Tuesday, August 21, 2012

ইরান : স্তালিনের রাশিয়া অথবা আল-কায়েদার আফগানিস্তান কিংবা আরও বেশি কিছু

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বেশ কিছুদিন যাবৎ মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত সংবাদগুলো অধিকাংশ স্থান দখল করে থাকছে। আরব বসন্তের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়ার ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ এবং একই সাথে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল এর কূটনৈতিক সম্পর্কের লাগাতর অবনতি এই অঞ্চলটির একটি বিস্ফোরন্মুখ অস্থিতিশীল অবস্থাকেই নির্দেশ করে। একইসাথে পাশ্চাত্যের শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ এবং ইরানের পারমানবিক শক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি এই অঞ্চলটি ঘিরে ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যবর্তী "কোল্ড ওয়ার" এর মতো আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করে দিয়েছে।হুরমুজ প্রনালীতে ইরানের নিত্যনতুন সমরাস্ত্র এবং যুদ্ধযানের সফল পরীক্ষা এবং একইসাথে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো বিতর্কিত কিছু বিষয়ে ইরান নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান প্রকাশ করেছে। তারই জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরশক্তির প্রদর্শন এই প্রনালীর আশেপাশের অবস্থানে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বেশকিছু শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের বহর এবং নৌসেনাদের বেশ বড় একটি অংশ ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে অবস্থানও নিয়েছে। একইসাথে সমমনা পরাশক্তিগুলোর সাথে বেশ কিছু যৌথ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ব্যাপারগুলোকে অনেকেই ইরানের প্রতি এই পরাশক্তির একটি আগাম সতর্কবার্তা বলে মনে করেছেন। এছাড়া ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের বর্তমান পারমানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো এই অঞ্চলটিকে খুব শীঘ্রই একটি যুদ্ধাবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এই রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে আরও একটি বিষয় বর্তমানে বেশ আলোচিত হচ্ছে আর তা হলো ইরানের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার লঙ্ঘন। আর এই বিতর্কটি আরও উসকে দিবে "দ্যা টেলিগ্রাফ" পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। ২০ আগস্ট, ২০১২ তে রবার্ট টেইট এর করা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা গেছে, ইরানের বেশ কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭০ টির মতো উচ্চশিক্ষার কোর্সে সেদেশের নারীদের অংশগ্রহনের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সরকারীভাবে লিঙ্গবৈষম্যের এহেন পদক্ষেপ দেশটির নারীদের অধিকার সম্পর্কে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। দেশটিতে সাংবিধানিকভাবেই নারীদের প্রতি বিভিন্ন রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, আর একারণে বর্তমানে যখন নারীদের সমান অধিকারের আন্দোলনটি অগ্রসর হয়েছে, তখনই সরকারের এহেন সিদ্ধান্ত নারীদের অধিকারের বিষয়ে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

নোবেল বিজয়ী খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী শিরিন এবাদী বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগের নিচে নামিয়ে আনা। ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭টি কোর্সকে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সময়ে ইরানের নারীরা শিক্ষার দিক থেকে পুরুষদের থেকে বেশি অগ্রসর হয়েছেন, বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক বিষয়েই যেখানে একসময়ে পুরুষ আধিপত্য ছিলো সেখানে এখন নারীরা এগিয়ে গেছেন সংখ্যা এবং ফলাফলের দিক থেকে। এই উন্নতিকে ইরানের পুরুষতান্ত্রিক সরকার ও সমাজ উভয়েই হুমকি হিসেবে দেখছে। ইংরেজি সাহিত্য ও অনুবাদ, হোটেল ব্যবস্থাপনা, পুরাতত্ত্ব, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ইলেকট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নারীদের অংশগ্রহন রহিত করা হয়েছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই এই ঘোষণার সাথে সংগতি রেখে তাদের ছাত্রীদের প্রতি নোটিশ জারি করেছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেখানে নারীদের অবস্থান, নারী ও পুরুষ গ্রাজুয়েট অনুপাতে, ইরানে সারা বিশ্বের মাঝে সব থেকে বেশি সেই দেশটিতে সরকারের তরফ থেকে এরকম উদ্যোগ আর কিছুই নয় নারীদের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। ইরানের শিক্ষামন্ত্রী এই উদ্যোগকে সমর্থন করে, এটি শুধুমাত্র নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা বলে জানিয়েছেন !!

ইরানে এধরনের বিষয় নতুন কিছু নয়। ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর দেশটির ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে চলেছে সরকারী পৃষ্টপোষকতায়। ইরানের "শাহ"দের হাত থেকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা অধিগ্রহনের পর দেশটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন একটি নিয়মিত ঘটনা।রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ এর্ভান্দ এর মতে পাহলভি রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনে মানবাধিকার বিষয়ক কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭১-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত যেখানে মাত্র ১০০ জন রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল সেখানে ১৯৮১-১৯৮৫ সালের মাঝে ৭,৯০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। অভ্যুত্থানের সময় ইসলামিক আন্দোলনকে দেশটির মার্ক্সিস্ট ও বামপন্থীরা সমর্থন করলেও পরবর্তিতে এদের অনেককেই হত্যা করা হয় কিংবা জেলে পাঠানো হয়। সমকামিতা, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, শিশু অপরাধী, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক বন্দী এসব বিষয়েই ইরান সরকার চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। ১৯৮৮ সালে পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে হত্যা করা হয়। রাশিয়ার লৌহ শাসক স্তালিনের রাজনৈতিক বন্দী নির্যাতন-হত্যা-দমনের মতই ইরানেও বিরোধী মতকে কঠিনভাবে দমন করা হয় এই সময়ে।বিরোধী পক্ষের সমর্থিত সূত্রের ভিত্তিতে, ১৯শে জুলাই, ১৯৮৮ থেকে শুরু হওয়া পাঁচ মাসব্যাপী এই দমন নির্যাতনে প্রায় ৩০,০০০ কর্মীকে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংস্থা "এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল" এর মধ্যে ৪,৪৮২ জন নিহত রাজনৈতিক বন্দির তালিকা তৈরী করতে সমর্থ হয়েছিল। ইসলামিক আন্দোলনের নেতা এবং ইরানের প্রথম শীর্ষ নেতা খোমেনীর সরাসরি নির্দেশে এই কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়।

খোমেনীর দেয়া একটি নির্দেশের অংশবিশেষ ছিলো এরকম-
«از آنجا که منافقین خائن به هیچ وجه به اسلام معتقد نبوده و هر چه میگویند از روی حیله و نفاق آنهاست و به اقرار سران آنها از اسلام ارتداد پیدا کردهاند، با توجه به محارب بودن آنها و جنگ کلاسیک آنها در شمال و غرب و جنوب کشور با همکاریهای حزب بعث عراق و نیز جاسوسی آنها برای صدام علیه ملت مسلمان ما و با توجه به ارتباط آنان با استکبار جهانی و ضربات ناجوانمردانهٔ آنان از ابتدای تشکیل نظام جمهوری اسلامی تا کنون، کسانی که در زندانهای سراسر کشور بر سر موضع نفاق خود پافشاری کرده و میکنند، محارب و محکوم به اعدام میباشند.» (رضایی و سلیمی نمین، پاسداشت حقیقت:147)

এতে পিপলস মুজাহিদিন অব ইরানের সকল গ্রেফতারকৃত সদস্যদের ইরান ও ইসলামের শত্রু উল্লেখ করে তাদের সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কথা বর্ণিত হয়েছিল। পরবর্তিতে এই সকল রাজনৈতিক বন্দিকে স্বচ্ছ ও গ্রহনযোগ্য কোনো বিচারব্যবস্থার সম্মুখীন না করেই মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়। এরকম বিভিন্ন বিষয়ে ইরান সরকার প্রথম থেকেই বিতর্কিতভাবে সাধারণ জনগনের অধিকার লঙ্ঘন করে এসেছে।

ইরানের এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূলে রয়েছে দেশটির রাজনৈতিক মতাদর্শ। দেশটিতে ধর্মীয় শীর্ষনেতার প্রভাব সর্বোচ্চ এবং ইসলামী শরিয়া আইনের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশটিতে রাষ্ট্রীয়ভাবেই সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করা হয়ে থাকে। সরকারিভাবে দেশটিতে মূল জনসংখ্যাকে ধর্মের ভিত্তিতে চারভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং জোরাস্ট্রয়ান। কিন্তু অন্যতম বৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাহা ধর্মালম্বীদের সেই দেশে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়না। এমনকি বিভিন্নসময়ে এদের অনেককেই মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। সংবিধানের ১৩নং আর্টিকেলে দেশটিতে তিনটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।

“Zoroastrian, Jewish, and Christian Iranians are the only recognized religious minorities, who, within the limits of the law, are free to perform their religious rites and ceremonies, and to act according to their own canon in matters of personal affairs and religious education.”

ইরানের সংবিধান বাহা সম্প্রদায়ভুক্তদের কোনভাবেই স্বীকার করেনা। একইভাবে তারা নাস্তিক জনগোষ্ঠীকেও স্বীকার করেনা।

ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের আরও কিছু নমুনা রয়েছে।



*President of the Islamic Republic of Iran, who must be a Shi’a Muslim (Article 1156)

*Commanders in the Islamic Army (Article 1447)

*Judges, at any level (Article 163 and law of 1983 on the selection of judges)

ইসলাম ধর্মালম্বী ব্যতীত দেশটিতে রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতার অধিকারী হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের থেকে সংসদে নির্ধারিত আসনে মাত্র একজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তারাও কোনভাবেই মূল রাজনৈতিক পরিমন্ডলে কোনধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম নয়।

একইভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অন্যান্য অধিকারও এক নয়। যদি কোনো মুসলিম নারী-পুরুষ অবৈধ সম্পর্কের কারণে দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে শাস্তি হচ্ছে ১০০ চাবুক। কিন্তু এই একই কাজে যদি একজন অমুসলিম পুরুষ একজন মুসলিম নারীর সাথে জড়িত থাকেন তাহলে অমুসলিম পুরুষের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। কিন্তু এই আইনের কোথাও একজন মুসলিম পুরুষ একজন অমুসলিম নারীর সাথে জড়িত থাকলে কি শাস্তি হবে তা উল্লেখ করা হয়নি !!

সমকামিতার ক্ষেত্রে এটিকে অপরাধ বিবেচনা করে মুসলিম অপরাধীর ক্ষেত্রে শাস্তি ১০০ চাবুক কিন্তু অমুসলিম অপরাধীর ক্ষেত্রে শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

আর্টিকেল ১০৫৯ অনুসারে একজন অমুসলিম পুরুষ কখনোই একজন মুসলিম নারীকে আইনত বিবাহ করতে পারেননা। কিন্তু একজন মুসলিম পুরুষ একজন অমুসলিম নারীকে বিবাহ করতে পারবেন।

এছাড়াও ১৯৯৩ সালে বাহা সম্প্রদায়ভুক্তদের বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ জারি করা হয়েছিল যার কথাগুলো ছিলো এরকম-


· “They must be expelled from universities, either in the admission process or during the course of their studies, once it becomes known that they are Bahá’ís.”
· “Deny them employment if they identify themselves as Bahá’ís.”
· “Deny them any position of influence, such as in the educational sector, etc.”
· “A plan must be devised to confront and destroy their cultural roots outside the country.”
তিন লক্ষেরও বেশি সদস্যভুক্ত একটি সম্প্রদায়ের প্রতি এধরনের আচরণ রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। এছাড়াও শুরু থেকেই এই সম্প্রদায়ের জনগনকে হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা হয়েছে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে।

একইসাথে নারীদের ইরানে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ১৯শে জুন, ২০০৫ সালে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নাতনি জোহরা এস্রাগীর ভাষায় নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়-

"Discrimination here [in Iran] is not just in the constitution. As a woman, if I want to get a passport to leave the country, have surgery, even to breathe almost, I must have permission from my husband."

ইরানে পরিবারের পুরুষদের অনুমতি ব্যতিরেকে নারী সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্তই নিজেরা নিতে সমর্থ নন। এছাড়াও নারীদের বোরখা ও হিজাব পরিধানের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানে দেশটির সরকার। আইনের মাধ্যমে দেশে নারীদের হিজাব ও বোরখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেসময় অসংখ্য নারীকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছিল পোশাকের কারণে। শরীরের কোনো অংশ দেখা গেলে ৭০টি চাবুক কিংবা ৬০ দিনের জেল এর শাস্তি। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে তেহরানে পুলিশ ভয়ঙ্করভাবে নারীদের এই বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের ব্যাপারে অভিযান শুরু করে। এই সময়ে নারীদের গ্রেফতার থেকে শুরু করে নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়।

১৯৯৭ সালের পরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কিছু পরিবর্তনের কারণে কিছু সময়ের জন্য নারীদের অবস্থার কিঞ্চিত পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়েছিল। এসময়ে সমাজে নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধি পায় দারুনভাবে। একইসাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের নারী মানবাধিকার কর্মী শিরিন এবাদী নোবেল পুরস্কারও লাভ করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের বিবাহ আইনের মাধ্যমে নারীদের পূর্বের থেকে বেশি অধিকার দেয়া হয় এবং পুরুষদের বিবাহ বিষয়ক স্বেচ্ছাচারিতা কিছুটা রোধ করা হয়। কিন্তু ২০০৭ এর পর থেকে আবার চাকা পেছন দিকে ঘুরতে থাকে। ২০০৮ সালে নতুন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ আহমদিনেজাদ একটি আইন পাস করেন। এতে বিবাহিত পুরুষকে তার প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিবাহ করার অধিকার প্রদান করে তবে প্রথম স্ত্রীকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে উল্লেখ থাকে। পরবর্তিতে এই অর্থসাহায্যের বিষয়টি সংসদে বাতিল হয়ে যায়।

মাহমুদ আহমদিনেজাদ এর আমলে অস্থায়ী বিবাহ (ত্রিশ মিনিট স্থায়িত্ব থেকে শুরু) এর ফতোয়ার প্রয়োগও উল্লেখযোগ্য। এই ফতোয়ার ভিত্তিতে একজন পুরুষ চারটি স্থায়ী বিবাহ এবং যতখুশি অস্থায়ী বিবাহ করতে পারেন। এছাড়াও শরিয়া আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের শাস্তি হিসেবে পাথর ছুড়ে হত্যা একটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। এরকম বেশ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে। ইরানের নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতিবাদের ফলস্বরূপ বেশ কিছু এধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই এই ঘটনা গুলোর সাথে জড়িত। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নারীদের সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ইরান ইতিমধ্যে নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় অনেক নারীকর্মীদের দেশ থেকে বিতারিত করেছে।

ইরানের আইন অনুযায়ী একজন নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের জীবনের মূল্যের অর্ধেক। দুজন নারীর জবানবন্ধি একজন পুরুষের সমান। এরকমভাবেই নারীদের পুরুষদের থেকে নিচু শ্রেনীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আর এর পেছনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে মধ্যযুগীয় আইন। বর্বর নির্যাতনে ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে অনেক নারী।

নারীদের নির্যাতনের উপরে একটি ভিডিও নিজ দায়িত্বে দেখুন। [নির্যাতনের বেশ কিছু অংশের সরাসরি (রক্তাক্ত) উপস্থাপন রয়েছে]




ইরান শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে। সাড়া পৃথিবীতে ১৮ (ছেলে) এবং ২১ (মেয়ে) বছরের নিচের সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হলেও ইরানে এই আইন পরিবর্তন করে ছেলে (১৫) এবং মেয়ে (৯) করা হয়। এর উপরের সবাইকে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধী হিসেবেই বিচার করা হয়ে থাকে। এইক্ষেত্রেও নারীশিশুর বয়স নির্ধারণে অসঙ্গতি লক্ষ্যনীয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩ জন শিশুর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ২০০৩ সালে ইরানের পার্লামেন্টে এই আইন পুনরায় বিবেচনার জন্য তোলা হলে এই বিলে বিরোধিতা করে "গার্ডিয়ান কাউন্সিল অভ দ্যা কনস্টিটিউশন"। ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল অভ দ্যা কনস্টিটিউশন এর ১২ জন সদস্যের, দেশের সংসদের উপস্থাপিত বিল এর বিরুদ্ধে
ভোট দেয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। শিশু অধিকার বিষয়ের এই প্রসঙ্গে ২০০৮ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,

"the legal age in Iran is different from yours. It’s not eighteen ... it’s different in different countries."
["ডেমোক্রেসি নাউ"]

১০ই ফেব্রুয়ারী, ২০১২ সালে ইরানের সংসদ শিশু মৃত্যুদন্ডের এই বিতর্কিত আইনটির পরিবর্তন করে। বর্তমানে উভয় লিঙ্গের জন্যই ১৮ বছর নির্ধারণ করে আলাদা আইনে বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

মৃত্যুদন্ড কিংবা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট এর ব্যাপারেও ইরানে রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই শাস্তির হারও এখানে বেশি। ২০০৮ সালে সরকারী হিসেবে ৩৪৬ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ২০০৯ সালে ২৫২ জনকে সরকারীভাবে মৃত্যুদন্ডের আসামি দেখানো হলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে আরও ৩০০ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ২০১১ সালের প্রথমার্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেব মতে প্রতিদিন গড়ে ২জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। যার অধিকাংশের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে এই অভিযোগের ভিত্তি সন্দেহাতীত নয়। এছাড়াও ইরানে হাত কিংবা পা কেটে ফেলে শাস্তি দেয়ার ঘটনাও নিয়মিত।

ইরান সরকার যেকোনো প্রতিবাদ কিংবা সমাবেশকে শক্ত হাতে দমন করেছে। ১৯৯৯ এর জুলাইয়ে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ৪০০ এর বেশি প্যারামিলিটারি হামলা করে। এতে প্রায় ১৭ জন নিহত হয়। ১,৫০০ এর মতো ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ এর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হয়। গ্রেফতার করা হয় অজস্র প্রতিবাদকারীকে। কারো কারো মতে নিহতের সংখ্যা ৩০ এর মতো এবং গ্রেফতারকৃত ২,৫০০।

১৯৮৫ এর সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে খবর প্রকাশ এর উপরে সরকারী নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয় এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
"রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্স" ২০০৭ এর সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক জরিপে ১৬৯টি দেশের মাঝে ইরান স্থান পায় ১৬৬ নাম্বারে। ২০০৭ সালে ৫০ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। ২০০০ থেকে ২০০২ সালের মাঝে বন্ধ করে দেয়া হয় ৮৫টি সংবাদপত্র। মানবাধিকার বিষয়ক ব্লগার কৌহার গৌদরাজি দুইবার গ্রেফতার হন। ৩১শে জুলাই, ২০১১ তে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন তবে তার অবস্থান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মাধ্যমের কাছে কোনো খবর প্রকাশ করেনি ইরান সরকার।
এছাড়াও মোহাম্মদ সাদিঘ এবং বহমান আহমাদি নামক দুজন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মী ইরান সরকারের রোষের শিকার হয়ে কারাগারে আছেন।


ইরান সরকারের রোষ এবং বৈষম্যের শিকার সেদেশের সমকামী এবং অন্যান্যরাও। ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭, নিউইয়র্ক এর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ বলেন-

In Iran we don’t have homosexuals like you do in your country. This does not exist in our country.
অন্যান্য মানবাধিকারের মতো এলজিবিটি (লেসবিয়ান,গে,বাই-সেক্সুয়াল,ট্রান্সজেন্ডার) অধিকারও ইরানে নেই। যার ফলে ইরানের সেক্সুয়াল মাইনরিটিদের ক্ষেত্রে চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। ইরানে সমকামীদেরকে সমাজে অস্বীকার করা হয়ে থাকে। আর এধরনের সম্পর্ককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইরানে একটি পরিসংখ্যানমতে প্রায় ১লক্ষের কাছাকাছি ট্রান্সজেন্ডার রয়েছে। ইরান সরকারের এদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন এর সংখ্যায় শীর্ষস্থানে রয়েছে এই দেশটি থাইল্যান্ডের সাথে। প্রতিবছর এই অপারেশন ও হরমোন চিকিৎসার পেছনে বিশাল অঙ্কের খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে এধরনের পরিবারগুলো।

এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে সমকামী দম্পতিকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে ইরানে। ২০১১ সালের শেষের দিকে এভাবেই ইসলামী পেনাল কোড ১০৮ ও ১১০ এর ভিত্তিতে ইরানে তিনজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

ইরানে এধরনের অনেক নাগরিকই সরকারী নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এরকমই ১২৫ জন নাগরিকের তথ্যের ভিত্তিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তৈরী করে তাদের “We Are a Buried Generation” রিপোর্টটি। বর্তমানে সমকামীদের অধিকার (LGBT) বিষয়ক ব্যাপারটি ইরানের মানবাধিকার আন্দোলন কার্যক্রমের অন্যতম একটি অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।


এই লেখাটি ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক তথ্যের একটি ভগ্নাংশমাত্র। বর্তমানে ইরান মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে সাথে গোপনে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পারমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে টানা-পোড়েন শুরু হলেও ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে কোনো রকমের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। একইসাথে বরাবরের মতো ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু প্রায় সকল দিক থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে প্রক্রিয়া ইরানের কট্টরপন্থী সরকার অব্যাহত রেখেছে তার সম্পর্কে আশু সমাধান সুদূর পরাহত মনে হয়।

রাশিয়ার স্তালিনের হাতে বিরোধীমত দমনের নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন সমগ্র বিশ্বে কম্যুনিজম মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে একই সাথে ব্যক্তিস্বার্থে চরমপন্থার দিকটি উন্মোচন করে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর স্বার্থে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং কট্টরপন্থীদের হাতে আফগানিস্থানের ক্ষমতা যাওয়ার পরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পরে। সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের নামে পাশ্চাত্য শক্তির মহড়া চলে। বর্তমানে ইরানের এধরনের কার্যক্রম এমনই একটি নতুন চক্রের সূচনা করবে কিনা এরকম সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায়না। ইরানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর প্রবেশ হয়তো সময়ের অপেক্ষামাত্র। আর একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাতই হয়তো এর ভবিষ্যত।

এখন দেখার বিষয় দুটি পাগলা রাজার হাতে ইট দিলে কি ঘটে আর দাবার ঘুঁটি কে আগে চালে !!

[বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মাধ্যম বিশেষ করে ব্লগ এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ইরানের প্রশাসনিক কাঠামো এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদকে আদর্শ বিবেচনা করে নানা ধরনের লেখা, ছবি এবং তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। যার মাঝে ধর্মীয় শুদ্ধতার একটি আবেশ কৌশলে মানুষের মনে প্রবেশ করানোর চক্রান্ত থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইরান সরকারের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যক্রম এড়িয়ে যাওয়া হয়। এখন এসব ছবি ও তথ্য যারা ধর্মীয় আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রচার করে তাদের সবাই কি মধ্যযুগীয় এরকম সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী কিনা এই প্রশ্নটা থেকে যায়। আর নারী প্রচারকারীরা ইরানের নারীদের মতো দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকায় সন্তুষ্ট কিনা সেটাও যৌক্তিক প্রশ্ন বৈকি।]

_____________________________________________________________________________________

তথ্য সংগ্রহ-

১. এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
২. হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
৩. দ্যা টেলিগ্রাফ
৪. দ্যা গার্ডিয়ান
৫. “We Are a Buried Generation” [Discrimination and Violence against Sexual Minorities in Iran]
৬. Discrimination against religious minorities in IRAN- Report presented by the FIDH and the Ligue de Défense des Droits de l’Homme en Iran
৭. উইকিপিডিয়া







Wednesday, August 8, 2012

ডি (১)


১.

দাঁতে দাঁত চেপে দশটি বছর অপেক্ষা করেছে সে ছয় বাই আট ফুটের এই অন্ধকারাছন্ন সেলে। ছোট্ট একটা ছিদ্রের মতো জানালাটা দুই ধাপে শক্ত লোহার শিক দিয়ে আটকানো। আর তার ফাঁক গলে যতটুকু রোদের আলো সেলে ঢোকে তাতে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা যেনো আরও ঘনীভূত হয়। প্রতিটি দিন নয়, প্রতিটি মুহূর্ত যেনো এক একটা বছরের সমান দৈর্ঘ্য নিয়ে কেটেছে। প্রথম প্রথম যখন এখানে আসে সে, ধারণা ছিলো না কতোটা নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু প্রথম সপ্তাহেই একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যখন সাত দিনের সলিটারি কনফাইনমেন্ট এ থাকতে হলো, তখন বুঝলো জীবন কতোটা শক্ত। ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাথর শীতল ছোট্ট সেলে থাকার সময় নিজেকে মানুষ বলে মনে হতো না। আর কয়েদীদের মানসিক অত্যাচার করার জন্য জেল গার্ডরা বেছে নিত খুব প্রাচীন কিন্তু অমানবিক একটা পন্থাকে। মাটির বহু নিচের সলিটারি কনফাইনমেন্ট সেলগুলোতে নিস্তব্দতার মাঝে কোনো এক অন্ধকার কোণ এর কল থেকে টিপ টিপ করে জল পড়ার শব্দ শোনা যেতো দিন-রাত ২৪ ঘন্টা বিরামহীনভাবে। মাথার ভেতরে হাতুড়ির মতো আঘাত হানতো শব্দটা। খুব বেশি দিন লাগাতর এই শব্দ শুনতে শুনতে অনেকে পাগল হয়ে যেতো। ঐসময় দিনে একবার খাবার মিলতো তাও সেটা খাবার কিনা সন্দেহ হতো। রাতের বেলা প্রচন্ড ঠান্ডায় অনেক সময় অচেতন হয়ে যেতো কয়েদীরা কিন্তু উলঙ্গ শরীরে পড়ে থাকতে হতো ঠান্ডা মেঝেতেই।


বলতে গেলে পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে টিঁকে থাকার জন্য যুদ্ধ করে যেতে হয় এখানকার অধিবাসীদের। এখানে তাকে সবাই ডাকতো শুধু “ডি”। কিভাবে এই নামটা এলো সেটা একটা রহস্য তবে মুখে মুখে এটাই চলতো এখানে। প্রথম দিনের ভিতু সাদামাটা মানুষটি এই সুকঠিন জীবনের মাঝে নিজেকে তিলে তিলে তৈরী করেছে, যেভাবে পাথর কুঁদে মূর্তি তৈরী করা হয়। এই কারাগারে বেঁচে থাকাটা অনেকের কাছে দুঃস্বপ্নের মতই, কিন্তু তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য যে একটা লক্ষ্য দরকার ছিলো তা তার আছে, “প্রতিশোধ”। তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করেছে সে, আর এক এক করে মানবীয় সকল অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করেছে। প্রতিদিনের প্রচন্ড পরিশ্রমের ফলে শরীরের যতটুকু মেদ ছিলো তা পরিণত হয়েছে শক্ত পেশীতে, গাইতি আর শাবল চালাতে চালাতে হাতগুলো এখন লোহার মতো শক্ত, কাঁধের পেশী ফুলে উঠেছে। এখন রক্ত মাংসের এই দেহের ভেতর আসলে গ্রানাইটের তৈরী দেয়ালের মতো। ভাবলেশহীন চোখের দিকে তাকালে যে কারো রক্ত শীতল হতে বাধ্য। এভাবেই বহু বছর আগের ছাপোষা অনুভূতিপ্রবণ মানুষটি আজকে রুপান্তরিত হয়েছে লৌহমানবে।


আর ঠিক এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলো সে, যেদিন শুনলো ভালো আচরণের জন্য তার সাজার মেয়াদ বিশ বছর থেকে কমিয়ে অর্ধেক করা হলো কোনো অনুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করেনি সেদিন। শুধু নিজের সেলে ফিরে প্রতিদিনের মতো দেয়ালে আর একটা দাগ কেটেছিলো সে, তবে সেদিনের দাগটা হয়তো অন্য যেকোনো দিনের থেকে একটু বেশি গভীর ছিলো। আর আজকে তার এখান থেকে বিদায় নেয়ার দিন।


আন্দামান সাগরের মাঝখানে একটা দ্বীপে, জাতিপুঞ্জের তৈরী এই কুখ্যাত কারাগারটি নৃশংস-ভয়ঙ্কর সব অপরাধীর জন্য তৈরী করা হয়েছিল বছর দশেক আগে। কয়েক ধাপে শক্ত কংক্রিটের তৈরী দেয়াল আর বৈদ্যুতিক তারে ঘেরা এই কারাগারটিতে রাখা হয় পৃথিবীর মারাত্মক সব অপরাধীকে। নানা দেশ থেকে বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের এখানে নিয়ে আসা হয়। এদের অধিকাংশেরই যাবজ্জীবনের শাস্তি। এক কথায় সমাজ থেকে নির্বাসন। এখান থেকে খুব কম লোকই জীবিত ফেরৎ গেছে। এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করাও বৃথা। দ্বীপের চারপাশেই সাগর। দূর দূর পর্যন্ত আর কোনো দ্বীপ নেই। পুরু কংক্রিটের দেয়াল আর মেঝেতে সুড়ঙ্গ বানানোর মতলব এখানে বৃথা। তার উপরে কারাগারের দেয়াল যেখানে শেষ হয়েছে তার ঠিক পর থেকেই নেমে গেছে খাদ, সোজা সমুদ্রে। নিচে প্রচন্ড ঘুর্নাবত সৃষ্টি করে ফেনিল জলরাশি সীমাহীন ক্রোধে আছড়ে পড়ছে পাথরগুলোর উপরে। দেয়াল বেয়ে অলক্ষ্যে নিচে নামতে যাওয়া যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর সমার্থক। শুধু একটা দিক থেকেই নিচে নামা যায়, যেদিক দিয়ে সমুদ্রতট থেকে কারাগারে চলাচলের জন্য সরু একটি রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। রাস্তাটি সর্পিল আকৃতি নিয়ে উঠে গেছে একদম কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত। এদিক দিয়েই প্রবেশ করতে হয়, আর সাজা শেষ করে যদি জীবন্ত বের হওয়ার ভাগ্য থাকে তাহলে এদিক দিয়েই বিদায় জানাতে হয়। প্রধান ফটক দিয়ে পালানোর চিন্তা কারো মাথায় আসবেনা, কারণ পুরো কারাগার ঘিরে পঁচিশটি উঁচু গার্ডপোস্টে দুজন করে গার্ড সারাদিন পাহাড়া দেয়, তাদের একজনের হাতে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক রাইফেল আর আরেকজনের হাতে দুরপাল্লার স্নাইপার।


প্রচন্ড অত্যাচারের জন্য বিখ্যাত এখানকার গার্ডরা। যেনো এদের হাত নিশপিশ করে বন্দুকের ট্রিগারে, একটু এদিক সেদিক দেখলেই গুলি চলে এখানে। দ্বীপের প্রচন্ড রুক্ষ আবহাওয়ার মতই এখানের সব কিছু। সকালে অধিকাংশ সময় তীব্র সুর্যের আলো আর আর্দ্র বাতাস, রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় দ্রুত, হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করে তখন। এরই মাঝে কয়েদীদের শারীরিক শ্রম দিতে হয় প্রতিদিন দশ ঘন্টা করে নিয়মিত। লোহার ব্যাটন হাতে পাহাড়া দেয় একদল গার্ড। বড় বড় পাথড়ের চাই ভেঙ্গে ছোট করা থেকে নানা রকমের ভারী কাজ করতে হয় কয়েদীদের। আর এক মুহুর্তের জন্য কাজ থামালে পিঠে লোহার গুঁতো। চড়া রোদে কাজ করতে করতে অনেক কয়েদী অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে টেনে হিঁচড়ে পাশে নিয়ে ফেলে রাখা হয়। কয়েদীদের উপরে বাজ পাখির মতো নজর রাখে গার্ডরা। প্রায় প্রতি মাসেই অত্যাচারে টিকতে না পেরে কিংবা পালাতে যেয়ে মারা পড়ে বেশ কয়েকজন। আক্ষরিক অর্থেই এই দ্বীপটার নাম হয়ে গেছে “কিলার আইল্যান্ড”। বহির্জগতের কাছে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের নাম এই কিলার আইল্যান্ড। আর এখানকার অধিবাসীদের এই দুঃস্বপ্নটাকেই পার করতে হয়।

[ক্রমশ:]

[গল্পটা চলবে কিনা কথা দিতে পারছিনা।]