Tuesday, June 19, 2012

মঙ্গলে মনুষ্য বসতি: মিশন ২০২৩ !!


বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনীগুলোতে তো হরহামেশাই মানুষ এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যাতায়াত করে, আবার স্টিভেন স্পিলবার্গের চলচ্চিত্রে নতুন গ্রহে মনুষ্য বসতি স্থাপন করার গল্প দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আমাদের সবারই। পৃথিবীর বাইরে আমাদের সৌরজগত এর অন্যান্য গ্রহ নিয়ে আমাদের আজন্ম আগ্রহ। এমন কেউ নেই যার জীবনের কিছুটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখে কাটেনি। কল্পনার পাখা মেলে আমরা ওই অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে কতো জিনিস নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি। চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার পর থেকেই জল্পনাকল্পনার শুরু, আবার কবে যাচ্ছে মানুষ নতুন আরেকটি গ্রহে। সায়েন্স-ফিকশন এর পাতা থেকে উঠে এসে কবে সত্যি হচ্ছে অন্য গ্রহে মনুষ্য বসতি স্থাপনের চিন্তা। মানুষ কবে শুরু করবে আন্তঃগ্রহ সমাজ ব্যবস্থা কিংবা কবে আমরা এই ঘুরে আসি বলে টুক করে প্যারিস ঘোরার বদলে চলে যাবো মঙ্গলে!!

তবে মনে হচ্ছে অপেক্ষার দিন ফুরোলো। হ্যাঁ, এরকমই আভাস দিয়েছেন "মার্স-ওয়ান" এর হর্তাকর্তারা। অন্য গ্রহে মানুষ পাঠিয়েই ক্ষান্ত দিতে চাইছেন না তারা, সরাসরি প্রস্তাব করেছেন বসতি স্থাপনের!! নাম দেখে এতক্ষণে নিঃশ্চয়ই ধারণা হয়ে গেছে তাদের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে। হ্যাঁ, আমাদের পৃথিবীর মানুষের সাধের "লাল গ্রহে" প্রথম মনুষ্য বসতি স্থাপনের বিশাল দক্ষযজ্ঞে হাত দিয়েছেন তারা। শুধু হাত দেয়া বললে ভুল হবে, গোপনে গোপনে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছেন। এবার মনে হয় মঙ্গল গ্রহে মানুষের পা পড়লো বলে!!

MARS One

["মার্স-ওয়ান"]

কল্পবিজ্ঞানের এই স্বপ্নকে সত্যি করতে এগিয়ে এসেছেন ডাচ উদ্যোক্তা ল্যান্সডরপ। এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোক্তার সাথে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন স্বপ্নবাজ মানুষ। যাদের নিয়ে "টিম মার্স-ওয়ান"। এরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন ১৯৯৯ সালের নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ প্রফেসর জেরার্ড। এরা সবাই মিলে হাতে নিয়েছেন ৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাজেটের একটি আকাশছোঁয়া (মঙ্গলছোঁয়া !!) স্বপ্ন। তাদের লক্ষ্য ২০২৩ সালে মঙ্গলের লাল মাটিতে মানুষ পাঠানো।

তবে এর আগেও যে এধরনের প্রস্তাব করা হয়নি তা নয়। ২০০৮ সালে নাসার প্রকৌশলী ম্যাকলেন এরকমই একটি উদ্যোগের কথা জানান। তবে তিনি চেয়েছিলেন শুধু একজন মানুষকে মঙ্গলে পাঠাতে। তার এই মিশন নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও পরবর্তিতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কথা চিন্তা করে এটি বাতিল করা হয়। ম্যাকলেনের এই অসম্পূর্ণ স্বপ্নকেই যেনো বাস্তবে রূপ দিতে নেমেছেন "মার্স-ওয়ান" এর সদস্যরা।

এরই মাঝে, ২০১১ সালে থেকে শুরু হওয়া এই গোপন প্রজেক্টে অনেকটা দূর অগ্রসর হয়েছেন তারা। যোগাযোগ করেছেন বেশ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার সাথে। তাদের সাথে ইতিমধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের। তারা বলছেন, কোনো নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়বেনা এই মিশনে। বর্তমানের প্রচলিত মহাকাশ অভিযানের বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এই কাজ সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর তাদের সংস্থা "মার্স-ওয়ান"। আর এই বিশাল বাজেটের কাজটির জন্য অর্থ যোগানের এক দারুন পদ্ধতিও হাতে আছে তাদের। এই মঙ্গল অভিযানের জন্য অভিযাত্রী বাছাই হতে শুরু করে শেষপর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি "রিয়ালিটি শো" এর মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন তারা। আর পুরো ১০ বছরের এই টিভিশো তে মঙ্গল অভিযানের শ্বাসরুদ্ধকর সব খুঁটিনাটি দর্শক ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারবেন আর তার সাথে সাথে বিপণনস্বত্ব থেকে প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও উঠে আসবে আরামসে। তাই বলতে গেলে পৃথিবীর সব থেকে উত্তেজনাকর টিভি রিয়ালিটি শো এর শুরু হলো বলে!! একই সাথে দুইটি পাহাড় সমান মিশন হাতে নিয়ে এরই মাঝে প্রচার মাধ্যমে বেশ সারা ফেলে দিয়েছে "মার্স-ওয়ান"। রিয়ালিটি শো এর দুনিয়াতে এবার বাকিদের অবস্থা দেখার বিষয় হয়ে দাড়াবে বৈকি।

mars_on_lander_580x343

[অবতরন দৃশ্য]

তবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে অভিযানের বিষয়টি কখনই সহজ ছিলোনা। এখনো নেই। বরং বেশ কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখে দাড়িয়ে আছে এটি। এর মাঝে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মনুষ্যবাহী মহাকাশযান কিভাবে মঙ্গলের হালকা ঘনত্বের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে এবং একই সাথে কি করে মাটিতে অবতরণ করবে, এই বিষয়ে কোনো সমাধান এখনো আলোর মুখ দেখেনি। নয়তো এতদিনে হয়তো আরও অনেকেই আগ্রহ দেখাতো এই বিষয়ে, তাই দেখা যাচ্ছে গোড়াতেই আটকে যাওয়ার অবস্থা। মহাকাশযান অবতরন নিয়ে এত ঝামেলার কারণগুলো একটু দেখা যাক।

মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক কম। তাই কোনো মহাকাশযান পৃথিবীতে ফেরত আসার সময় যেমন করে বায়ুমন্ডলের ঘনত্বের কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার গতিরোধ হয় এবং পরবর্তিতে প্যারাসুট এর সাহায্যে কিংবা রকেট প্রপালশন এর সাহায্যে মাটিতে নেমে আসে, সেরকম করে সম্ভব নয়। বরং তীব্র গতির এই মহাকাশযান যখন মঙ্গলে অবতরণ করতে যাবে তা অন্তত ১০ গুন বেশি গতিতে মাটিতে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই বিষয়টি নিয়ে ২০০৪ সালে নাসা কর্তৃক আয়োজিত সভাতে বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত সব কয়টি পদ্ধতিরই কোনোনা কোনো সমস্যা থেকে যায়।

যদি অবতরণের জন্য এয়ারব্যাগ ব্যবহার করা হয় যা কিনা মহাকাশযানটিকে একটি আপাত ভারসাম্যপূর্ণ এবং সংরক্ষিত অবস্থানে নামিয়ে আনবে তাতেও সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত মানুষ বহনকারী যানের ওজন অনেক বেশি হবে এবং এতটা ওজনের মহাকাশযান এরকম তীব্র গতিতে যখন অবতরন করবে, মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের কম ঘনত্বের জন্য কোনো এয়ারব্যাগই এর পতন রোধ করতে সক্ষম হবেনা। এছাড়াও যখন মানুষকে বাসস্থান তৈরির উপযোগী সব কিছু বহন করে নিয়ে যেতে হবে তখন সেই মহাকাশযানের ওজন কোনভাবেই ১০ মেট্রিক টনের কম হবেনা যা এয়ারব্যাগ দিয়ে অবতরণের জন্য অকল্পনীয় একটি ওজন। পূর্বে যেসব মিশনে রোবট পাঠানো হয়েছিল তার মাঝেও প্রায় ৬০ ভাগ ব্যর্থ হয় শুধু মাত্র এই অবতরণজনিত সমস্যার জন্য।সেখানে মহাকাশযান কিংবা রোভারের ওজন ছিলো এর তুলনায় অনেক কম।

এছাড়াও প্যারাসুট ব্যবহার করার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু এখানেও সমস্যা, একে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল যথেষ্ঠ কম ঘনত্বের। এর উপরে নামার সময় হঠাৎ বাতাসে জায়গা পরিবর্তন হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এতে অবতরণের জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় নামলে পুরো যানটি আবার আসল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা। আর তাতে যা জ্বালানি খরচ হবে তা চন্দ্রাভিযানের কয়েকগুন বেশি। আর এই ভারী জ্বালানি পৃথিবী থেকে মঙ্গল পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়া কোনো ভাবেই সমাধান হতে পারেনা। এছাড়াও এই বিশাল ওজনের যানটি মাটিতে অবতরণের আগে ঠিক কয়েক মিনিট সময় পাবে প্যারাসুট খোলার। তাতে যে পরিমান চাপ আসবে প্যারাসুটের উপর তাতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক। এছাড়াও সঠিকভাবে যদি অবতরন করতে হয় তাহলে অন্তত ১০০ মিটার পরিধির সুপারসনিক প্যারাসুট প্রয়োজন, যা কিনা সঠিক ভাবে খুলে কাজে লাগতে লাগতে মাটিতে আছড়ে পড়বে অভিযাত্রীরা।

হিট শিল্ড এবং থ্রাস্টার ব্যবহার করে অবতরণের কথা চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু রকেট প্রপালশন একটি অতি বিপদজনক পদ্ধতি। এই অস্থিতিশীল পদ্ধতিতে নামার জন্য বিপুল পরিমানের জ্বালানি প্রয়োজন এবং তাও প্রচন্ড তাপ ও গতিতে নির্গত হবে মহাকাশযান থেকে। এই পদ্ধতিতে যেকোনো মুহুর্তে এরকম ভারী মহাকাশযানের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শতভাগ। এছাড়াও প্রপালশন এর জন্য যে পরিমান প্রচন্ড চাপ ও ঝাকুনি সৃষ্টি হবে তাতে যানটি নামার আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ ভাগ। কিন্তু যদি প্যারাসুট, হিট শিল্ড এবং থ্রাস্টার ব্যবহার করা হয় তাহলে একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু আবার ওই প্যারাসুট ঠিকমত কার্যকর হওয়া নিয়ে সমস্যা এতে লাঘব হয়না।

পরবর্তিতে সুপারসনিক ডিএক্সিলারেটর কিংবা স্পেস এলেভেটর ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়।কিন্তু স্পেস এলেভেটর এখনো একটি পরীক্ষাধীন প্রক্রিয়া। তাই এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো কিছু বলা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে অন্তত এই অভিযান এখনো সুদূর ভবিষ্যত। এছাড়াও তাদের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ হচ্ছে এর উচ্চ বাজেট। একটি প্রজেক্টেই ৬ বিলিয়ন ডলার দেয়ার মতো বাজেট নাসার কাছে নেই যখন এই প্রজেক্টের ফলাফল সম্পূর্ণ অনিঃশ্চিত।

কিন্তু তাই বলে থেমে নেই মার্স ওয়ানের সদস্যরা। তারা ইতোমধ্যে একটি রোড ম্যাপ দিয়ে দিয়েছেন। ২০১১ সালের মাঝেই তারা এই অভিযানের জন্য সকল প্রাথমিক প্রস্তুতি এবং ড্রয়িং চূড়ান্ত করেন। এরপরেই তারা বসেন পৃথিবীর বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা মহাকাশ অভিযানের জন্য উপাদান তৈরী ও সরবরাহ করতে প্রস্তুত। ২০১৪ সালে তাদের কাজ শুরু হবে যেসব উপাদান এই মিশনে পাঠানো হবে তাদের প্রস্তুতি নিয়ে। ২০১৬ সালে প্রথম সরবরাহ যানটি ২৫০০ কে.জি সামগ্রী নিয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে এবং সব কিছু ঠিক থাক থাকলে পূর্বনির্ধারিত জায়গার আশেপাশেই অবতরণ করবে। ২০১৮ তে একটি রোবট পাঠানো হবে মঙ্গলের মাটিতে মানুষ অবতরণের জন্য গ্রহনযোগ্য একটি স্থান খুঁজে বের করার জন্য। এই কাজটি পৃথিবীর মানুষ সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দেখতে পাবে ঘরে বসে। ২০২১ সালে মনুষ্য বসতি স্থাপনের উপযুক্ত সকল সামগ্রী নিয়ে কয়েকটি যান এবং রোভার মঙ্গলে অবতরণ করবে এবং অভিযাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করবে তাদের জন্য নির্ধারিত অবতরনস্থলে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে অভিযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুর প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে সম্পন্ন হলে ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ হতে যাচ্ছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এইদিনই মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পৃথিবী ছেড়ে যাবে চার জন অভিযাত্রীর একটি দল। দীর্ঘ সাত মাসের যাত্রা শেষে ২০২৩ সালে প্রথম মঙ্গলের মাটিতে পা পড়বে পৃথিবীর মানুষের প্রথম দলটির। এরপর ২০২৫ সালে পাঠানো হবে দ্বিতীয় দল। আর হ্যাঁ, ২০১৩ সাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে এই রোমাঞ্চকর অভিযানের জন্য অভিযাত্রী বাছাই এর কাজ। প্রথম ৪০ জন অভিযাত্রী সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে নেয়া হবে এরপর এদের নিয়ে শুরু হবে দীর্ঘ ১০ বছরের কার্যক্রম। এই ১০ বছরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা উতরে পৃথিবীর কয়েক কোটি উত্সুক দর্শকের সামনে শেষ পর্যন্ত থাকবে ৪ জন অভিযাত্রী। যারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে মনুষ্য বসতি স্থাপনের মতো একটি অসাধারণ মিশন সফল করতে যাত্রা করবে। এই মিশন সম্পর্কে সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এখানে

mars-one1

[মানুষের প্রথম মঙ্গল বসতি হবে কিছুটা এরকম]

এই মিশনে মহাকাশযান উৎক্ষেপনের জন্য মার্স ওয়ান ব্যবহার করছে স্পেস এক্স ফ্যালকন ৯ এবং অবতরণের জন্য ব্যবহার করছে স্পেস এক্স ড্রাগন। যদি অবতরণজনিত সব সমস্যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয় তাহলে আর মাত্র ১১ বছর পরেই মঙ্গল জয় করতে যাচ্ছে মানুষ। হয়তো সেই দিনটি সচক্ষে দেখার জন্য আমরা অনেকেই বসে থাকবো টিভি সেটের সামনে।

20080111_sunsetmoonrise

[স্পেস এক্স ফ্যালকন ৯]

SpaceX_Dragon

[স্পেস এক্স ড্রাগন]


আসলেই কি তাহলে কল্পবিজ্ঞানের সেই বহুবার পড়া গল্পগুলো সত্যি হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে? মানুষ কি তাহলে পৃথিবীর পরে তাদের দ্বিতীয় কলোনি স্থাপন করবে মঙ্গলে? একসময় কি মানুষ বেড়িয়ে আসার নাম করে ঘুরে বেড়াবে গ্রহ-গ্রহান্তরে? নাকি শুধুই আর একটি কর্পোরেট পলিসির বাস্তবায়ন দেখতে চলেছি আমরা? এই সকল প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আপাতত অপেক্ষা করতে হচ্ছে ২০২৩ সাল পর্যন্ত!

তাহলে আর দেরি কি? অভিযাত্রী বাছাইয়ে নাম লেখানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিক আগ্রহীরা। হয়তো আমাদের মাঝেই কেউ একজন প্রথমবারের মতো পা রাখবে মঙ্গলের লালচে রুক্ষ মাটিতে। তবে ব্যাগ গুছিয়ে দৌড় দেয়ার আগে আসল কথা বলতে ভুলেই গেছি, এই মিশনের আর একটি নাম হচ্ছে "ওয়ান ওয়ে ট্রিপ টু মার্স"। কারণ যারা পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে যাচ্ছে তাদের কেউই আর পৃথিবী ফেরত আসছেনা। তাদেরকে থেকে যেতে হবে ওই দুরের লালচে গ্রহটাতে মানব সভ্যতার পতাকা হাতে নিয়ে!!

শেষ করার আগে "মার্স-ওয়ানের" মনকাড়া এই ভিডিও প্রেজেন্টেশনটা দেখে নিলে মন্দ হবেনা।



Friday, June 15, 2012

রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান

কিছুদিন যাবৎ বেশ জোরেসোরে আলোচনা চলছে মায়ানমারে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে। এতে পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের এবং তাদের সরকারের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে যা ধারণা পেলাম তা হলো, অধিকাংশ ব্যক্তিই কোননা কোনোভাবে কিছু কিছু বাস্তব প্রেক্ষাপট এবং কারণ অগ্রাহ্য করে নিয়েই, নিজেদের অবস্থানে তর্ক করে চলেছেন। এতে করে পরিস্থিতির সামগ্রিক একটি ধারণা কারো বক্তব্যেই পাওয়া যাচ্ছেনা। বরং মনে হচ্ছে মায়ানমারে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে আক্রান্ত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকেদের আমাদের দেশে শরণার্থীর জায়গা দেয়া হবে কি হবেনা এই নিয়ে দুটি পক্ষ তৈরী হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যখন এই দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বার্থ ছাড়া গলার স্বর জোরালো করেননা, এই বিষয়টিতেও অনেকেই নিজেদের স্বার্থ খুঁজে নিয়েছেন। একইসাথে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের ধর্মের ভাই পরিচয় দিয়ে তাদের জন্য মায়া কান্নার আয়োজনে। তাই মনে হলো রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে একটি সামগ্রিক ধারণা নেয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে।

প্রথমেই এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, মায়ানমারের অন্তর্গত ভূখন্ডে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবস্থানজনিত সমস্যা নতুন নয়। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ একদম শুরু থেকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিলো। ইতিহাস ঘাঁটলে মায়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবস্থানজনিত ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়না। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজন একরকম দেশান্তর হয়ে বিভিন্ন সময়ে মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই দেশান্তরের পেছনের মূল কারণও স্বচ্ছ নয়। অনেকের ধারণা, স্বল্প ব্যায়ের জীবনযাত্রা কিংবা ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশে কাজের জন্য তত্কালীন বার্মায় স্থানান্তর। এছাড়াও একটি তথ্য প্রচলিত আছে রোহিঙ্গা ইতিহাসবিদদের মাঝে যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, এটি হলো, প্রাচীন আমলে আরব সওদাগরী জাহাজ আরাকানের নিকটবর্তী অঞ্চলে কোনো কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তিতে এই জাহাজের লোকেরা আরাকানের রাজার দয়ায় এখানেই থেকে যায় এবং এই আরব সম্প্রদায়ের লোকেরাই পরে কালক্রমে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত হয়। তবে "রোহিঙ্গা" এই শব্দটি কিভাবে এলো তা নিয়ে সদুত্তর এখনো পাওয়া যায়না। তবে এই বিষয়ে মোটামুটি সকল ইতিহাসবিদই নিঃশ্চিত যে, রোহিঙ্গারা প্রথম থেকেই স্থানীয়দের বৈরী ব্যবহারের শিকার। এর পেছনের কারণ একটাই যেহেতু তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ভুক্ত বাসিন্দা নয়। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের সেই সময়ের বাংলা থেকে অনেক বাঙালি সেই সময় কাজের জন্য আরাকান অঞ্চলে গমন করে, পরবর্তিতে এরাও রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনগণ ইসলাম ধর্মানুসারী।

মূলত লক্ষনীয় যে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকেদের সাথে প্রথম থেকেই রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেদের বৈরীতা বিদ্যমান ছিলো। রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। একারণে অনেকেই রোহিঙ্গা-রাখাইন বৈরীতাকে ধর্মীয় বৈরীতা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু এর পেছনের মূল কারনগুলো দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। যেহেতু আরাকান অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা ছিলো রাখাইন তাই নতুন সম্প্রদায়ের লোকেদের আগমনে স্বাভাবিক ভাবেই যেই আর্থ-সামাজিক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় বৈরীতা আসে সেখান থেকে, এখানে ধর্ম মূল কারণ নয়।আর যেহেতু নতুন বসতি গড়া রোহিঙ্গাদের কোনো বংশানুক্রমিক জায়গা ছিলোনা তাই এখানে জমি-জমা সংক্রান্ত একটি বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একারণে স্বাভাবিক ভাবেই রোহিঙ্গারা তাদের শুরুটা করেছিলো প্রতিকূল পরিবেশে। কিন্তু এই সমস্যা হয়তো মায়ানমারের সরকারের হস্তক্ষেপে সমাধান হতে পারতো, কিন্তু এটা জানার অপেক্ষা রাখেনা যে, মায়ানমারের সামরিক সরকার প্রথম থেকেই বিভিন্নভাবে সাধারণ জনতাকে নির্যাতন-নিপীড়ন করে এসেছে। তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি ছিলো দমন-নিপীড়ন। এর মাঝে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোকাং, পানথে এবং রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ছিলো অন্যতম। এখানে লক্ষনীয় যে, সংখ্যালঘু হিসেবে শুধু রোহিঙ্গারাই নয় অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও সামরিক জান্তার নির্বিচারে নির্যাতনের শিকার।

এখানে আরও একটি জিনিস লক্ষ্ করি, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সংঘটিত জরিপে ১৮৯১ সালে আরাকান রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো ৫৮,২২৫ জন যা কিনা পরবর্তিতে ১৯১১ সালে এসে দাড়ায় ১,৭৮,৬৬৭ জনে। অর্থাৎ ২০ বছরে দ্বিগুনেরও বেশি। এর পেছনে কারণ ছিলো ব্রিটিশ অধ্যুষিত এলাকা থেকে তত্কালীন বার্মা রাজ্যে কম মূল্যে শ্রমিক স্থানান্তর। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেদের বিরাগভাজন হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

তাই ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে রাখাইন-রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক বৈরীতার কারণ হিসেবে যে কারণ গুলো চোখে পড়ে তার মাঝে ধর্মের গুরুত্ব একদমই গোড়ার দিকে। মূলত এটি স্থানীয়দের সাথে অবস্থানগত বৈরীতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এখানে মুখ্য নয়।

এখন রোহিঙ্গাদের এই অবস্থানগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখতে হয় এই সমস্যা অতীতে কিরকম ছিলো। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়েই শাসক কিংবা আগ্রাসী গোষ্ঠির কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার। এই ঘটনাগুলোকে মোটা দাগে ভাগ করলে কয়েকটি ঘটনা আলাদা করা যায়।

২৮শে মার্চ, ১৯৪২

মিনব্যা এবং ম্রহুং অঞ্চলের প্রায় ৫,০০০ মুসলিম রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং করেন্নি গোষ্ঠির আক্রমনে নিহত হয়। একই সময়ে উত্তর রাখাইন অঞ্চলের মুসলিমরা প্রায় ২০,০০০ আরাকানী ধ্বংস করে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে তত্কালীন ডেপুটি কমিশনার U Kyaw Khaing তাদের হাতে নিহত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

এইসময় জাপানি সৈন্যরা বার্মা দখল করে। কিন্তু তখন বার্মা ব্রিটিশ অধীনে ছিলো। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী পিছু হটলে, জাপানি সৈন্যরা নির্যাতন শুরু করে স্থানীয়দের উপরে। এসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গা-রাখাইনদের মাঝে, এমনকি তখন বার্মা জাতীয়তাবাদীগোষ্ঠী এবং ব্রিটিশ অনুগতদের মাঝেও দাঙ্গা শুরু হয়। রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ব্রিটিশদের সমর্থন করতো এবং জাপানিদের প্রতিরোধ করতে অংশগ্রহন করে,তাই স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রাসী জাপানি সৈন্যবাহিনীর ক্ষোভের শিকার হয় এবং সেসময় অকথ্য হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন এর শিকার হয়। অনুমান করা হয় এই সময় প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে তত্কালীন বাংলাতে প্রবেশ করে পালিয়ে যায়। পরবর্তিতে বার্মিজ এবং জাপানিদের লাগাতর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। যাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে কিন্তু অধিকাংশ সেখানেই শরণার্থী বসতি গড়ে তোলে।

বার্মার সামরিক জান্তা

বার্মার সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই নির্যাতন শুরু করে। তাদের নির্যাতনের প্রধান লক্ষ্য হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যার মাঝে রোহিঙ্গারাও ছিলো। সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ এবং স্থানীয়দের সাথে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা কখনই রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা করতে দেয়নি। এমনকি সেই দেশের গণতন্ত্রপন্থীরাও রোহিঙ্গাদের অবস্থানগত ভাবে স্বীকার করতে চায়না, তাই রোহিঙ্গারা একরকম বহিরাগত ভাবে বসবাস করে এসেছে এই অঞ্চলগুলোতে।

১৯৭৮, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

মায়ানমার সৈন্যবাহিনীর "নাগামিন" অপারেশনের মাধ্যমে নির্যাতিত ও নিহত হওয়ার ভয়ে প্রায় ২,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। "নাগামিন" এর মূল লক্ষ্য ছিলো এথেনিক ক্লিনসিং। তাই সরকার কর্তৃক বিতারিত হয়ে যেসকল রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের পক্ষে মায়ানমার আবার ফেরত যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

১৯৯১-৯২, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

মায়ানমার সরকার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আবার অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরবর্তিতে জাতিসংঘের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ-মায়ানমার সরকারের প্রতিনিধিদলের সিদ্ধান্তে কিছু সংখ্যক শরণার্থী মায়ানমার পুনঃপ্রবেশ করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতেই থেকে যায়।


এখন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে প্রায় ৫,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। ১৯৯১-৯২ সালে এদেশে আসা শরণার্থীদের অনেকেই দেশে ফেরত গেলেও যারা এখানে থেকে গেছে তাদের মাঝে মাত্র ৩০,০০০ নথিভুক্ত। বাকি প্রায় ২,০০,০০০ নথিভুক্ত নয়। তাই জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এই নথিভুক্ত শরণার্থীরাই কক্সবাজারের কুতুপালং এবং নয়াপাড়া এই দুটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। বাকিদের ব্যাপারে তথ্য অপ্রতুল।

এছাড়াও থাইল্যান্ড-মায়ানমার সীমান্তের থাইল্যান্ড শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১,১১,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু শরণার্থী বিক্ষিপ্ত ভাবে সমুদ্র থেকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের জাহাজের মাধ্যমে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়।


এখন কয়েকদিন ধরে সংঘটিত হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আবারও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি সবার সামনে চলে এসেছে। দাঙ্গার পেছনের কারণ সঠিক ভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মতে একজন রাখাইন তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা ১০ জন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোক হত্যা করে। পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে উভয় পক্ষের প্রায় ৩০ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৩০০রও বেশি বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়। চলমান দাঙ্গায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের এসব অঞ্চল থেকে সরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এমনকি জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও ওই অঞ্চল থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। এর পরেই বিভিন্ন জলযানের মাধ্যমে সমুদ্র পারি দিয়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকেরা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আর দেশের অভ্যন্তরের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দেয়া হবেনা বলে জানিয়ে দেয়া হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত তৈরী হয়েছে এবং বিতর্ক চলছে। কিন্তু কোনো একটি পক্ষে সহজেই মত প্রদানের আগে "রোহিঙ্গা শরণার্থী" একটি জটিল প্রসঙ্গ এটি ভেবে দেখা উচিত। আবার কিছু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে। এরকমই একটি গুজবের নমুনা দেখুন "কোরানের আলো" নামের একটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক পেইজে এখানে

এই পেইজ যেই ছবিটিকে দাঙ্গায় নিহত রোহিঙ্গাদের মৃতদেহ হিসেবে দাবি করছে তা আসলে ১৩ জানুয়ারী, ২০০৯ সালে থাইল্যান্ড সমুদ্রসীমান্তে আটককৃত রোহিঙ্গা জেলেদের ছবি। এদের শাস্তি হিসেবে সমুদ্রতটে রোদে শুয়ে থাকতে বাধ্য করেছে থাইল্যান্ড সীমান্তবাহিনী। এই বিষয়ে খবর দেখুন এখানে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জীবন্ত মানুষের ছবিকে যারা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মৃত মানুষের ছবি বানিয়ে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করে তারা ঠিক কতোটা মানুষ? এই ছবিটি ওই পেইজে ১৩ জুন, ২০১২ পোস্ট করা হয়। মাত্র একদিনের মাঝে শেয়ারের সংখ্যা দাড়িয়েছে ২,১৬৯। ধর্মের ভাই স্বীকৃতি দিয়ে এভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দেয়ার এরকম নির্লজ্জ প্রচেষ্টাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই।


এখন প্রশ্ন উঠছে সরকারের অনমনীয় সিদ্ধান্তের প্রতি। মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্তটি সমর্থনের প্রশ্ন আসেনা। একারণে অনেকেই মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত খুলে দিতে বলছেন বাংলাদেশ সরকারকে। তাদের এই মানবতাবাদী প্রচেষ্টাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একটি দেশের সরকারের পক্ষে এইধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত কিংবা এরকম পরিস্থিতিতে কতোটা কার্যকর বা সহজ এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। মত দেয়ার আগে কিংবা ঢালাওভাবে সরকারকে দোষ দেয়ার আগে একবার সমগ্র পরিস্থিতিকে চিন্তা করে নেয়া উচিত বলে মনে করি। যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো আলাদা আলাদা করে দেখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জায়গা দিতে কতটুকু দায়বদ্ধ? মানবিক দিক বিবেচনা করলে এবং শুধুমাত্র এই দাঙ্গার কথা বিবেচনায় আনলে সরকার শরণার্থীদের জায়গা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে পারে। কিন্তু এখানে ভুলে গেলে চলবেনা, একটি দেশের সরকার আগে সেই দেশের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। মানবিক দিক বিবেচনায় আনলেও সরকারের কর্তব্য অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু বেশ কিছু ঘটনায় এখন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৫,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে তাহলে নতুন করে যদি সীমান্ত খুলে দেয়া হয় তাহলে শরণার্থী সংখ্যা আরও বাড়বে কয়েক গুন। জনবহুল বাংলাদেশ নিজের দেশের মানুষের ভারেই নিমজ্জিত। সেখানে আগের পাঁচ লক্ষ এবং বর্তমানের অতিরিক্ত শরণার্থী স্থান দেয়া দেশের জনগনের স্বার্থ এবং সরকারের কর্মপরিধির সাথে সামঞ্জস্য কিনা তার প্রশ্ন চলে আসে। এছাড়াও এই অতিরিক্ত শরণার্থীদের নতুন জায়গার প্রয়োজন হবে, যা কিনা আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে একটি বিরাট সমস্যা। এছাড়াও এদের জন্য খাদ্য/বস্ত্র/চিকিৎসা অন্যান্য সুবিধা নিঃশ্চিত করা ঋণের ভারে জর্জরিত একটি দেশের সরকারের জন্য বাড়তি চাপ। তাই সরকারের পক্ষ থেকে শুধু মানবতার দিকটি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভবপর নয়।

অনেকের মতে বর্তমানের শরণার্থীদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার কথা চিন্তা করা যায়। কিন্তু সমস্যা এখানেও। মায়ানমার সরকার প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিতারণে উত্সাহী। এর আগে যেই পরিমান শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশে তার খুবই কম অংশও আবার ফেরত গেছে। মায়ানমার সরকার কখনোই এই ব্যাপারে আগ্রহী ছিলোনা। সামরিক শাসনামলে মায়ানমারের সাথে আমাদের দেশের সম্পর্ক আর যাই হউক মিষ্টি-মধুর ছিলোনা এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন দেখা যাচ্ছে, মায়ানমার সরকার অতীতের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতেই আগ্রহী নয় তাহলে এই সরকারের থেকে বর্তমান শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা পাওয়া যাবেনা এই কথা অনায়াসে বলা যায়। এছাড়াও মায়ানমারের অবস্থানগত দিক বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, এর সাথে চারটি দেশের লাগোয়া সীমান্ত রয়েছে, ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড এবং চীন। কিন্তু শরণার্থী সমস্যা সবসময়ই সামাল দিয়েছে বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ড। তবুও থাইল্যান্ডের থেকে ৫ গুন বেশি শরণার্থী বাংলাদেশে আছে। একের পর এক সমস্যায় রোহিঙ্গা শরণার্থী আসা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে যা কোনো দেশের সরকারের পক্ষে একক ভাবে সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এই শরণার্থী সমস্যা সামলানো কঠিন। তারপরও এর আগে বাংলাদেশ কখনো বৈরী মনোভাব পোষণ করেনি। কিন্তু শরণার্থী আশ্রয় প্রদান কখনোই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মায়ানমারের প্রেক্ষিতে নতুন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিকভাবে কখনই সেরকম কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি কিংবা চাপ প্রয়োগ করা হলেও মায়ানমার সরকার তা অগ্রাহ্য করে গেছে অতীতে। তাই এই দাঙ্গায় যদি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ও তাহলেও যে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হবেনা এ আশা করা সহজ নয়। তাই জাতিসংঘ এবং উন্নত শক্তিশালী দেশগুলোর উচিত যেভাবেই হোক চাপ প্রয়োগ করে এই সাম্প্রদায়িক সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করা। নাহলে অগুনিত শরণার্থী কোননা কোনো ঘটনায় বাংলাদেশে সমানত অতিক্রম করে আসতেই থাকবে। যা কোনভাবেই একটি দেশের সরকারের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক উপদেষ্টার অনুরোধে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছে সরকার। এছাড়াও যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশ্রয় গ্রহণ করেছে অতীতে সেসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পাওয়া গেছে।

বর্তমান শরণার্থী বিষয়টি যেকারণে আরও জটিল হয়েছে তা হচ্ছে বাংলাদেশের মায়ানমার সংলগ্ন এবং পার্বত্য অঞ্চলগুলোর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। যেহেতু রোহিঙ্গা শরনার্থীরা অশিকাংশই নথিভুক্ত নয় তাই এদের বড় একটা অংশ সময়ের সাথে সাথে সমাজ বিরোধী নানা কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, অপহরণ এবং মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই সব শরণার্থী শিবিরে মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতার কথা। তাই পূর্বের শরণার্থীদের এহন কর্মকান্ড যেহেতু কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়, বর্তমানের শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব কোনো সরকারের পক্ষেই নেয়া সম্ভবপর নয়। যেখানে নিজের দেশের জনগনের অবস্থান বিপন্ন সেখানে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও কমে আসে এটা বোঝা উচিত। এছাড়াও অনেক শরণার্থীই বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠির প্রত্যক্ষ মদদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে এদের হয়ে কাজ করেছে। এছাড়াও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অনেক সময়েই এদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে।

অনেকেই এর সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের শরণার্থী আশ্রয়ের তুলনা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এখানে তারা মূল বিষয়টি ভুলে গেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের সহায়তা প্রদান এবং শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র একটি রাজনৈতিক ও অবস্থানগত সিদ্ধান্ত। এখানে অধিকাংশ শরণার্থী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে ফেরত আসে এবং যুদ্ধকালীন এককালীন এই পরিস্থিতির উদ্ভবে ভারতের দীর্ঘ মেয়াদী কোনো নেতিবাচক প্রভাব ছিলোনা। কিন্তু মায়ানমার কোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত নয়। আর রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এককালীন নয়। আগে অনেকবার বাংলাদেশ নিজের সীমান্ত খুলে দিয়েছে কিন্তু এই সমস্যা লাঘব হয়নি। বরং রোহিঙ্গা শরণার্থী কর্তৃক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে বিরূপ প্রভাব রয়েছে। একই সাথে এটাও দেখা উচিত যে বাংলাদেশে শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীই নয় ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির পরে মিরপুরের বিপুল সংখ্যক শরণার্থীও রয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে একই সাথে এতগুলো অবস্থানে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করা আসলেই কঠিন। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক প্রভাব যে বিরূপ তা সকলেই অবগত আছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে শরণার্থী সমস্যার পেছনের কারণ কি? এখানে শরণার্থী সমস্যার পেছনের কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি সামলানোর দায়িত্বও সেই দেশের সরকারের। এই ব্যাপারে সরকার অপারগ হলে সাহায্য অবশ্যই করা প্রয়োজন। কিন্তু মায়ানমার নিজের দেশের এই সমস্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছুক। দাঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে কিন্তু মায়ানমার সরকার যেহেতু কখনোই রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয় তাই এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার যদি শরণার্থী আশ্রয় প্রদান করে তাহলে বিষয়টি একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে পরিনত হবে। বাংলাদেশেও অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে কিন্তু কখনোই কি কোনো দেশের সীমান্ত এর জন্য খুলে দেয়া হয়েছে? সংখ্যালঘু অত্যাচার বাংলাদেশেও ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলো কখনোই সেটিকে দুই দেশের মধ্যকার সমস্যায় পরিনত করেনি বরং বাংলাদেশের সরকার নিজেরাই এই অভ্যন্তরীণ বিষয় রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করেছে। তাই মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়টিকে বাংলাদেশ যদি দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে পরিনত করে এবং নতুন করে শরণার্থী আশ্রয় প্রদান করে তাহলে সেটি আগের সমস্যাটিকেই আরও জটিল করবে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উত্থিত এই শরণার্থী সমস্যায় কিছু উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নিজেদের অপপ্রচার চালাতে ব্যস্ত। তারা এমনভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরছে যাতে মনে হয়, বৌদ্ধ-মুসলমান ধর্মীয় দাঙ্গাই একমাত্র কারণ। এতে করে কিছু সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শরণার্থী আশ্রয় প্রদানে এই অপশক্তির মূল বক্তব্য হচ্ছে ধর্মীয় দিক এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের ধর্মীয় ভাই হিসেবে তুলে ধরে পুরো বিষয়টিকে একটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু সাধারণ মানুষের এটা মনে রাখা প্রয়োজন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যদি বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় প্রদান করে তাহলে মানবিক দিক বিবেচনায় এনেই করবে, ধর্মীয় দিক নয়। আমরা সাধারণ মানুষ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আমাদের দেশে আশ্রয়ের ব্যাপারে সমর্থন জানাই তাহলে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক দিক বিবেচনা করে, কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হিসেবে নয়। আর যারা এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও নিজ হীন সাম্প্রদায়িক স্বার্থের জন্য ব্যস্ত তাদের উদ্দেশ্য যে কতোটা মানবিক তা আর বলার প্রয়োজন পড়েনা। এদের প্রতিহত করা প্রয়োজন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ে এই সব বিষয়ে চিন্তা প্রাধান্য পাওয়া উচিত নাকি মানবিকতা? কিন্তু পূর্ব পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় আনলে শরণার্থী আশ্রয়ের মতো ব্যাপারে সিদ্ধান্তে সরকার আসলেই একটি সংকটময় অবস্থানে পড়ছে। কিন্তু যথাসম্ভব ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করার, বিজেবি সদস্যরা আগত শরণার্থীদের খাবার,চিকিৎসা,জ্বালানি দান করছেন। আহত শরণার্থীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এই মানবিক সাহায্য যথেষ্ট মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্রয় প্রদানের মত অবস্থা সরকারের আছে কিনা এই বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ পর্যবেক্ষণদল মায়ানমার সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে চাইছে এবং অনুরোধ করা হয়েছে যাতে যত দ্রুত সম্ভব এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগত সহিংসতার দিকে তাকালেও কিন্তু আমরা ওই একই চিত্র দেখি। একটি ক্ষুদ্র বিষয় থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গার শিকার অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ। সরকারগুলো হয়তো শেষপর্যন্ত এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে সক্ষম হয় কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। আর এই ক্ষতি অপূরণীয় যা কোনো আশ্বাসে কিংবা সাহায্যেই পূরণ হওয়ার নয়।

বর্তমান সময়ের মায়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদান করলে অবশ্যই সেই সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পেত, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যেত সেটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কিনা। অনেক সময়েই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ বিবেচনায় এনে এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে সরকারকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা কিনা ঘোর মানবতাবিরোধী কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গায় যে মানুষগুলো বসে আছেন তাদের জন্য কাজটি যে সহজসাধ্য নয় সেটিও বোঝা প্রয়োজন।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করছিনা ব্যক্তিগতভাবে কিন্তু এর পেছনের কারণগুলোকেও উড়িয়ে দিচ্ছিনা। আমি নিজে যদি এই আক্রান্ত মানুষগুলোকে কিছু সাহায্য করতে পারতাম তাহলে হয়তো কোনো কাজ হতো। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে মানবিক দিক বিবেচনায় এনে সরকার ঠিক কতটা উদার আচরণ করবে তা সময়ই বলে দিবে।

মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে অন্তত বাংলাদেশের সমুদ্রতট অঞ্চলে একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক এই কামনা করবো। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় এই সকল শরণার্থীকে নিজের বাসভূমিতে নিরাপত্তা নিঃশ্চিত করে ফিরিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করা হোক এই আশাও করবো। যতই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় আনি না কেন, দিন শেষে আমরা মানুষ। তাই মানবিক গুনাবলী ভুলে শুধু কূটনীতি বিবেচনায় আনলে যে আত্মগ্লানির সৃষ্টি হয় তার সামনে আমরা দাড়াতে পারবো কি?

এখন দেখার অপেক্ষা শুভ-অশুভের এই অসম যুদ্ধে মানবিকতার জয় হয় কিনা ??






Monday, June 11, 2012

মুক্তিকামী প্রজ্জ্বলিত প্রাণ

মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ২৬ বছর বয়সী এক বিক্ষুব্ধ তিব্বতী তরুণ, জামপা ইয়েশি। (ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে, যন্তর-মন্তর এলাকায়) স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে সে| অগুনিত আত্মত্যাগের ভিড়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে সে, বেঁচে থাকা অসংখ্য মানুষের মনে এনে দিয়ে গেছে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা। গল্পের ফিনিক্স পাখির মতো তার ছাই থেকে জন্ম নেবে আরো অজস্র প্রতিবাদী প্রাণ| কতোটা তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন হলে নিজেকে এভাবে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া যায়? হয়তো এভাবেই মুক্তির মশাল এগিয়ে চলবে আরও বহুকাল-বহুদুর|

হিমালয়ের কোলের ছোট্ট এই ভূখন্ডটিকে নিয়ে রক্তাক্ত রাজনীতি কিংবা সমরনীতি চলছে সেই বহুকাল আগে থেকেই| ১২৩৯ সালে মোঙ্গলদের আগমন, এরপরে ১৮ শতাব্দীর কুইং রাজত্ব। সবক্ষেত্রেই রক্তাক্ত হয়েছে শান্ত এই ভূখন্ডটি| কখনো আগ্রাসী যুদ্ধবাজ নেতার কারণে, কখনো রাজনীতির কূটকৌশলের কারণে| এরপরে উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন পরাশক্তি ব্রিটিশদের আগমন| ১৯০৪ সালে, ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ড এর নেতৃত্বে বিশাল সৈন্যদল আক্রমন করে তিব্বত| ব্রিটিশদের ভয় ছিলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া তিব্বত-এ তাদের প্রভাব জারি করছে| শুধুমাত্র অনুমানের বশবর্তী হয়ে এই আক্রমনে প্রাণ হারায় ১,৩০০ এরও বেশি স্থানীয়| কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে সংখ্যাটা ৫,০০০ এর বেশি|

tibet-1

এরপর ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত চলে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন-এর ধরপাকড়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন চুক্তিতে তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয়| এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং চীনের গৃহযুদ্ধের দাপটে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই কিছুটা স্তিমিত থাকে| কিছু কিছু অঞ্চল তখন বিক্ষিপ্ত ভাবে দালাই লামার অধীনে ছিলো| কিন্তু এরপরেই এই সমস্ত অঞ্চলের উপর একক কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে চীন| ১৯৫০ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি তিব্বত প্রবেশ করে| ১৯৫১ সালে দালাই লামার প্রতিনিধিদের সাথে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যাতে তিব্বত একটি যৌথ শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হওয়ার প্রস্তাব ছিলো| কিন্তু চীন প্রশাসনের জমি বন্টনের দাবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ১৯৫৬ সালের জুন মাসের মধ্যে| ধীরে ধীরে এই বিপ্লব লাসা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লেও শক্ত হাতে দমন করা হয় ১৯৫৯ সালের মধ্যেই| ১৪তম দালাই লামা এবং তিব্বতের অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ভারতে পালিয়ে যান এই সময়ে| ১৯৫০ সালের পরবর্তী বছরগুলোর অস্থিতিশীলতার সুযোগে সিআইএ তিব্বতের বিপ্লবীগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ,অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য দেয়া শুরু করে|

potala-palace-500

১৯৫০ সালের পর থেকেই তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল টানাপড়েন শুরু হয়| একদিকে সমাজতান্ত্রিক চীনের আগ্রাসন অন্যদিকে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের কূটনীতি| পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা তিব্বতী বিপ্লবীদের সাহায্য করা শুরু করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চীনকে শায়েস্তা করার জন্য| এদিকে একই সাথে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাও তিব্বতী বিপ্লবীদের সাহায্যের হাত বাড়ায়| সশস্ত্র বিপ্লবে সাহায্যদানকারী এই দেশগুলোর মূল লক্ষ্য কখনোই এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাধীনতা ছিলনা, মূল অভিসন্ধি ছিলো চীনকে নাজেহাল করার| তাই বিপ্লবীদের গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্য করা ছাড়া এরা রাজনৈতিক ভাবে কখনই চীনের এই আগ্রাসনকে মোকাবেলা করার ইচ্ছা দেখায়নি|

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে ১৯৬০ সালের দিকে| পরবর্তিতে মার্কিন প্রধানমন্ত্রী রিচার্ড নিক্সন কর্তৃক চীন এর প্রতি ভিন্ন রাজনৈতিক পন্থার কারণে ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে এই সাহায্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়| ১৯৯৮ সালের ২রা অক্টোবর, নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দালাই লামা প্রশাসনের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, প্রতিবছর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য দান করতো তিব্বতী বিপ্লবীদের|

১৯৫০ সালের পূর্ববর্তী ইতিহাস বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো সব সময়েই উত্থান-পতনের মাঝে| ১৯১২ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই পুরো সময়টাই ছিলো তিব্বত এর স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে টানাপোড়েন| তবে কুইং রাজত্বের পতনের পরে মঙ্গোলিয়া এবং তিব্বত উভয়েই নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে| এছাড়াও তিব্বত এর শাসন ক্ষমতা কখনই একছত্র ভাবে কোনো দেশের কিংবা রাজত্বের অধীনে ছিলোনা| বিভিন্ন সময় ক্ষমতার হাত বদলের মাঝে তিব্বত স্বাধীন ভাবেই নিজেদের ভূখন্ড পরিচালনা করতো| যেহেতু দেশটির অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিজীবী এবং বৌদ্ধ লামা, সেহেতু সামাজিকভাবে তিব্বতে সবসময়ই একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকতো| কিন্তু ১৯৫০ সালের চীন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর থেকে তিব্বতের সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে| চীন কর্তৃক তিব্বত অধিগ্রহণ ছিলো সম্পূর্ণ অবস্থানগত সুবিধা আদায় এবং খনিজ সম্পদের আশায়| চীন নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিব্বতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন সাধন করে| সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তিব্বতের প্রাচীন পন্থাকে পরিবর্তন করার প্রয়াস দেখায়| বিভিন্ন সময় তিব্বতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়ে রাজনৈতিক পটভূমি সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে চীন|চীন এর প্রশাসন, তিব্বত সবসময়ই তাদের নিজেদের অংশ ছিলো বলে দাবি করে এসেছে|যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে তারা| এমনকি তিব্বতের স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সবসময়ই পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছে তারা| কিন্তু চীনের শাসনের এই সময়টিতে তিন মিলিয়নের বেশি তিব্বতী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে| যাদের অনেকেই মারা গেছে নয়তো পালিয়ে গেছে| এই সংখ্যাই বলে দিচ্ছে এই ভূখন্ডটির আসল পরিস্থিতি|

090308014005BR

কিন্তু স্থানীয় তিব্বতী বাসিন্দারা প্রথম থেকেই চীন এর এই কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে আসছিলো| বর্তমান সময়ে এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে| শুধুমাত্র ২০১১ সালের মার্চ মাসের পর থেকেই ৩০ জন তিব্বতী নিজেদের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে| ছাত্র, বৌদ্ধ লামা হতে শুরু করে সাধারণ গৃহিনী অনেকেই এভাবে আত্মাহুতির পথ বেছে নিয়েছেন নিজেদের দাবি সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য| যার মধ্যে জামপা ইয়েশি অন্যতম| এছাড়াও ২৭ মে, ২০১২, প্রথমবারের মতো তিব্বতের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ঝোকাং মন্দিরের সামনে দুজন যুবক নিজেদের গায়ে আগুন লাগায়| যার মাঝে ১৯ বছর বয়সী দর্জি সেতেন মারা যায় এবং অপরজন গুরুতরভাবে আহত হয়| এর কিছুদিন পরেই ৩০ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী রেচক একইভাবে স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে নিজের জীবন দান করে|

Free-Tibet1

বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে এই আত্মাহুতির সংখ্যা| শুধু তাই নয়, আগের থেকে আরও তীব্র হয়েছে স্বাধীন তিব্বতের জন্য এই আন্দোলন| তিব্বতের ধর্মীয় নেতা ১৪ তম দালাই লামা অবশ্য স্বাধীন তিব্বতের দাবি থেকে সরে এসে এটিকে চীনের অধীনে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার জন্য বলেছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সভায়| কিন্তু সাধারণ তিব্বতীরা স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসেনি একবারের জন্যও| অপরিসীম সৌন্দর্যের পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই ভূখন্ডটিতে এখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল| স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকারী জনতার অনেকেই আত্মত্যাগ করছেন নির্দ্বিধায়|বিশ্বের কাছে নিজেদের দাবি তুলে ধরার জন্য নিজেকে মুক্তির মশালে পরিনত করতেও দ্বিধা করছেনা এই প্রতিবাদী মানুষগুলো। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতী সাধারণ ছাত্র-জনতা বহু বছর ধরে এই আন্দোলন করে আসছে কিন্তু এখনো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা পোষণ করেনি| দিনে দিনে তাই বেড়ে চলেছে শহীদের সংখ্যা|

তাই এখনই সময় সকল মুক্তিকামী মানুষ এক হয়ে সাধারণ তিব্বতবাসীদের এই ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন দান করে আরও শক্তিশালী করার| একটি স্বাধীন ভূখন্ডের স্বাধীন মানুষ কোনভাবেই আগ্রাসী শক্তির কাছে পরাস্ত হতে পারেনা| তিব্বতের চরম মানবাধিকার অবমাননা সমগ্র সভ্য সমাজের কলঙ্ক| মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে যুগে যুগে আগ্রাসী শাসকগোষ্ঠীর এই শোষণ-নির্যাতন প্রতিরোধ সাধারণ মানুষকেই করতে হবে| যদি জামপা ইয়েশির মতো অসংখ্য স্বাধীনতাকামী প্রাণের প্রজ্জ্বলিত মুক্তি মশাল আমরা বহন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে হয়তো একদিন দাসত্বের শৃঙ্খল আমাদের নিজেদেরও হতে পারে| সেদিন হয়তো বলার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা|

26-tibet-protest-IndiaInk-blog480

http://www.freetibet.org/newsmedia/selfimmolations
http://www.freetibet.org/campaigns/case-studies
http://www.tibetjustice.org/materials/#tibet
http://freetibet.blog.co.uk/2009/03/08/50-years-of-the-national-uprising-tibetan-solidarity-march-through-the-streets-of-london-5713623/
http://buddhisttrends.com/tibetan-new-year-at-un-headquarter-in-nyc/793/





Saturday, June 2, 2012

তিয়ানানমেন স্কয়ার এর সেই প্রতিবাদী মানুষটি

ঠিক কিসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে একজন অতি সাধারণ মানুষ নিজের ক্ষুদ্র জীবনের গন্ডি পেরিয়ে নিজেকে অসামান্য উচ্চতায় তুলে ধরে? ঠিক কিসের নেশায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সম্ভব? কিংবা ঠিক কিসের তাগিদে একজন মানুষ প্রতিবাদের ইস্পাত কঠিন বর্ম তুলে ধরে আগলে ধরে নির্যাতিতকে? এইরকম অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়তো সম্ভব নয়। সভ্যতার ইতিহাস এরকম অসংখ্য মানুষের উদাহরণে ভারী, যারা পারিপ্বার্শিকতার কথা চিন্তা না করে, কোনকিছুর তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে গেছেন নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে| তাদের কঠিন সংকল্পে পরাস্ত হয়েছে আগ্রাসী শক্তি। বাধ্য হয়েছে পিছু হটতে। সভ্যতার ইতিহাস তাই এই বীরদের কথা বলে।

তিয়ানানমেন স্কয়ার, ১৯৮৯।

চীনের বেইজিং শহরে ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৯-৫ জুন, ১৯৮৯ পর্যন্ত সময়ে ঘটে যাওয়া প্রতিবাদ কর্মসূচি, আধুনিক বিশ্বে সাধারণ জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের একটি জ্বলন্ত উধাহরণ| অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, শাসকগোষ্ঠির নির্যাতন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগ্রত জনতার তীব্র প্রতিবাদে চমকে উঠেছিলো চীনের আধুনিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা| চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এর প্রচেষ্টায় সত্তর দশকের শেষের দিকে, নেতা ড্যাং জিয়াওপিং মাওবাদী কম্যুনিজম থেকে জাতিকে "সোশ্যাল মার্কেট ইকোনমি"-তে রূপান্তর করেন|আশির দশকের শেষের দিকে, বর্ধমান অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, বেকারত্ব, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং শাসকগোষ্ঠির উচ্চশ্রেনীর দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ| ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হু য়াওবাং এর মৃত্যুতে| সাধারণ ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জমা হয় তিয়ানানমেন স্কয়ারের মধ্যে| মে মাসের ১৩ তারিখের মাঝে আন্দোলন এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, সেখানে ৫ লক্ষাধিক লোক জমায়েত হয়| সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলন খুব শীঘ্রই জনমতের ভিত্তিতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি থেকে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিনত হয়| শান্তিপূর্ণ এই অবস্থান প্রতিবাদকে দমিয়ে দিতে রাজনৈতিক মহলে তোড়জোড় শুরু হয়| কর্তৃপক্ষ ২০ মে, সামরিক আইন জারি করলেও ৪ জুন পর্যন্ত সেরকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি| কিন্তু এরপরেই শুরু হয় নির্লজ্জভাবে সামরিক দমন পীড়ন। তিয়ানানমেন স্কয়ারের আশেপাশের রাস্তাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেয়া প্রতিবাদকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করতে করতে প্রধান স্কয়ারের দিকে এগোতে থাকে সামরিকযান এবং ভারী ট্যাঙ্ক। নিহত এবং গুরুতর আহত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ|

৫ জুন, ১৯৮৯।

৪ জুন এর রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরে, এদিন প্রতিবাদকারীদের সম্পূর্ণ স্তব্ধ করতে প্রধান স্কয়ারের দিকে এগোতে থাকে প্রায় ২৫টি ট্যাঙ্ক। সবার আতঙ্কিত দৃষ্টির সামনে, পূর্ব-পশ্চিম কোণের রাস্তা দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকা সাজোয়া গাড়িগুলোর সামনে হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে দাড়িয়ে পড়েন একজন সাধারণ মানুষ| সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়া মানুষটির দুই হাতে বাজারের ব্যাগ। নির্দ্বিধায়-নিঃসংকোচে, দৃঢ় সংকল্পে একা দাড়িয়ে থাকেন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকা ট্যাঙ্কগুলোর সামনে| ঠিক তার সামনে এসে থামতে বাধ্য হয় সারির প্রথম ট্যাঙ্কটি| সেই মানুষটি নির্ভয়ে হাত নেড়ে ট্যাঙ্কগুলোকে চলে যেতে বলতে থাকেন| সামনের ট্যাঙ্কচালক বেশ কয়েকবার ডানে-বামে সরিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবারই এই মানুষটি সামনে গিয়ে রাস্তা আটকে দাড়িয়ে যান| একসময় তার শরীরের প্রায় ইঞ্চিদুয়েক দুরে এসে থামে প্রথম ট্যাঙ্কটি| সেই মানুষটির এই অসীম সাহসে যেনো রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সময়|


[গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে বামদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সাদা শার্ট পরিহিত মানুষটি অগ্রসরমান ট্যাঙ্কের রাস্তায় দাড়িয়ে গেছেন|]

এরপরে হঠাৎ লাফ দিয়ে ট্যাঙ্কের উপরে উঠে দাড়ান তিনি| ঢাকনার উপর থেকে চালককে ফেরত যাওয়ার জন্য বলতে থাকেন| তর্কের কিছু সময় পরে নিচে নেমে এসে আবার দাড়িয়ে যান সামনে| বারবার চেষ্টা করেও তাকে সরাতে ব্যার্থ হয় ট্যাঙ্কের চালক| এসময় দুজন মানুষ এসে সরিয়ে নিয়ে যায় এই অসীম সাহসী প্রতিবাদী মানুষটিকে| ট্যাঙ্কের সারি এগিয়ে যাওয়া শুরু করে|


[ট্যাঙ্কের সামনে দাড়িয়ে আছেন সেই প্রতিবাদী মানুষটি।]

কে এই মানুষটি? যিনি নিজের সাধারণ জীবনের আকর্ষনকে তুচ্ছ করে অগ্রসরমান ভারী ট্যাঙ্কের সামনে এভাবে নির্ভয়ে দাড়িয়ে যেতে পারলেন। বাজারের ব্যাগ হাতে এই মানুষটির কোনো সঠিক পরিচয় আজ অবধি পাওয়া যায়নি| নাম না জানা এই মানুষটিকে টাইম ম্যাগাজিন "আননোন রেবেল" হিসেবে আখ্যা দিয়ে "শতাব্দীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি" তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে|



[পুরো ঘটনার ধারণকৃত ভিডিও।]

আজও সারা পৃথিবীতে ট্যাঙ্কের সামনে নির্ভয়ে দাড়িয়ে থাকা এই মানুষটির ছবি প্রতিবাদের প্রতীক এবং আদর্শ| সেই সময়টিতে ৪ জন আলোকচিত্রী এই ঘটনাটির ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন| যাদের মাঝে জেফ ওয়াইডেনার এর ছবি সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে|

সামরিক শাসকের রোষানলে পরে এই প্রতিবাদের সাথে সম্পৃক্ত অনেককে গ্রেফতার করা হয়| এই প্রতিবাদের সব ধরনের ছবি ও ভিডিও নিষিদ্ধ করা হয়| চরম সামরিক নির্যাতন চলে এই প্রতিবাদী মানুষগুলোর উপরে| একই সাথে হারিয়ে যায় "ট্যাঙ্ক ম্যান" হিসেবে পরিচয় পাওয়া এই নাম না জানা মানুষটির কথাও। পরে সাধারণ ছাত্রদের মাধ্যমে মানুষের হাতে আসে এই মানুষটির অসীম সাহসিকতার প্রমানস্বরূপ ছবিগুলো| অধিকাংশ মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি এই ছবিটির সত্যতা| পরবর্তিতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কাছে থেকে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পরে বিশ্বে| আর মুহুর্তেই প্রতিবাদী মানুষের প্রতীক হয়ে দাড়ায় এই ছবি| কিন্তু এই ঘটনার পরে আর কোনদিন এই মানুষটির কোনো দেখা পাওয়া যায়নি, এমনকি পাওয়া যায়নি কোনো পরিচয়| জানা যায়নি কি ঘটেছিল তার ভাগ্যে|

এই ঘটনার পরে, চীনের সরকার সংবাদ মাধ্যমের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে| আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয় এবং যেকোনো ধরনের সংবাদের উপরে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়| বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং এই প্রতিবাদকে ধামা চাপা দেয়া হয়| নিহত মানুষের সংখ্যা কখনো জানা যায়নি, ধারণা করা হয় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল ৪ জুন এর ওই সংঘর্ষে|

ঠিক কি কারণে সেই মানুষটি হঠাৎ একা এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন? কিসের তাগিদে? সামনে নিঃশ্চিত মৃত্যু জেনেও এভাবে মাথা উঁচু করে কিভাবে দাড়িয়ে থাকা সম্ভব? জানিনা| আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো তিনি পারতেন বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে| চুপচাপ সরে যেতে, কিংবা লুকিয়ে পড়তে| তিনি হয়তোবা পাশের ফুটপাত থেকে চিত্কার করতে পারতেন, ঢিল ছুড়তে পারতেন, বেছে নিতে পারতেন আরও কোনো সাধারণ উপায়| কিন্তু তা না করে, এই চরম দুঃসাহসী মানুষটি নিজের সাধারণত্ব এর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, নিজের জন্য নয়, তাদের জন্য যাদের তাকে দরকার ছিলো| নিজের জীবন বিপন্ন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সমগ্র বিশ্বকে, প্রতিবাদ কাকে বলে, বিপ্লব কাকে বলে|

আসন্ন ৫ই জুন, ২০১২ তে তিয়েনানমেন স্কয়ার এর এই ঘটনার ২৩ বছরপূর্তি হবে। সেই আন্দোলন, শহীদ ছাত্র-জনতা এবং এই অতি সাধারণ মানুষটি, বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর অগুনিত সংগ্রামী মানুষকে নিজের শক্তির প্রতি আস্থা জাগিয়ে চলেছেন| অসংখ্য প্রতিবাদী-বিপ্লবীর প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকা এই পরিচয়হীন মানুষটির জন্য স্যালুট|

[ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।]