Sunday, July 29, 2012

মেক্সিকো (১৯৬৮) অলিম্পিক এর সেই স্যালুট

blackpower460
[ছবি কৃতজ্ঞতা হাল্টন সংগ্রহশালা]

২০১২ সালের অলিম্পিক গেমস এর পর্দা উন্মোচন হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ এখন লন্ডন এ। মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই অলিম্পিক জন্ম দিয়েছে নানা কৌতূহলের। লৌহ কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নানা বিষয়েই খবরের শীর্ষে এখন "লন্ডন অলিম্পিক :২০১২"।
প্রতি বছরই অলিম্পিক জন্ম দেয় নানা ঐতিহাসিক ঘটনার। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অসংখ্য ক্রীড়াবিদদের আরাধ্য এই অনুষ্ঠানটি এর জন্মলগ্ন থেকেই নিজ বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয় হয়ে আছে। এরকমই একটি অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলো "মেক্সিকো অলিম্পিক : ১৯৬৮"।

আজকে বিশ্বের অনেকের কাছেই এই ঘটনাটি অজানা হিসেবেই রয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া সেই অনন্যসাধারণ ঘটনাটি আজকের দিনেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান ক্রীড়াবিদ টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস এর সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি মানবতার ইতিহাসে তাদের অমর করে রেখেছে। আর সেই সাথে ১৯৬৮ সালের মেক্সিকান অলিম্পিক অনুষ্ঠানটিকে আপন মহিমায় আলাদা করে রেখেছে এতো বছর পরেও। কিন্তু আজ অনেক ক্রীড়াবিদও হয়তো এই দুজন ব্যক্তিত্বের নাম সম্পর্কে অবগত নন।

তখন মানব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্ন। গায়ের বর্ণের পার্থক্যের জন্য মানুষকে সহ্য করতে হতো অমানুষিক নির্যাতন-নিগ্রহ। ধাপে ধাপে উন্নত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলা সমাজব্যবস্থা তখন সাদা-কালো বর্ণের বিভেদে টালমাটাল। অসংখ্য ঘটনা কালো মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে আরও তরান্বিত করে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত নিপীড়িত কালো মানুষেরা তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকার মাটির মানুষেরা রুখে দাঁড়িয়েছে বহু বছর ধরে তাদের উপরে চলে আসা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এই দ্বন্দ-বিক্ষুব্দ সময়েই ১৯৬৮ সাল হয়ে দাঁড়ালো আরেকটি প্রতিকী বছর। এ বছরেই আততায়ীর হামলায় নিহত হলেন রবার্ট কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিং, দাঙ্গা হলো প্যারিসে, মূল অলিম্পিক গেমস শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বেই মেক্সিকোতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর হলো বর্বরোচিত হামলা। আর এরকমই একটি বছরকে আরও স্মরনীয় করে রাখতে ১৬ অক্টোবরের এক সকালে, পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে টমি স্মিথ এবং তার বন্ধু জন কার্লোস মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে রচিত করলেন প্রতিবাদের এক অসামান্য দৃশ্য।

CRsmithT1
[ছবি কৃতজ্ঞতা স্পার্টাকাস এডুকেশনাল]

১৬ অক্টোবর সকালে টমি স্মিথ ২০০ মিটার দৌড়ে ১৯.৮৩ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড তৈরী করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একইসাথে তারই বন্ধু জন কার্লোস তৃতীয় স্থান অধিকার করেন ২০.১০ সেকেন্ড সময়ে। দ্বিতীয় স্থান এ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়াবিদ পিটার নর্মান, তার সময় ছিলো ২০.০৬ সেকেন্ড। দৌড় শেষে এই তিনজন ক্রীড়াবিদই মেডেল গ্রহণ করতে যান মঞ্চে। এসময় দুই আফ্রিকান আমেরিকান ক্রীড়াবিদ খালি পায়ে শুধু কালো মোজা পায়ে মঞ্চে উঠেন "কালো মানুষের দারিদ্র্য" এর প্রতিকী রূপ উপস্থাপনের জন্য। কালো মানুষের গর্বের প্রতীক হিসেবে স্মিথ এর গলায় ছিলো কালো একটি স্কার্ফ, কার্লোস তার জ্যাকেট এর চেইন খোলা রেখেছিলেন, গলায় ছিলো একটি নেকলেস যা ছিলো নির্যাতিত নিপীড়িত নিহত সকল কালো মানুষের জন্য। তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে পিটারও ধারণ করেছিলেন একটি ব্যাজ। তাদের তিনজনের বুকেই ছিলো "অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস" এর প্রতিকী ব্যাজ। মেডেল গ্রহণ করার পরে টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস দুজনেই কালো দস্তানা পড়া মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরেন। [জন কার্লোস তার দস্তানা নিজের ঘরে ভুলে রেখে এসেছিলেন, পিটার নর্মান এর বুদ্ধিতে তিনি টমি স্মিথ এর বাঁ হাতের দস্তানা ব্যবহার করেছিলেন। তাই তুলে ধরেছিলেন বাঁ হাত।] মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরা ছিলো কালো মানুষের মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে নিরব প্রতিবাদ।

smith-carlos_ap_2085290i
[ছবি কৃতজ্ঞতা "দ্যা টেলিগ্রাফ"]

তাদের এই প্রতিকী প্রতিবাদে সাথে সাথে সমগ্র স্টেডিয়ামে হৈ চৈ পড়ে যায়। ছুটে আসেন অলিম্পিক এর কর্মকর্তারা। পরবর্তিতে বিশ্রামকক্ষে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে অনেক দর্শকই দুয়োধ্বনি দিয়ে উঠে। এ সম্পর্কে পরে স্মিথ বলেছিলেন, "If I win, I am American, not a black American. But if I did something bad, then they would say I am a Negro. We are black and we are proud of being black. Black America will understand what we did tonight."

Icon-Fist
[ছবি কৃতজ্ঞতা উইকিপিডিয়া]

পরবর্তিতে অলিম্পিক কমিটির সভা থেকে এই প্রতিবাদকে দুঃখজনক এবং অগ্রহনযোগ্য বলে অভিহিত করা হয়। তাদের গৃহিত সিদ্ধান্তে দুই ক্রীড়াবিদ টমি স্মিথ এবং জন কার্লোসকে অলিম্পিক গেমস থেকে বহিঃস্কার এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আমেরিকান দল এর পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করলে তাদের পুরো দলকে বহিঃস্কার এর হুমকি দেয়া হয়। পরবর্তিতে এই দুজন ক্রীড়াবিদকেই বহিঃস্কার আদেশ মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। অলিম্পিক কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে বলে হয়, "a deliberate and violent breach of the fundamental principles of the Olympic spirit." আজও অলিম্পিক কমিটির ওয়েবসাইটে তাদের সম্পর্কে লেখা আছে, "Over and above winning medals, the black American athletes made names for themselves by an act of racial protest."

পরে দেশে ফেরৎ যাওয়ার পরেও তাদের দুজনকেই বিভিন্নভাবে অপমানিত হতে হয় এমনকি মৃত্যুহুমকি পর্যন্ত সহ্য করতে হয়। এধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতেও তারা দুজনই ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন।

এই দুই ক্রীড়াবিদের প্রতিবাদ সমগ্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরে কালো মানুষের মানবাধিকার বিষয়ক আন্দোলনকে। এমনকি কালো ক্রীড়াবিদদের অধিকারের বিষয়টিও সবার সামনে উঠে আসে। দলের কোচ হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারের বিষয়টি আলোচিত হয়। সামগ্রিকভাবে মানবাধিকারের আন্দোলন পায় এক নতুন মাত্রা।

এই তিনজন ক্রীড়াবিদ এর সম্মানে অস্ট্রেলিয়ার নিউটাউন এ একটি মুরাল তৈরী করা হয়। নাম দেয়া হয় "THREE PROUD PEOPLE MEXICO 68"। তবে পরবর্তিতে বিভিন্ন কারণে এটি অপসারণ এর জন্য চেষ্টা করা হলেও এটিকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা এখনও চলছে।

Smith_Carlos_statue1
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত]


টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস পৃথিবীর ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন তাদের কীর্তির জন্য। অসংখ্য মানুষের কাছে তারা মানবাধিকার আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবেন আজীবন। তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের সেই ছবি হয়ে থাকবে প্রতিবাদের জ্বলন্ত প্রমান। এই লেখাটি সেই সব মানুষের জন্য যারা আজও স্বপ্ন দেখে শোষনমুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন একটি পৃথিবীর।

তথ্যসূত্র-
লিঙ্ক ১
লিঙ্ক ২
লিঙ্ক ৩
লিঙ্ক ৪
লিঙ্ক ৫
লিঙ্ক ৬
লিঙ্ক ৭
লিঙ্ক ৮

No comments:

Post a Comment