Wednesday, August 8, 2012

ডি (১)


১.

দাঁতে দাঁত চেপে দশটি বছর অপেক্ষা করেছে সে ছয় বাই আট ফুটের এই অন্ধকারাছন্ন সেলে। ছোট্ট একটা ছিদ্রের মতো জানালাটা দুই ধাপে শক্ত লোহার শিক দিয়ে আটকানো। আর তার ফাঁক গলে যতটুকু রোদের আলো সেলে ঢোকে তাতে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা যেনো আরও ঘনীভূত হয়। প্রতিটি দিন নয়, প্রতিটি মুহূর্ত যেনো এক একটা বছরের সমান দৈর্ঘ্য নিয়ে কেটেছে। প্রথম প্রথম যখন এখানে আসে সে, ধারণা ছিলো না কতোটা নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু প্রথম সপ্তাহেই একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যখন সাত দিনের সলিটারি কনফাইনমেন্ট এ থাকতে হলো, তখন বুঝলো জীবন কতোটা শক্ত। ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাথর শীতল ছোট্ট সেলে থাকার সময় নিজেকে মানুষ বলে মনে হতো না। আর কয়েদীদের মানসিক অত্যাচার করার জন্য জেল গার্ডরা বেছে নিত খুব প্রাচীন কিন্তু অমানবিক একটা পন্থাকে। মাটির বহু নিচের সলিটারি কনফাইনমেন্ট সেলগুলোতে নিস্তব্দতার মাঝে কোনো এক অন্ধকার কোণ এর কল থেকে টিপ টিপ করে জল পড়ার শব্দ শোনা যেতো দিন-রাত ২৪ ঘন্টা বিরামহীনভাবে। মাথার ভেতরে হাতুড়ির মতো আঘাত হানতো শব্দটা। খুব বেশি দিন লাগাতর এই শব্দ শুনতে শুনতে অনেকে পাগল হয়ে যেতো। ঐসময় দিনে একবার খাবার মিলতো তাও সেটা খাবার কিনা সন্দেহ হতো। রাতের বেলা প্রচন্ড ঠান্ডায় অনেক সময় অচেতন হয়ে যেতো কয়েদীরা কিন্তু উলঙ্গ শরীরে পড়ে থাকতে হতো ঠান্ডা মেঝেতেই।


বলতে গেলে পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে টিঁকে থাকার জন্য যুদ্ধ করে যেতে হয় এখানকার অধিবাসীদের। এখানে তাকে সবাই ডাকতো শুধু “ডি”। কিভাবে এই নামটা এলো সেটা একটা রহস্য তবে মুখে মুখে এটাই চলতো এখানে। প্রথম দিনের ভিতু সাদামাটা মানুষটি এই সুকঠিন জীবনের মাঝে নিজেকে তিলে তিলে তৈরী করেছে, যেভাবে পাথর কুঁদে মূর্তি তৈরী করা হয়। এই কারাগারে বেঁচে থাকাটা অনেকের কাছে দুঃস্বপ্নের মতই, কিন্তু তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য যে একটা লক্ষ্য দরকার ছিলো তা তার আছে, “প্রতিশোধ”। তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করেছে সে, আর এক এক করে মানবীয় সকল অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করেছে। প্রতিদিনের প্রচন্ড পরিশ্রমের ফলে শরীরের যতটুকু মেদ ছিলো তা পরিণত হয়েছে শক্ত পেশীতে, গাইতি আর শাবল চালাতে চালাতে হাতগুলো এখন লোহার মতো শক্ত, কাঁধের পেশী ফুলে উঠেছে। এখন রক্ত মাংসের এই দেহের ভেতর আসলে গ্রানাইটের তৈরী দেয়ালের মতো। ভাবলেশহীন চোখের দিকে তাকালে যে কারো রক্ত শীতল হতে বাধ্য। এভাবেই বহু বছর আগের ছাপোষা অনুভূতিপ্রবণ মানুষটি আজকে রুপান্তরিত হয়েছে লৌহমানবে।


আর ঠিক এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলো সে, যেদিন শুনলো ভালো আচরণের জন্য তার সাজার মেয়াদ বিশ বছর থেকে কমিয়ে অর্ধেক করা হলো কোনো অনুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করেনি সেদিন। শুধু নিজের সেলে ফিরে প্রতিদিনের মতো দেয়ালে আর একটা দাগ কেটেছিলো সে, তবে সেদিনের দাগটা হয়তো অন্য যেকোনো দিনের থেকে একটু বেশি গভীর ছিলো। আর আজকে তার এখান থেকে বিদায় নেয়ার দিন।


আন্দামান সাগরের মাঝখানে একটা দ্বীপে, জাতিপুঞ্জের তৈরী এই কুখ্যাত কারাগারটি নৃশংস-ভয়ঙ্কর সব অপরাধীর জন্য তৈরী করা হয়েছিল বছর দশেক আগে। কয়েক ধাপে শক্ত কংক্রিটের তৈরী দেয়াল আর বৈদ্যুতিক তারে ঘেরা এই কারাগারটিতে রাখা হয় পৃথিবীর মারাত্মক সব অপরাধীকে। নানা দেশ থেকে বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের এখানে নিয়ে আসা হয়। এদের অধিকাংশেরই যাবজ্জীবনের শাস্তি। এক কথায় সমাজ থেকে নির্বাসন। এখান থেকে খুব কম লোকই জীবিত ফেরৎ গেছে। এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করাও বৃথা। দ্বীপের চারপাশেই সাগর। দূর দূর পর্যন্ত আর কোনো দ্বীপ নেই। পুরু কংক্রিটের দেয়াল আর মেঝেতে সুড়ঙ্গ বানানোর মতলব এখানে বৃথা। তার উপরে কারাগারের দেয়াল যেখানে শেষ হয়েছে তার ঠিক পর থেকেই নেমে গেছে খাদ, সোজা সমুদ্রে। নিচে প্রচন্ড ঘুর্নাবত সৃষ্টি করে ফেনিল জলরাশি সীমাহীন ক্রোধে আছড়ে পড়ছে পাথরগুলোর উপরে। দেয়াল বেয়ে অলক্ষ্যে নিচে নামতে যাওয়া যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর সমার্থক। শুধু একটা দিক থেকেই নিচে নামা যায়, যেদিক দিয়ে সমুদ্রতট থেকে কারাগারে চলাচলের জন্য সরু একটি রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। রাস্তাটি সর্পিল আকৃতি নিয়ে উঠে গেছে একদম কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত। এদিক দিয়েই প্রবেশ করতে হয়, আর সাজা শেষ করে যদি জীবন্ত বের হওয়ার ভাগ্য থাকে তাহলে এদিক দিয়েই বিদায় জানাতে হয়। প্রধান ফটক দিয়ে পালানোর চিন্তা কারো মাথায় আসবেনা, কারণ পুরো কারাগার ঘিরে পঁচিশটি উঁচু গার্ডপোস্টে দুজন করে গার্ড সারাদিন পাহাড়া দেয়, তাদের একজনের হাতে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক রাইফেল আর আরেকজনের হাতে দুরপাল্লার স্নাইপার।


প্রচন্ড অত্যাচারের জন্য বিখ্যাত এখানকার গার্ডরা। যেনো এদের হাত নিশপিশ করে বন্দুকের ট্রিগারে, একটু এদিক সেদিক দেখলেই গুলি চলে এখানে। দ্বীপের প্রচন্ড রুক্ষ আবহাওয়ার মতই এখানের সব কিছু। সকালে অধিকাংশ সময় তীব্র সুর্যের আলো আর আর্দ্র বাতাস, রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় দ্রুত, হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করে তখন। এরই মাঝে কয়েদীদের শারীরিক শ্রম দিতে হয় প্রতিদিন দশ ঘন্টা করে নিয়মিত। লোহার ব্যাটন হাতে পাহাড়া দেয় একদল গার্ড। বড় বড় পাথড়ের চাই ভেঙ্গে ছোট করা থেকে নানা রকমের ভারী কাজ করতে হয় কয়েদীদের। আর এক মুহুর্তের জন্য কাজ থামালে পিঠে লোহার গুঁতো। চড়া রোদে কাজ করতে করতে অনেক কয়েদী অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে টেনে হিঁচড়ে পাশে নিয়ে ফেলে রাখা হয়। কয়েদীদের উপরে বাজ পাখির মতো নজর রাখে গার্ডরা। প্রায় প্রতি মাসেই অত্যাচারে টিকতে না পেরে কিংবা পালাতে যেয়ে মারা পড়ে বেশ কয়েকজন। আক্ষরিক অর্থেই এই দ্বীপটার নাম হয়ে গেছে “কিলার আইল্যান্ড”। বহির্জগতের কাছে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের নাম এই কিলার আইল্যান্ড। আর এখানকার অধিবাসীদের এই দুঃস্বপ্নটাকেই পার করতে হয়।

[ক্রমশ:]

[গল্পটা চলবে কিনা কথা দিতে পারছিনা।]

No comments:

Post a Comment