Monday, June 11, 2012

মুক্তিকামী প্রজ্জ্বলিত প্রাণ

মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ২৬ বছর বয়সী এক বিক্ষুব্ধ তিব্বতী তরুণ, জামপা ইয়েশি। (ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে, যন্তর-মন্তর এলাকায়) স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে সে| অগুনিত আত্মত্যাগের ভিড়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে সে, বেঁচে থাকা অসংখ্য মানুষের মনে এনে দিয়ে গেছে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা। গল্পের ফিনিক্স পাখির মতো তার ছাই থেকে জন্ম নেবে আরো অজস্র প্রতিবাদী প্রাণ| কতোটা তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন হলে নিজেকে এভাবে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া যায়? হয়তো এভাবেই মুক্তির মশাল এগিয়ে চলবে আরও বহুকাল-বহুদুর|

হিমালয়ের কোলের ছোট্ট এই ভূখন্ডটিকে নিয়ে রক্তাক্ত রাজনীতি কিংবা সমরনীতি চলছে সেই বহুকাল আগে থেকেই| ১২৩৯ সালে মোঙ্গলদের আগমন, এরপরে ১৮ শতাব্দীর কুইং রাজত্ব। সবক্ষেত্রেই রক্তাক্ত হয়েছে শান্ত এই ভূখন্ডটি| কখনো আগ্রাসী যুদ্ধবাজ নেতার কারণে, কখনো রাজনীতির কূটকৌশলের কারণে| এরপরে উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন পরাশক্তি ব্রিটিশদের আগমন| ১৯০৪ সালে, ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ড এর নেতৃত্বে বিশাল সৈন্যদল আক্রমন করে তিব্বত| ব্রিটিশদের ভয় ছিলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া তিব্বত-এ তাদের প্রভাব জারি করছে| শুধুমাত্র অনুমানের বশবর্তী হয়ে এই আক্রমনে প্রাণ হারায় ১,৩০০ এরও বেশি স্থানীয়| কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে সংখ্যাটা ৫,০০০ এর বেশি|

tibet-1

এরপর ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত চলে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন-এর ধরপাকড়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন চুক্তিতে তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয়| এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং চীনের গৃহযুদ্ধের দাপটে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই কিছুটা স্তিমিত থাকে| কিছু কিছু অঞ্চল তখন বিক্ষিপ্ত ভাবে দালাই লামার অধীনে ছিলো| কিন্তু এরপরেই এই সমস্ত অঞ্চলের উপর একক কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে চীন| ১৯৫০ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি তিব্বত প্রবেশ করে| ১৯৫১ সালে দালাই লামার প্রতিনিধিদের সাথে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যাতে তিব্বত একটি যৌথ শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হওয়ার প্রস্তাব ছিলো| কিন্তু চীন প্রশাসনের জমি বন্টনের দাবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ১৯৫৬ সালের জুন মাসের মধ্যে| ধীরে ধীরে এই বিপ্লব লাসা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লেও শক্ত হাতে দমন করা হয় ১৯৫৯ সালের মধ্যেই| ১৪তম দালাই লামা এবং তিব্বতের অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ভারতে পালিয়ে যান এই সময়ে| ১৯৫০ সালের পরবর্তী বছরগুলোর অস্থিতিশীলতার সুযোগে সিআইএ তিব্বতের বিপ্লবীগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ,অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য দেয়া শুরু করে|

potala-palace-500

১৯৫০ সালের পর থেকেই তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল টানাপড়েন শুরু হয়| একদিকে সমাজতান্ত্রিক চীনের আগ্রাসন অন্যদিকে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের কূটনীতি| পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা তিব্বতী বিপ্লবীদের সাহায্য করা শুরু করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চীনকে শায়েস্তা করার জন্য| এদিকে একই সাথে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাও তিব্বতী বিপ্লবীদের সাহায্যের হাত বাড়ায়| সশস্ত্র বিপ্লবে সাহায্যদানকারী এই দেশগুলোর মূল লক্ষ্য কখনোই এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাধীনতা ছিলনা, মূল অভিসন্ধি ছিলো চীনকে নাজেহাল করার| তাই বিপ্লবীদের গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্য করা ছাড়া এরা রাজনৈতিক ভাবে কখনই চীনের এই আগ্রাসনকে মোকাবেলা করার ইচ্ছা দেখায়নি|

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে ১৯৬০ সালের দিকে| পরবর্তিতে মার্কিন প্রধানমন্ত্রী রিচার্ড নিক্সন কর্তৃক চীন এর প্রতি ভিন্ন রাজনৈতিক পন্থার কারণে ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে এই সাহায্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়| ১৯৯৮ সালের ২রা অক্টোবর, নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দালাই লামা প্রশাসনের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, প্রতিবছর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য দান করতো তিব্বতী বিপ্লবীদের|

১৯৫০ সালের পূর্ববর্তী ইতিহাস বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো সব সময়েই উত্থান-পতনের মাঝে| ১৯১২ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই পুরো সময়টাই ছিলো তিব্বত এর স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে টানাপোড়েন| তবে কুইং রাজত্বের পতনের পরে মঙ্গোলিয়া এবং তিব্বত উভয়েই নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে| এছাড়াও তিব্বত এর শাসন ক্ষমতা কখনই একছত্র ভাবে কোনো দেশের কিংবা রাজত্বের অধীনে ছিলোনা| বিভিন্ন সময় ক্ষমতার হাত বদলের মাঝে তিব্বত স্বাধীন ভাবেই নিজেদের ভূখন্ড পরিচালনা করতো| যেহেতু দেশটির অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিজীবী এবং বৌদ্ধ লামা, সেহেতু সামাজিকভাবে তিব্বতে সবসময়ই একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকতো| কিন্তু ১৯৫০ সালের চীন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর থেকে তিব্বতের সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে| চীন কর্তৃক তিব্বত অধিগ্রহণ ছিলো সম্পূর্ণ অবস্থানগত সুবিধা আদায় এবং খনিজ সম্পদের আশায়| চীন নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিব্বতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন সাধন করে| সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তিব্বতের প্রাচীন পন্থাকে পরিবর্তন করার প্রয়াস দেখায়| বিভিন্ন সময় তিব্বতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়ে রাজনৈতিক পটভূমি সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে চীন|চীন এর প্রশাসন, তিব্বত সবসময়ই তাদের নিজেদের অংশ ছিলো বলে দাবি করে এসেছে|যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে তারা| এমনকি তিব্বতের স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সবসময়ই পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছে তারা| কিন্তু চীনের শাসনের এই সময়টিতে তিন মিলিয়নের বেশি তিব্বতী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে| যাদের অনেকেই মারা গেছে নয়তো পালিয়ে গেছে| এই সংখ্যাই বলে দিচ্ছে এই ভূখন্ডটির আসল পরিস্থিতি|

090308014005BR

কিন্তু স্থানীয় তিব্বতী বাসিন্দারা প্রথম থেকেই চীন এর এই কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে আসছিলো| বর্তমান সময়ে এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে| শুধুমাত্র ২০১১ সালের মার্চ মাসের পর থেকেই ৩০ জন তিব্বতী নিজেদের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে| ছাত্র, বৌদ্ধ লামা হতে শুরু করে সাধারণ গৃহিনী অনেকেই এভাবে আত্মাহুতির পথ বেছে নিয়েছেন নিজেদের দাবি সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য| যার মধ্যে জামপা ইয়েশি অন্যতম| এছাড়াও ২৭ মে, ২০১২, প্রথমবারের মতো তিব্বতের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ঝোকাং মন্দিরের সামনে দুজন যুবক নিজেদের গায়ে আগুন লাগায়| যার মাঝে ১৯ বছর বয়সী দর্জি সেতেন মারা যায় এবং অপরজন গুরুতরভাবে আহত হয়| এর কিছুদিন পরেই ৩০ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী রেচক একইভাবে স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে নিজের জীবন দান করে|

Free-Tibet1

বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে এই আত্মাহুতির সংখ্যা| শুধু তাই নয়, আগের থেকে আরও তীব্র হয়েছে স্বাধীন তিব্বতের জন্য এই আন্দোলন| তিব্বতের ধর্মীয় নেতা ১৪ তম দালাই লামা অবশ্য স্বাধীন তিব্বতের দাবি থেকে সরে এসে এটিকে চীনের অধীনে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার জন্য বলেছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সভায়| কিন্তু সাধারণ তিব্বতীরা স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসেনি একবারের জন্যও| অপরিসীম সৌন্দর্যের পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই ভূখন্ডটিতে এখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল| স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকারী জনতার অনেকেই আত্মত্যাগ করছেন নির্দ্বিধায়|বিশ্বের কাছে নিজেদের দাবি তুলে ধরার জন্য নিজেকে মুক্তির মশালে পরিনত করতেও দ্বিধা করছেনা এই প্রতিবাদী মানুষগুলো। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতী সাধারণ ছাত্র-জনতা বহু বছর ধরে এই আন্দোলন করে আসছে কিন্তু এখনো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা পোষণ করেনি| দিনে দিনে তাই বেড়ে চলেছে শহীদের সংখ্যা|

তাই এখনই সময় সকল মুক্তিকামী মানুষ এক হয়ে সাধারণ তিব্বতবাসীদের এই ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন দান করে আরও শক্তিশালী করার| একটি স্বাধীন ভূখন্ডের স্বাধীন মানুষ কোনভাবেই আগ্রাসী শক্তির কাছে পরাস্ত হতে পারেনা| তিব্বতের চরম মানবাধিকার অবমাননা সমগ্র সভ্য সমাজের কলঙ্ক| মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে যুগে যুগে আগ্রাসী শাসকগোষ্ঠীর এই শোষণ-নির্যাতন প্রতিরোধ সাধারণ মানুষকেই করতে হবে| যদি জামপা ইয়েশির মতো অসংখ্য স্বাধীনতাকামী প্রাণের প্রজ্জ্বলিত মুক্তি মশাল আমরা বহন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে হয়তো একদিন দাসত্বের শৃঙ্খল আমাদের নিজেদেরও হতে পারে| সেদিন হয়তো বলার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা|

26-tibet-protest-IndiaInk-blog480

http://www.freetibet.org/newsmedia/selfimmolations
http://www.freetibet.org/campaigns/case-studies
http://www.tibetjustice.org/materials/#tibet
http://freetibet.blog.co.uk/2009/03/08/50-years-of-the-national-uprising-tibetan-solidarity-march-through-the-streets-of-london-5713623/
http://buddhisttrends.com/tibetan-new-year-at-un-headquarter-in-nyc/793/





No comments:

Post a Comment