Friday, October 26, 2012

সেই আড্ডা

স্কুলে থাকাকালীন খুব একটা বেশি আড্ডা হতোনা। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ফলাফল বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে সময়টা ছিল এক্কেবারে ফাঁকা তখন ধুমিয়ে আড্ডা দেয়া হতো। পুরনো ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদের উপরে উঁচু একচিলতে জায়গায় বসে চলতো সেই মহাড্ডা। সবে বিঁড়ি ধরেছি তখন, বিষয়বস্তুহীন সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ধুম্রশলাকা জ্বালিয়ে চরম ভাব নিতাম। কতো কি নিয়েই না চলতো কথোপকথন। মোড়ের পুরির দোকানে আলু কম কি বেশি, এই থেকে শুরু করে আম্রিকার গুষ্ঠিশুদ্ধ আলাপে চলে আসতো। বেশ বড়সড় একটা দল ছিলো তখন। কেউ গান গাইতো, কেউবা নিজের একদম নতুন ব্যর্থ ভাব বিনিময়ের কাহিনী শোনাত। হতো সবই। তারপরে রাত বাড়তেই গুটিগুটি পায়ে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতো। আড্ডার শুরুতে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের হাঁটাটা যত দ্রুত থাকতো, ফেরার পথে থাকতো ততোটাই ধীর। সেই দিনগুলো চলে গেল খুব দ্রুত। এখনও মনে পড়ে সেই নোনায় ধরা ছাদ, তাতে গাদাগাদি করে বসে থাকা, মন কষাকষি। কখনো ঐ ছোট্ট ছাদেই লর্ডসের ক্রিকেট, কিংবা রঙ্গিন ঘুড়ি। পাশের বাসার মেয়েটির সাথে একটু চোখাচোখি, সলজ্জ হাসি। এসবই অতীত।

কলেজের প্রথমবর্ষে থাকাকালীন আড্ডার রেশটা তখনও ভালোভাবে আসেনি। নটরডেম এর হঠাৎ চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া যাওয়া জীবন, সাথে "জীবনে দৌড় ছাড়া কিছু নেই" এর প্রথম উপলব্ধি। তখন কোনমতে ক্লাস শেষ করে বাসায় আসতে পারলেই যেন বাঁচা যেত। তার উপরে সাপ্তাহিক পরীক্ষা, স্যার এর পড়া আরও আরও কতো কি! কিন্তু তবুও ধীরে ধীরে আড্ডা জমলো। তাছাড়া উপায়ই বা কি? এক ক্লাস শেষ হয়ে আরেক ক্লাস শুরুর মাঝের যে কিছু মুহূর্ত মাত্র, ঐটুকু সময়েই কি কথাই না বলতাম আমরা! আর ছিলো মধ্যবিরতির সেই মূল্যবান দশ-পনের মিনিট। প্রাণখুলে আড্ডা হতো। ছোট ছোট দলে কিংবা মাত্র দু-তিনজনে। বন্ধুত্ব গাড় হচ্ছিলো এভাবেই।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয়বর্ষ। ততদিনে শিখে গেছি কি করে সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে চলতে হয়। পরীক্ষা আছে? তাতে কি, ওতো থাকবেই। পড়া আছে? তাতেই বা কি, ওরকম তো থাকেই। তখন আমরা মাত্র স্বাধীন। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্লান্ত-শ্রান্ত আমরা তখন আড্ডা দিতাম রাস্তার মোড়ের চা-সিগারেটের দোকানে কিংবা আরামবাগ কলোনিতে বন্ধুর মেসের ছোট্ট একটা ঘরে। কখনো হেঁটে যেতাম বেইলি রোড পর্যন্ত, কখনও বা রিকশায় টি.এস.সি। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল খুব খুব দ্রুত। কলেজে উঠার আগে কেউ একজন বলেছিল, "দেখো, কলেজের দুইবছর চোখের পলকে চলে যাবে"। সত্যিই তাই! আড্ডায় উজির মেরে মাত্রই রাজাকে কব্জা করে এনেছি তখন দেখলাম হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল। সবাই খুব মনোযোগী হয়ে উঠলো, ফালতু সময় নষ্ট করার মতো হাতে বাড়ন্ত সময় কারো কাছেই আর রইলো না। স্রোতের টানে আমিও হাবুডুবু খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। জীবনের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে আমি হাঁফিয়ে উঠতাম কখনো কখনো। তখন ছুটে যেতাম আরামবাগ কলোনির সেই ছোট্ট ঘরে, যেখানে তিন চারজন মানুষ তাদের মূল্যহীন জীবনের কিছু মূল্যবান সময় হেলায় নষ্ট করে দিতাম। তারপরে আবার সেই দৌড়,দৌড়।

এরপরে বদলে গেল সবকিছু। দেশ ছেড়ে আরেকদেশে পড়তে গিয়ে দেখলাম, আশেপাশের মানুষগুলো ঠিক আগের মতো নয়। চলনে-বলনে কাছাকাছি হলেও এরা আমার মতো নয়। এরা জীবনকে চেনে অঙ্কের হিসেবে, নিক্তিতে মেপে নেয় সময়। এরা আড্ডাকে ফালতু সময় নষ্ট বলে মনে করে! কখনও একসাথে বসলেও ঘুরেফিরে প্রকৌশলী হয়ে মোটা অঙ্কের মাইনের একটা চাকরি ছাড়া এদের আর কোন কিছু নিয়েই কথা বলার থাকেনা। জীবন যান্ত্রিক, বুঝতে সময় লাগেনা মোটেও। তবুও খুঁজে নিলাম গুটিকয়েক আমার মতো ফাঁকিবাজ মানুষকে যারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাজে বকে যেতে পারে অনায়াসে, বিনা ক্লেশে। ধীরে ধীরে ঐ নতুন পরিবেশেও মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধটা আর যুদ্ধ রইলোনা।

তখন আড্ডা হতো ছাত্রাবাসের অনির্দিষ্ট কোন ঘরে, যখন যেমন। ঘর হতে দুরে এসে অপরিচিতের আপন হতে সময় লাগেনা। তাই দুই টাকার সিঙ্গারার সাথে চা হোক কিংবা শুধু চাটনি, আমরা লেগে থাকতাম, তর্ক করতাম, অযথা চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু প্রথমবর্ষ চলে যেতেই আবার ছিটকে গেল একেকজন, ছাত্রাবাসগুলোর একেক অংশে। তখন দল ছোট হয়ে কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, তাতে নতুন মুখ যোগ দিতো কদাচিৎ। আমরা তখনও রাজা-উজির মারতাম। গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায় কিংবা ভলিবলের মাঠে, কখনোবা বাস্কি-গ্রাউন্ড। যেই রাতগুলোতে বিদ্যুৎ থাকতো না সেই রাতগুলোতে চলে যেতাম ছাদে কিংবা যমুনার উপরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সেতুতে। সেই রাতগুলোতে আমরা যান্ত্রিকতা ছেড়ে স্বপ্নবিলাসী হয়ে উঠতাম। আমাদের ভেতরের দ্বিতীয় স্বত্তারা সব বের হয়ে আসতো কবি, গায়ক,তার্কিক কিংবা শুধুই শ্রোতা হিসেবে। হোক না মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যই।

সব বদলে যায়। তাই পরিচিত মুখগুলো বদলে গেল। সবাই জীবনকে সাজানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। জীবনের তাগিদে জীবনকে দেয়ার মতো ফুসরত কারো কাছেই আর রইলোনা। সবাই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে একজন একজন করে সৈনিক হয়ে গেল। আমি তখনও হতে পারিনি কিছুই। তাই সময়ের অভাব ছিলোনা আমার। আমি তখনও হেঁটে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায়, ভলিবলের মাঠে, বাস্কি-গ্রাউন্ডে কিংবা ভাঙ্গা সেতুতে, একা। এক সময় এই অধ্যায়েরও শেষ হলো। আমি পরাজিত আর একাই থেকে গেলাম।

দেশে ফিরে আর আগের মত আড্ডা জমেনা। সবাই ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে। "আমরা" থেকে সবাই এখন "আমি" কে নিয়ে ব্যস্ত। রাস্তায় এখন হাঁটা দায়। গলির মুখে দাঁড়ালেও ধুলো আর ধোঁয়ার চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমার আড্ডা দেয়ার পুরনো জায়গাগুলো আর নেই, নেই পুরনো মুখগুলোও। সরল থেকে জীবনের জটিল সমীকরণগুলো মেলাতে মেলাতে গোপনে কখন নিজেরাই জটিল হয়ে গেছি। তাই কদাচিৎ একসাথে হলেও আমরা এখন আর আগের মতো গান গাইনা, হুল্লোড় করিনা। আমাদের অনির্দিষ্ট হাঁটার পথগুলোর দৈর্ঘ্য এখন অনেক কম।

বাড়ির ছাদে উঠা নিষেধ! তাই টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে ইট আর লোহার জঙ্গলের মাঝে যে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায় সেটাই প্রাকৃতিক বিনোদন।আকাশচুম্বী দালান বানাতে গিয়ে আকাশটাই আজ ঢেকে গেছে, চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। যন্ত্র দিয়ে ঘেরা জীবন যান্ত্রিক হবে এটাই অবশ্যম্ভাবী। তাই সব কিছুর পেছনে আমরা শক্ত কারণ খুঁজি। অহেতুক কিছু করার মতো ছেলেমানুষী আমাদের আর পোষায় না।

আমি তারপরেও নিয়ম করে অহেতুক আড্ডা দিই। গভীর রাতে, তারাদের সাথে, একা।

No comments:

Post a Comment