস রেপ"- ধর্ষণ, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি মানসিক মারনাস্ত্র। এর নিকৃষ্ট প্রয়োগ বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সব জায়গাতেই লক্ষনীয়। নারীকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করেই শুধু নয়, এর প্রয়োগ প্রতিপক্ষের মনোবল ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। এরকমই ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হচ্ছে "নানকিং ম্যাসাকার", ইম্পেরিয়াল জাপান কর্তৃক চীনের নানকিং প্রদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও ধর্ষণ পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে ভয়ঙ্কর, যুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি উধাহরণ। এই যুদ্ধে অসংখ্য মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়, যার মধ্যে নারীরা শিকার হয় গণধর্ষণ ও হত্যার। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন চীনের প্রায় তিন লক্ষ-চার লক্ষ মানুষ এই সময়টিতে জাপানের আগ্রাসী সৈন্যবাহিনীর হাতে নির্যাতনের পরে মৃত্যুবরণ করে। এই ইতিহাস সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা ছিলো, চলচ্চিত্রটি দেখার পরে হতবাক হয়ে রইলাম। পরিচালক অসাধারণ দক্ষতায় মানবিকতার চরম বিপর্যয়কে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ১৪৬ মিনিট সময়টুকুর মধ্যে। এক মুহুর্তের জন্যও পর্দা থেকে চোখ ফেরানো দুষ্কর।

220px-The_Flowers_of_War_english_poster

একগাদা চলচ্চিত্রের মাঝখানে ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো এটি, শুরু করে একটু এগিয়ে এগিয়ে দেখতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো। স্থির করতেই হলো না দেখলেই নয়। ১৯৩৭ সালের চীন-জাপান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে অসংখ্য চরিত্রের মিশেলে ফুটে উঠেছে সেই সময়ের মানুষের নানান অনুভূতিগুলো। প্রিয় অভিনেতা ক্রিস্চিয়ান বেএল দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন আবারও। তার চরিত্রটির উপর ভর করে কাহিনী এগিয়েছে অদ্ভুত একটি গতিতে।
কখনো মানুষের ভালোলাগা-খারাপলাগার অনুভূতিতে চরিত্রগুলো হয়ে গেছে অনেক আপন, কখনো আলাদা আলাদা ভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে গেছে এক অদ্ভুত ঘোরলাগা পরিবেশে। মানুষের ভালো-মন্দ দিকগুলো উঠে এসেছে অকৃপণভাবে, একটা সময় দর্শক নিজে থেকেই লক্ষ্য করবে চরিত্রগুলো তাদের অতি সাধারণ খোলস থেকে বের হয়ে একটি অসাধারণ উচ্চতায় নিজেদেরকে নিয়ে গেছে, যেখানে মানুষের ভালো-মন্দ এক হয়ে একটি আলাদা জগৎ তৈরী হয়েছে।

প্রধান পাঁচটি চরিত্র আলাদা করা যায় পুরো সময় থেকে, যাদের গুরুত্ব ছিলো বেশি। প্রথমেই আসে একজন সাধারণ মরটিসিয়ান জন মিলার এর চরিত্রে ক্রিস্চিয়ান বেএল, তার অনবদ্য অভিনয় যেকোনো দর্শকের জন্য আলাদা প্রাপ্তি। আমার মনে হয়েছে তার জীবনের সেরা অভিনয়গুলোর একটি। এর পরে মেজর লি এর চরিত্রে তং দাঅই, দেহপসারিনী যু মো এর চরিত্রে নি নি, ছাত্রী সুজুয়ান এর চরিত্রে জহাং এবং চার্চের সেবক অনাথ জর্জ এর চরিত্রে হুয়াঙ। এরা প্রত্যেকেই তাদের অভিনয়ের জন্য প্রশংসার দাবীদার।

FlowersOfWarPoster

ক্যাথিড্রালের ফাদার এর মৃত্যুতে যুদ্ধকালীন সময়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে নানকিং এ আসে জন মিলার, এখানে দেখা হয় জাপানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে চলা কনভেন্টের দুজন ছাত্রীর সাথে যাদের মধ্যে একজন সুজুয়ান। তারপর ঘটনা এগিয়ে চলে। যুদ্ধকালীন দৃশ্যগুলো দারুন দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ধ্বংসস্তুপ এর আড়ালে চলা গেরিলা যুদ্ধ এবং প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলো যথেষ্ট নিঁখুত এবং বিস্তৃত। পোশাক এবং সেট দুটোই উচ্চ-প্রশংসার যোগ্য। একটি ক্যাথিড্রাল এবং কনভেন্ট বিদ্যালয়কে ঘিরেই মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে।

জাপানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে এই কনভেন্টে আশ্রয় নেয় বেশ কিছু ছাত্রী একই সাথে ঘটনাচক্রে সেখানে আশ্রয় নেয় নানকিং প্রদেশের বেশ কয়েকজন দেহপসারিনী। এই কনভেন্টটিতেই আসে জন মিলার। এখানে মূলঘটনাটিকে একটি অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে সমাজের তথাকথিত অস্পৃশ্য কয়েকজন নারী তাদের বিপরীতে সদ্য কিশোরী কনভেন্ট ছাত্রী, আবার দৃঢ় মনের সেবক জর্জ তার বিপরীতে অর্থলোভী জন মিলার। এই বিপরীত চরিত্রগুলোকে একসাথে একটি জায়গায় আবদ্ধ রেখে যুদ্ধের চরম পরিস্থিতিতে তাদের মানবিক অনুভূতিগুলোকে উত্থান-পতনের মাধ্যমে এক জাদুকরী ছন্দে পরিচালনা করা হয়েছে। শক্তিশালী প্লট, সাধারণ কিন্তু গভীর সংলাপ এবং যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, উপাদানগুলো এক হয়ে পুরো সময়টি দর্শককে বিমোহিত করে রাখবে এটা নিঃশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

চলচ্চিত্রটির ঘন্টাখানেকের সময় জন মিলার যখন সেনাদের ধর্ষণের হাত থেকে ছাত্রীদের বাঁচানোর জন্য নিজের কাপুরুষোচিত মনোভাবকে ছুড়ে ফেলে চার্চের ফাদারের পোশাকে, নিজের জীবন বাজি রেখে বাইরে এসে কঠিন স্বরে তার মূলচরিত্রে প্রবেশ করে তখন স্বতস্ফুর্ত হাততালি আটকে রাখা সম্ভব নয়। একই ভাবে যখন দেহপসারিনী হিসেবে সমাজে অবহেলিত-ঘৃণিত কয়েকজন নারী তাদের ক্ষুদ্র বৈচিত্রহীন জীবনের বাইরে এসে নিজের জীবন উত্সর্গ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পিছুপা হয়না, তখন সাধারণ মানবিক গুনাবলীর বাইরে তাদের দেবত্বের আসনে বসানো কম হয় বৈকি। এভাবেই চলচ্চিত্রটি মানুষের জীবনের অজস্র ক্ষুদ্র অনুভূতি ও পরিস্থিতিগুলো বিশ্লেষণ করে তুলে ধরেছে অসংখ্য জটিল সমীকরন যার হিসেব মেলানো সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর আর মানুষের মাঝে প্রাচীন দন্দ্বের অনবদ্য প্রকাশও এই চলচ্চিত্রটি।

"দ্যা ফ্লাওয়ার্স অফ ওয়ার"- আমার দেখা চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে অন্যতম সেরা, এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। জীবন-মৃত্যু, সৌন্দর্য্য-ধ্বংস, যুদ্ধ-ভালোবাসা এরকম অসংখ্য বিপরীত পরিস্থিতির সংঘর্ষে, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কেউ জয়ী হলো কিনা তা হয়তো প্রকাশ পেলোনা। কিন্তু এই যে দর্শককে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি চুর্ণবিচুর্ণ করে আবার প্রতিটি মুহুর্তে নতুন করে গড়তে বাধ্য করা হলো, এর জন্য সাধারণ প্রশংসা কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত অন্যসব চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে আমি "দ্যা ফ্লাওয়ার্স অফ ওয়ার"-কে প্রথম সারিতে রাখবো অবশ্যই।

the-flowers-of-war02

[চলচ্চিত্রের পোস্টারগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

No comments:

Post a Comment