Friday, October 26, 2012

সেই আড্ডা

স্কুলে থাকাকালীন খুব একটা বেশি আড্ডা হতোনা। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ফলাফল বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে সময়টা ছিল এক্কেবারে ফাঁকা তখন ধুমিয়ে আড্ডা দেয়া হতো। পুরনো ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদের উপরে উঁচু একচিলতে জায়গায় বসে চলতো সেই মহাড্ডা। সবে বিঁড়ি ধরেছি তখন, বিষয়বস্তুহীন সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ধুম্রশলাকা জ্বালিয়ে চরম ভাব নিতাম। কতো কি নিয়েই না চলতো কথোপকথন। মোড়ের পুরির দোকানে আলু কম কি বেশি, এই থেকে শুরু করে আম্রিকার গুষ্ঠিশুদ্ধ আলাপে চলে আসতো। বেশ বড়সড় একটা দল ছিলো তখন। কেউ গান গাইতো, কেউবা নিজের একদম নতুন ব্যর্থ ভাব বিনিময়ের কাহিনী শোনাত। হতো সবই। তারপরে রাত বাড়তেই গুটিগুটি পায়ে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতো। আড্ডার শুরুতে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের হাঁটাটা যত দ্রুত থাকতো, ফেরার পথে থাকতো ততোটাই ধীর। সেই দিনগুলো চলে গেল খুব দ্রুত। এখনও মনে পড়ে সেই নোনায় ধরা ছাদ, তাতে গাদাগাদি করে বসে থাকা, মন কষাকষি। কখনো ঐ ছোট্ট ছাদেই লর্ডসের ক্রিকেট, কিংবা রঙ্গিন ঘুড়ি। পাশের বাসার মেয়েটির সাথে একটু চোখাচোখি, সলজ্জ হাসি। এসবই অতীত।

কলেজের প্রথমবর্ষে থাকাকালীন আড্ডার রেশটা তখনও ভালোভাবে আসেনি। নটরডেম এর হঠাৎ চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া যাওয়া জীবন, সাথে "জীবনে দৌড় ছাড়া কিছু নেই" এর প্রথম উপলব্ধি। তখন কোনমতে ক্লাস শেষ করে বাসায় আসতে পারলেই যেন বাঁচা যেত। তার উপরে সাপ্তাহিক পরীক্ষা, স্যার এর পড়া আরও আরও কতো কি! কিন্তু তবুও ধীরে ধীরে আড্ডা জমলো। তাছাড়া উপায়ই বা কি? এক ক্লাস শেষ হয়ে আরেক ক্লাস শুরুর মাঝের যে কিছু মুহূর্ত মাত্র, ঐটুকু সময়েই কি কথাই না বলতাম আমরা! আর ছিলো মধ্যবিরতির সেই মূল্যবান দশ-পনের মিনিট। প্রাণখুলে আড্ডা হতো। ছোট ছোট দলে কিংবা মাত্র দু-তিনজনে। বন্ধুত্ব গাড় হচ্ছিলো এভাবেই।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয়বর্ষ। ততদিনে শিখে গেছি কি করে সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে চলতে হয়। পরীক্ষা আছে? তাতে কি, ওতো থাকবেই। পড়া আছে? তাতেই বা কি, ওরকম তো থাকেই। তখন আমরা মাত্র স্বাধীন। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্লান্ত-শ্রান্ত আমরা তখন আড্ডা দিতাম রাস্তার মোড়ের চা-সিগারেটের দোকানে কিংবা আরামবাগ কলোনিতে বন্ধুর মেসের ছোট্ট একটা ঘরে। কখনো হেঁটে যেতাম বেইলি রোড পর্যন্ত, কখনও বা রিকশায় টি.এস.সি। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল খুব খুব দ্রুত। কলেজে উঠার আগে কেউ একজন বলেছিল, "দেখো, কলেজের দুইবছর চোখের পলকে চলে যাবে"। সত্যিই তাই! আড্ডায় উজির মেরে মাত্রই রাজাকে কব্জা করে এনেছি তখন দেখলাম হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল। সবাই খুব মনোযোগী হয়ে উঠলো, ফালতু সময় নষ্ট করার মতো হাতে বাড়ন্ত সময় কারো কাছেই আর রইলো না। স্রোতের টানে আমিও হাবুডুবু খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। জীবনের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে আমি হাঁফিয়ে উঠতাম কখনো কখনো। তখন ছুটে যেতাম আরামবাগ কলোনির সেই ছোট্ট ঘরে, যেখানে তিন চারজন মানুষ তাদের মূল্যহীন জীবনের কিছু মূল্যবান সময় হেলায় নষ্ট করে দিতাম। তারপরে আবার সেই দৌড়,দৌড়।

এরপরে বদলে গেল সবকিছু। দেশ ছেড়ে আরেকদেশে পড়তে গিয়ে দেখলাম, আশেপাশের মানুষগুলো ঠিক আগের মতো নয়। চলনে-বলনে কাছাকাছি হলেও এরা আমার মতো নয়। এরা জীবনকে চেনে অঙ্কের হিসেবে, নিক্তিতে মেপে নেয় সময়। এরা আড্ডাকে ফালতু সময় নষ্ট বলে মনে করে! কখনও একসাথে বসলেও ঘুরেফিরে প্রকৌশলী হয়ে মোটা অঙ্কের মাইনের একটা চাকরি ছাড়া এদের আর কোন কিছু নিয়েই কথা বলার থাকেনা। জীবন যান্ত্রিক, বুঝতে সময় লাগেনা মোটেও। তবুও খুঁজে নিলাম গুটিকয়েক আমার মতো ফাঁকিবাজ মানুষকে যারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাজে বকে যেতে পারে অনায়াসে, বিনা ক্লেশে। ধীরে ধীরে ঐ নতুন পরিবেশেও মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধটা আর যুদ্ধ রইলোনা।

তখন আড্ডা হতো ছাত্রাবাসের অনির্দিষ্ট কোন ঘরে, যখন যেমন। ঘর হতে দুরে এসে অপরিচিতের আপন হতে সময় লাগেনা। তাই দুই টাকার সিঙ্গারার সাথে চা হোক কিংবা শুধু চাটনি, আমরা লেগে থাকতাম, তর্ক করতাম, অযথা চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু প্রথমবর্ষ চলে যেতেই আবার ছিটকে গেল একেকজন, ছাত্রাবাসগুলোর একেক অংশে। তখন দল ছোট হয়ে কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, তাতে নতুন মুখ যোগ দিতো কদাচিৎ। আমরা তখনও রাজা-উজির মারতাম। গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায় কিংবা ভলিবলের মাঠে, কখনোবা বাস্কি-গ্রাউন্ড। যেই রাতগুলোতে বিদ্যুৎ থাকতো না সেই রাতগুলোতে চলে যেতাম ছাদে কিংবা যমুনার উপরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সেতুতে। সেই রাতগুলোতে আমরা যান্ত্রিকতা ছেড়ে স্বপ্নবিলাসী হয়ে উঠতাম। আমাদের ভেতরের দ্বিতীয় স্বত্তারা সব বের হয়ে আসতো কবি, গায়ক,তার্কিক কিংবা শুধুই শ্রোতা হিসেবে। হোক না মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যই।

সব বদলে যায়। তাই পরিচিত মুখগুলো বদলে গেল। সবাই জীবনকে সাজানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। জীবনের তাগিদে জীবনকে দেয়ার মতো ফুসরত কারো কাছেই আর রইলোনা। সবাই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে একজন একজন করে সৈনিক হয়ে গেল। আমি তখনও হতে পারিনি কিছুই। তাই সময়ের অভাব ছিলোনা আমার। আমি তখনও হেঁটে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায়, ভলিবলের মাঠে, বাস্কি-গ্রাউন্ডে কিংবা ভাঙ্গা সেতুতে, একা। এক সময় এই অধ্যায়েরও শেষ হলো। আমি পরাজিত আর একাই থেকে গেলাম।

দেশে ফিরে আর আগের মত আড্ডা জমেনা। সবাই ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে। "আমরা" থেকে সবাই এখন "আমি" কে নিয়ে ব্যস্ত। রাস্তায় এখন হাঁটা দায়। গলির মুখে দাঁড়ালেও ধুলো আর ধোঁয়ার চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমার আড্ডা দেয়ার পুরনো জায়গাগুলো আর নেই, নেই পুরনো মুখগুলোও। সরল থেকে জীবনের জটিল সমীকরণগুলো মেলাতে মেলাতে গোপনে কখন নিজেরাই জটিল হয়ে গেছি। তাই কদাচিৎ একসাথে হলেও আমরা এখন আর আগের মতো গান গাইনা, হুল্লোড় করিনা। আমাদের অনির্দিষ্ট হাঁটার পথগুলোর দৈর্ঘ্য এখন অনেক কম।

বাড়ির ছাদে উঠা নিষেধ! তাই টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে ইট আর লোহার জঙ্গলের মাঝে যে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায় সেটাই প্রাকৃতিক বিনোদন।আকাশচুম্বী দালান বানাতে গিয়ে আকাশটাই আজ ঢেকে গেছে, চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। যন্ত্র দিয়ে ঘেরা জীবন যান্ত্রিক হবে এটাই অবশ্যম্ভাবী। তাই সব কিছুর পেছনে আমরা শক্ত কারণ খুঁজি। অহেতুক কিছু করার মতো ছেলেমানুষী আমাদের আর পোষায় না।

আমি তারপরেও নিয়ম করে অহেতুক আড্ডা দিই। গভীর রাতে, তারাদের সাথে, একা।

Tuesday, October 23, 2012

অতীতের সন্ধানে কজন বোহেমিয়ান

এক মধ্যরাতে দীপ্রর ফোন থেকেই ঘটনার শুরু। মরমী সাধক লালনের জন্মউৎসবে যোগ দিতে কুষ্টিয়া যাওয়া হবে এটাই তার ইচ্ছা। আমিও কোন ধুনফুন না করে এক কথায় রাজি। তবে দুজনের মাথাতেই অন্যচিন্তা, যখন যাওয়া হচ্ছেই তখন শুধু কুষ্টিয়াতেই হয়তো সফর সীমাবদ্ধ থাকবেনা। তাহলে কি আগে থেকেই ঠিক করা হবে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, নাহ সেটাও পছন্দসই সিদ্ধান্ত হলোনা দুজনেরই। গিয়েই দেখা যাক পথ চলতে চলতে ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ হয় আমাদের এই অনির্দিষ্ট যাত্রা। ভবঘুরে-যাযাবর হওয়ার স্বাদ, নাহয় জীবনে একবার আস্বাদন করেই দেখা যাক। সাথে যোগ দিলো অভিজিৎ আর পার্থ।

আমি আর দীপ্র ছোট্ট দুখানা ঝোলা ঝুলিয়ে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করছি বাকি দুজনের জন্য। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করানোর পর বুয়েটের হল থেকে শেষপর্যন্ত অভিজিৎ আর পার্থ হাজির, তবে সাথে কোন ব্যাগ-ফ্যাগ নেই। অভিজিৎ এর অফিসে ছুটি মাত্র একদিনের তাই পরেরদিন সকালেই ফেরৎ আসতে হবে আর পার্থ নাকি খাঁটি বোহেমিয়ান হয়ে ঘুরে বেড়াবে তাই এক কাপড়েই ভরসা!

গাবতলী গিয়ে কুষ্টিয়ার কোন ভালো পরিবহনের এর টিকিট পাওয়া যাচ্ছেনা। শেষমেষ হন্তদন্ত হয়ে একটা স্বল্প পরিচিতি কিংবা অপরিচিত বাসের টিকিট পাওয়া গেল তাও ঠিক সামনের চারটা সিট। আমাদের তাতেই চলবে। কিন্তু বাস খুঁজে বের করতে গিয়ে যখন তার টিকির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা তখন হেলপারের কাছ থেকেই জ্ঞান নিতে হলো যে, বাসের অগ্রভাগে লেখা ইংরেজির এস আর ডি দিয়ে "সুমন ডিলাক্স"ই একমাত্র বোঝা উচিত ছিলো!! তবে এটা ঠিক এই প্রথমবার দেশের কোন একটা পরিবহনে স্পিডমিটার এর কাঁটা ঠিক কাজ করতে দেখলাম! কোন অযাচিত ঝামেলা ছাড়াই পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে ঠিক ভোরবেলা হালকা কুয়াশায় ঢাকা, কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে গেলাম।চলতে চলতেই শহরে ঢোকার কিছুটা আগে খোকসার পরেই সাতসকালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউলদের দেখা মিললো।

অনেকে ছেউড়িয়ার উদ্দেশ্যে ভ্যানে চেপেছেন কেউবা হেঁটেই চলেছেন।সাধক লালনের জন্মবার্ষিকীর দিনটি ছিলো বুধবার, এই উপলক্ষে মেলা দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছিলাম রাতের বেলা গানের আসরে যোগ দিবো। তাই সকালটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কাঙ্গাল হরিনাথের ছাপাখানা আর মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ি দেখার জন্য ছিলো।

[b]আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে ![/b]

প্রথমেই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জনপ্রতি পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে পার হলাম গরাই নদী। সেখান থেকে আবার শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নসিমনে করে প্রায় ১০ কি.মি। কুঠিবাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই দূর থেকে প্রধান ভবনটি চোখে পড়ে। সাদামাটা ধরনের বাড়ি কিন্তু এখনও বোঝা সম্ভব অতীতে একসময় যথেষ্ঠ জৌলুসপূর্ণ ছিলো। বাড়িটি এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বিশেষ জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। রবি ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের কিছু ছবি আর কিছু চিত্রকর্মের নকল দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আছে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তার সবগুলোতেই অতি উৎসাহী দর্শকরা নিজেদের নাম আবার কেউ কেউ "করিম+সাথী" এরকম করে দাগ কেটে রেখে গেছে। অবাক হলাম এদের বুদ্ধি দেখে আর রক্ষনাবেক্ষনের এরকম দশা দেখে।

2
[কুঠিবাড়ির অগ্রভাগ]

উপরে ছাদে দুটো ধাতুর তৈরী নৌকা রাখা আছে, নিচের ঘরে আছে একটা পালকি। সবকিছুতেই যত্নের দারুন অভাব। তবে দোতলার বারান্দার একাংশে দাঁড়ালে সামনে থেকে অনেকদুর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, আশপাশও অনেকটা চোখে পড়ে। এখনও বাগান কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সাথে আছে কয়েকটা পুকুর, বাঁধানো ঘাট।

1
[দোতলার বারান্দা থেকে]

বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকের যে প্রধান ঘাট তার একপাশে স্থানীয় গায়কদলের গানের আসর চলছে, দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সেখানে। এই ঘাটেই রবি ঠাকুরের বজরাটি এনে রাখা হয়েছে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ পেছনের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। গাছের ছায়ার নিচে, মৃদুমন্দ বাতাস, চারিদিক এই সকালবেলাতেও নিস্তব্দ। দারুন একটা পরিবেশ। প্রশান্তিতে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

3
[পুকুর পাড়ে]

44
[সেই বজরা]

[b]অরূপের রূপের ফাঁদে....[/b]

এরপরে ব্যাটারিচালিত ছোট্ট গাড়িতে করে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। তবে বাড়ি খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হলো, অনেকেই বুঝতে পারলেননা কোথায় যেতে চাচ্ছি। পরে স্থানীয় একজনকে প্রশ্ন করতেই নিজে আমাদের সাথে এসে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

কাঙ্গাল হরিনাথ "ফকিরচাঁদ বাউল" হিসেবেও পরিচিত ছিলেন, ভালো নাম ছিলো "হরিনাথ মজুমদার"। কুষ্টিয়া জেলার এই কৃতিসন্তান লালনের একজন শিষ্যও ছিলেন। "কাঙ্গাল ফকির চন্দ্র দল" নামে তাঁর একটি বাউল দলও ছিলো একসময়। তাঁর করা বিভিন্ন গান এবং সুরের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রের কাজে। এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষটিই ইংরেজ শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র ছাপানো শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পৃষ্টপোষকতায়। "সংবাদ প্রভাকর" নামের এই সংবাদপত্রটিই সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র। এটি প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তিতে আট বছরের ব্যবধানে এটি দৈনিক সংবাদপত্রে রুপান্তরিত হয়। তৎকালীন সমাজে এর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যচর্চা এই সংবাদপত্রের মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের নীলকুঠি ও সাহেবদের নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সংবাদ প্রকাশিত হতো এখানে।

ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটির চরম ভগ্নদশা দেখে আমরা চারজনই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ছাপাখানাটি ধ্বসে পড়েছে স্থানে স্থানে। কোনমতে টিকে আছে মূল কাঠামোটি। দরজাগুলো ভেঙ্গে গেছে। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে আমরা বাংলার প্রথম ছাপার যন্ত্রটি দেখার চেষ্টা করছি তখন। পেছনের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। তিনি আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করার একপর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি কাঙ্গাল হরিনাথের নাতি। আমাদের উৎসাহ দেখে নিজেই তালা খুলে নিয়ে গেলেন ছাপাখানাটি দেখাতে। তার কাছ থেকে জানলাম আরও কিছু তথ্য আর হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলাম অতীতকে।

4
[ছাপাখানার সামনের দেয়াল]

5
[ভগ্নদশা]

কাঙ্গাল হরিনাথ এই যন্ত্রটি কিনে নেন মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে কোলকাতা থেকে। দুটো ছাপার যন্ত্র তখন আসছিলো কোলকাতায়। পথে ডাকাতের কবলে পড়ে
বেহাত হয়ে যায়। নানা হাত ঘুরে স্থান পায় হরিনাথের ছাপাখানাতে। সেসময় কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রায় অর্ধশতাধিক নীলকুঠি ছিলো। আর তার প্রধান দপ্তর ছিলো এখানে। হরিনাথ তখন ইংরেজদের নানা অত্যাচারের খবর তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ছাপাখানার উপরে বোমাবর্ষণ করা হলে ছাদ ধ্বসে পড়ে। এরপরে কোনমতে সেটি ঠিক করা হয়। পরবর্তিতে নানা সময়ে এটি সংস্কার ও সংরক্ষণের নানা প্রতিশ্রুতি আসলেও কোন কিছুই হয়নি, শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ছবি তোলা ছাড়া। এই ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্রটি জাদুঘরেও নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনি ঘুরে দেখালেন আগেকার যন্ত্রটি, অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স। জানতে পারলাম মীর মশাররফ হোসেনের "বিষাদসিন্ধু" এই ছাপাখানাতেই ছাপানো হয়েছিল সর্বপ্রথম। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন হরিনাথের একজন গুনমুগ্ধ ভক্ত। হরিনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কয়েকবার এসেছিলেন।

6
[ছাপার যন্ত্রটি]

7
[যন্ত্রাংশ সাথে ভিত্তিপ্রস্তরের দুখন্ড]

8
[অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স]

9
[পুরনো কাগজ]

একপর্যায়ে তিনি নিয়ে এলেন কাঙ্গাল হরিনাথের নিজ হাতে লেখা গানের একটি পান্ডুলিপি। এই সেই বিখ্যাত গান "দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমায়" যা সত্যজিৎ রায় তাঁর "পথের পাঁচালি" চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এই বিখ্যাত গানটির আসল পান্ডুলিপিটি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ। এটিও সংরক্ষণের কোন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়নি।

11
[গানের পান্ডুলিপি]

10
[কাঙ্গাল হরিনাথের সমাধিস্থান]

এই উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ, একজন গুনী বাউলসাধক, সুরকার এবং গায়ক, একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীর জন্মস্থান থেকে তাঁর ধ্বসে পড়া অতীতচিহ্ন দেখে যখন আমরা ফিরে আসছি তখন সবার মন কিছুটা হলেও ভারাক্রান্ত ছিলো। কানে বাজছে তাঁর নাতির কথাগুলো, "সবাই তো আসে, ছবি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কেউ রক্ষা করার জন্য কিছুই করেনা বাবা"। আমাদের অতীতকে আমরা মর্যাদা দিতে শিখিনি।

এরপরে যাওয়া হলো মীর মশাররফ হোসেন এর জন্মভিটায়। সেটি এখন বিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হয়েছে। পাশে একতলায় একটি ছোট জাদুঘর, তাতে তাঁর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী। পুরনো কোন স্থাপত্য আর নেই এখন।

[b]তিন পাগলের হলো মেলা ....[/b]

রাতের বেলা গেলাম লালনের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে। ঢোকার মুখেই মানুষের প্রচন্ড ভিড়ে অবাক হলাম। বাংলালিংকের সৌজন্যে চলছে মেলা। আর তাতে মাঠের পাশে বড় স্ক্রিনে বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন। পুরো মাঠ জুড়ে অসংখ্য দোকান। তাতে শিকড়ের মহৌষধী থেকে শুরু করে দা-খুন্তি সব বিক্রি হচ্ছে। বুঝলাম মানুষের আগ্রহ লালনের সাধনায় নয় বরং নিজের সাংসারিক জীবন সাধনায়। অসাম্প্রদায়িক লালনের আখড়ার সামনে ধর্মব্যবসায়ীদের ভিড়ও লক্ষ্য করার মতো। ধর্মই মনে হয় এমন একটি জিনিস যা জায়গাভেদে সবক্ষেত্রেই পণ্য হিসেবে বেশ ভালো বিক্রি হয়। কিছু বিকলাঙ্গ মানুষকে দেখিয়ে টাকা তুলছে একদল আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেক মানুষ, কেউ কেউ নিজের মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবিও তুলে নিচ্ছে! মানুষের বিকলাঙ্গতা যে দর্শনের বস্তু হতে পারে সে সম্পর্কে নতুন করে ধারণা হলো। এরকম নানা কিসিমের মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত হতে বেশিক্ষণ লাগেনা। শেষপর্যন্ত ভিড় ঠেলে ঢুকলাম প্রধান অংশে। দেখলাম সাধক লালনের সমাধিস্থল। এরপরে ঘুরে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম বাউলদের গান। এখানে কেউ টানছে ধুম্রশলাকা, কেউ কল্কি। কেউ এখানে ভবের পাগল, কেউবা ভাবের। এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম। অনুভূতির বাণিজ্যিকিকরণ আমাদের থেকে ভালো করে কেউ করতে পারে কি?

14
[প্রবেশদ্বার]

12
[সমাধিস্থল]

13
[মেলায় আগত সন্ন্যাসীরা]


[b]পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন....[/b]

পরের দিন ভোরে অভিজিৎ বিদায় নিলো। বাকি আমরা তিনজন চেপে বসলাম বাসে, নাটোরের উদ্দেশ্যে। বনলতা সেনকে খোঁজার আগ্রহ তো আছেই তার সাথে আছে রানী ভবানীর রাজবাড়ি আর চলনবিল দেখার আগ্রহ। ঘন্টা দুয়েক পরে নেমে পড়লাম নাটোর শহর ঢোকার মুখে। সেখান থেকে অটোরিক্সা করে রানী ভবানীর রাজবাড়ি।

রাজবাড়ি ঢোকার মুখেই বিশাল একটা পুকুর। তার শান বাঁধানো ঘাটে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। ছায়া-সুশীতল ঘাট, নিস্তরঙ্গ জল। তার পাশেই শিবমন্দির।কম করে হলেও ৩০০ বছরের পুরনো। তার সাথেও বড় পুকুর। চারিদিকে গাছপালায় ঢাকা, ছায়া ছায়া। মন্দিরের ভেতরে গমগম করছে জটাধারী সন্ন্যাসীর গলা, লাল বস্ত্র, তিলক কপালে, মন্ত্র আউড়ে যাচ্ছেন।

15
[প্রথম পুকুর]

16
[শিব মন্দির]

মন্দিরের পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে সামনে পরে কাচারী বাড়ি। এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। চারিদিকে অযত্নের ছাপ। কোন রক্ষনাবেক্ষণ নেই বোঝাই যাচ্ছে। এই রাজবাড়ি রানীর মৃত্যুর পরে তার দুই ছেলের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। একপাশে বড় ছেলের জমিদারি অন্যপাশে ছোট ছেলের। বাড়িগুলো জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। টিকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করা হয়নি। অনেকগুলো বাড়ি পুরোপুরি ধ্বসে গেছে। এখানেও দেয়ালে নানা ধরনের লেখা। বোঝাই যাচ্ছে অতি উৎসাহীদের কাজ। বাড়িটি ঘিরে বড় বড় পাঁচটি পুকুর, অসংখ্য গাছ। কোনমতে টিকে থাকা বিশাল দালানগুলোতে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে দারুন সব কাজ। কোনায় কোনায় যুগলদের ফিসফাস, হঠাৎ সামনে পড়ে যাওয়ায় বিব্রত আমরা।

17
[কাচারী বাড়ি]

18
[কাচারী বাড়ির বারান্দা থেকে সামনের পুকুর]

19
[লোহার সিড়ির ভগ্নদশা]

20
[কিছু মর্কটের ভালোবাসার আহ্ববান]

21
[ভেঙ্গে পড়া বাড়ির একাংশ]

22
[পুরাতন কুয়ো]

23
[ছোট জমিদারের দালানের একাংশ]

24
[দালানের পেছনের ঝর্না]

রাজবাড়ির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত রানী ভবানীর মহলটি। পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মাটিতে অনেকটা দেবে গেছে প্রায় পুরো জায়গাটি। ভাঙ্গা দেয়ালে বাসিন্দাদের জামা কাপড় শুকোতে দেয়া হয়েছে। হাঁস-মুরগি আর ছাগল চড়ে বেরাচ্ছে এদিক সেদিক। বিন্দুমাত্র রক্ষনাবেক্ষণ নেই। বড় জমিদারের দালানটি এখনও টিকে আছে সব থেকে ভালো অবস্থায়। তাই বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর আফসোস করলাম। দরজার কপাটের ফাঁক দিয়ে ভেতরের ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। প্রবেশাধিকার নেই তাই ভেতরটা এখনও টিকে আছে দেখে ভালো লাগলো। সামনের মাঠে স্থানীয়দের ক্রিকেট খেলার জায়গা। যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজবাড়িটি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো কোন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা এভাবে অরক্ষিতভাবে ব্যবহার করা হয় বলে আমাদের জানা ছিলোনা।

25
[রানীর মহলের অবস্থা]

26
[বড় জমিদারের মহলের ভেতরে, কপাটের ফাঁক দিয়ে তোলা]

27
[বড় জমিদারের মহল সামনের রাস্তা থেকে, মাঠে স্থানীয়রা ক্রিকেট খেলছে]

বের হয়ে আসার সময় টিকিট কাউন্টারে প্রশ্ন করলাম টাকা নেয়া হচ্ছে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে কিন্তু কোন যত্ন নেই কেন? তাদের সোজা উত্তর, "আমাদের বলে লাভ নেই, অফিসে বলুন"। অফিসের দেয়ালে লেখা পাঠাগার, কিন্তু ভেতরে একটা টেবিল আর কখানা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই! একটা ক্রোধ জন্মালো
মনের মধ্যে অযথাই।

সেখান থেকে গেলাম নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা চেখে দেখার জন্য। তবে সেটারও খুব একটা সুবিধাজনক স্বাদ পেলামনা। এবার যাত্রা চলন বিলের উদ্দেশ্যে। বাসে করে নাটোর মাদ্রসা মোড় থেকে প্রায় আধাঘন্টার দুরত্ব। ভর দুপুরে নামলাম শিঙ্গা মোড়। সেখান থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে গেলাম বিলের নৌকা ঘাটে। মাত্র ৮০ টাকায় ঠিক করা হলো একটা ছিপ নৌকা। মাঝি বয়সে তরুণ, হাসিখুশি দারুন ব্যবহার। ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো বিলের এদিক সেদিক। প্রচন্ড রোদে প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়ে উঠলো পরিবেশ। চারিদিকে জল তার মাঝে মাঝে একটা দুটো গ্রাম। নৌকাই এখানের প্রধান বাহন। চারিদিকে ধান লাগানো হয়েছে। মাঝি জানালো সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ এর সংযোগ আছে, আছে ক্যাবল টিভির সংযোগ। হাসিমুখে জানালেন ঢাকা শহরে কাজ করেছিলেন ৭ বছর, তার থেকে অনেক ভালো আছেন এখন নিজের গ্রামে।

28
[নৌকা থেকে]

29
[বিলের অগভীর জায়গায় শস্যের ক্ষেত্]

30
[বিলের মাঝখানে একটুকরো চর]

31
[নৌকার মাঝি]

32
[পেতে রাখা মাছ ধরার জাল]

প্রচুর মাছ ধরা হয় এখানে। মৌসুমে ৭০-৮০ মন মাছ উঠে এক এক নৌকায়। এখন ধান চাষ করা হচ্ছে। আর কদিন পরেই জল এসে উচ্চতা বেড়ে গেলে জেগে উঠা ছোট ছোট চর ঢেকে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরার জাল লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমাদের নৌকার দিকে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি। একটা ছোট চরে নেমে পড়লাম অল্প কিছুক্ষণের জন্য। জায়গাটা দারুন সুন্দর। চারপাশে জল তার মাঝখানে একটুখানি মাটি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুরে বেড়ানো হলো নৌকায় আর মাঝির সাথে চললো নানা বিষয়ে গল্প। মাঝির একটাই কথা, শহরের মানুষ যে দূষণে থাকে তার থেকে তারা অনেক ভালো আছেন, শান্তিতে আছেন। দুপুরে তাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্যও বললেন কয়েকবার। বিল দেখা শেষ করে এবার আবার ফিরে এলাম নাটোর শহরে। রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ধরে যেতে হবে জয়পুরহাট। উদ্দেশ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দর্শন। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো জয়পুরহাট থেকেই আমাদের জন্য সুবিধা হবে। শেষ বিকেলের আলোয় ট্রেনে চেপে বসলাম। আরেকটি দিনের জন্য কিছুটা বিষাদগ্রস্ত মন নিয়েই যাত্রা শেষ হলো, নতুন গন্তব্যে রওনা হলাম।


রাতের দিকে পৌঁছালাম জয়পুরহাট শহরে। সেখানে হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারের খোঁজে বের হলাম। দারুন আতিথেয়তায় খাবার খেলাম, অসাধারণ রান্না। অনেকদিন পর ফরমালিনমুক্ত খাবার খেয়ে যারপরনাই খুশি আমরা। পরের দিন সকালে রওনা হবো পাহাড়পুরে।

সকালে নাস্তার পরে ঘুরে এলাম জয়পুরহাট সুগার মিলস। যতদূর জানি এটাই এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্বয়ংসম্পূর্ন চিনির কল। আখ মাড়াই করে এখানে চিনি তৈরী করা হয়। আখের ছোবরা দিয়েই জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। জায়গায় জায়গায় আখের ক্ষেত। কারখানাতে ঢোকা গেলনা। ৩৫ বছর ধরে গার্ডপোস্টে চাকরি করা মানুষটি শোনালেন এই কারখানার নানা কাহিনী। দুঃখ প্রকাশ করলেন কারখানা বন্ধ থাকায় ঘুরিয়ে দেখাতে পারলেননা বলে। জানা গেল প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতির মধ্য দিয়েই চলছে। ৪১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই কারখানাটি সঠিক পরিচালনা এবং সংরক্ষণ জরুরি।

দুপুরে রওনা হলাম পাহাড়পুরের উদ্দেশ্যে। ১০০ টাকা ভাড়ায় অটোরিক্সা করে প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরে পৌঁছালাম সেখানে। পথে অসাধারণ সবুজের মেলা।চারপাশে শস্যের ক্ষেত, নীল আকাশ, মন উদাস করা বাতাস। ছোট ছোট গ্রাম, শিশুদের খেলা। অনেকদিন পরে গ্রামের রাস্তায় চলতে গিয়ে মন নিজের অজান্তেই নানা স্মৃতিচারণ শুরু করলো।

[b]জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক....[/b]

পাহাড়পুর বিহারটি অতীতকাল থেকেই বেশ অযত্নে রয়েছে। বৌদ্ধ শাসকদের হটিয়ে সেন রাজারা যখন দখল করে তখন তারাও এটিকে যত্ন করেনি। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে বারবার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর নানা অংশ। তারপরেও কোনমতে টিকে আছে এখন।

33
[ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সামনে থেকে]

পাহাড়পুরে যখন ঢুকলাম তখন সূর্য মাথার উপরে। রোদ মাথায় নিয়েই ঘুরতে শুরু করলাম। অতিথি বাংলোর অংশটুকু বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিহারের ধবংসাবশেষ বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। তিন স্তরে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠা যায়। দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। অবাক হলাম বিহারের উপরে এক কোনে দর্শনার্থীরা মুত্র বিসর্জন করতে করতে মুত্রাগার বানিয়ে ফেলেছে দেখে। প্রাচীন স্থাপত্যের এহেন অবমাননা ভাবতেও কষ্ট লাগে। অনেক জায়গাতেই খাবারের প্যাকেট ফেলে রাখা হয়েছে, রয়েছে পানির ব্যবহৃত বোতল। এখানেও রক্ষনাবেক্ষনের অভাব। তারই মাঝে কিছু মর্কট চেষ্টা করছে দেয়াল বেয়ে একদম উপরে উঠার জন্য। অশ্রাব্য ভাষা বিনিময়ে তাদের ফুর্তি দেখে মনে হলো এটা তাদের পিকনিক গ্রাউন্ড।

34
[দেয়ালের কাজ]

35
[নানা ধরনের প্রতিকৃতি]

36
[জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা]

37
[বিহারের ভেতরের একাংশ]

38
[বিহারের পেছনদিকে]

39
[বিহারের বিস্তৃতি]

পাহাড়পুর জাদুঘরটি বেশ সমৃদ্ধ। শুধু এখান থেকে পাওয়া জিনিসেই নয় সাথে রাখা আছে আশেপাশের নানা অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রাচীন সামগ্রী। অধিকাংশই প্রাচীন পাথরের বড় বড় পৌরানিক দেব-দেবীর মূর্তি কিংবা কাহিনীর বর্ণনা। অসম্ভব নিঁখুত এসব কাজ দেখে বেশ সময় কেটে গেল।

এরপরে আমরা ঠিক করলাম খুঁজে বের করবো "হলুদ বিহার" নামের জায়গাটিকে। এ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলোনা। তাই স্থানীয় মানুষের মাধ্যমেই খুঁজে খুঁজে যেতে হলো। পাহাড়পুর বাজার থেকে শ্যালোইঞ্জিন চালিত টেম্পো ভাড়া করলাম ২০০ টাকা দিয়ে। এরা আমাদের নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে এখানে। যাওয়ার পথ গ্রামের ভেতর দিয়ে। খুবই খারাপ অবস্থা রাস্তার। এক মুহূর্ত স্থির বসে থাকা যাচ্ছেনা। শরীর ব্যথা হয়ে গেল ঘন্টা দেড়েক এর যাত্রায়। তবে আশেপাশের প্রত্যন্ত গ্রাম দেখে বেশ অন্যরকম অনুভূতি হলো। টেম্পো চললো "কুলি" নামক জায়গা পর্যন্ত সেখান থেকে আবার গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। "বদলগাছি" পর্যন্ত বাসে করে এসে "কুলি" মোড় থেকে টেম্পু নিয়েও যাওয়া যায়। গ্রামে বসেছে গরুর হাট, তারই মাঝ দিয়ে চললাম। শেষমেষ বড় একটা ধবংসাবশেষ এর কাছে গাড়ি থামলো। এটাই "হলুদ বিহার"।

43
[উঠার সিড়ি]

রাস্তার মোড়ে প্রায় ৫/৬ কি.মি আগে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম তাও গাছের শাখাপ্রশাখায় ঢেকে আছে, এছাড়া আর কোন দিকনির্দেশনা নেই।জায়গাটা দেখে হতাশ হলাম পুরোপুরি। স্থানীয় লোকেদের তাস খেলা আর বৈকালিক বিড়ি খাওয়ার জায়গা সেটা। উঁচু ইটের ঢিবি, মাটিতে ঢেকে আছে। একটা সিড়ি মোটামুটি টিকে গেছে।নেই কোন সাইনবোর্ড কিংবা কর্মী। চারপাশে গ্রাম বিস্তার লাভ করেছে, বসেছে দোকানপাট। এদিকে শহরের লোক খুব একটা আসেনা। স্থানীয়রা খুব উৎসাহ নিয়েই আমাদের নানা অভিজ্ঞতা বলে গেল। এখানে নাকি "হলুদ রাজা" নামে কোন এক রাজা ছিলেন, তারই নামে এই অঞ্চলের নাম। তাই এই বিহারটির নামও লোকমুখে চলে এসেছে "হলুদ বিহার"। পাশেই এক দোকানে চা খেতে খেতে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। দোকানি জানালো জন্মের পর থেকেই জায়গাটি দেখছেন। তাদের বাপ-দাদারাও দেখেছে তাদের জন্মের আগে থেকেই। তিনি যখন তরুণ ছিলেন তখন এর ঢিবির উচ্চতা ছিলো অনেক। একবারে হেঁটে উপরে উঠা যেত না। কালক্রমে এটি মাটিতে বসে যাচ্ছে। আশেপাশে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা ছিলো, লোকে সাহস করতো না খুব একটা এখানে আসার। পরে লোকজন বসতি স্থাপন শুরু করলে আস্তে আস্তে জঙ্গল সাফ করা হয়। বিহারের জায়গাতেই বসতি নির্মান শুরু হয়।

40
[হলুদ বিহার]

41
[খননকার্যের জায়গাটি]

42
[উপরের অংশ]


কিছু বিদেশী মানুষ নাকি এসেছিলেন এখানে। খোড়াখুড়ি চলেছিলো বেশ কিছুদিন। কয়েকটা মাটির তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছিলো। এর পরে আর কিছু কাজ হয়নি। মাটি খুড়ে বিহারের ভিত্তি পর্যন্ত কোন হদিস পাওয়া যায়নি তাই কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে বছরের পর বছর ধরে ধুলো ময়লা জমে গর্ত বন্ধ হয়ে যায়। পাশেই একটা পুকুর দেখলাম। ধারণা হলো নিচের মাটি বেশ নরম তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে জায়গাটি। একসময় হয়তো আর যা আছে তাও অবশিষ্ট থাকবেনা। একটি প্রাচীন জায়গায় অন্তত সরকারী একটা দেখভালের ব্যবস্থা করা যেত। অতীতকে এতোটা অবহেলা করার কোন মানে আছে বলে মনে হয়না।

ফেরার পথে অন্য রাস্তা ধরলো গাড়ি। অন্ধকার রাস্তা তার উপরে কুয়াশা। গাড়ির হেডলাইট কাজ করেনা। অন্ধকারেই কোনমতে চলছে। একবার দুর্ঘটনা হতে হতে বাঁচলো। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ একটা স্পিডব্রেকার। মাথায় ব্যথা পেল পার্থ। পরে নোকিয়া ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পথ দেখে দেখে চললো ঘন্টাখানেক! ভয় হচ্ছিল কখন গাড়ি রাস্তা ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে ক্ষেত কিংবা জলাশয়ে গিয়ে নামে! কোনমতে ফিরে এলাম পাহাড়পুর বাজারে। সেখান থেকে রাতের শেষ বাসে জয়পুরহাট শহরে। সেদিন রাতের ট্রেন ছিলো ১২টায়।

ট্রেন ধরার সময় আরেক ঘটনা। আমাদের জায়গা ছিলো "ঠ" বগিতে। খুঁজতে গিয়ে দেখি গাড়ির শেষে "ঠ" বগিই নেই! আমাদের টিকেট চেকার বললো ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই ওখানে বসা যাবেনা। ভালো কথা কিন্তু তার ঘোষণা তো দেয়া উচিত আমরা এখন কোথায় বসি? প্রশ্ন করতেই বললেন, যেখানে খুশি! তো আমাদের টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য কে ফেরৎ দিবে এই প্রশ্নে সে নিরব। শেষে যখন অন্য বগিতে উঠতে যাচ্ছি তখন ট্রেন ছেড়ে দিলো। কোন মতে দৌড়ে গিয়ে ঝুলে ঝুলে ট্রেনে উঠে পড়লাম।

কয়েকদিনের কিছু অপার্থিব মুহূর্ত আর ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে ফিরে এলাম যান্ত্রিক শহর ঢাকাতে। পুরো সফরে স্থানীয় মানুষদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। তাদের সরল ব্যবহারের কাছে নিজেদের অন্যরকম লেগেছে। নিজের দেশে এতোটা অমায়িক আচরণের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। এই মুহুর্তগুলো মনে দাগ কেটে রইলো।

map
[সম্পূর্ণ সফরের যাত্রাপথ]

কিছু উপলব্ধি হলো একই সাথে। আমরা অধিকাংশ সময় নিজেদের সমাজ,সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ধবংসের জন্য নানা রকম আগ্রাসনকে দায়ী করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা। নিজের চোখে দেখলাম কিভাবে অনাদরে-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে শত শত বছরের পুরনো সব স্থাপত্য। কিভাবে আমরা নিজেরা নষ্ট করছি আমাদের অতীত স্মৃতিকে। আমরা যদি আমাদের অতীতকে মর্যাদা দিতে না পারি, যদি তাদের আগলে রেখে রক্ষা করতে না পারি তাহলে এরজন্য দায়ী কে? অপরের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজেদের দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা সেই প্রশ্নটার আগে সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করি।


[লেখাটি প্রিয় বন্ধু, সহব্লগার তারেক অনুর ( আমাদের ঘনুদা) জন্য। এই মানুষটি আমার কাছে একটি রহস্য, মনে হয় অন্যগ্রহের প্রাণীর সাথে নির্ঘাত যোগাযোগ আছে!]

Thursday, October 11, 2012

মালালা ইউসাফযাই তোমাকে স্যালুট





মাত্র ১৪ বছরের মেয়েটিকে মাথায় এবং ঘাড়ে গুলি করা হয়েছে হত্যার জন্য। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘসময় মেয়েটি মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে। চার ঘন্টার দীর্ঘ অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসকরা তার মাথা থেকে শেষপর্যন্ত গুলি বের করতে সক্ষম হয়েছেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছে এখন সে। যে মেয়েটিকে এই অল্প বয়সেই কট্টরপন্থী উগ্রবাদী তালেবানদের রোষের শিকার হতে হয়েছে তার নাম মালালা ইউসাফযাই। শুধু মালালাই নয় গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে তার আরও দুজন সহপাঠিনী। হয়তো এই যাত্রায় বেঁচে যাবে মালালা। কিন্তু তারপর?

এই অমানবিক-নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায়। যেখানে তালেবানদের একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য বজায় ছিলো দীর্ঘকাল। এখনও যেখানে প্রায়শই হামলা চালায় তালেবান জঙ্গিরা।

এরই মাঝে তালেবানরা আবার হুমকি দিয়েছে, মালালাকে বাঁচতে দেয়া হবেনা। যেভাবেই হোক, তাকে হত্যা করা হবে। মেয়েটির মা তাই পাকিস্তান সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। মালালার প্রতি এহেন নৃশংস হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ সহ আরও অনেকেই। কিন্তু এই প্রতিবাদ কি যথেষ্ট?

কি অপরাধ ছিলো মালালা নামের মেয়েটির? সে মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে ব্লগ লিখত। আর লিখত তাও আবার তালেবানদের বিরুদ্ধে, ধর্মের আইন প্রতিষ্ঠার নামে তাদের অত্যাচার এর বিরুদ্ধে। সে লিখত নারীশিক্ষার সমর্থনে, লিখত সেকুলার একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যে সোয়াত উপত্যকায় তালেবানদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজিনা, সেখানে এরকম ছোট্ট একটি মেয়ের সাহসী প্রতিবাদ কি করে মেনে নিবে সন্ত্রাসীরা? তাই বয়স কোন ব্যাপার না, সে শিশু হোক আর বৃদ্ধ চালাও গুলি, হত্যা করো, নিঃশ্চিহ্ন করে দাও তাকে পৃথিবীর বুক থেকে। কারন সে শিক্ষার কথা বলে, উন্নত সমাজের কথা বলে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা যাদের লক্ষ্য তাদের কাছে এর থেকে বড় হুমকির বিষয় আর কি হতে পারে? তার উপরে সে নারী!!

এই তালেবানরাই কদিন আগে আফগানিস্তানের একটি মেয়েদের স্কুলে পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলো, আক্রান্ত হয়েছিল অর্ধশতাধিক মেয়ে শিক্ষার্থী। কেন? কারণ নারীশিক্ষা তাদের জন্য ভীতিকর। তারা চায়না, নারীরা শিক্ষিত হোক, মাথা উঁচু করে বাঁচুক। তারা চায়, নারীরা আপাদমস্তক নিজেদের আচ্ছাদনে আবৃত করে সারাদিন পুরুষের হুকুমে চলবে আর রাতে তাদের জৈবিক চাহিদা পূরণ করবে। নারীরা তাদের কাছে ভোগ্যবস্তু ছাড়া বেশি কিছু তো নয়!!

তাই মালালাকে গুলি করে তাদের দাম্ভিক স্বীকারোক্তি। তাদের মুখপাত্র জানায়, মালালা তদের জন্য শত্রু। সে নারীশিক্ষার কথা বলে, সে পাশ্চাত্যের মুখপাত্র। তাই তাকে হত্যা করা জায়েজ।

মুখপাত্র ইহ্সানুল্লাহ ইহসান এর মতে,


“Any female that, by any means, plays a role in the war against mujahideen should be killed,” said Taliban spokesman Ihsanullah Ihsan, using the term for Islamic holy warriors to refer to the Taliban.

“We are dead against co-education and a secular education system.”


ঠিক কতোটা ধর্মান্ধ, উগ্র-মৌলবাদী হলে এধরনের আচরণ সম্ভব!! নারীদের পশুর মতো ব্যবহার করা যাদের কাছে সাধারণ বিষয়, নারীদের যারা ভোগ্যপণ্য ছাড়া বেশি কিছু ভাবতে নারাজ তাদের থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও বোকামি।

আজকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের সব থেকে বড় ভয় নারীশিক্ষা। নারীদের অগ্রযাত্রা তারা ভয় পায়। পিঞ্জরবন্ধী নারীরা যদি শিক্ষিত হয়ে, আত্মনির্ভরশীল হয়ে সমাজে অবদান রাখা শুরু করে তাতে পুরুষশাসিত সমাজে তাদের অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান এরকম সবগুলো দেশেই মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ্য নারীদের গৃহবন্ধী করে রাখা। তাদেরকে শিক্ষা থেকে যথাসম্ভব দুরে রাখা। তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা, মানসিকতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে তাদের শুধুমাত্র যৌনদাসী বানিয়ে রাখা।

এদের চোখ রাঙানি আর ভয়কে অগ্রাহ্য করে তাই নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। মালালা ইউসাফযাই এর মতো এক একজন প্রতিবাদী নারীই পারবে সমাজের এই অবস্থা পরিবর্তন করে নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। নিজেদেরকে অন্ধকুপে আবদ্ধ না রেখে, দাসত্বের বিরুদ্ধে, নিজেদের জীবনের প্রয়োজনে এই ঘৃণ্য মানসিকতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

যখন একজন ১৪ বছরের মালালা ইউসাফযাই, অস্ত্রধারী জঙ্গি তালেবানদের ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম, তখন বোঝা উচিত পৃথিবীর ৮৮৪,২৬৮,৩৭৮ জন নারী ঐক্যবদ্ধভাবে আরও কতোটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম।


খবরের লিঙ্ক

Friday, October 5, 2012

সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, মানবিকতার "রোহিঙ্গা" ইস্যু এবং কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়



বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরে যেই বিষয়টি নিয়ে সব থেকে বেশি আলোচনা হয়েছে সেটি সাম্প্রতিক সময়ে রামু,পটিয়া,উখিয়া এই অঞ্চলগুলোতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যখন সোচ্চার হয়েছে, তখন অন্য সকল ঘটনার মতো এই ঘটনাতেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সুযোগসন্ধানী একটি গোষ্ঠী। যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শুভশক্তি ও মানবিকতার উত্থানের প্রশ্নে আজকে দেশের একটি বড় অংশ একতাবদ্ধ, সেখানেও একটি বিশেষ গোষ্ঠী নানাধরনের অযৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এই কর্মকান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। তাদের মূল বক্তব্যগুলোর মাঝে একটি প্রসঙ্গ প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসছে, আর তা হলো, মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া রাখাইন-রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের মানবিকতা কোথায় ছিলো? এই প্রশ্নটি দিয়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মূল প্রসঙ্গ থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করার একটি অপ-প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে বেশ কিছু আলোচনা লক্ষ্য করে এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, একটি মহল, মায়ানমারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষয়টি দিয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে ঘটে যাওয়া এই সাম্প্রদায়িক নির্যাতনকে সিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই ব্যক্তি অবস্থান থেকে এই অপ-প্রয়াসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করা জরুরি মনে করছি।


সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের পার্থক্য :

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং নির্যাতন এই বিষয়টিকে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতভাবে এক করে দেখার চেষ্টা করেন। প্রথমেই এই দুটি বিষয়ের মধ্যবর্তী পার্থক্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। উপমহাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রাচীন ব্যাধি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল সম্প্রদায়ভেদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অনলে দগ্ধ হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতা কি শুধুই নির্যাতন নাকি দাঙ্গা এই বিষয়েও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় একটি কিংবা একাধিক সম্প্রদায় জড়িত থাকে। কোন উস্কানিমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয়া দাঙ্গার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতে অংশগ্রহণকারী যেকোন সম্প্রদায়ভুক্ত ক্ষতিগ্রস্থ হন। লক্ষনীয় বিষয় এই যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কম-বেশি উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাণহানি, সম্পদের ধ্বংস হতে শুরু করে প্রত্যেকটি বিষয়ে উভয়েই আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এই দাঙ্গার মূলে থাকে সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা। তাই এক্ষেত্রে দলবদ্ধভাবে দাঙ্গাকারীদের আক্রমনে ঘটনাস্থলে দুর্বল প্রতিপক্ষ যেকোন সময় যেকোন ভাবে আক্রান্ত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষয়টি এবং এর ব্যাপকতা, অংশগ্রহণকারী উভয়পক্ষের উপর নির্ভরশীল।

সাম্প্রদায়িক নির্যাতন এর থেকে ভিন্ন। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি সম্প্রদায়ের কাছে একটি কিংবা একাধিক সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থ হন। উস্কানিমূলক কোন ঘটনার থেকে এর উৎপত্তি হলেও এর প্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হয় শুধুই দুর্বল প্রতিপক্ষকে। তাই প্রাণহানি এবং সম্পদের ধ্বংসসাধনের মতো ব্যাপারগুলো নির্যাতিত সম্প্রদায়ের উপরেই চলে। তাই সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আক্রমনকারী/দাঙ্গাকারী শক্তিশালী সম্প্রদায়টির উপরে নির্ভরশীল এবং অনেকাংশেই পূর্বপরিকল্পিত।

মায়ানমারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দাঙ্গা নাকি শুধুই নির্যাতন এটি ঘটনা পরবর্তী তথ্যসমূহ যাচাই করলে কিছুটা বোঝা সম্ভব।

প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দাঙ্গার শুরু হয় একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। রোহিঙ্গা অধিবাসীদের একটি দল রাখাইন একজন সন্ন্যাসিনীকে গণধর্ষণ এর পর হত্যা করলে রাখাইন সম্প্রদায়ের মাঝে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আর এর পেছনে অনুঘটকের কাজ করে বহুদিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। এই ঘটনাটি কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে সংঘটিত হলে এই দাঙ্গা হয়তো সূচনাই হতোনা। কিন্তু সংঘর্ষপ্রবণ দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ঘটনাটি বিস্ফোরক হিসেবে কাজ করে এবং উভয়পক্ষের মাঝে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই দাঙ্গায় একইসাথে উভয়পক্ষই আক্রান্ত হয়। মায়ানমার সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই দাঙ্গায় ৮৮ জনের মৃত্যু হয়, এর মাঝে ৫৭ জন মুসলিম এবং ৩১ জন বৌদ্ধ। ৯০,০০০ হাজার মানুষ স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ২,৫২৮টি বসতি আগুনে ভস্মীভূত হয়। এর মাঝে ১,৩৩৬টি বসতি রোহিঙ্গাদের এবং ১,১৯২টি রাখাইনদের।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই অনুমেয়, কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় এই দাঙ্গায় এককভাবে ক্ষতিগ্রস্থ নয়। বরং এই সহিংসতায় উভয়পক্ষেরই মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়েছে। বৈষয়িক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই দাঙ্গার শিকার উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই কোন একপক্ষের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করা মানে অন্য আরেকটি পক্ষের প্রতি অমানবিক আচরণ।

তাই আরাকান প্রদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাটি একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লক্ষনীয়, এই ঘটনার সাথে বাংলাদেশের কোন নাগরিক, সে যে সম্প্রদায়ের হোক না কেন, কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নয়।

রামু,পটিয়া,উখিয়াতে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলো যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, এটাও প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে বোঝা সম্ভব।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন বৌদ্ধ যুবককে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিতে যুক্ত করা হয় একটি গ্রুপ থেকে। যার জন্য ঐ যুবক নিজে কোনভাবেই দায়ী নন। কিন্তু এতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম ধর্মালম্বী সম্প্রদায়ের মাঝে। আপাতভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকা এই দুই সম্প্রদায়ের মাঝে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সূচনা হয়।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, রামুতে আক্রান্ত সম্প্রদায় হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা। প্রায় ১০টি গ্রামে, তাদের ১০টি প্যাগোডা এবং ৪০টি বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। ভাংচুর হয়েছে শতাধিক বসতি। বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সাথে একইসাথে বসবাস করা আর অন্য কোন সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়নি। এমনকি এই হামলায় কারো প্রাণহানির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আগুন জ্বালানোর আগে প্রত্যেকটি বাড়ি থেকে সম্পদ লুট করা হয়, প্যাগোডা থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় সোনার গৌতম বুদ্ধের মূর্তি ও দামি অন্যান্য সামগ্রী। সুচারুভাবে সম্পন্ন করা এই হামলা পর্যবেক্ষণ করে প্রায় সকল মাধ্যম একে পূর্বপরিকল্পিত বলে ঘোষণা করেছে।

রামুর ঘটনাটি যেই রাতে সংঘটিত হয় তার পরের দিন মধ্যাহ্নে হামলা হয় পটিয়াতে। এই হামলায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সাথে আক্রান্ত হয় সনাতন ধর্মালম্বীরাও। বেশ কয়েকটি প্যাগোডা এবং মন্দির ধ্বংস করা হয়, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় বসতিতেও। পটিয়াতে এই হামলার জন্য আগের থেকে কোন উত্তেজনা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা না থাকলেও এই নির্যাতনের শিকার হয় বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

এরপরে হামলা হয় উখিয়াতে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরের ভিত্তিতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপরে এই হামলা করে তাদের মুসলিম প্রতিবেশীরাই। এতেও বেশ কয়েকটি প্যাগোডা এবং বসতিতে আগুন জ্বালানো হয়।

এই তিনটি ঘটনাতেই কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, ঘটনার সাথে জড়িত ছিলো বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলগুলোতে স্থান নেয়া রোহিঙ্গারা। শুধু তাই নয়, অনেকেই এই নির্যাতনের ঘটনাটিকে, মায়ানমারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিশোধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রামুতে দাঙ্গাকারীদের মাঝে প্রায় হাজারখানেক এর বেশি সংগবদ্ধ রোহিঙ্গার জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে পটিয়াতে যেখানে সনাতন ধর্মালম্বীদের স্থাপনাতেও হামলা হয়েছে তাই এই ঘটনাটি শুধুই মায়ানমারের ঘটনায় বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা এটা যুক্তিযুক্ত অনুমান নয়।

এই অঞ্চলগুলোতে যা হয়েছে তা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। এই ঘটনায় আক্রান্ত সংখ্যার দিক থেকে দুর্বল সম্প্রদায়্ভুক্তরা এবং ক্ষতিগ্রস্তও এরাই। বিনা উস্কানিতে এই ঘটনা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এবং আক্রমনাত্মক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।


রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শরণার্থী হিসেবে সমস্যা :

১৯৭৮ সালে, মায়ানমার সৈন্যবাহিনীর "নাগামিন" অপারেশনের মাধ্যমে নির্যাতিত ও নিহত হওয়ার ভয়ে প্রায় ২,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। "নাগামিন" এর মূল লক্ষ্য ছিলো এথেনিক ক্লিনসিং। তাই সরকার কর্তৃক বিতারিত হয়ে যেসকল রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের পক্ষে মায়ানমার আবার ফেরত যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপরে ১৯৯১-১৯৯২ সালের সময়, মায়ানমার সরকার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আবার অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরবর্তিতে জাতিসংঘের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ-মায়ানমার সরকারের প্রতিনিধিদলের সিদ্ধান্তে কিছু সংখ্যক শরণার্থী মায়ানমার পুনঃপ্রবেশ করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতেই থেকে যায়।

এখন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে প্রায় ৫,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। ১৯৯১-৯২ সালে এদেশে আসা শরণার্থীদের অনেকেই দেশে ফেরত গেলেও যারা এখানে থেকে গেছে তাদের মাঝে মাত্র ৩০,০০০ নথিভুক্ত। বাকি প্রায় ২,০০,০০০ নথিভুক্ত নয়। তাই জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এই নথিভুক্ত শরণার্থীরাই কক্সবাজারের কুতুপালং এবং নয়াপাড়া এই দুটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। বাকিদের ব্যাপারে তথ্য অপ্রতুল।

এছাড়াও থাইল্যান্ড-মায়ানমার সীমান্তের থাইল্যান্ড শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১,১১,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু শরণার্থী বিক্ষিপ্ত ভাবে সমুদ্র থেকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের জাহাজের মাধ্যমে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়। এখানে লক্ষনীয় যে, থাইল্যান্ড এ সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী, তাই রোহিঙ্গা মাত্রই বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের প্রতিহিংসার শিকার এই অভিযোগ যারা করে তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আরাকানে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তা শুধু বৌদ্ধ রাখাইন আর মুসলমান রোহিংগাদের মাঝেই নয়, আছে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মাঝেও। সামরিক সরকারের অন্যায় অবিচারের অধীনে থাকা এই বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলো প্রায়ই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংখ্যালঘু হিসেবে শুধু রোহিঙ্গারাই নয় কোকাং, পানথে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকজনও সামরিক জান্তার নির্বিচারে নির্যাতনের শিকার। এই পরিস্থিতিকে শুধুমাত্র, মুসলমান-বৌদ্ধ অথবা ধর্মীয় বৈরিতা দিয়ে বিবেচনা করা অযৌক্তিক।

বছরের পর বছর ধরে বিপুলসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সরকার নিজেদের জনগোষ্ঠিকেই ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সক্ষম নয়। তার উপরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হচ্ছে সবক্ষেত্রে। এরই মাঝে পাঁচ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেশে রাখা সরকারের জন্য সকল দিক থেকেই অসুবিধা। তার পরেও নানা সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে মায়ানমার সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকার সবসময়ই অনমনীয় আচরণ করেছে এবং দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কখনোই সম্মত হয়নি। এছাড়াও প্রতিবছর মায়ানমার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই বাংলাদেশের দুর্গম অঞ্চলগুলো দিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবারকে এদেশে পুশ করার চেষ্টা চালিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। তাই শুধুমাত্র আপদকালীন সময়েই নয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে সবসময়। রোহিঙ্গা শরণার্থী তাই বাংলাদেশের জন্য একটি লাগাতর সমস্যা। আর এর সমাধানে মায়ানমার সরকার এর কোন সদিচ্ছা নেই। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সামরিক শক্তি দিয়ে সীমান্ত অঞ্চল তটস্থ রেখেছে যাতে কোন রোহিঙ্গা এদেশ থেকে আবার ফেরত যেতে না পারে।


রোহিঙ্গা সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত সমস্যা :

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন এর ব্যবস্থা এদেশে অপ্রতুল। যেখানে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ জনসংখ্যা বেকার তাই সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগটিও নগন্য। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মানবেতরভাবে তাই জীবন কাটাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। তারপরেও প্রতিমাসে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নিয়মিতই অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। কিন্তু এই দুর্দশাই পুরো চিত্র নয়।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকেই পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে নানা ধরনের অপকর্মের সাথে সরাসরি জড়িত। এই অঞ্চলগুলোর দুর্গম স্থানে শিবির স্থাপন করে অনেক রোহিঙ্গাই সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করছে। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ, হত্যা থেকে শুরু করে অপরাধের নানা শাখায় বিশেষ করে মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালানে রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা তাই বহুদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো নানাধরনের অস্ত্রের সহজলভ্য জায়গা। মাদক এবং অস্ত্র/বিস্ফোরক এই দুই ব্যবসায় এসব শিবিরের অনেকেই জড়িত। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনায় রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার প্রমান প্রায় সময়েই পত্র-পত্রিকায় নজরে এসেছে।

এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিকতম সময়ের নানা অভিযানে আটককৃত জঙ্গিদের অনেকেই রোহিঙ্গা এবং তারা দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এই বিষয়ে নানা তথ্যের ভিত্তিতে প্রমান পাওয়া গেছে, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাহায্যে তারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং আরাকান নিয়ে তারা স্বতন্ত্র একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। পাহাড়ের দুর্গম সব জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করে তারা উন্নত অস্ত্র এবং বিস্ফোরকের মাধ্যমে প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করিয়েছে কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন। তাদের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনেক রোহিঙ্গা গেছে। সেখানেও নানা অপরাধ করে তারা ধরা পড়েছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এবং শ্রমিক রপ্তানি।

বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সক্রিয় এ সম্প্রদায় বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে এটাই প্রমান করেছে যে, শরণার্থী হিসেবে তাদের স্থান দিয়ে এদেশের মানুষ এবং সরকার ভুল করেছে। তাই এবার পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় মানুষেরা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের সাথে রাত জেগে পাহাড়া দিয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের রুখতে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ এখন আর স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দেয়া হলেও তারা এর প্রতিদানে শুধু এদেশের সামাজিক ক্ষতি করেই ক্ষান্ত হয়নি, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। হয়তো এই গোষ্ঠির সবাই এতে জড়িত নয় কিন্তু তারপরেও সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এখন বাংলাদেশের জন্য একটি হুমকি।


সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সাথে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা :

রামু,পটিয়া এবং উখিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নির্যাতনের সাথে প্রতক্ষ্যভাবে জড়িত ছিলো রোহিঙ্গারা। তারা লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ এসব কিছুর সাথেই জড়িত। শুধু তাই নয়, উস্কানিমূলক সমাবেশের জন্যও এরা দায়ী। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ তাদের প্রাণ নাশের হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ কোম্পানির হাজারখানেকের বেশি সিম সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের কাছে চলমান। আর এসব সংযোগ ব্যবহার করে অনেকদিন ধরেই তারা চোরাচালানের মতো নানাবিধ দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে সশস্ত্র হামলায় মদদ দিয়ে এইসব সংযোগ থেকেই আবার হুমকি দেয়া হচ্ছে আক্রান্তদের, যাতে তারা কোন তথ্য সরকারী সংস্থাকে না দিতে পারে। এহেন কর্মকান্ড শুধুমাত্র আপত্তিকরই নয়, আতঙ্কের। স্বাধীন দেশের ভূখন্ডের নাগরিকদের একটি ভিন্ন দেশের নাগরিকরা হামলা করছে, নির্যাতন করছে, লুন্ঠন করছে তার উপরে প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করছে, এসকল কর্মকান্ডই বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত সংখ্যালঘু বৌদ্ধ এবং সনাতন কোন ধর্মালম্বীর মানুষই রোহিঙ্গাদের প্রতি কোনধরনের নির্যাতনের জন্য দায়ী নয়। এমনকি সাম্প্রতিক সহিংসতায়ও কোন ধরনের প্রতিরোধ এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষগুলো করতে পারেনি। তার পরেও এদেশীয় সাহায্যকারীদের মদদে মায়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের হাজারখানেক সদস্য যখন বাংলাদেশী জনগনকে নির্যাতন করে তখন সেটি আর শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটি একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই সাধারণ বিষয়টি এদেশের মানুষকে বুঝতে হবে।

এদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকদিন ধরেই একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী স্থানীয়ভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এদেরকে দেশের নাগরিক হিসেবে নথিভুক্ত করার একটি অপচেষ্টা চলছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকেও এই দাবি উঠেছে যে তাদের বাংলাদেশে বসবাসের অনুমতি দেয়া হোক এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। আর এই ধরনের কর্মকান্ডের পেছনে মদদ রয়েছে চিহ্নিত একটি রাজনৈতিক দলের। তাহলে, ঘটনাচক্রে এই পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতন কি এইসব রোহিঙ্গাদের এই অঞ্চলগুলোতে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসার জন্য একটি শো-ডাউন কিনা সেটার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা।

আজকে যে কারণেই এই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হোক না কেন, সেখানে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহন দেশের সামাজিক পরিস্থিতির চরম অবনতিকেই নির্দেশ করে।


বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতন :

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায় নানাভাবে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই ঘটনাগুলো কোনটাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয় বরং একপেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। আর নির্যাতনের হাত থেকে কেউই মুক্ত নয়। ৯০ এর দশকে সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মালম্বীদের প্রতি নির্যাতন, তারপরে ২০০১ সালের পরবর্তী সরকারদলীয় সমর্থিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতন এসবই এর প্রমান। শুধু তাই নয়, এই বছরে ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন ঘটনায়, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর এবং সর্বশেষ রামু, পটিয়া, উখিয়া এদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের জ্বলন্ত উদাহরণ। এই নির্যাতনগুলো একপাক্ষিক এবং এতে আক্রান্ত সম্প্রদায় সংখ্যালঘুরা।

ঘটনা শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়, আদিবাসী, বাউল, আহমদিয়া ইত্যাদি নানা সম্প্রদায় এদেশে নানাভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ঘটনাগুলো একটি দেশের সামাজিক পরিস্থিতির জন্য হুমকিস্বরূপ। নানা জাতি-বর্ণ-সংস্কৃতির মিশ্র এই সমাজ ব্যবস্থায় কতিপয় ধর্মান্ধ উন্মাদ কর্তৃক এসমস্ত নির্যাতন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির আবহের বিরুদ্ধে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

বিভিন্ন সময় এসমস্ত নির্যাতনের প্রতিবাদকারীদের প্রায়শই কিছু যুক্তির মুখোমুখি হতে হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি নির্যাতনের সাথে এদেশের নির্যাতনকে এক করে অনেক সময়ই জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষদের এটা ভুলে গেলে চলবেনা, একটি দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনার দায় সমানভাবে সকল নাগরিক এর উপরেই বর্তায়। শুধু তাই নয়, এটি সমাজের অস্থিতিশীল একটি অবস্থাকে উন্মোচন করে এবং সম্প্রীতির সমাজকে সহিংসতার দিকে ধাবিত করে। আর এই সহিংসতার কবল থেকে আপাতদৃষ্টিতে কেউ কেউ নিরাপদ হলেও অদূর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করলে আসলে কেউই নিরাপদ নয়। যখন একটি মৌলবাদী সমাজের উত্থান হয় তার রেশ শুধু সংখ্যালঘুদের উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এর রেশ পড়ে সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার উপরে।

তাই সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিকে কোন যুক্তিতেই হালকা ভাবে দেখার অবকাশ নেই। এদেশের সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থলের ক্ষতিসাধন, তাদের মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটছে। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ভবিষ্যতে শুধু এতেই আবদ্ধ থাকবেনা, আস্তে আস্তে আক্রান্ত হবে অন্যান্যরাও। মৌলবাদী ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠির উত্থান কখনোই কারো জন্য সুফল বয়ে আনেনা, আনতে পারেনা। তাই এই ঘটনাগুলোকে ভাবার সময় এখনই।

----------------------------------------



সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন ঘটে চলা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, দেশে মৌলবাদী এবং উন্মাদ একটি মানসিকতার উত্থান নির্দেশ করে। অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত কিংবা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার এই শেকড় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সমাজের সকল স্তরেই, পরিকল্পিতভাবে। প্রায়শই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বুঁদ হয়ে উন্মত্ততায় মেতে উঠা একটি জনগোষ্ঠির আচরণ যখন স্বাভাবিক হয়ে উঠে তখন বোঝা উচিত সমাজের ভারসাম্য হুমকির মুখে। সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে যখন ধর্মান্ধতাই মূল হয়ে উঠে তখন সমাজব্যবস্থার প্রতি নাগরিকদের গভীর মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বৈকি। এই অস্থিতিশীল সময়ে যেকোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়ানোর জন্য সাধারণ নাগরিকদেরই প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখা উচিত, মৌলবাদী মনোভাব কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়।


তথ্য কৃতজ্ঞতা-

দৈনিক জনকন্ঠ
দৈনিক প্রথম আলো
বিডিনিউজ ২৪
বাংলানিউজ ২৪
উইকিপিডিয়া

তিনটি প্রাসঙ্গিক লেখা-

রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, জঙ্গি তৎপরতা এবং বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক একটি পরিস্থিতি
আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী





















Monday, October 1, 2012

আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী


২০০১

২০০১ সালের এক সকালে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ আর ভারী পাথর গড়িয়ে পড়ার প্রচন্ড শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল আফগানিস্থানের বামিয়ান প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চল।

ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন তালিবান সরকারের উগ্রপন্থীরা সেদিন সকালে বিস্ফোরক দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল যথাক্রমে ১৮০ ফুট ও ১২১ ফুট উচ্চতার, পাথর কুঁদে তৈরী করা

হাজার বছরের পুরনো দুটো বৌদ্ধমূর্তি। এই দুটো সুউচ্চ প্রস্থরমূর্তি ছিলো আফগানিস্থানে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। তালিবানরা ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা

এদুটো মূর্তিকে তাদের ধর্মবিরোধী স্থাপনা হিসেবে উল্লেখ করে ধ্বংস করতে তৎপর ছিলো। অবশেষে ২০০১ সালের মার্চের ২ তারিখ থেকে, শুরু হয় এই ধ্বংসযজ্ঞ।

এন্টিএয়ারক্রাফট গান, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক সবধরনের শক্তি প্রয়োগ করে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উন্মত্ত কিছু মানুষ (!!) ধ্বসিয়ে দিতে থাকে পাথরের মূর্তিগুলো।

শেষে ডিনামাইটের শক্তিতে স্থাপত্যগুলো পুরো ধ্বংস করে ক্ষান্ত দেয় তারা। এভাবেই ধর্মীয় উগ্রপন্থার শিকার হয়ে হারিয়ে যায় মানব সভ্যতার অত্যন্ত মূল্যবান দুটো

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

727px-Taller_Buddha_of_Bamiyan_before_and_after_destruction
[ছবিসুত্র উইকিপিডিয়া]

সেদিন কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অবমাননা হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে এটা সত্যি, অবমাননা হয়েছিল মানব সভ্যতার। যেই উন্নত সংস্কৃতি আর

কৃষ্টির জোরে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, সেদিন আর কিছুর না হোক, দুটো পাথরের নির্বাক-নিষ্প্রাণ মূর্তি ভেঙ্গে অপমান করা হয়েছিল তার। অপমান হয়েছিল

মানবিকতার।

২০১২

৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১২। কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে একদল ধর্মান্ধ উন্মাদ হামলা চালায় সে অঞ্চলের বৌদ্ধ বসতিগুলোতে।

গভীর রাতে এই হামলায় আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয় ৭টি বৌদ্ধ মন্দির এবং ৩০টি বাড়ি। ভাংচুর করা হয় আরও শতাধিক বসতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

ফেইসবুকে কোরআন শরিফ অবমাননা করে ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগ এনে শনিবার রাতে করা এই তান্ডবে কমপক্ষে ১০টি বৌদ্ধ গ্রামে হামলা চালিয়ে বসতভিটায় আগুন

জ্বালিয়ে দেয়া হয়, লুটপাট করা হয়।

IMG649TM
ছবিসূত্র

ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। রামুর পর পটিয়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালায় ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। রোববার বেলা ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে এই হামলায় দুটি হিন্দু

মন্দির ও দুটি বৌদ্ধ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত করে হামলাকারীরা। তবে এই অঞ্চলে ঠিক কে, কাকে, কিভাবে, অবমাননা করলো সে বিষয়ে কোন খবর নেই কারো কাছে! তবে

হামলা যখন হয়েছে, ধরে নিতেই হচ্ছে কারো অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। এভাবেই আজকাল বড় নাজুক মানুষের এই ধর্মীয় অনুভূতি।

727px-Taller_Buddha_of_Bamiyan_before_and_after_destruction

তবে এতোগুলো ধর্মীয় স্থাপনা ভেঙ্গে, এতো মানুষের ঘর পুড়িয়ে দেয়ায়, আক্রান্ত মানুষগুলোর কারো কোন অনুভূতিতে আঘাত নিঃশ্চয় হয়নি, একথা আমি হলপ করে বলতে

পারি। সংখ্যালঘুদের অনুভূতি আঘাতপ্রুফ। এতো সহজে তাতে আঘাত লাগেনা। তবে অন্য কারো মানবিক অনুভূতিতে আঘাত লাগলো কিনা সেটা একটা প্রশ্ন বটে। নাও

লাগতে পারে, সংখ্যালঘুরা কি মানুষ?


২০০১

এবার আবার ২০০১। তবে এবার বাংলাদেশ। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই দলবেধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্ত উগ্রপন্থীরা। গ্রামের পর গ্রাম চলে

অগ্নি-সংযোগ, হত্যা, লুন্ঠন, গণধর্ষণ, নির্যাতন।১১ বছর আগের হলেও এরকম কয়েকটি ঘটনা মনে গেঁথে আছে।

গভীর রাতে প্রায় ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল এমনি একটি গ্রামের ঘরে প্রবেশ করে। তিন সদস্যের ঐ ঘরে বাবা-মাকে বাইরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের অল্পবয়সী

মেয়ে সন্তানটিকে ধর্ষণ শুরু করে। সেসময় মেয়েটির মা সন্ত্রাসীদের কাছে হাতজোড় করে যেই কথাটি বলেছিল, "বাবা তোমরা একজন একজন করে যাও, আমার মেয়েটা

এখনও ছোট......।" ঠিক কতোটা অসহায় হলে সন্তানের জন্মদাত্রী মা এই অনুরোধ করতে পারেন সেটা আমার জানা নেই।

আরেকটি ঘটনায় গান-পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল একটি ঘরে। বের হতে দেয়া হয়নি ঘরের একজন সদস্যকেও।

একগ্রামে পালাক্রমে নির্যাতনের শিকার হয় শাশুড়ি-পুত্রবধু। অপমান সইতে না পেরে পরের দিন সকালে আত্মহত্যা করে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।

পূর্ণিমা নামের সিরাজগঞ্জের উল্ল­াপাড়ার মেয়েটিকে এভাবেই দলবেধে নির্যাতন করেছিল কিছু পশু। বহুল আলোচিত এই ঘটনাটি সেসময়ের অসংখ্য ঘটনাগুলোর মাত্র একটি।

এরপরে দেশ ছেড়ে, নিজের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকে। সাথে করে নিয়ে গেছেন কিছু দুঃসহ-অবর্ণনীয় স্মৃতি। পার হয়ে গেছে ১১টি বছর। সময় খুব দ্রুত হারিয়ে

যায়। মুছে যায়না শুধু ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো।

২০১২

সরকার বদল হয়েছে। বদল হয়েছে অনেক কিছুই।

বদল হয়নি সংখ্যালঘুদের জীবনচিত্র। তাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সাতক্ষীরা আর দিনাজপুরে পুড়েছে তাদের ঘর, ভেঙ্গেছে তাদের উপাসনালয়, লুট হয়েছে তাদের সম্পদ।

শিক্ষিকার একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তানকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছে উগ্রপন্থীরা। একজন প্রতিবন্ধী শিশুকে!!

সংখ্যালঘুরা তাই আবারও ঘর ছেড়েছে। পালিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। যেভাবে তাদের আশেপাশের অনেকেই পালিয়েছিলো অতীতে। পেছনে পড়ে রয়েছে ঘরের ভাঙ্গা টিনের

চাল, কিছু হাড়ি-পাতিল আর দীর্ঘশ্বাস।

_________________________________________________________________________________________

____________

পত্রিকায় সংবাদ, এদেশে ১০ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমেছে ৯ লাখ। আসলে বাস্তবতায় সংখ্যাটা আরও বেশি। এটা আমরা জানি। জেনেও চুপ থাকি। কারণ

চুপ থাকাটাই স্বাভাবিক, এসব বিষয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়না। সংখ্যালঘুদের দেশান্তরের হার বেশি। এরা কোথায় যায় আর কেনই বা যায়? কারনটা সবাই জানি, কিন্তু

বলা বারণ। সব কথা বলতে হয়না।

এদেশে মানুষ "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা" কথাটা অহরহ ব্যবহার করে। এদেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়না, হবেও না। দাঙ্গায় মারে দুইদলই, মরেও দুইদলই। কিন্তু এদেশে মারে

একদল, মার খায় আর মরে আরেকদল। তাই এদেশে হয় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। আর এই নির্যাতন সবসময় হয়েছে। গনিমতের মাল হিসেবে নির্যাতন করেছে পাকিস্তানিরা,

এরপরে করেছে স্বদেশীরা। শুধু হাত বদল। নির্যাতনের কথা উঠলেই নানা ষড়যন্ত্রের কথা এসেছে, এসেছে রাজনৈতিক পালা বদলের কথা। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা অহেতুক,

কিছু সংখ্যায়-শক্তিতে দুর্বল মানুষকে নির্যাতন করতে কোন কারণ লাগেনা। তাদের দুর্বলতাটাই যথেষ্ট বড় কারণ। লাগে শুধু একটু উস্কানি। আর এই দেশে উস্কানির অভাব

হয়না। নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোতে ওস্তাদ এদেশের মানুষ। তাই কোন মহাদেশের কোন চিপায় কোন অবমাননা হলেই হলো, হাতের ঝাল মেটাতে দলবেধে নেমে

পড়ে। আর এরজন্য সব থেকে ভালো টার্গেট আর কি হতে পারে?

এই নির্যাতনের শেষ হবে না, তাই সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে পালাবে। এটা স্বাভাবিক। তবে আমার চিন্তা অন্যখানে, একদিন দেশে সংখ্যালঘু নামক সম্প্রদায় থাকবেনা। সবাই

সংখ্যাগুরু। তখন কাদের বাড়ি পোড়ানো হবে, কাদের খুন করা হবে, কাদের স্ত্রী-সন্তানকে গণধর্ষণ করা হবে?


লেখার শুরুতে আফগানিস্থানের ঘটনাটা কেন লিখলাম? কেউ যদি দুই দেশের ঘটনাচক্রের মাঝে কোন মিল খুঁজে পেয়ে থাকেন তাহলে সেটা হয়তো কাকতাল মাত্র। আমার

শুধু মনে হয়, ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্য কোন নির্দিষ্ট দেশের প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন হয় মানুষরুপী কিছু ধর্মান্ধ পশু আর কিছু নিঃশ্চুপ মেরুদন্ডহীন মানুষের।


একটা প্রিয় উক্তি আছে আইনস্টাইন বুড়োর-
“The world is a dangerous place to live, not because of the people who are evil, but

because of the people who don't do anything about it.”