Sunday, July 29, 2012
মেক্সিকো (১৯৬৮) অলিম্পিক এর সেই স্যালুট
[ছবি কৃতজ্ঞতা হাল্টন সংগ্রহশালা]
২০১২ সালের অলিম্পিক গেমস এর পর্দা উন্মোচন হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ এখন লন্ডন এ। মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই অলিম্পিক জন্ম দিয়েছে নানা কৌতূহলের। লৌহ কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নানা বিষয়েই খবরের শীর্ষে এখন "লন্ডন অলিম্পিক :২০১২"।
প্রতি বছরই অলিম্পিক জন্ম দেয় নানা ঐতিহাসিক ঘটনার। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অসংখ্য ক্রীড়াবিদদের আরাধ্য এই অনুষ্ঠানটি এর জন্মলগ্ন থেকেই নিজ বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয় হয়ে আছে। এরকমই একটি অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলো "মেক্সিকো অলিম্পিক : ১৯৬৮"।
আজকে বিশ্বের অনেকের কাছেই এই ঘটনাটি অজানা হিসেবেই রয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া সেই অনন্যসাধারণ ঘটনাটি আজকের দিনেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান ক্রীড়াবিদ টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস এর সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি মানবতার ইতিহাসে তাদের অমর করে রেখেছে। আর সেই সাথে ১৯৬৮ সালের মেক্সিকান অলিম্পিক অনুষ্ঠানটিকে আপন মহিমায় আলাদা করে রেখেছে এতো বছর পরেও। কিন্তু আজ অনেক ক্রীড়াবিদও হয়তো এই দুজন ব্যক্তিত্বের নাম সম্পর্কে অবগত নন।
তখন মানব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্ন। গায়ের বর্ণের পার্থক্যের জন্য মানুষকে সহ্য করতে হতো অমানুষিক নির্যাতন-নিগ্রহ। ধাপে ধাপে উন্নত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলা সমাজব্যবস্থা তখন সাদা-কালো বর্ণের বিভেদে টালমাটাল। অসংখ্য ঘটনা কালো মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে আরও তরান্বিত করে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত নিপীড়িত কালো মানুষেরা তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকার মাটির মানুষেরা রুখে দাঁড়িয়েছে বহু বছর ধরে তাদের উপরে চলে আসা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এই দ্বন্দ-বিক্ষুব্দ সময়েই ১৯৬৮ সাল হয়ে দাঁড়ালো আরেকটি প্রতিকী বছর। এ বছরেই আততায়ীর হামলায় নিহত হলেন রবার্ট কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিং, দাঙ্গা হলো প্যারিসে, মূল অলিম্পিক গেমস শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বেই মেক্সিকোতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর হলো বর্বরোচিত হামলা। আর এরকমই একটি বছরকে আরও স্মরনীয় করে রাখতে ১৬ অক্টোবরের এক সকালে, পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে টমি স্মিথ এবং তার বন্ধু জন কার্লোস মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে রচিত করলেন প্রতিবাদের এক অসামান্য দৃশ্য।
[ছবি কৃতজ্ঞতা স্পার্টাকাস এডুকেশনাল]
১৬ অক্টোবর সকালে টমি স্মিথ ২০০ মিটার দৌড়ে ১৯.৮৩ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড তৈরী করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একইসাথে তারই বন্ধু জন কার্লোস তৃতীয় স্থান অধিকার করেন ২০.১০ সেকেন্ড সময়ে। দ্বিতীয় স্থান এ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়াবিদ পিটার নর্মান, তার সময় ছিলো ২০.০৬ সেকেন্ড। দৌড় শেষে এই তিনজন ক্রীড়াবিদই মেডেল গ্রহণ করতে যান মঞ্চে। এসময় দুই আফ্রিকান আমেরিকান ক্রীড়াবিদ খালি পায়ে শুধু কালো মোজা পায়ে মঞ্চে উঠেন "কালো মানুষের দারিদ্র্য" এর প্রতিকী রূপ উপস্থাপনের জন্য। কালো মানুষের গর্বের প্রতীক হিসেবে স্মিথ এর গলায় ছিলো কালো একটি স্কার্ফ, কার্লোস তার জ্যাকেট এর চেইন খোলা রেখেছিলেন, গলায় ছিলো একটি নেকলেস যা ছিলো নির্যাতিত নিপীড়িত নিহত সকল কালো মানুষের জন্য। তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে পিটারও ধারণ করেছিলেন একটি ব্যাজ। তাদের তিনজনের বুকেই ছিলো "অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস" এর প্রতিকী ব্যাজ। মেডেল গ্রহণ করার পরে টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস দুজনেই কালো দস্তানা পড়া মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরেন। [জন কার্লোস তার দস্তানা নিজের ঘরে ভুলে রেখে এসেছিলেন, পিটার নর্মান এর বুদ্ধিতে তিনি টমি স্মিথ এর বাঁ হাতের দস্তানা ব্যবহার করেছিলেন। তাই তুলে ধরেছিলেন বাঁ হাত।] মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরা ছিলো কালো মানুষের মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে নিরব প্রতিবাদ।
[ছবি কৃতজ্ঞতা "দ্যা টেলিগ্রাফ"]
তাদের এই প্রতিকী প্রতিবাদে সাথে সাথে সমগ্র স্টেডিয়ামে হৈ চৈ পড়ে যায়। ছুটে আসেন অলিম্পিক এর কর্মকর্তারা। পরবর্তিতে বিশ্রামকক্ষে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে অনেক দর্শকই দুয়োধ্বনি দিয়ে উঠে। এ সম্পর্কে পরে স্মিথ বলেছিলেন, "If I win, I am American, not a black American. But if I did something bad, then they would say I am a Negro. We are black and we are proud of being black. Black America will understand what we did tonight."
[ছবি কৃতজ্ঞতা উইকিপিডিয়া]
পরবর্তিতে অলিম্পিক কমিটির সভা থেকে এই প্রতিবাদকে দুঃখজনক এবং অগ্রহনযোগ্য বলে অভিহিত করা হয়। তাদের গৃহিত সিদ্ধান্তে দুই ক্রীড়াবিদ টমি স্মিথ এবং জন কার্লোসকে অলিম্পিক গেমস থেকে বহিঃস্কার এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আমেরিকান দল এর পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করলে তাদের পুরো দলকে বহিঃস্কার এর হুমকি দেয়া হয়। পরবর্তিতে এই দুজন ক্রীড়াবিদকেই বহিঃস্কার আদেশ মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। অলিম্পিক কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে বলে হয়, "a deliberate and violent breach of the fundamental principles of the Olympic spirit." আজও অলিম্পিক কমিটির ওয়েবসাইটে তাদের সম্পর্কে লেখা আছে, "Over and above winning medals, the black American athletes made names for themselves by an act of racial protest."
পরে দেশে ফেরৎ যাওয়ার পরেও তাদের দুজনকেই বিভিন্নভাবে অপমানিত হতে হয় এমনকি মৃত্যুহুমকি পর্যন্ত সহ্য করতে হয়। এধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতেও তারা দুজনই ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন।
এই দুই ক্রীড়াবিদের প্রতিবাদ সমগ্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরে কালো মানুষের মানবাধিকার বিষয়ক আন্দোলনকে। এমনকি কালো ক্রীড়াবিদদের অধিকারের বিষয়টিও সবার সামনে উঠে আসে। দলের কোচ হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারের বিষয়টি আলোচিত হয়। সামগ্রিকভাবে মানবাধিকারের আন্দোলন পায় এক নতুন মাত্রা।
এই তিনজন ক্রীড়াবিদ এর সম্মানে অস্ট্রেলিয়ার নিউটাউন এ একটি মুরাল তৈরী করা হয়। নাম দেয়া হয় "THREE PROUD PEOPLE MEXICO 68"। তবে পরবর্তিতে বিভিন্ন কারণে এটি অপসারণ এর জন্য চেষ্টা করা হলেও এটিকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা এখনও চলছে।
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত]
টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস পৃথিবীর ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন তাদের কীর্তির জন্য। অসংখ্য মানুষের কাছে তারা মানবাধিকার আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবেন আজীবন। তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের সেই ছবি হয়ে থাকবে প্রতিবাদের জ্বলন্ত প্রমান। এই লেখাটি সেই সব মানুষের জন্য যারা আজও স্বপ্ন দেখে শোষনমুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন একটি পৃথিবীর।
তথ্যসূত্র-
লিঙ্ক ১
লিঙ্ক ২
লিঙ্ক ৩
লিঙ্ক ৪
লিঙ্ক ৫
লিঙ্ক ৬
লিঙ্ক ৭
লিঙ্ক ৮
Sunday, July 22, 2012
কাক কিংবা শকুনের গল্প
“স্যার, কিছু হইছে?”
আনমনে মাথা নেড়ে অন্যমনস্ক হয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসলেন তিনি। রিকশাটা এগিয়ে চলতে শুরু করতেই পেছনে ঘুরে আবার কাকগুলোকে একবার দেখলেন।
নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকলেন অফিসে বসে। কাক একটা দেয়ালে বসে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক, বসে থাকতেই পারে। এতে চমকে উঠার কি আছে। নিজের মন থেকে চিন্তাটা দূর করার চেষ্টা করেও লাভ হলোনা। তার মনে হতে থাকলো, তার সামনের টেবিলে বসে কাকগুলো রক্তচুক্ষ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দিনের বেলাতেও তার কেন জানি একধরনের ভয় হতে থাকলো। অফিসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। মুছতে গিয়েও হাত উঠলোনা।
ঘটনাটার শুরু কয়েকদিন আগে থেকে। তিনি লক্ষ্য করলেন যখনই তিনি আশেপাশে তাকাচ্ছেন প্রায়শই শকুন এর ঝাঁক দেখতে পাচ্ছেন। তিনি প্রথম প্রথম আমলে নেননি ব্যাপারটা। একটা সময় জিনিসটা অস্বাভাবিক লাগা শুরু করলো। ঢাকা শহরে রাস্তা-ঘটে ময়লা পড়ে থাকে, শকুন কিংবা কাক এর মতো পাখি আশেপাশে ঘোরাফেরা করতেই পারে। তার বাসার আশেপাশে গাছপালাও যেনো একটু বেশি। কিন্তু যখনই আকাশে তাকাচ্ছেন ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পাখিগুলো। খুব ভালো করে ভেবে দেখলেন কিছুদিন যাবৎ তিনি আর অন্য কোনো পাখিই দেখতে পাচ্ছেননা। কিন্তু শকুনের সাথে যোগ হয়েছে কাক কিংবা চিল।
হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখলেন পাশের বাগানটায় যে বড় গাছটা, তাতে প্রচুর কাক এর জটলা। কখনো বাজার করে ফিরছেন, মনে হচ্ছে একদল চিল তাকে লক্ষ্য করেই বারবার উড়ে এসে সাই করে মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভাবলেন হয়তো এবছর এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরে ধীরে ধীরে ভয় পেতে শুরু করলেন যখন দেখলেন রাতের বেলাতেও তিনি এদের তার আশেপাশেই দেখতে পাচ্ছেন। একটা সময় মনে হলো পাখিগুলো তার প্রতি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। নিজের সন্দেহ নিজেই হেসে উড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হতে চাইলেন। কিন্তু পারলেননা। এখন তার মনে হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে শকুন কিংবা কাকগুলো তার পেছনে সর্বদাই লেগে আছে।
এই ধারনাটা এক ছুটির দিনে সকালে নাস্তা করতে করতে বলতে গেলেন নিজের স্ত্রীকে। তার স্ত্রী মাত্রই সকালের খবরের কাগজটা খুলেছে। তার অর্ধেক কথা শুনেই তার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। স্ত্রীর মুখভঙ্গি দেখে বাকিটুকু বলার আর সাহস পেলেন না। চুপচাপ বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো সেদিন বিকেলে, হঠাৎ তার ছোট ভাই এসে হাজির বাসায়। এসেই নানা কথার মাঝে বলে বসলো, “ভাইয়া, এক কাজ করুন না, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, ভাবিকে সঙ্গে করে কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসুন। মনটাও ভালো লাগবে। এভাবেই শহরের যা অবস্থা। নোংরা-পলিউশন। আর অনেকদিন একজায়গায় থাকলে মানুষের মনেও চাপ পড়ে বলে শুনেছি। তাই মাঝেমধ্যে দু-একটা ট্রিপ ভালোই।” কথাটার উত্তর দিতে গিয়ে চোখ পড়ল তার স্ত্রীর উপরে। বুঝতে বাকি রইলোনা সকালের কথাবার্তাটা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এরপরে আর কাউকে কিছু বলতে চাননি।
কিন্তু আজকে যখন অফিসে বসে সকালের কথাটা ভাবছিলেন, মনে হলো একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ দেখালে কেমন হয়। ক্ষতি তো নেই। ভাবতে ভাবতে নিজের এক কলিগকে কথাটা বললেন। তবে ঘুরিয়ে, জানালেন যে তার এক আত্মীয়র দরকার। ঢাকায় ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কে আছেন আজকাল, জানতে চাইলেন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে। একটা নামও পেলেন সাথে ফোন নাম্বার।
তিনি এখন দাড়িয়ে আছেন ডা: ইকবাল হোসেন এর চেম্বারের সামনে। বাইরে থেকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ বড় ডাক্তার। জায়গাটা বেশ পরিপাটি গোছানো, আভিজাত্যের ছাপ। একবার ভাবলেন কি দরকার, অযথা কতগুলো টাকা নষ্ট। আবার ভাবলেন দিন সাতেক আগে ফোন করে এপয়েনমেন্ট নিয়েছিলেন। না গেলে কেমন দেখায়। আবার ভাবলেন, একবার দেখাই যাকনা কি সমস্যা। ভাবতে ভাবতে পেছনে “কা-কা-কা”, শব্দটা শুনেই আর দেরি করলেননা, সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লেন কোনো দিকে না তাকিয়েই।
তরুণ ডাক্তার, খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলেন। হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন কিছু। স্বাভাবিক প্রশ্ন, এই যেমন, কতো বয়স, কিরকম ডায়েট মেনে চলেন, কোনো ধরনের নেশার অভ্যাস, এইসব। এরপরে বেল বাজিয়ে চা দিতে বললেন। আনোয়ার সাহেব এর একটু অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার চলে যাওয়া উচিত ছিলো। এবার ইকবাল হোসেন মুখ খুললেন,
“আপনার ছেলেবেলায় এমন কোনো ঘটনা আছে কি যাতে আপনি কোনভাবে পশু-পাখির মাধ্যমে আতঙ্কগ্রস্থ হয়েছিলেন?”
প্রশ্নটা শুনে কিছুটা সময় নিলেন তিনি, মনে মনে ভাবলেন, একবার গ্রামের মাঠে খেলতে গিয়ে গরুর গুঁতো খেয়েছিলেন অসাবধানতায়। সেটাকে কি আতঙ্ক বলা চলে? এটা কি ডাক্তারকে বলা উচিত হবে? তারপর বলার ইচ্ছাটা বাদ দিয়ে উত্তর দিলেন না সুচক।
“আচ্ছা ছোটবেলায় কোনো পাখি শিকারের ঘটনা?”
তিনি ভাবলেন, ছোটবেলায় গুলতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন অনেক, অযথা প্রাণী হত্যা কখনো করেননি। তাই এবারও উত্তর দিলেন, “না”।
“আপনি কি একা একা থাকাই পছন্দ করেন নাকি বন্ধু-বান্ধব আছে মোটামুটি?”
“একা থাকা কিনা বলতে পারবোনা, কিন্তু ঝামেলামুক্ত থাকি, খুব বেশি বন্ধু-বান্ধবও নেই এই বয়সে।”
কিছুটা চুপ থেকে ডাক্তার বললেন, “আপনি যে পাখিগুলোর নাম বললেন তাদের সবাই মৃতভোজী। এই একটা বৈশিষ্ট্য কমন। বিশেষ করে শকুন অনেক দূর থেকে তার খাদ্যের গন্ধ পায়। অনেক সময় মৃতপ্রায় প্রাণীর মাথার উপরে চক্কর কাটতে থাকে। কিন্তু আর কোনো পাখি বাদ দিয়ে এই একটি বিশেষ ধরনের পাখি দেখার কারণ হয়তো তেমন কিছুই নয়, পুরোটাই স্বাভাবিক। হয়তো আশেপাশে এদের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েও থাকতে পারে। এভাবেও রাস্তায় আবর্জনার স্তুপ যত্রতত্র পড়ে থাকে। আপনি হয়তো খুব ভালো করে লক্ষ্য করছেন দেখে চোখে পড়ছে। অন্যরা হয়তো এতোটা খেয়াল করছেনা।”
কথাটায় সায় জানালেন আনোয়ার সাহেব নিজেও। এরপরে দু-চারটা টুকিটাকি কথা বলে দুটো ওষুধের নাম নিয়ে বিদায় নিলেন তিনি ডাক্তারের কাছ থেকে। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ডাক্তার বললেন তাকে বেশি চিন্তা না করতে আর এই ব্যাপারটা নিয়ে না ভেবে নিজের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে। ভালো করে ঘুমাতেও বলে দিলেন।
আজ মঙ্গলবার, সকালে অফিসে যাননি তিনি। বারান্দায় চেয়ারে বসে পেপার পড়ছেন। আগের দিনের একদলের রাজনৈতিক সভায় গন্ডগোল হয়েছে। কেউ একজন হাতবোমার আঘাতে মারাও গেছে। বিরোধীদল সেই ব্যক্তিকে নিজের দলের সংগ্রামী নেতা দাবি করে হরতাল ডেকেছে সাথেসাথেই। এদিকে সরকারী দল বলছে, ঐ ব্যক্তি তাদের কর্মী। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, সাধারণ পথচারী। সেই পুরনো ঝামেলা। রাজনীতি আর মিডিয়ায়, জিন্দার থেকে মুর্দার কদর বেশি। ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে চমকে উঠে হাতের কাগজটা নামাতেই দেখলেন বারান্দার কার্নিশে সার বেঁধে বসে আছে অনেকগুলো কাক। আর সবগুলোই লাল টকটকে চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হুশ হুশ শব্দ করে হাতের কাগজটা নাড়াতে লাগলেন কিন্তু পাখিগুলো নড়লোনা।
“কি হলো”- পেছনে স্ত্রীর কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো হার্ট-এটাক হয়ে যাবে তার, এতটাই ঘাবড়ে গেলেন।
“কই, কিছু নাতো”।
“কিছুনা !! স্পষ্ট দেখলাম পত্রিকাটা হাতে নিয়ে মুখে কি বলে চলেছ !”
“না, না কই”, মুখ ঘুরিয়ে কার্নিশের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলেন, একটা কাকও নেই!!
কতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেতরে চলে গেলো তার স্ত্রী।
সারাদিন খুব বেশি কথা হলোনা তাদের মাঝে। কিন্তু তিনি দেখলেন তাকে বেশ পরখে রাখা হচ্ছে। তিনি একবার হেসে তাকে আশ্বস্ত করতে গিয়েছিলেন, কোনো কাজ হলোনা।
বিকেলে ছাদে ঘুরতে গেলেন আনোয়ার সাহেব। ছাদের কোনায় দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনের রাস্তাটা আজকে মোটামুটি ফাঁকা। গলির মোড়ের চায়ের দোকানের ঝাপ খোলা থাকলেও কোনো ভিড় নেই আজকে, পাড়ার দুএকজন বসে বসে কথা বলছে। কি মনে হতে ঘুরে আকাশের দিকে তাকালেন, অবাক হলেননা, দেখতে পেলেন, মাথার উপর চক্কর কাটছে কয়েকটা শকুন। তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নামতে গিয়ে দেখলেন ছাদের এক কোনে, একটা বেশ বড়সড় শকুন বসে আছে। ধারালো ঠোঁট আর অদ্ভুত ভয় লাগানো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে একনজরে। দ্রুত ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নেমে এলেন তিনি।
গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন আনোয়ার সাহেব। কি হচ্ছে এসব তার সাথে। আর তার সাথেই বা কেন? ডাক্তার বলছিলো, মৃতপ্রায় প্রাণীর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় এই পাখিগুলো। তাহলে কি তিনি মারা যাচ্ছেন। আর সেটা কোনভাবে টের পেয়েছে এরা! তিনি দেখেছেন, পশু-পাখির অনেক ক্ষমতা থাকে। এরা অনেক জিনিস বুঝতে পারে। তাহলে কি তিনি খুব বেশিদিন বাঁচবেননা? মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো তার। সারাজীবন খুব সাধারণ ভাবে কাটিয়েছেন, এই শেষ বয়সে এসে অযথাই কেন এসব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাকে বুজতে পারছেননা।
ভাবতে ভাবতে টিভিটা খুললেন, চ্যানেল থেকে চ্যানেল ঘুরতে লাগলেন। একটা খবরের চ্যানেলে এসে স্থির হলেন। দেখলেন, দেশের স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি মারা গেছেন। খবরটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজকাল অনেক বড় মাপের মানুষই বিদায় নিচ্ছেন দুনিয়া থেকে। টিভিটা বন্ধ করে দিলেন তিনি, চুপচাপ বসে রইলেন চোখ বন্ধ করে।
আজকে সকালে অফিসে যাওয়ার সময় একটা কাকও দেখলেননা তিনি। অবাক হয়ে গেলেন। আকাশে তাকিয়ে দেখলেননা একটাও শকুন। তাজ্জব ব্যাপার। তাহলে কি এতদিন মনের ভুল ছিলো?
অফিসে বসে সকালের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন। একটু পরেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আবার। কালকে রাতে যিনি মারা গেছেন তাকে নিয়ে অজস্র সংবাদ হয়েছে আর একটা কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে তাকে কোথায় সমাহিত করা হবে। এই নিয়ে তর্কে মেতেছে সংবাদপত্রগুলো। ভেবে অবাক হলেন, এই নিয়েও তর্ক করে চলেছে সংবাদপত্রগুলো !! ভেতরের পাতায় কয়েকটা বিশেষ কলামের বিষয়বস্তু দেখে মনে মনে ভীষণ রেগে গেলেন তিনি। খ্যাতনামা মানুষটির জীবদ্দশার নানা কাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সাথে ইচ্ছে মতন কিছু ঘটনা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে অযাচিতভাবে। অযথা মানুষটিকে একটা বিতর্কের মাঝে আনার চেষ্টা চলছে। এর পেছনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেননা তিনি। কিন্তু সারাদিনের জন্য মনটা বিষন্ন হয়ে রইলো।
বিকেলে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় বের হতেই অবাক হয়ে গেলেন। অফিসের রাস্তাতে আশেপাশের বাড়িগুলোর দেয়ালে দেয়ালে অজস্র কাক।তিনি দ্রুত একটা রিকশা ডেকে চড়ে বসলেন। দেখলেন কাকগুলোর মাঝে একটা আলোড়ন তৈরী হয়ে গেলো। কয়েকটা উড়ে রিকশার পিছু নিলো। তিনি রিকশাওয়ালাকে গতি বাড়াতে বললেন। পেছনে ফিরে দেখলেন অসংখ্য কাক তার পেছনে উচ্চস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলেছে। তিনি রিকশার চালককে অবাক করে দিয়ে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে কোনমতে নেমে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চললেন। পেছনে তাড়া করে চললো পাখিগুলো। দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলেন মাথার উপরে কিছুটা ছায়া হয়ে এলো। চোখ উঠাতেই দেখলেন আকাশ অন্ধকার করে প্রচুর শকুন আর চিলের মেলা। তিনি দৌড়ে চলেছেন, মনে হচ্ছে বাড়ি পৌঁছাতে পারবেননা আর। আতংকিত হয়ে খেয়াল করলেন এখন কাকগুলো তার প্রায় কাঁধের কাছে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আপনা থেকেই অমানুষিক একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো মুখ থেকে তারপর হঠাৎ গতি সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে রাস্তার উপরে পড়ে গেলেন। তাকে ঘিরে ধরলো অজস্র কাক আর শকুন। চোখের সামনে থেকে দিনের আলোটা নিভে গেলো।
ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন আনোয়ার সাহেব। সাড়া শরীর কাঁপছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ। নিজের বুকের ভেতরের শব্দ এতো জোরে শুনতে পাচ্ছেন মনে হচ্ছে পাশেই শুয়ে থাকা স্ত্রী জেগে উঠবেন এই শব্দে। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নিলেন পাশে রাখা জলের বোতলটা, হাতে লেগে নিচে পড়ে গেলো কাগজটা। উঠিয়ে রাখতে গিয়ে আবারও চোখে পড়ল সেই সংবাদের হেডলাইনগুলো।
তিনি আনমনে ভাবলেন, কি অদ্ভুত এই সমাজ। মরেও শান্তি নেই এখানে।
আস্তে করে শুয়ে পড়লেন আবার।
Wednesday, July 18, 2012
শহুরে বৃষ্টির রোজনামচা
জায়গাটা বড়, আশেপাশে নানা কিসিমের লোক। অধিকাংশ অযথাই ঘন ঘন মাথা নেড়ে অদ্ভুত স্বরে ইংরেজি বলে চলেছে। কয়েকজন অতি উৎসাহী আবার মাঝে এক উঠতি বুদ্ধিজীবিকে নিয়ে জটলা করছে। কোনায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ঘরভর্তি মানুষ দেখার একটা আনন্দ আছে। মনে হয় বিনা টিকিটের সার্কাসে আছি! অভুক্ত পথশিশুদের জন্য অনুষ্ঠানে কোট-টাই পড়া অভুক্ত লোকেদের সমাগম দেখে আস্তে করে বেরিয়ে এলাম।
এম্বুলেন্সটা অনেকক্ষণ ধরেই হর্ন দিয়ে চলেছে, কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। রিকশাওয়ালাকে বললাম চেপে জায়গা করে দিতে, অবাক হয়ে ঘুরে তাকালো। ঘন্টাখানেক ধরে ঠিক একই জায়গায় আছে গাড়িগুলো। গ্লাসের ভেতরে আবছায়া, রোগীর আত্মীয়দের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে হঠাৎ মনে পড়ল, দেশে ইমার্জেন্সি সার্ভিসের আগে দরজায় পিৎজার হোম ডেলিভারি পৌঁছে! ব্র্যান্ড কালচারের উপর ভর করে আসলেই দেশ এগিয়ে চলেছে, ভাবতে ভালোই লাগে।
শেষ পর্যন্ত হাঁটুজল পার করে আসতে হলো, মেজাজ পুরো খিঁচে আছে। ধুর, এভাবে আর কদ্দিন? ড্রেনের গন্ধে নাক কুঁচকে তাকালাম। অজস্র মানুষের ভিড়ে এক কোনে বৃদ্ধ একজন, হাতে শতছিন্ন ছাতা আর সামনে রাখা টুকরিতে কিছু সবজি, ড্রেনের পাশেই কোনমতে জায়গা করে নিয়েছে। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে জনস্রোতের দিকে। ভাবলাম, ঘ্রানের মতো স্বাভাবিক অনুভূতিগুলোও, কারো কারো জন্য শুধুই বিলাসিতা।
বেশ রাত হলো, এখন বৃষ্টির জোর অনেক। বারান্দায় বসে পিচের রাস্তায় বৃষ্টির দাপট দেখছি। আগে বারান্দা থেকে দূর পর্যন্ত দেখা যেতো। রাস্তার ঐদিকটায় কিছু গাছ ছিলো, উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলো সেগুলো। তাই এখন শুধু ইটের গাঁথুনি চোখে পড়ে। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোগুলো আগে হলদেটে ছিলো এখন সাদা। বদলেছে অনেক কিছুই।
একটা রিকশা টুং-টাং করতে করতে চলে গেলো। এতো রাতে!
চেয়ারটা ছেড়ে উঠতে উঠতে মনে হলো, অজস্র মানুষের ভিড়ে দিনশেষে আমরা সবাই ভীষণ একা। এই অনুভূতিটা বদলায়না, কিংবা বদলে দেয়া যায়না।
Friday, July 6, 2012
"বিবর্তন" তুমি মোরে করেছ মহান !!
বিবর্তন আমাদের প্রানীজগতে সুবিধের পাশাপাশি অনেক অসুবিধেও করে দিয়েছে। এই যেমন মানুষের কথাই ধরি। বিবর্তনের ফলে আজকে আমরা যেমন উন্নত একটি সভ্যতা তৈরী করেছি, তেমনি বহন করে চলেছি কিছু দৈহিক অসুবিধেও। এর সবটাই কিন্তু বিবর্তনের ফল। সঠিকভাবে বুঝতে গেলে বিবর্তনের একদম প্রথম থেকে জানা জরুরি। কিন্তু ৯টা-৫টা ডিউটি সেরে আর কতো ধৈর্য্য থাকে এইসব নিয়ে গুঁতোগুতি করার? তার উপরে আবার "আদমের পঞ্জরাস্থি হতে ইভের আগমন" তত্বে বিশ্বাসীদের জন্য তো কোনো প্রমানই যথেষ্ট নয়। তারা সব কিছুতেই "ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন" খুঁজে বেড়ায়! তারা সারাদিন ফসিলের মিসিং লিঙ্ক নিয়ে আস্ফালন করে। দুইটা ফসিলের মাঝে একটা মিসিং লিঙ্ক নিয়ে একাধিক তর্কে লিপ্ত হয়। তারপর ওই দুই ফসিলের মাঝে আরও একখানা ফসিল আবিস্কার করে বিজ্ঞানীরা যখন একটু হাসিহাসি মুখ করে ছবি তুলতে যান, তখনই তেড়েমেড়ে এসে বলা শুরু করে, আরে হতভাগা আগে দুই ফসিলের মাঝে ছিলো একটা মিসিং স্পট এখন তিন ফসিলের মাঝে দুইটা মিসিং স্পট কি চোখে পড়েনা? কি আর করা!! তার উপরে "জোকার নায়েক ফ্যানক্লাব" তো ঘোষণাই করে দিয়েছে, বিবর্তন একটি বাতিল তত্ত্ব। যখন জোকার নায়েকের মতো মহাজ্ঞানী এধরনের কথা বলেন তাতে আমাদের মতো অকালকুষ্মান্ডদের সম্মতি জানানোই শ্রেয়, কিন্তু ওই যে, পূর্বপুরুষদের লেজখানা যে কারো কারো মাঝে আজো বিদ্যমান, তাই শান্তি কোথায়?
সবাই নিঃশ্চয়ই এতক্ষণে ভেবে বসে আছেন, কি যা তা বকে চলেছে!!নাহ, ভয় পাওয়ার কারণ নেই, সবুরে যেমন ভালো ফল পাওয়া যায়। তেমনি একটু বেশি সবুরে কিন্তু বিবর্তন পাওয়া যায়। বিশ্বাস করুন, ডাইনোসরের কসম!! যাই হোক, আজকের বিষয়বস্তু হচ্ছে, বিবর্তনের ফলে মানবদেহে কি কি অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম লেখার শিরোনাম দিবো, "বিবর্তন-তুমি মোরে দিয়েছো বাঁশ", কিংবা "যেভাবে বিবর্তন আমাদের ইয়ে মারিয়া দিয়েছে", কিন্তু কোনো শিরোনামই মনঃপুত না হওয়ায় আপাতত ওই চিন্তা বাদ। মোটামোটি পাঁচটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো, যাতে বুঝতে সুবিধে হবে, বিবর্তনের ফলস্বরূপ মানবদেহে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া। তাহলে "বাবা ডারউইন" এর নামে শুরু করা যাক।
[b]১. মানুষের অন্ডথলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হলে দিনের বেলাতেও তারা দেখে কেন?[/b]
হুমম, শিরোনাম দেখেই নিঃশ্চয় ভাবছেন, কি ছেলে রে বাবা, শুরুতেই লুঙ্গি ধরে টানাটানি!! নাহ, ভয়ের কিছু নেই, কারো লুঙ্গি বিসর্জন হচ্ছেনা আপাতত।
তার আগে এই ছবিটা দেখুন ভালো করে-
দেখে কি ভাবছেন? হয়তো ভাবছেন, আবোল-তাবোল বকে একদম মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই তো? নাহলে কি ফুটবলের ছবি দিয়ে বিবর্তন দেখাতে আসে!! উহু, মোটেই তা নয়, বরং ছবিটা ভালো করে আবার দেখুন। কিছু নজরে পড়লো? কেন দেখতে পাচ্ছেননা, লোকগুলো কিরকম বিশেষ জায়গায় হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত? এরকম তো সব খেলাতেই দেখা যায়, এ আর নতুন কি। কিংবা কোনো ঢিশুম-ঢিশুম একশন ছবি দেখতে ব্যস্ত? ভিলেনকে মারতে গিয়ে নায়কের গুলি ফুরিয়ে গেছে? এবার কি হবে ভেবে নিজের চুল টানছেন? হঠাৎ দেখলেন, নায়ক ভিলেনের দুই পায়ের মাঝখানে দিলো এক মোক্ষম লাথি। আর তাতেই ভিলেন বেচারা ওরে মারে-বাবারে করে পপাত্ধরনিতল!! ভাবছেন বেশ করেছে। কিন্তু সাথে সাথে এটাও ভাবুন, এরকম একটা স্পর্শকাতর জিনিসকে দেহের বাইরে শোকেসে ঝুলিয়ে রাখা কেন? এইতো প্যাঁচ লেগে গেলো তো? চিন্তা নেই ওই প্যাঁচ ছাড়াতেই তো লিখছি।
[মানব দেহের পুরুষ প্রজাতির প্রাণীর অন্ডথলি]
পুরুষ দেহের সব থেকে স্পর্শকাতর অঙ্গটি হচ্ছে এই অন্ডথলি। এর ভেতরে থাকে অন্ডকোষ। এই শুক্রাশয়ে উত্পন্ন হয় নতুন প্রাণ সঞ্চারকারী শুক্র। কিন্তু এই মহাদরকারী জিনিসটিকে এরকম অরক্ষিত অবস্থায় রাখা কেন? এটাকে দেহের ভেতরে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যেতো। তখন হঠাৎ এরকম বেকায়দা আঘাতে সমস্যাও হতোনা। নিদেনপক্ষে একখানা হাড়ের খাঁচা তো তৈরী করে দেয়া যেতো। কিন্তু না, তা হয়নি। কারণ, শুক্রগুলোর বেঁচেবর্তে থাকার জন্য একটু ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া দরকার। দেহের ভেতরে তো আর এসি লাগানো নেই। বরং সারাদিন নানা খাটুনির কারণে দেহের ভেতরটা থাকে উত্তপ্ত। তাই দেহের বাইরের এই জায়গাটিই কিছুটা ঠান্ডা থাকে। এর তাপমাত্রা দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা থেকে কয়েক ডিগ্রী কম। আর ঐটুকুই যথেষ্ট। তাই এরকম ভাবে রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ নয়, শুক্র উত্পন্ন হতে যেমন একটু কম তাপমাত্রা আবশ্যক তেমনি, শুক্র নির্গত হতে প্রয়োজন একটু বেশি তাপমাত্রার। কিন্তু কি করে সম্ভব? সম্ভব, সবই সম্ভব। যখন পুরুষ স্ত্রীর সাথে সঙ্গমের জন্য উত্তেজিত হয়, তখন দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। সাথে সাথে অন্ডথলিটিও কিছুটা সংকুচিত হয়, আর লিঙ্গের উত্থানের ফলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এতে করে শুক্র নির্গমনের জন্য দরকারী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্যাস, ঐটুকুই যথেষ্ট। বেশি বিস্তারিত দিতে গেলে আবার সেন্সর বোর্ড কাঁচি চালাবে।
[স্পার্ম সেল]
আলোচনা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এবার এসে বলবেন, তো সব প্রাণীর কি একই অবস্থা!! না, সব প্রাণীর নয়। প্রজাতিভেদে বিভিন্ন প্রাণীর লিঙ্গের আলাদা আলাদা গঠন রয়েছে। এবার বলে বসবেন, তাহলে কি সবাই লাথি খেলে ওরকম গড়িয়ে পড়ে? আমি বলবো, আসুন একে লাথি মেরে দেখুন-
আর লাথি মারতে যাওয়ার আগে, এর পেছনের দুখানা পা, তার খুড় এবং সামনের দুখানা শিং-এর কথা ভুলবেননা যেনো। আর আপনি যাতে খুব সহজে লাথি মারতে না পারেন তার জন্য ওই লেজটি কিরকম ঝুলছে দেখুন!
আর হ্যাঁ, যারা এই লেখাটি নিজের ল্যাপটপে আরাম করে পড়ছেন, তাদের জন্য-
যদি এভাবে বসে থাকেন, তাহলে শীঘ্রই জায়গা পরিবর্তন করুন। ল্যাপটপের নিচের দিকে যে পরিমান তাপ উত্পন্ন হয়, তার উচ্চ তাপমাত্রা আপনার শুক্রাশয়ের শুক্রগুলোকে ফ্রাই করার জন্য যথেষ্ট। যদি জন্মের আগেই বেচারাদের এভাবে হত্যা করতে না চান তাহলে এভাবে বসার আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন আশা করি!
আর যারা মানবদেহের এই অঙ্গটির ঝুলন্ত অবস্থান নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঝোলাঝুলি করতে চান তাদের জন্য এইটা।
যারা এই অংশটুকু পড়ে আমাকে শালীনতার শত্রু মনে করে বসে আছেন, তাদের জন্য বলছি। আমি খুবই দুঃখিত। এর থেকে সুশীলভাবে আমি লিখতে পারতামনা। কি আর করবো বলুন, আমি যে সুশীল সমাজের কেউ নই!! বরং পরের বিষয়ে যাই।
[b]২.ক্লোজআপ হাসি হাসার আগে আমাদের ১০০ বার ভাবতে হয় কেন?[/b]
ভেবে দেখুন, দাঁতের যন্ত্রনায় আমরা কষ্ট কে না পাই। যন্ত্রণা কি শুধু এক ধরনের? নানা ধরনের যন্ত্রনায় ফেলে এই দাঁতগুলো। দাঁত কেলিয়ে হাসতে গেলে নিজের দাঁতের উঁচু-নিচু টিলা আকৃতির কথা চিন্তা করে অনেকেই মুখে হাত দিয়ে আড়াল করি কিংবা মুখ টিপে ফিচকে মার্কা হাসি দেই। আজকাল টিভির মডেলরা কিরকম ঝকঝকে মার্বেল এর মতো বাঁধানো দাঁত দেখিয়ে খেক খেক করে হাসে!! আবার পেস্ট এর বিজ্ঞাপনে যাওয়ার আগে বলে যায়, আমার মতো প্রাণখুলে (নাকি দাঁত খুলে?) হাসতে চাইলে ব্যবহার করুন অমুক-তমুক পেস্ট। আমরা ভাবি, ধুর, ওরকম সাদা দাঁত না হয় হলো, কিন্তু এদের আকার-আকৃতির কি হবে? এর জন্যে আবার পকেট ফুটো করতে দৌড়াই দাঁতের ডাক্তারের কাছে। আর দাঁতের ডাক্তারও ভালো মানুষের মতো একখানা "ব্রেস" লাগিয়ে দিয়ে জ্ঞানীর মতো মাথা নাড়তে থাকে। আমরা দাঁতের উপরে অদ্ভুত আকৃতির জিনিসটি বসিয়ে আরও কিছুদিন মুচকি হাসার পণ করে চলে আসি সুরসুর করে। আবার কখনো আক্কেল দাঁত নামক মহাযন্ত্রণার এই জিনিসটি আমাদের কাঁদিয়ে মারে। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি, "ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের" ইন্টেলিজেন্ট কর্তা আমাদের দাঁত নিয়ে এরকম দেঁতো কাজকর্ম কেন করে রেখেছেন? এইরে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দিয়ে ফেললাম নাতো কারো? থাক, বরং বিবর্তনকে আঘাত করি, অন্তত ঢিল মেরে পাটকেল খেতে হবেনা এখানে।
[মাথার খুলির গঠন]
বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি হতে থাকে। আয়তনে বাড়তে থাকে দ্রুত। অন্য প্রানীদের তুলনায় আমরা মস্তিষ্কের অনেক বেশি ব্যবহার করেই কিন্তু জয় করেছি এই পৃথিবী। আর চিন্তা করে দেখুন, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মস্তিষ্কের ওজন হচ্ছে ১,৩০০ গ্রাম থেকে ১,৪০০ গ্রাম। এই ওজনের একটা জিনিস ঐটুকু খুলির ভেতরে আটকে রাখাটা কি চাট্টিখানি কথা! আর একদম প্রথম থেকেই কিন্তু এরকম ছিলোনা। ধাপে ধাপে হয়েছে এই পরিবর্তন। আগে একটা সময় আমরা সম্পূর্ণ তৃনভোজী ছিলাম। নির্ভর করতাম শাক-পাতা, ফল-মূল এসবের উপরে। এর সব কিছুই ছিলো শর্করাভিত্তিক খাবার। তাই অল্পতে কি পোষায়? সুযোগ পেলেই ধুমসে চলতো পেট পুজো। আর পুষ্টির জন্য এহেন অল্প সময়ে বেশি বেশি খাবারের কারণে আমাদের
প্রয়োজন ছিলো শক্তিশালী দাঁত। আক্কেল দাঁত ঠিক একারণেই কাজে লাগতো। আর আমাদের মুখের আকৃতিও ছিলো খুলির থেকে কিছুটা আগে বাড়ানো। কারণ প্রচুর শর্করা আমাদের চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হতো। তার জন্য জায়গা প্রয়োজন। আর এতো চিবানোর জন্য আমাদের চোয়ালও ছিলো সেরকম। কিন্তু এতো খাদ্য হজম করতে লাগে বড়সড় একটা পাকস্থলী। কিন্তু বড় পাকস্থলী আর বড় মস্তিস্ক যেকোনো একটা পেতে পারো। এটা তো আর ফ্রির জিনিস নয় যে, চাইলেই সব পাবে।
একটা সময়ে শর্করা খাবারের ঘাটতি দেখা দিলো, গাছে চড়ে ঘুরে বেড়ানো পূর্বপুরুষরা নেমে এলো তৃণভূমিতে। দু পায়ে হাঁটতে শিখলো আস্তে আস্তে। এরই মাঝে আজ থেকে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন বছর আগে আমাদেরই কোনো এক পূর্বপুরুষ কোনো এক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বললো , "ঐ তো মাংস। চলো ট্রাই করি!" হ্যাঁ, এভাবেই একটা সময় শুরু হলো মাংস ভোজন। প্রয়োজনের তাগিদে প্রোটিনের দিকে ঝুঁকে পড়লো তারা। আর এতে নানা ধরনের সুবিধে হলো, অল্প পরিমান খাদ্যতেই দেহের প্রয়োজন সম্পূর্ণ হতে লাগলো। এখন আর বেশি বেশি শর্করা না খেলেও হচ্ছে। আবার খালি হাতে বাঘ-সিংহের সাথে পাল্লা দিয়ে শিকার করতে অসুবিধে তাই মাথা খাঁটিয়ে বের করতে লাগলো পাথড়ের অস্ত্র। মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থের আলোড়নে একসময় আগুনও জ্বালাতে শুরু করলো। এভাবেই প্রয়োজন ফুরিয়ে এলো আক্কেল দাঁতের এবং বড় চোয়ালের। কিন্তু ঐ বেঢপ্ বড় মস্তিস্কটিকে জায়গা দিতে গিয়ে খুলির আকৃতি পরিবর্তন হতে শুরু করলো আর সাথে সাথে ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইলো দাঁত এর সারি, সামনের দিকে। আর এভাবেই আঁকাবাঁকা হয়ে আজকের দিনের আকৃতি ধারণ করলো আমাদের দাঁতের পাটি।
বিভিন্ন শর্করাভোজী প্রাণীর সাথে তাই আমাদের চোয়ালের সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেলো। যেমন, মাংসাশী হওয়ার কারণে আমাদের সামনের দিকের দাঁত কিছুটা দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পেলো মাংস ছিড়ে খাওয়ার জন্য, যাকে শ্বদন্ত বলা চলে। তাই ভ্যাম্পায়ার কিংবা ড্রাকুলা দেখার জন্য পেনসিলভানিয়া যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একটা টর্চ হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মুখ খিচে নিজের দাঁতগুলো দেখুন আর চমকে উঠে হরর মুভি দেখার স্বাদ নিন!
আরও ভালো করে দেখতে চাইলে এই ছবিতে দাঁতগুলো দেখে নিন এরপরে গুনে গুনে দেখুন তো ৩২খানা আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে অতি অবশ্যই উচ্চ আদালতে বিচার জানাতে পারেন, তবে তাতে দাঁত ফেরত পাবেন কিনা তার কিন্তু গ্যারান্টি নেই।
তবে হ্যাঁ, মাংস খাওয়ার শুরু করাতে মানুষ কিন্তু উন্নত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের অভাব পূরণ হওয়ার সাথে সাথে মানুষ শিকারের জন্য অস্ত্র বানাতে শিখেছে। শিখেছে মস্তিস্ক খাটিয়ে নানা রকমের ফন্দি-ফিকির বের করতে। এতে মস্তিষ্কের যেমন উন্নতি সাধন হয়েছে একই সাথে উন্নত হয়েছে সভ্যতা। তাই দুঃখিত নিরামিষাশী বন্ধুরা আপাতত আজকের জন্য আপনাদের সমর্থন জানাতে পারছিনা। আপনাদের পূর্বপুরুষরা মাংস না খেলে আজকে হয়তো আপনি "ভেজিটেরিয়ান" হওয়ার জায়গায় আসতে পারতেননা। তাই আজকে নাহয় কিছুটা "নন-ভেজ" চলুক।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দাঁতের গঠন দেখে নিন এই ফাঁকে। তবে এখনও কিন্তু শর্করাভোজী প্রানীদের চোয়ালের আকৃতি আমাদের থেকে বড়। যেমন- ঘোড়া কিংবা গরু। স্বাভাবিকভাবেই এদের প্রচুর পরিমান শর্করা চিবিয়ে দেহের উপযোগী করার জন্য বড় আকৃতির চোয়ালের প্রয়োজন। আমাদেরই এক বন্ধু সাত সকালে ব্রেকফাস্টের পরে কিরকম "ক্লোজআপ" হাসি দিয়ে ছবি তুলেছেন দেখুন-
আর যারা এখনও নিজের দাঁতের কিম্ভূত আকৃতি নিয়ে বেশ মন খারাপ করে আছেন তাদের জন্য বলি, কেনো অযথা মন খারাপ করছেন। ঐ টিভি কিংবা বিজ্ঞাপনে যাদের সুন্দর সাজানো দাঁতের পাটি দেখছেন তার সবগুলোই হচ্ছে কৃত্রিম। ডাক্তারকে অযথা অনেক টাকা গচ্চা দিয়ে করা। তার থেকে বরং নিজের দেহে যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকুন। আপনি আপনার পূর্বপুরুষদের কীর্তি বহন করে চলেছেন এটাই বা কম গর্বের নাকি?!
ও এখন বলবেন তো, ব্যাটা, বিবর্তনের জন্য পূর্বপুরুষদের মস্তিস্ক আকৃতিতে বৃদ্ধি পেলে আমাদেরটা কি দোষ করলো রে হতভাগা!! না কোনো দোষ করেনি, তাইতো ভেতরে ভেতরে জটিলতা বাড়িয়ে তৈরী করেছে ১০০ বিলিয়ন নিউরনের এক অসাধারণ নেটওয়ার্ক। কি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? সমস্যা নেই, ওরকম অনেক কিছুতেই কষ্ট করতে হয়, নাহলে কি আর সুফল মেলে? দাঁত নিয়ে দাঁতাদাঁতি আরনা-আরনা। চলুন অন্য বিষয়ে।
[b]৩. গলায় খাবার আঁটকে গেলে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয় কেন?[/b]
গলায় খাবার আঁটকে গিয়ে নাকের জল-চোখের জল এক হয়নি এরকম মানুষ পৃথিবীতে কমই আছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটাও বিবর্তনের দোষ। তার আগে জেনে রাখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ৩,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন শুধু এই কারণে। একবার চিন্তা করে দেখুন কি যাচ্ছেতাই ব্যাপার।
তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে কিংবা খেতে খেতে হাসতে গিয়ে হঠাৎ করেই কাশতে কাশতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাড়াতাড়ি কোনমতে গলায় আটকে থাকা খাবারটা সরাতে পারলেই যেনো জীবন বাঁচে। এই কারণের পেছনে কিন্তু আছে মানবদেহের একটি মহান উন্নতি। আর তা হচ্ছে, আমাদের কথা বলতে পারার ক্ষমতা!
ভাবছেন, কি বিটকেলে ব্যাপার-স্যাপার। হবেই তো, এতো সহজ হলে তো আর এতকিছু লিখতে হতোনা।
আমাদের গলায় যে ভোকাল কর্ড আছে এর জন্যেই আমরা কথা বলতে পারি, এটা তো সবাই জানে। কিন্তু এই ভোকাল কর্ডটা থাকে কই? থাকে হচ্ছে, গলার শেষপ্রান্তে একটি বাক্স আকৃতির স্থানে। যাকে বলে ল্যারিংস। তো ঐ ভোকাল কর্ডখানা গলার এতোটা ভেতরে যাওয়ার কি দরকার ছিলো? মুখের শেষে জায়গার তো অভাব নেই, ওখানেই চেপেচুপে বসে গেলেই চলতো। তা না করে অতো হ্যাঁপা। কারণ আছে, ঐ ইঞ্চিদুয়েক নিচের জায়গাটাতে থাকার কারণেই আমরা অন্য প্রানীদের থেকে বেশি নানা ধরনের আওয়াজ করতে পারি। নিজের মাথাটাকে কি বাদ্যযন্ত্র মনে হচ্ছে? ব্যাপারনা, ওরকমই ধরে নিন আপাতত।
কিন্তু এই যে কারিগরী, তার কিন্তু সমস্যাও আছে। শ্বাসনালীর সাথে একই জায়গায় অবস্থিত হওয়ায় যেকোনো সময় খাবার আটকে যায় ওখানে। আর শুরু হয় বেদম কাশাকাশি। আমরা জানি, গলার ভেতরে আছে দুইটা নলাকৃতির অংশ। একটা হচ্ছে, Esophagus, এটা খাদ্য বহন করে পরিপাকতন্ত্রে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। অন্যটা ল্যারিংস, যেটা বায়ু বহন করে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। যেহেতু ল্যারিংস কিছুটা নিচে অবস্থিত যাতে আমরা নানাধরনের শব্দ উচ্চারণ করতে পারি, তাই আমাদের শ্বাসনালী সরাসরি দেহের সায়নুস এর সাথে যুক্ত হতে পারেনা। হতে পারলে, গলায় একখানা আস্ত ডিম আটকে গেলেও আমরা ঠিকই শ্বাস নিতে পারতাম আরামসে। বরং এই দুই নল একইসাথে গাদাগাদি করে ছোট একটা জায়গা দখল করে রাখে। আর তাতে একটা ছোট ভাতের দানা প্রবেশ করলেও আমাদের বারোটা বেজে যায়।
[দেখে নেই কিভাবে আছে সব কিছু]
[ল্যারিংসই বা বাদ যায় কেন]
এখন ভাবছেন, কি হারামীপনা করে রেখেছে শরীরে!! উহু, হারামীপনা নয়, একটু সাবধানে খেলেই তো হলো। আর ঐ যে, বিষম খাওয়া, ওটা নাহলে দেহের আরো ক্ষতি হতো। বিষম খাওয়া দেহের এস্পিরেশন নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী সুরক্ষা ব্যবস্থা। এস্পিরেশন নিউমোনিয়া হচ্ছে, শ্বাসনালি কিংবা ফুসফুসে কোনো বাইরের জিনিস প্রবেশের ফলে এদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেখেছেন তো বিষম না খেলে কি অবস্থা হতো? বিবর্তন একেবারে ভাতে মেরে রেখে যায়নি ঠিকই। তাই খাওয়ার সময় একটু মনোযোগী হলেই কিন্তু আর বিষম খেয়ে ভীষণভাবে কাশতে হয়না। আর এই একটু অসুবিধের বদলে যে এতো সুন্দর করে প্রেমিকার কথা শুনতে পাচ্ছেন এটাই বা কম কিসের!! কথা বলার ক্ষমতা না থাকলে কি হতো ভাবুন, ফোন কোম্পানিগুলো তখন কি করতো, "দুরে গিয়ে, কাছে থাকুন বলে" চেঁচিয়ে উঠতো কারা? তাই ঠিক ভাবে খেতে শিখুন, শান্তিতে বাঁচুন।
[b]৪. গর্ভবতী নারীদের মর্নিং সিকনেস হয় কেন?[/b]
মর্নিং সিকনেস, যেকোনো গর্ভবতী নারীকে প্রশ্ন করুন। ঠিক উত্তর পাবেন কি ভীষণ বিরক্তিকর সমস্যা এটা। সবাই কয়েক মাসের জন্য হলেও এই সমস্যায় পড়েন গর্ভের প্রথম দিনগুলোতে, বিশেষ করে প্রথম দুই-তিন মাস। শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নারী নিজের প্রথম তিন মাসে এইরকম বমি-বমিভাব অনুভব করেন। শুধু তাই নয়, খাদ্যের এই অস্বাভাবিক নিঃসরণ-এর কারণে অনেকেই পানি স্বল্পতায় ভুগে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হন।
কিন্তু এই সমস্যার কি কারণ? আদিম মানুষদের যখন রান্না করে খাওয়ার মতো অবস্থা হয়নি তখন কাঁচা ফল-মূল/মাংস খেয়েই জীবনধারণ করতে হতো। কিন্তু এই সব খাদ্যের সাথে অনাগত অতিথির মতো দেহে প্রবেশ করতো বিভিন্ন ধরনের পরজীবি। পরজীবিদের নিয়ে লিখতে গেলে আলাদা একখান পোস্টের প্রয়োজন। তাই চাইলে, আপাতত এই লিঙ্কটাতে গিয়ে উনাদের দর্শন করে আসুন। দেখবেন কি বাহারি তাদের রূপ। তো এইসব পরজীবি যদি দেহে প্রবেশ করে সবকটাকে তো আর দেহের সুরক্ষা ব্যবস্থা কিলিয়ে ভূত বানাতে পারেনা, তো কয়েকটাকে লাথি দিয়ে দেহ থেকে বের করেও দিতে হয়। আর এজন্যই আমাদের দেহে আছে একটি "কিক-এস" সুরক্ষা ব্যবস্থা। আর সেটি হচ্ছে এই বমন প্রক্রিয়া।
[দেখো, রূপের কি বাহার আমার!]
তো গর্ভের প্রথম তিন মাসে যখন ভ্রুণ সব থেকে স্পর্শকাতর অবস্থায় থাকে, যখন তার সুরক্ষার দরকার সব থেকে বেশি, তখন দেহের এই সুরক্ষা ব্যবস্থা আপনা থেকেই দেহের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী এই সব অনাগত অতিথিকে লাথি মেরে বের করে দেয় যাতে আপনার আগত প্রিয় অতিথিটি থাকে সুরক্ষিত এবং সুস্থ। তাতে মায়েদের একটু কষ্ট হয় বৈকি, কিন্তু আগত শিশুটির কথা চিন্তা করে অতটুকু কষ্ট নাহয় সহ্য করে নেয়া গেলো। মর্নিং সিকনেস নিয়ে বিস্তারিত আরও জানতে ঘুরে আসতে পারেন এখানে। আর এই ঘুরে আসার ফাঁকে বিবর্তনকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেননা যেনো, এই দারুন একটি "কিক-এস মর্নিং" আপনাকে উপহার দেয়ার জন্য!
[b]৫. একবার ভাঙিলে মেরুদন্ড হয়না সোজা আর, কেন?[/b]
কোনো এথলেটকে দেখেছেন নিজের পিঠের যন্ত্রনায় হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়তে? দেখবেন, উপস্থিত চিকিৎসকরা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে স্ট্রেচারে করে তুলে আনছে তাকে। আর স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক উঠে দাড়িয়ে পড়েছে একই চিন্তায়, "যেনো মেরুদন্ডের আঘাত না হয়, প্লিজ"। কিংবা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মেরুদন্ড ভেঙ্গে গিয়ে চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যেতে দেখেছেন বা শুনেছেন। অনেকেই সাড়া জীবনের জন্য প্যারালাইসিস হয়ে থাকেন শুধু মাত্র একটি আঘাতের ফলে। কেন এই সমস্যা? আমাদের হাড় ভাঙ্গলে তো আরামসে জোড়া লাগে তাহলে মেরুদন্ডের বেলায় কেন সেটা হয়না? হ্যাঁ, এটা বিবর্তনের ফসল।
মেরুদন্ডের সাথে আমাদের নার্ভ সিস্টেম সরাসরি জড়িত তাই দেহের এই অংশটির গতিবিধি একটু জটিল। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, প্রাণী জগতে এরকম অনেক প্রজাতি আছে যাদের হাড় ভাঙ্গলে খুব দ্রুতই জোড়া লাগে এমন কি মেরুদন্ড সংলগ্ন হাড় প্রতিস্থাপিত হওয়ার উদাহরণও আমাদের পৃথিবীতে আছে। এমন একটা প্রজাতি কিন্তু আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায় আর টিকটিক করে লেজ নাড়িয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। হ্যাঁ, সেই আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় গিরগিটি/টিকটিকি। এরা কিন্তু বিবর্তনের ফলে দারুন একটি উপায় আত্মস্থ করেছে। শিকারী প্রাণীকে দিকভ্রান্ত করার জন্য এরা নিজের লেজটি খসিয়ে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি তাদের মস্তিষ্কের সাথে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়ও ৩০ মিনিটের বেশি নড়াচড়া করতে থাকে কোনো রক্তপাত ছাড়াই। আর এই তিড়িংবিড়িং করা অংশটি দেখে শিকারী প্রাণী ভাবে এটিই তার শিকার আর ততক্ষণে পগারপার গিরগিটি মহাশয়। আবার কিছুদিনের মাঝেই সেই লেজের অংশটি আবার গজিয়ে উঠে আগের মতো করে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে কেন এরকম হয়না?
প্রথমত মানুষের মস্তিষ্কের গঠন জটিল। এই জটিল গঠনে জড়িয়ে আছে অসংখ্য শিরা-উপশিরা। তৈরী হয়েছে নার্ভাস সিস্টেম। আর এই সিস্টেমে মস্তিষ্কের নিউরনের সাহায্যে তথ্য আদান প্রদান হয় সাড়া শরীরে। আর এই জটিল তারের নেটওয়ার্কটি মেরুদন্ডের সাহায্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। একবার ভাবুন, অতো ছোট খুলিতে ২.৫ বর্গফুটের মস্তিষ্কের গঠন কতোটা জটিল হওয়া সম্ভব!
তাই কোনো নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে হুট করেই আবার নিজেরা আগের মতো করে তৈরী হয়না। কিন্তু সব নার্ভের ক্ষেত্রেই এরকম নয়, কিছু কিছু নার্ভ ঠিকই আগের মতো নিজেদের প্রস্তুত করে নেয় দুর্ঘটনার পরে। এদের জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজনও পরে না, বড়জোড় কয়েক বাটি চিকেন স্যুপ আর কয়েকটা গ্রুপ-হাগ আর টেডি বিয়ার! কিন্তু এইসব জায়গায় যেসব নার্ভ ওস্তাদের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে তাদের ক্ষেত্রে আবার ব্যাপারটা আলাদা।
মস্তিস্কের এইসব নার্ভের সাথে দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জড়িত। তাই এদের নিয়ন্ত্রনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নকশা (না, লাফানোর দরকার নেই এই নকশা সেই বুদ্ধিমান কর্তার নকশা নয় রে বাবা) অনুসরণ করে আমাদের মস্তিস্ক। বলা যায়, প্রতি দেহে মাত্র একটিমাত্র সুনির্দিষ্ট "ব্লু-প্রিন্ট" (হ্যাঁ, এটা নীল-নকশা, কোনো ইয়ে নয়) যোগান দেয় এটি। যাতে কোনো নার্ভ হঠাৎ করে বেখাপ্পা ভাবে বেড়ে গিয়ে পুরো নেটওয়ার্কে ঝামেলা না পাকাতে পারে। তাই এই অত্যন্ত জটিল এবং নির্দিষ্ট কঠিন নকশার বাইরে এই গুরুত্বপূর্ণ নার্ভগুলো নিজেদের দ্বিতীয়বার প্রস্তুত করতে পারেনা। আর তাই মেরুদন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হলে মস্তিস্ক এই নার্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সঠিকভাবে কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়। মানুষ প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
মস্তিষ্কের এসব আচরণ নিয়ে এখনও চলছে বিস্তর গবেষণা। একবার ভাবুন, আমাদের মস্তিষ্কে আছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন। না না এখনই নিজেকে মহান ভাবার কিছু নেই, একখান অক্টোপাস এরও আছে ৩০০ মিলিয়ন। ওরাই বা কম যায় কিসে?
এরই মাঝে যারা বর্ণভিটা খেতে খেতে ব্রেন নিয়ে নিজেদের ব্রেন এর চাকা বনবন করে ঘোরাতে চান তারা চলে যান এখানে|
তবে আজকের মতো "বিবর্তন" সংক্রান্ত বকবক এই পর্যন্তই থাক। এই পাঁচ-পাঁচটি বড় বাঁশ খাওয়ার পরে, সামলাতেও তো একটু সময় লাগে নাকি? সবাই এই যাত্রায় সামলে উঠতে থাকি তারপরে না হয় আর এক শুভদিনে আরও কিছু [s]বাঁশ [/s] তথ্য নিয়ে আসবো। আর "জোকার নায়েক ফ্যানক্লাব" এর অতি উত্সাহী মুমিন বান্দাদের জন্য একখানা পুরনো ভিডিও আমার তরফ থেকে উপহার স্বরূপ আরেকবার।
বাকিরা আশা করি "মিসিং লিঙ্ক" আর "মিসিং গ্রে-মেটার" এর পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা রাখেন।
আডিওস।
Thursday, July 5, 2012
সড়ক দুর্ঘটনা : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বিশেষ করে রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানো এবং উঠানো হতে শুরু করে, বেপরোয়াভাবে সংকীর্ণ রাস্তায় ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তায় চলাচলরত পথচারীদের প্রায় শরীরের উপরে চাকা উঠিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানাধরনের কার্যক্রম থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এইসব যাত্রীবাহী গাড়িগুলোর কোনো চালকই অন্তত আইনগতভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। এমনকি হয়তো এদের কেউই শিক্ষিত লাইসেন্সধারী চালক নয়। এছাড়াও ব্যস্ত রুটগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য বাস এবং মিনিবাস চলাচল করে যাদের অধিকাংশ চালকই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখেনা। আর ট্রাক চালকদের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। সাধারণ সড়ক কিংবা হাইওয়ে সব জায়গাতেই অসংখ্য দুর্ঘটনার কারণ এই ট্রাক চালকরা অধিকাংশ সময়ই প্রচন্ড বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে নানা ধরনের আইন অমান্য করে অসংখ্য মানুষের জীবনহানির কারণ। হাইওয়ের অধিকাংশ চালককেই রাতের বেলা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে দেখা যায়। এসব ব্যাপারে সরকারিভাবে নেই কোনো বিশদ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা। তাই দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত।
সরকারী হিসেব মতে দেশে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন যন্ত্রচালিত গাড়ি চলাচল করে এর সাথে আছে আনুমানিক ৩ মিলিয়নের মত সাধারণ রিকশা,ভ্যান,সাইকেল ইত্যাদি। যন্ত্রচালিত গাড়ির মাঝে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ হচ্ছে দুই বা তিন চাকার। দেশে বিভিন্ন সড়কের উন্নয়নের সাথে সাথে যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহনের সংখ্যা একই সাথে বেড়ে চলেছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার রেজিস্টার্ড যানবাহনের বিপরীতে সড়ক দুর্ঘনায় মৃতের সংখ্যা ৮৫ জন। যা পার্শ্ববর্তী যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এদের মাঝে শতকরা ৫০ ভাগ হচ্ছেন পথচারী। দেশের সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর প্রায় শতকরা ৭৭ ভাগ মারাত্মক প্রকৃতির। যাতে আক্রান্তদের মৃত্যু ঝুঁকিই বেশি।
দেশের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটে গ্রামাঞ্চলে। এছাড়াও প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটছে হাইওয়েগুলোতে। বিশেষ করে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। দুর্ঘটনাগুলোর পরিসংখ্যান যাচাই করলে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, শতকরা ৩৮ ভাগ ঘটনা ন্যাশনাল হাইওয়েগুলোতে, শতকরা ১২ ভাগ আঞ্চলিক রাস্তাগুলোতে, শতকরা ১৫ ভাগ সাধারণ রাস্তাগুলোতে এবং শতকরা ৩৫ ভাগ আরও বিভিন্ন রাস্তায় যার মাঝে শহরের রাস্তাগুলোও রয়েছে।
বিভিন্ন মাধ্যম হতে পাওয়া তথ্যগুলো একসাথে করার চেষ্টা করি। ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যার হিসেব-
প্রতিবছর যেভাবে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহত মানুষের সংখ্যাও। ১৯৯৫-২০১০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরের সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্যগুলো-
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত আহত-নিহত ব্যক্তির মোট সংখ্যাটি কখনোই ৪,০০০ এর নিচে নামেনি। এই সংখ্যাগুলোকে যদি একটি চার্টের মাধ্যমে প্রকাশ করি তাহলে দেখা যাবে, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাটি সম্পর্কযুক্ত।
[১৯৯৫-২০০২ সাল]
[২০০৩-২০১০ সাল]-
দেখা যাচ্ছে যে, প্রতি বছরই আশংকাজনক মাত্রায় ঘটে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু তারপরেও সরকারী উদ্যোগে যানবাহন ও তার চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কঠোর ব্যবস্থা বেয়া হচ্ছেনা। এছাড়াও অশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণবিহীন এসব চালকদের মাধ্যমে যানবাহন নিয়ন্ত্রনের ফলে রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুন। অনেকসময় দেখা যাচ্ছে গাড়ির হেলপার কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছে। এতে করে যেভাবে যাত্রীদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে একইসাথে বেড়েছে পথচারীদের ঝুঁকি।
২০১১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় শতকরা ৬০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এই চারমাসে সংঘটিত ৮৬৩টি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৮৬ জন মানুষ।
এসবই সরকারীভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা কিছু চার্ট। তবে পুলিশের খাতায় রেজিস্টার করা দুর্ঘটনা ছাড়াও প্রতিবছর অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। যাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যাও অনেক। তাহলে বাস্তব প্রেক্ষাপটে এই হিসেবগুলোর বাইরে সত্যিকার অর্থে দুর্ঘটনা এবং আহত-নিহত ব্যক্তির সংখ্যাও আরও অনেকটাই বেশি।
দক্ষিন-এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের হার সব থেকে বেশি। প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে যদি একটি গ্রাফের মাধ্যমে প্রকাশ করি তাহলে দেখা যায়-
দেখা যাচ্ছে, ১ লক্ষ গাড়ির বিপরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬,৩০০। এর পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে একমাত্র পাকিস্তান যাদের সংখ্যা ২,৩০০। নেপাল ছাড়া বাকি দেশগুলোর কারোই এই সংখ্যাটি হাজারের উপরে নয়। এই আশংকাজনক মাত্রায় দুর্ঘটনা ঘটে চলার পরেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও প্রশিক্ষণবিহীন চালকের সংখ্যা। একইসাথে সাধারণ জনগণও উপেক্ষা করে চলেছে ট্রাফিক আইন।
দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়া কিছু পুরনো যানবাহনের ছবি দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর হয়ে উঠে এইধরনের গাড়ি রাস্তায় চলে কি করে। কিন্তু বাস্তবে রাস্তায় বের হলেই এদের দেখা মেলে হাজারে হাজারে।
বিশেষ করে সিএনজি গ্যাস চালিত অটোরিক্সাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু তারপরেও এদের লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছেনা।
পরিবারে সদস্যরা রাস্তায় বের হলেই এখন প্রধান চিন্তার বিষয় তারা ঠিক ভাবে ঘরে ফিরবে কিনা? প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি এখন চরম মাত্রা অতিক্রম করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। এমনকি সাধারণ জনগণ এর মাঝেও এই বিষয়ে সচেতনতা খুবই কম।
দেশের রাস্তাগুলোতে রোড-সাইন একটি দুর্লভ বিষয়। অধিকাংশ হাইওয়ের অবস্থাও তাই। পর্যাপ্ত সাইন এর অভাব এবং একই সাথে অশিক্ষিত প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের রোড সাইন সম্পর্কে অজ্ঞতা দুর্ঘটনার আরও একটি কারণ।
এই রোড-সাইনগুলোর অধিকাংশই দেশের কোনো রাস্তায় খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এমনকি চালক কিংবা সাধারণ পথচারী অনেকেই এই সাইনগুলোর সাথে পরিচিত নন।
দেশে বেপরোয়া গতির যানবাহনের গতিরোধ করার জন্য যে অদ্ভুত আকৃতির কিছু গতিরোধক নির্মান করা হয়েছে তাও অনেকক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। এই ধরনের অসংখ্য গতিরোধক দেশের রাস্তাগুলোর যত্রতত্র নির্মান করা হয়েছে এবং অধিকাংশের আগে কোনো ধরনের সতর্কতা নির্দেশনা নেই। তাই বিশেষ করে রাতের বেলা চলাচলকারী যানবাহনের জন্য এটি অন্যতম দুঃশ্চিন্তার কারণ। ট্রাফিক সিগন্যাল এর সাথে সাথে দেশে নিয়োজিত আছে ট্রাফিক পুলিশ কিন্তু অধিকাংশ যানবাহনের চালকই এই সিগন্যাল অমান্য করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। এরকম অসংখ্য দুর্ঘটনা খোদ ঢাকা শহরেই ঘটেছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের সিগন্যাল অমান্য করে গাড়ি চালাতে হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও অনেক বাস চালকই বেপরোয়া গতিতে ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে নিয়মিত গাড়ি চালাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের চালকদের থামানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে গিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে সংকেত দিয়ে গাড়ি থামাতে হচ্ছে। এই যদি হয় একটি সভ্য দেশের রাস্তার চিত্র তাহলে কি করে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে?
বাংলাদেশের বিভিন্ন সড়কের অবস্থাও সঙ্গিন। বিশেষ করে বর্ষাকালে রাস্তায় চলাচল করা একধরনের অভিযানের মতো। তার উপরে সারা বছর ধরে রাস্তা আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে চলে নানা ধরনের সরকারী-বেসরকারী নির্মান কাজ। একেই দেশের রাস্তাগুলো যানবাহনের মোট সংখ্যার তুলনায় নগন্য তার উপরে এভাবে রাস্তা বন্ধ করার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভোগান্তি ও নানা ধরনের ছোটখাটো দুর্ঘটনার সংখ্যা। এছাড়াও দেশের অধিকাংশ রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা নেই। তাই অন্ধকারেই দৌড়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শহরের আবাসিক এলাকার ভেতরের অনেক রাস্তাই সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে। রাস্তাগুলো নির্মাণগত দিক থেকেও ত্রুটিপূর্ণ অনেকাংশেই। কিন্তু তারপরেও সরকারীভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছেনা। অধিকাংশ রাস্তাতে পথচারীদের চলাচলের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থাই নেই! রোড ডিভাইডার হতে শুরু করে প্রয়োজনীয় জেব্রা ক্রসিং পর্যন্ত নেই আমাদের দেশের রাস্তাগুলোতে। এমনকি যেসব রাস্তায় জেব্রাক্রসিং আছে সেখানেও মানুষ এর কোনো ব্যবহার জানেনা কিংবা জানলেও ব্যবহার করছেনা। অধিকাংশ চালক জেব্রাক্রসিং দিয়ে চলাচলকারী পথচারীদের দেখে গাড়ি ধীরগতির না করে বরং তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দেশের শহরগুলোতে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য যেসব ফুটওভারব্রিজ রয়েছে তাতে বিভিন্ন হকার নিয়ে বসছে তাদের পসরা। এতে করে জায়গা সংকীর্ণ হচ্ছে একই সাথে পথচারীদের ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারেও নানা অনীহা কাজ করছে। অধিকাংশ মানুষ রাস্তা দৌড়ে পারাপার হওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেন। এছাড়াও যেসব সাবওয়ে বানানো হয়েছিল সেগুলো অধিকাংশই এখন ব্যবহার অনুপযোগী। এগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী অসংখ্য ঘটনা ঘটার ফলে মানুষ এগুলোও ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। তাই রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নিয়মিত চলাচল করছে মানুষ। প্রধান সড়কগুলোতে এরকম অজস্র যানবাহনের মাঝখান দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত পারাপার হয় সাধারণ মানুষ।
অনেকসময়ই রেলক্রসিংগুলোতে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে মানুষ। দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা, নেই কোনো সঠিক আগাম সংকেতের ব্যবস্থাও। অনেকক্ষেত্রে রেল লাইন সংলগ্ন বস্তিগুলোর অসচেতন বাসিন্দারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। রেলক্রসিংগুলোতে উন্নত সুরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োগে এই দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
এছাড়াও দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে দ্রুত চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছানো, এম্বুলেন্স, ইমার্জেন্সি সার্ভিস এবং ফার্স্ট-এইড টিম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো দেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হাইওয়েগুলোতে পুলিশের পেট্রোল কারের সংখ্যাও নগন্য। নেই কোনো মেডিকেল হেলিকপ্টার এর ব্যবস্থা। তাই দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষদের হাসপাতালে স্থানান্তরে জন্য অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে এবং তাতে মৃত্যু সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলোতে সরকারের আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন।
গাড়ির সিটবেল্ট এবং হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা, ঝুঁকিপূর্ণ গতিতে গাড়ি ওভারটেক করা, ওভারলোডিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি নানা কারণে বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটিতে রাস্তার তুলনায় যেরকম বৃদ্ধি পেয়েছে যানবাহনের সংখ্যা একই সাথে বাড়ছে সড়কে মানুষের জীবনের ঝুঁকি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন গাড়ি ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে সাধারণ জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা ভুলে যাচ্ছে এটা কোনো পন্থা নয়। বরং নিজের দেশের সম্পত্তিই বিনষ্ট করা হচ্ছে কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ কিংবা সচেতনতা কিছুই হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার এবং জনগণ উভয় ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। প্রয়োজন ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। দেশে উন্নত ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থা, উন্নত সড়ক তৈরী, কঠোরভাবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রতিরোধ এবং প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের অপসারণ সহ অজস্র জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন সড়কে যানবাহন চলাচল এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ। নাহলে একদিন এভাবেই আবার হারিয়ে যাবে কোনো প্রিয়জন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে।
[তথ্য:
বাংলাদেশ যোগাযোগ মন্ত্রনালয়
পুলিশ হেডকোয়ার্টার (এফআইআর রিপোর্ট)
বিভিন্ন সংবাদপত্র
বিআরটিএ
সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত উইকিপিডিয়া রিপোর্ট
ইন্টারনেট]
Subscribe to:
Posts (Atom)